আমার ভিনদেশি তারা পর্ব-৬০

0
1831

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৬০
—————————————
লিওর মাথায় রাখা হাত টা থমকে গেল। দম খিঁচে বসে রইলাম। অপেক্ষা করছি পরবর্তী ঝড়ের জন্য। কিন্তু না! লিওর কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে কি শুনেছে আমি কি বলেছি? তাহলে চুপ কেন? আমার বিয়ে হয়ে গেলে ওর কোনো সমস্যা হবে না?
লিও কে ডাকলাম
“লিও!”
লিও জবাব দিল না। তবে জবাবের বদলে ফোৎ ফোৎ নিঃশ্বাসের শব্দ পেলাম। তাকিয়ে দেখলাম লিও ঘুমাচ্ছে। সে শুনতেই পাই নি কি বলেছি। এত দুঃখের মাঝেও আমি হেসে দিলাম। পাগলাটে কপালের পাগলাটে চুল গুলো কে পরিপাটি করতে লাগলাম। চারদিকে মশা রা বেশ জ্বালাতন করছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে বার বার মশা তাড়াচ্ছি। লিও শান্তি তে ঘুমাচ্ছে। মাঝে মাঝে মশার জ্বালায় হাত পা নাড়াচ্ছে। ওর ঘুম দেখে আমার কষ্ট হল। কেন সে বেহুদা কষ্ট গুলো করছে? চাইলে সে তার রাজপ্রাসাদের মত বাড়িতে থাকতে পারতো না? টিনা কে বিয়ে করে আরো ধনী হতে পারতো না?
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ছিড়ে বেড়িয়ে এল। সে ঠিক যেন আকাশে হীরের মত জ্বল জ্বল করতে থাকা তারা। কখন টুপ করে আমার কাছে ধরা দিয়েছে বুঝতেই পারি নি। সেই অমূল্য তারা কে না পারছি বুক মাজার থেকে সরাতে, না পারছি রাখতে।
কোলের মধ্যেই একটু পাশ ফিরে শুলো লিও। পাশ ফিরতেই দেখলাম ঘাড় টা ভিজে আছে। ইশশ! এক নাগাড়ে চেপে থাকায় ঘেমে গেছে। আমি মুছে দিয়ে বাতাস করতে লাগলাম।
মাঝখানে আর কয়েকটা ঘণ্টা। এরপর তুমুল একটা ঝড় বয়ে যাবে। যে ঝড়ে হয়ত আমাকে ভাসাবে নয়ত আমাকে মারবে।
লিও আবারো পাশ ফিরলো। এবারে আমার পেটে মাথা গুজে দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। আমি শিউরে উঠলাম। সময় ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দিতে লাগল আর কয়েকটা ঘণ্টা মাত্র লিও তোমার।
চারদিকে ঝি ঝি পোকা অসহ্যকর ভাবে ঢেকে চলেছে। দূর থেকে কোনো এক ডাহুক সঙ্গীনি বিচ্ছেদের শোকে এক টানে চিৎকার করে চলেছে। হয়ত আজ তার শেষ দিন। আজই তার মৃত্যু ঘটবে।
আমি লিওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আমি কি পারবো লিও কে ছাড়া বাঁচতে? লিও কি পারবে আমাকে ছাড়া থাকতে?
চিন চিন করে উঠলো বুকটা। চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো। নাক দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে প্রস্তুত। ইতোমধ্যে নিঃশ্বাসের সাথে ফোঁস ফোঁস শব্দ বেড়ুচ্ছে। আমি যথা সম্ভব চেপে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু মনটাকে কিভাবে চেপে রাখবো। সে তো হু হু করে কাঁদছে।
.
ধীরে ধীরে রজনী খতম হয়ে এলো। পাখিরা ডানা ঝাপটে ফযরের প্রস্তুতি নিতে লাগল। আর আমি নিদ্রা বিহীন রক্তিম চক্ষু নিয়ে একদৃষ্টিতে লিওর দিকে তাকিয়ে আছি। নিঃশ্বাসের সাথে তার বুক উঠা নামা করছে। মনে মনে জপছি আমি লিও কে ছাড়া থাকতে পারবোনা। কিছুতেই না।
আরো একটা অশ্রু ফোটা গন্ড বেয়ে গড়িয়ে যাবার আগেই মুছে ফেললাম। মাথাটা ভীষণ এলোমেলো হয়ে আছে। চোখ দুটো খুব জ্বলছে। কিন্তু বলতে ইচ্ছে করছে “তোমায় ভালোবাসি লিও।”
কাঁপা কাঁপা হাতে লিওর গালটা আলতো করে স্পর্শ করলাম। হাসলে গালের ঠিক এই খান টাতে টোল পড়ে। রাগলো গালের ঠিক এখান টা পাকা টমেটোর মত লাল হতে থাকে। দুঃখ পেলে চোখ দুটো বড় মায়াময় আর ড্যাবডেবে হয়ে থাকে। ঠিক আদুরে বিড়ালের মত।
আস্তে করে লিওর মাথা টা নামিয়ে রাখলাম। তারপর টলতে টলতে নেমে দাড়ালাম। আশ্চর্য্য! আমি টলছি নাকি দুনিয়া টলছে?
চোখ দুটো ইতি উতি করে পথ খুজছে। ঘরের পথ টা কোন দিকে?
চমকে উঠলাম ফযরের আযানের সুরে। নিস্তব্ধতা কে চূর্ন করে দিয়ে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
আমি চললাম। ঘরের দিকে। উঠানে তেরপালের নিচে কয়েক জন কে আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে। তারা হয়ত বিয়ের রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি কিছুক্ষন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওই দিকে। তারপর ঘরে ঢুকে গেলাম।
পুরো ঘর এখন গভীর ঘুমে তলিয়ে। তবে জাগ্রত হতে বেশি দেরী নেই। আমি আমার রুমে গেলাম না। হাটা টা পায়ের উপর ছেড়ে দিলাম। পা যেদিকে নিয়ে যায়।
টলতে টলতে আব্বা আম্মার রুমের সামনে এসে দাড়ালাম। মোরগ টা ডেকে উঠলেই সবাই ঘুম থেকে উঠবে। তাই ধপ করে দুয়ারে বসে মোরগ ডাকার অপেক্ষা করতে লাগলাম। কখন মোরগ ডাকবে? কখন আব্বা বের হবে?
দেখতে দেখতে চারপাশের ঘন অন্ধকারের ছাদর পাতলা হতে শুরু করলো। আর গলা কে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়ে বড় মোরগ টা ডেকে উঠলো কক কক করে। আমি হতচকিত হয়ে গেলাম।
গলাটা শুকিয়ে গেছে। পানির তৃষ্ণা পেয়েছে ভীষণ। কেউ কি আমাকে পানি দেবে? চোখ টা এখনো জ্বলছে। আব্বা কখন বেরুবে?
উঠে দাড়ালাম। তারপর ঠক ঠক করে দরজায় টোকা দিতে লাগলাম আর ডাকতে লাগলাম কাঁপা কাঁপা গলায়
“আ-আব্বা! আব্বা!”
আবার ডাকলাম
“আ-আব্বা দরজা খোল।”
দরজায় আওয়াজ হল টুক করে। খিল খুলে গেছে। আমি হাত নামিয়ে নিলাম। দরজায় আব্বা দাড়ানো। পাঞ্জাবী গায়ে সবে টুপি দিয়েছেন মাথায়। নিশ্চয় বের হচ্ছিলেন মসজিদের জন্য। তার গম্ভীর চেহারার চোখে একরাশি বিস্ময়। তিনি হয়ত কিছুটা অবাক হলেন। আমার এমন টালমাটাল অবস্থায় তার অবাক হওয়ারই কথা। পুরো রাত ঘুমাই নি। হয়তো চোখ দুটো দেবে গিয়ে আব্বা কে সব কথা বলে দিচ্ছে। উসকো খুসকো চুল নিশ্চয় তার সাক্ষী দিচ্ছে
পিছন থেকে আম্মা ডেকে উঠলেন
“তাহমিনা! তুই এখানে? কি হয়েছে মা?”
আমি ভিতরে ঢুকলাম। আম্মা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে আমার কপাল ঘাড় চেক করতে লাগলো। আমি হাত সরিয়ে বললাম
“আম্মা আমি ভালো আছি।”
“তাহলে তোর অবস্থা এমন কেন?”
আমার ঠোঁটের কোণে একটু করে হাসি ফুটে উঠল। অথচ চোখে টল মল করা জল। আব্বা আম্মা দুজনে সন্দিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জবাবের আশায়।
“আ-আব্বা আ-আমি…!”
গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ঢোক গিলতেও পারছিনা। চোখটা বা হাতে একটু ডলে বললাম
“আব্বা আ-আমি এ-এ বিয়ে ক-করবোনা। তু-তুমি এ বিয়ে ভেঙে দাও।”
স্তব্ধতা ছেয়ে আছে চারদিকে। আব্বা আম্মা দুজনে মূক হয়ে আছে। অস্বস্তিকর থমথমে একটা পরিবেশ। পা দুটো টলছে। মনে হচ্ছে এখনি পড়ে যাব। আব্বা আম্মার চাহনী দেখে আবার বললাম
“আ-আমি অন্য কাউকে পছন্দ করি।”
বাইরে মোরগ টা আবারো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো। আব্বা একটু কেঁপে উঠলেন। কিন্তু তা এক মুহুর্তের জন্য। পরক্ষনে চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো তার। এগিয়ে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে দিল গালে। আমি ব্যথা পেলাম। কিন্তু কষ্ট লাগলো না। আব্বা ফোঁস ফোঁস করতে করতে আরেকটা থাপ্পড় মেরে দিল। প্রথম থাপ্পরে ঠাই ধরে দাড়িয়ে থাকতে পারলেও দ্বিতীয় থাপ্পড়ে পারলাম না। ধুপ করে পড়ে গেলাম।
“বেয়াদব মেয়ে! লজ্জা করে না তোর এসব বলতে? কি ভেবেছিস তুই? যা ইচ্ছা করবি আর আমি চুপচাপ দেখবো? একবার ডুবিয়ে গেছিস। এখন আবার ডোবানোর পায়তারা করছিস? দাড়া তোকে!”
এই বলে আব্বা আমার চুলের মুটি ধরে হেচড়িয়ে টেনে তুলতে লাগলেন। আমি ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম।
“আ-আব্বা…!
চুলের মুটি ধরাবস্থায় আব্বা এলোপাথারি থাপ্পড় মারতে লাগলো। মনে হতে লাগল এতোদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ এক নিমিষেই আমার উপর মিটিয়ে ফেলবেন।
আম্মা প্রথমে হতচকিত হয়ে গেলেও পড়ে চিৎকার করে আব্বার হাত ধরে টানতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন আমাকে ছেড়ে দিতে। একের পর এক থাপ্পড়ে আমার বেহাল দশা হয়ে যাচ্ছিল। চোখ পর্যন্ত খুলে দেখতে পারছিনা। কোনো রকম ডাকলাম
“আ-আব্বা!”
আব্বা ধাক্কা দিলেন। ধাক্কার চোটে আমি পড়ে গেলাম। আব্বা পাঞ্জাবির হাত কনুই পর্যন্ত তুলে আমাকে শাসিয়ে বলতে লাগলেন
“খবরদার বাপ ডাকবি না আমাকে। মেরে ফেলবো তোকে। এমন মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। আজকেই বিদায় হবি এখান থেকে। আমি চাই না তোকে আর দেখতে।”
এই বলে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। কিন্তু আমি ছিলাম প্রেমে প্রেমাসক্ত, নিরুপায় এক তৃষ্ণার্ত প্রেমিকা। যে প্রেমের সুধা পান করেছে তার কাছে এই আঘাতের চেয়ে প্রেম বেদনা যেন মৃত্যুর সমতুল্য। কাতরাতে কাতরাতে বলে ফেললাম
“আ-আমিহ…”
ঢোক গিলার চেষ্টা করলাম। হচ্ছে না। ঠাঠিয়ে থাকা গলায় বললাম
“এ বিয়ে করবোনা।”
আব্বা থমকে দাড়ালেন। আম্মা তাড়াতাড়ি আমার মুখ চেপে ধরলেন। বলতে লাগলেন
“চুপ কর তাহমিনা! আল্লাহর ওয়াস্তে একটু চুপ কর। কি বলে যাচ্ছিস?”
আব্বা ফিরে তাকালেন। রক্ত চক্ষুতে পুনরায় যেন বিষ ভরে উঠল। আবার ফিরে আসতে লাগলে আম্মা তাড়াতাড়ি আব্বার কাছে মিনতি করে বলল
“না বুঝে বলছে। আ-আমি বুঝিয়ে দিব। ছেড়ে দাও ওকে।”
আব্বা আম্মাকে পাত্তাও দিলেন না। এক হাতে সরিয়ে দিয়ে আমার চুলের মুটি টা আবার ধরলেন। এবার আমাকে থাপ্পড় মারলেন না। সরাসরি টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। ফযরে চিৎকার চেঁচামেচিতে কৌতুহলী হয়ে সবাই বেড়িয়ে এলেন। কিন্তু আব্বার কারণে কেউ এগিয়ে আসছিলেন না। ছোট মামাও নাই। তাকে কাল রাতেই কোথাও পাঠানো হয়েছে। আর তৈয়ব চাচু নিশ্চয় মসজিদে।
চুলের মুটি ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে আর্তনাদ করছিলাম। বলছিলাম
“ব্যথা লাগছে আব্বা। ছেড়ে দাও আমাকে।”
আব্বা ছাড়লেন না। আম্মা পিছন পিছন হাউমাউ করতে করতে এগিয়ে আসতে লাগলেন। এরপর আমার রুমের দরজা টা খুলে আব্বা ভিতরে ধাক্কা মারলেন। তারপর ঝট করে বাইরে থেকে দরজা বেধে দিলেন। আমি দ্রুত দরজায় এগিয়ে এসে করাঘাত করতে লাগলাম
“আব্বা দরজা খোলো। আমি বিয়ে করবোনা। আমাকে বাঁচতে দাও আব্বা। ও আব্বা! তুমি চলে যেও না? দরজা টা খোলো।”
আমি আর দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। কান্না করতে করতে বসে গেলাম। মনে হচ্ছে বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। হাত মুটো করে ক্রমাগত মেঝেতে আঘাত করতে লাগলাম। কি হয়ে যাচ্ছে, কি হয়ে যাচ্ছে? আমি তো মরে যাব।
.
কান্না থেমে গেছে বহু আগে। কতক্ষণ পর পর শরীর কেঁপে কেঁপে শুধু দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে যাচ্ছে। সে সাথে অস্পষ্ট গোঙ্গানি। চিৎকার করার মত শক্তি আমার কাছে আর অবশিষ্ট নেই। শুধু চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে মাড়িতে ব্যথা হচ্ছে অনেক।
আব্বা দরজা বেধে দেওয়ার পর থেকে কেউ আমার সাথে দেখা করতে আসেনি। সে আব্বা আমার গায়ে হাত তুলেছে যে কখনো আমার গায়ে ফুলের টোকাও লাগায় নি। বেশি প্রয়োজন হলে আম্মা থাপ্পড় মারত আর নাকি কান্নায আমি আব্বা কে নালিশ জানাতাম। বেলা উঠেছে অনেক আগে। বাইরে মানুষের শোরগোল বাড়ছে। আমার চোখ ঢুলু ঢুলু। আর খুলে রাখতে পারছিনা। কখন মেঝেতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেই পারলাম না।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here