আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -২৪

0
1970

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ২৪
———————————————–
“হেই টামিনাহ! ওয়েট প্লীজ!”
আমি চলে আসছিলাম রিচার্ডের ডাক না শুনে। জানি না তবে আমার ভালো লাগছিলো না ওকে। রিচার্ড গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে আমার পাশে এসে দাড়ালো। হাপাচ্ছিল ভীষন। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
“টামিনা আমি তোমাকে বলতে চাইছিলাম যে ওই দিন সকালের জন্য আমি দুঃখিত। আমি সত্যিই জানতাম না তুমি মোজলিম!”
“ইটস ওকে রিচার্ড।”
বেশ কিছুক্ষন নিরবতা ছিল চারপাশে। শুধু হাটার আওয়াজ ছাড়া নিঃশব্দে বাল্ব লাইট গুলো জ্বলছিল। আমি ভেবেছিলাম রিচার্ড চলে যাবে। কিন্তু সে গেলো না। যেন আমার সাথে কথা বলতে ভীষন আগ্রহী। কিন্তু হার্ড ওয়ার্ক করে আমি খুব পরিশ্রান্ত ছিলাম।
“তো তুমি বাংলাডেশ থেকে এখানে এসেছো পড়ালেখা করতে।”
“হুম”
আমার হোস্টেল এসে পড়াই রিচার্ড আরো প্রশ্ন করতে গিয়েও করলো না। শুধু বলল
“টামিনা?”
“হাহ!”
“এই সানডে তে তুমি কি ফ্রি আছো?”
“হুম কেন?”
রির্চাড একটু ইতস্থত করে বলল
“তুমি কি সানডে তে আমার সাথে ডিনার করবে?”
আমি একটু ভাবলাম। তারপর বললাম
“ঠিক আছে।”
“থ্যাংকস টামিনা।”
আমি শুধু একটু হাসলাম। তারপর ভিতরে ঢুকে গেলাম। আজ অনেক কাজ করেছি। ক্লান্ত অনেক। হাত দুটো যেমন ব্যাথা করছে পাও তেমন ব্যাথা করছে।
গোসল করে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম।
.
বেশ কয়েক দিন ধরেই লিওর কাছে পড়তে পারছিনা। মার্থা হাউজে একই সময় কাজের ডিউটি হওয়ায় লিও কে স্যরি বলে চলে আসতে হয়। লিও আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করে কি এমন কাজ যেটা ওকে বলতে পারি না। আমি শুধু নার্ভাস ভাবে একটু হাসতাম আর ও সায় জানাতো।
আজ আবারো দুরু দুর বুকে লিওর সামনে দাড়িয়ে আছি। লিও চোখ ছোট ছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছিল। বুঝতে পারছি না এ বিদেশ বিভুইয়ে এসে এরকম কড়া শাসন করা অঘোষিত অভিভাবক কিভাবে পেয়ে গেলাম?
“দেখ লিও দেরী হয়ে যাচ্ছে। আ-আমি যাই?”
“নো।”
“তোমার সব এ্যাসাইনমেন্ট আমি তৈরি করে দিব। এখন যেতে দাও”
“আমার এ্যাসাইনমেন্ট আমি তৈরি করতে পারি।”
“লিও এবারের মত যেতে দাও। আমি তোমাকে খুবই সুস্বাদু বাংলাদেশী খাবার রান্না করে খাওয়াবো।”
“কখন খাওয়াবে?”
আমি ভাবতে লাগলাম কখন খাওয়াবো। কিন্তু সময় খুজেই পাচ্ছি না। অনেক ভেবে চিন্তে বললাম
“সানডে তে। আমি শিউর। ঠিক আছে লিও?”
লিও চিরাচরিত ভঙ্গিতে চোখের পলক না ফেলে বলল
“নো!”
“লিওওও!”
লিও বসা থেকে উঠে দাড়ালো। তারপর বলল
“কেননা বাংলাদেশী ফুড আজকেই খাব আমি।”
“মানে!”
“মানে আজকে তুমি কোথাও যেতে পারবেনা।”
আমি আর্তনাদ করে উঠলাম। এক পা করে পিছু নিয়ে বললাম
“না লিও। আমাকে যেতে হবে।”
বলেই আরো এক পা পিছু নিব তখন ঝট করে আমার হাত ধরে ফেলল। আমি চমকে উঠলাম।
“আমি জানতাম তুমি পালাতে চাইবে। কিন্তু আজকে আর তোমাকে যেতে দিচ্ছি না।”
আমার ভয়ে বুক দুর দুর করছিল। করুন স্বরে বললাম
“লিও। এ-এমন টা করো না প্লীজ! তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো। এবারের মত যেতে দাও”
“উহু!”
এই বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। আমি অনুরোধ করছিলাম। কিন্তু অনুরোধের তোয়াক্কা না করে কার পার্কিংয়ে গিয়ে লক অন করতে লাগলো। কার পার্কিং এ এসে একটা ভিরমি খেলাম। তার মানে সে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। তার কার টাও নিয়ে এসেছে। তাহলে তো আমার অনুরোধ সব বেকার। হে আল্লাহ! মিস মার্থা এবার না নির্ঘাত আমাকে ব্লেন্ডার মেশিনে ঢুকিয়ে জুস বানিয়ে খেয়ে ফেলে।
“ঢুকো!”
নিঃশব্দে লিও কে শাসাতে শাসাতে গাড়িতে ঢুকে গেলাম। গাড়িতে ঢুকতেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে লিও অদ্ভুদ কান্ড করলো। গাড়ির শার্সি বরাবর একটু নিচু হয়ে সে আমাকে একটা ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিল। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। এটা ওর জন্য কতটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল আমি জানি না। তবে আমার জন্য পুরো ৪০/৫০ রিখটার স্কেল মাপের ভুমিকম্প ছিল। কোথাও সব কিছু ভেঙে গুড়ি হয়ে যাচ্ছিলো। চোখে শুধু ভাসছিল যে ভঙ্গিতে সে আমাকে ফ্লাইং কিস পাঠালো। খেয়াল ছিল না আশে পাশের কিছুই। লিও ড্রাইভিং সিটে বসেই আমার থুতনিতে হালকা টোকা দিয়ে বলল
“হাতি ঢুকবে। মুখ বন্ধ কর।”
এবং বলেই নিজে নিজেই হাসতে লাগল। আমি তাড়াতাড়ি মুখ বন্ধ করে ফেললাম।
“লিও?”
“হুম!”
“তোমাকে কি কেউ বলেছে যে তুমি হাসলে তোমাকে জোকারের মত লাগে?”
“নো মিইইরা। আমি তো জানতাম আমাকে হ্যান্ডসাম লাগে। ইনফ্যাক্ট এখনো লাগছে।”
এই বলে কার মিররে চুল ঠিক করতে করতে নিজেকে দেখতে লাগলো। তারপর গাল হা করে হাসার ভঙ্গি করেও দেখতে লাগল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
“হাসলে আমাকে হট লাগে!”
মুখ ভেঙচি দিলাম কথা শুনে। হাসলে আমাকে হট লাগে!
তারপর আমি সিরিয়াস ভঙ্গিতে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললাম
“কিন্তু লিও সত্যি টি হচ্ছে তুমি হাসলে তোমাকে জোকারের মতই লাগে। তাই আপাতত হাসা বন্ধ করে।”
এতক্ষন সে মিট মিট করে হাসছিল। এটা শুনেই আরো জোরে জোরে হু হা হা হা শব্দ করে হাসতে লাগল। যেন হাসি না পাওয়া স্বত্তেও ইচ্ছে করে হাসছে।
আমি কানে আঙ্গুল দিলাম।
পুরোটা সময় গাড়িতে ওর শব্দ অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। এতটা লাউডস্পীকার লিও হতে পারে তা আজই জানলাম।
গ্যাংনাম স্টাইল গান টা ছেড়ে দিয়ে ধুপ ধুপ শব্দে গানটার সাথে সে নাচছিল। আর হেড়ে গলায় নিজেও গাইতে লাগল।
বাড়ি পৌছতেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক অন্তত শব্দ অত্যাচার থেকে এখন মুক্তি পাবো।
কার টা থামতেই দ্রুত গতিতে নেমে গেলাম। বাড়ির ভিতর ঢুকতে যাবো তার আগেই দেখি প্রবেশ মুখে শাকিরা দাড়িয়ে। লেজ নেড়ে নেড়ে যেন আমাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
আমি দমে গেলাম। একা প্রবেশ করা টা বেশ বিপদ জনক। পিছিয়ে গিয়ে আবারো লিওর পাশে দাড়ালাম।
কার লক করতে করতে লিও জিজ্ঞেস করলো
“হোয়াট হ্যাপেন্ড ব্রেইভ লেডি!”
একটা শুকনো হাসি দেখিয়ে বললাম
“নাথিং।”
প্রবেশ মুখে শাকিরা দেখে লিও এবার বুঝে গেল।
“মিইইরা! ও খুব ভালো মেয়ে। দেখ তোমাকে স্বাগত জানানোর জন্য ওখানে দাড়িয়েছে।”
“দেখ লিও একদম ফালতু কথা বলবেনা। ওকে বল ওখান থেকে সরে যেতে।”
আমি লিওর পিছনে দাড়িয়ে খামছি দিয়ে তার শার্ট টা ধরেছি। শাকিরার মুখ থেকে গর গররর শব্দ বেরুচ্ছে। নিশ্চয় আমাকে দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই কুকুর জাতের উপর আমার একদম ভরসা নেই। কুকুরের কামড়ের দাগ এখনো আমার শরীরে আছে।
লিও শিষ দিতেই শাকিরা লেজ নাড়াতে নাড়াতে লিওর পাশে এসে দাড়ালো। লিও নিচু হয়ে বসে ওর গায়ে হাত বুলাতে লাগল। আদরে গদ গদ হয়ে শাকিরা লিওর গাল, গলা সব চেটে দিচ্ছে। ইয়াক!
বাম হাতে লিও আমাকে টানতে লাগলো
“মিইইরা এদিকে আসো। আই প্রমিজ শাকিরা তোমাকে কামড়াবে না। শুধু একটু করে ওর গায়ে হাত বুলাও।”
আমি আমার হাত টেনে নেওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।
“নো লিও!”
আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হেচকা টানে লিও আমাকে বসতে বাধ্য করলো। তারপরও লিওর পিছনের দিকে গুটিসুটি মেরে বসে রইলাম। শুধু হাত টাই বাইরে।
লিও আমার হাত ধরে শাকিরার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। আহ! কি নরম আর মোলায়েম লাগছে। শাকিরাও মাথা নিচু করে আছে। যেন চাইছে আরো কিছুক্ষন হাত বুলিয়ে দিই। আমি একটু করে এগিয়ে এলাম। ধীরে ধীরে ওর পিঠে হাত বুলাতে লাগলাম। আসলেই কি এতো নরম আর মোলায়েম হয় কুকুরের শরীর?
লিও আমার দিকে এক গাল হেসে বলল
“কেমন?”
“সো সফট!”
“বলেছিলাম না।”
আমার কথার ফাকে কখন শাকিরা কখন আমার হাত চাটা শুরু করেছে খেয়ালও করি নি। ভিজা ভিজা লাগতেই লাফিয়ে উঠলাম।
“ইয়াক!”
শাকিরা পুরো হাতের কব্জি টা চেটে ভিজিয়ে দিয়েছে।
লিও ততক্ষণে হাসতে হাসতে ফ্লোরে বসে গেছে। এত হাসছে কেন ছেলেটা? নিশ্চয় তার কান্নার সময় এসেছে তাই এত হাসছে। একদম পুরো টা ইডিয়ট!
.
প্রথম যেদিন এসেছিলাম সেদিন এই বাড়িটা লোকে লোকারন্য ছিল। কিন্তু আজ এত নিঃশব্দ কেন? মিসেস উইলিয়াম কোথায়? আর লিওর পিতা? লিওর কি আর ভাই বোন নেই?
আমি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রচুন্ড পিপাসা পেয়েছে। তাই গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করলাম
“লিও কাউকে দেখছিনা? সবাই কোথায়?”
“তারা কেউ নেই। পুরো বাড়িতে তুমি আর আমি শুধু!”
“হোয়াট!”
পানি টুক পান করার জন্য মুখে দিয়েছিলাম। কিন্তু লিওর কথা শুনে কিছু পানি নাকে উঠে গেল। কিছু পানিতে মুখ আর জামা ভিজে গেল। ভীষন খারাপ ভাবে আমি কাশতে লাগলাম। লিও দৌড়ে এসে হাত থেকে গ্লাস টা রেখে মাথায় হালকা চাপড় দিতে দিতে বলল
“ইটস ওকে মিইইরা। শান্ত হও। শুধু আমরা দুজন না, শাকিরা আছে, মেইড রা আছে।”
আমি তীক্ষ্ণ চোখে লিওর দিকে তাকিয়ে নাক টা ডলতে লাগলাম। পানি ঢুকে ভীষন ঝাঝাচ্ছে নাক টা।
“তার মানে পুরো বাড়ি খালি?”
লিও ইতস্থত করে বলল
“না-আআ! মে-মেইড রা আ-আছে তো!”
লিও তোতলাতে লাগল। ব্যাপার টা ভীষন মজার লাগলো। আমি আরো তীক্ষ্ণ চোখে বললাম
“কোথায় মেইড রা? আমি দেখছিনা?”
এই বলে চারপাশে একটু একটু হেটে দেখতে লাগলাম। আসার সময় ইয়ার্ডে দুজন গার্ড দেখতে পেয়েছিলাম। তারপরও কথা টা বেমালুম চেপে গেলাম। এরপর লিওর দিকে তাকালাম। লিও তার মেইড দের ডাকতে লাগল। অবাক করা বিষয় ডাক শুনে একজন মেইডও বেড়িয়ে এলো না। এদিকে লিওর চেহারার বারোটা বেজে যাচ্ছে। সে মনে করছে যে আমি তাকে খুবই চিপ আর প্রেভাট পারসান মনে করেছি। তাই চোখ মুখ রক্ত শূন্য হয়ে আছে। বাম হাতে লকেটের ক্রুশ টা চেপে ধরে আছে। নিশ্চয় মনে মনে প্রার্থনা করছে। আমার খুব হাসি পেল। আমি চোখ মুখ আরো শক্ত করে লিওর সামনে দাড়ালাম। সে আরো ক্ষীন স্বরে তাদের মেইড কে ডাকতে লাগলো। যেন তার বিশ্বাস কেউ না কেউ ছুটে আসবে তাকে উদ্ধার করতে।
“লিও! আমি তোমাকে খুব ভালো বন্ধু মনে করেছিলাম।”
মিনমিনে স্বরে লিও বলল
“বিশ্বাস কর মিইইরা! কেউ না থাকলেও মেইড রা আছে। কিন্তু কেন যে তারা আসছে না! বুঝতে পারছি না!”
“কিন্তু আমি বুঝতে পারছি। তুমি আজকে এতটুকু নিচে নামবে তা আমি ভাবতে পারি নি। তাই আজকের পর থেকে…
“গুড আফটারনুন স্যার। রুমের বাথরুমে ছিলাম। তাই ডাক শুনতে পাই নি।”
আমার কথা কেটে গেল। ফর্মাল ড্রেসে একজন মেইড এসে দাড়িয়েছে। সাথে আরো কয়েকজন আসছে। মনে মনে রাগ হল। আরেক টু পড়ে আসলে কি হতো?
লিও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল
“ইটস ওকে। এখন যাও।”
তারপর আমার দিকে বিরাট একটা ডিম্পল ওয়ালা হাসি ছুড়ে দিয়ে বলল
“দেখেছো আমি বলেছিলাম না!”
“তাতো দেখছি!”
মনে মনে আফসোস করে বলছিলাম ইশশরে! আমার এত্তো ভালো একটা মোমেন্ট!
.
(চলবে)
.
কেমন লাগলো জানাবেন 😉

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here