আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -২৮

0
1752

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ২৮
———————————————–
আমি ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড ফোপাচ্ছিলাম। এত বড় প্রতারনা! আমার সাথে!
“ওয়েট মিইইরা! ছাড়ো আমাকে!”
আমি ছাড়লাম না। ইদানিং এক্সেরসাইজ করে হাত পায়ে ও জোর এসেছে বই কি! তাছাড়া আমি গড়পড়তা বাঙালি নারী।
সহ্য করতে না পেরে লিও আমার দু হাত ধরে ফেলল। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
“কি করছো মিইইরা! আমাকে মেরে ফেলবে নাকি!”
লিওর গালে আমারে নখের আচড়ে লম্বাটে একটা দাগ হয়েছে। কিন্তু সেটা দেখেও আমার মন গলল না। বললাম
“তোমাকে মেরেই ফেলবো।”
আবারো মারতে চেষ্টা করতেই লিও আরো শক্ত করে হাত চেপে ধরলো।
“মিইইরা! মাই প্রিন্সেস! দেখ আমার গাল জ্বলছে! মনে হয় কেটে গিয়েছে। পেটে ব্যাথা করছে অনেক। আমার হাত দেখ! তোমার সব গুলো দাঁত ওখানে বসে আছে। এবার তো মাফ করে দাও। তোমার জন্য নিজ হাতে এত কষ্ট করে আমি রান্না করেছি। সেটাতো দেখো।”
আমি টেনে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। বললাম
“আমি যেটা নিজের হাতে রান্না করেছিলাম ওটা? ওটা কি আকাশ থেকে পড়েছিল? আমার কষ্ট হয় নি সেটা করতে?”
“সেই জন্যই তো কান ধরে উঠ বস করলাম। এবার তো মাফ করে দাও। তাছাড়া তুমি যেভাবে আমাকে আহত করেছো সেটা কানাডিয়ান পুলিশ জানলে তোমাকে এক্ষুনি জেলে পুরবে!”
ঝট করে মাথায় আগুন ধরে গেল আমার। বললাম
“আর তুমি যে আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছো সেটার জন্য বুঝি আদর করবে?”
আমার কথা শুনে লিও লজ্জাতুর দৃষ্টিতে মিটি মিটি হাসতে লাগলো।
আর সে সময় দেয়াল ঘড়িটা আবারো ঢং ঢং করে উঠল। চমকে উঠলাম দুজনেই। কতক্ষণ ধরে ঝগড়া করছি? আর কিছুক্ষন পর তো ভোর হয়ে যাবে। ব্যায়ামের জন্য ফিল্ডে যেতে হবে। এখন কি হবে?
.
ক্লাসে বসে অনূভুতি হীন দৃষ্টিতে মিস এর দিকে তাকিয়ে আছি। কি বলছে সেটা মাথায় ঢুকছে না। অথচ লিও কে যে জিজ্ঞেস করবো সেটারও কোনো ব্যবস্থা নেই। লাট সাহেব এখন ঘুমাতে ব্যস্ত। এভাবে হা করে ঘুমাতে ঘুমাতে কখন মিসের চোখে পড়ে যাই সেটা ভেবেই আমার ঘাম ছুটে যাচ্ছে। বার বার কনুই দিয়ে তাকে গুতো মারছি।
আল্লায় জানে সারা রাত কি করেছিল? আবার ভাবলাম। কি করেছিল আবার কি? পুরো রাত ইলিশের জগা খিচুড়ি করেছিল আর আমাকে কিডন্যাপ করেছিল। ভাগ্যিস সবাই ফিল্ডে পৌছার আগে আমি পৌছতে পেরেছিলাম।
আমি আবার তাকালাম লিওর দিকে। ইডিয়ট টা হা করেই ঘুমাচ্ছে। চোখের নিচে এক গাদা কালি জমেছে। হাতের কামড়ের দাগ টা প্রায় মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গালে নখের আচড় টা ভালো ভাবেই লেগেছে। লাল হয়ে আছে। যেন কেউ ছুরি দিয়ে পোচ দিয়েছে। ইশশশ! কেন যে দেখে শুনে মারলাম না।
এখনো নিশ্চয় ব্যাথা হচ্ছে। স্পর্শ করতে যাবো ঠিক তখন দেখলাম মিস লি এগিয়ে আসছে। আমি আবারো কুম্ভকর্ন টাকে গুতো মারলাম। সে আবছা ভাবে একটু চোখ খুলে আবার বুজে ফেললো। আমার আর কিছু করার নাই। পাক্কা ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতে হবে তাকে।
“এডওয়ার্ড!”
মিস লিও কে ডাক দিলো। কিন্তু সে এখন ঘুমাতে ব্যস্ত। পুরো ক্লাস খিক খিক করে হাসছে। মিস লি এবার জোরে ধমকে উঠলো
“এডওয়ার্ড!”
মিস লির ধমকের সাথে আমি লিওর হাতে জোরে চিমটি মারলাম। আর সাথে সাথে লিও চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলো। কিন্তু মিস কে সামনে দেখে চুপ হয়ে গেল। চোখ দুটো ভীষন ফুলে গেছে। মিস কটমটে দৃষ্টিতে বলল
“হোয়াট ইজ দিস এডওয়ার্ড?”
লিও মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল
“আই এ্যাম স্যরি মিস!”
.
ক্লাস শেষে লিও কে খুজতে লাগলাম। ক্লাস থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আল্লায় জানে কোথায় গিয়ে ঘুম কে উদ্ধার করছে। আমারো ঘুম আসছিলো। কিন্তু তেমন জোরালো না।
কফি পান করতে করতে রিচার দিকে তাকালাম। সে এক নাগাড়ে বক বক করছে। কোন একটা ছেলেকে দেখে সে ক্রাশ খেয়েছে তার গল্প। সবাই মনযোগ দিয়ে শুনছে।
লিও এখনো আসছেনা দেখে সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম
“লিও কোথায় বলতে পারো!”
সবাই না বোধক উত্তর দিল। তবে রিচা বলল
“লাইব্রেরিতে দেখতে পারো। যখন কোথাও পাওয়া যাবে না, তখন লাইব্রেরি তে পাবে এটা শিউর!”
“ওহ্ তাহলে আমি দেখে আসি!”
এডালিন আমাকে বাধা দিল
“কোথায় যাচ্ছো? কফিটাতো শেষ করো। এতদিন পরে এসেছো! কয় দিন পরই ফাইনাল পরিক্ষা! এত ফাঁকি দিয়ে চললে হবে?”
আমি একটু হাসলাম। বললাম
“ওটা পুষিয়ে নিব। তাছাড়া লিওর কাছে টিউশন পড়ছি। ও যথেষ্ট সাহায্য করছে।”
“দেখিও টামিনা! লিও না আবার প্রেমের টিউশন দেয়! তা না হলে পড়ালেখা বাদে প্রেমে গ্র্যাজুয়েট করবে। যেমন টা আমাদের এডি করছে!”
“চুপ কর ফাজিল!”
এডালিন কলম ছুড়ে মারল কার্লের দিকে।
“এর গাল পেকেছে ভীষন। শায়েস্তা করতে হবে একে!”
.
লাইব্রেরিতে এসে লিও কে পেলাম। জানালার ধারে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। কেউ যাতে টের না পাই সে জন্য মুখে বই দিয়ে ঢেকে রেখেছে। কি বই পড়ছে সে? নিয়ে দেখলাম ড্যান ব্রাউনের বই। দ্য ভিঞ্চি কোড। পড়ে নি আমি নিশ্চিত। শুধু মাত্র শান্তি তে ঘুমানোর জন্য লাইব্রেরি কে বেছে নিয়েছে। যাতে কেউ ডিস্টার্ব না করে। আমি ডাকলাম
“লিও!”
সে জবাব দিল না। আরো কয়েক বার ডাকলাম। রেসপন্স না পেয়ে ভাবলাম অন্য কিছু করি। তারপর লিওর কানে কানে বললাম
“লিও! আমি আর রিচার্ড আজ ডেটে যাচ্ছি!”
বলেই সোজা হয়ে বসে গেলাম। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ডের সময় সে ঝট করে চোখ খুলে ফেলল। সাথে সাথে মাথা তুলে বলল
“হোয়াট?”
আমি হাসতে লাগলাম। পাছে শব্দ হয় তাই মুখে হাত চাপা দিলাম। লিও ঘুমন্ত চোখ দুটো সজাগ হওয়ার চেষ্টা করছে। আমাকে হাসতে দেখে বলল
“কি বলেছো তুমি?”
“নাথিং! তোমার হোম ওয়ার্ক। দেখবেনা?”
ব্যাক প্যাক থেকে নোট বের করে দিলাম।
“আর ঘুম আসলে বাড়িতে চলে যাও। এখানে ওখানে ঘুমাচ্ছো কেন?”
লিও হাত বাড়িয়ে নোট টা নিল। দেখতে দেখতে আমাকে বলল
“কেন আসি সেটা বুঝবেনা!”
“কেন বুঝবোনা!”
লিও জবাব না দিয়ে শুধু হাসলো। আমি আর জবাবের অপেক্ষা করলাম না।
“লিও আমি যাচ্ছি। আমার অল্প কাজ আছে।”
“কি কাজ?”
মাথা উপরে না তুলেই লিও জিজ্ঞেস করলো।
“লিও!”
“স্যরি!”
.
মার্থা হাউজে ডিনের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব্ হয়েছে। সে আমাকে নিজের ছোট বোনের মতই স্নেহ করে। সে সাথে যথেষ্ট রেসপেক্ট করে। আমার মনে হল ডিনের মত কয়েকজন নিগ্রো হীরা আছে যাদের চাইতে কেউ কখনো কোনো নারী সম্মান করতে পারবেনা। কথায় কথায় ডিন সব সময় একটা ডায়ালগ বলে
“All womens are beautiful!”
আমার অনেক ভালো লাগে শুনতে। ওর মত স্পষ্টবাদীও খুব কম দেখেছি আমি।
আজ কে ওর হাতে ম্যাপল সিরাপ বানানো শিখেছি। খেয়েও দেখেছি। চমৎকার সিরাপ সেটা।
ওভেন কিভাবে ব্যবহার করে ঝটপট ডিশ তৈরি করা যাই সেটা শিখছিলাম কিন্তু ফ্রান্সিস আমাকে ডেকে বললো যে কোনো এক ভদ্র মহিলা এসেছে নাকি আমার সাথে দেখা করতে। মনে মনে ভাবলাম নিশ্চয় মিসেস হুড এসেছে। কিন্তু বাইরে গিয়ে অবাক হতে হল। কারন আমার সাথে দেখা করতে এসেছে মিসেস উইলিয়াম মানে লিওর মম।
“হ্যালো ম্যাম!”
“টামিনা তোমার সাথে কথা আছে!”
“বলুন কি কথা?”
“তোমার সময় হবে?”
আমি একটু ইতস্থত করলাম।
“এক মিনিট!”
দৌড়ে গিয়ে ডিনের কাছ থেকে কিছু সময় চেয়ে আসলাম। মিস মার্থা ছিলেন না। সুতরাং তেমন সমস্যা হবে না।
মিসেস উইলিয়াম কে টেবিলে বসতে দিয়ে একটা ক্যাপাচিনো অফার করলাম। কিন্তু মানা করে দিলো। ভীষন্ন গলায় বললো
“তুমি বসো!”
বসে পড়লাম।
“জি!”
“কাল রাতে তুমি আমাদের ঘরে ছিলে তাই না!”
একটু চমকে উঠলাম। ইতস্থত করে বললাম
“আমি বুঝতে পারছিনা আপনি কি বলতে চাইছেন?”
“ভান করিও না টামিনা। আমি কি বলতে চাইছি তুমি স্পষ্ট বুঝতেছো।”
“ম্যাম?”
“কাল রাতে তুমি এডের সাথে ছিলে?”
মাথা নেড়ে সায় জানালাম
“ছিলাম।”
“তুমমি আর এডের মধ্যে কি…”
একটু কাশি দিলেন। তারপর বললেন
“টামিনা তুমি আর এডের মধ্যে কোন রুপ ফিজিক্যাল রিলেশন চলছে কি?”
আমি চমকে উঠলাম
“নো ম্যাম। কি বলছেন এসব আপনি। লিওর সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই!”
“উত্তেজিত হয়ো না। আমি সব বুঝি। আমি শুধু একটা কথা বলতে এসেছি এখানে।”
“জি বলুন!”
“দেখ তুমি মোজলিম। ব্যাংলাডেশ থেকে এসেছো। পড়ালেখা শেষে আবার সেখানে চলে যাবে। আর এড খ্রিষ্টান। অযথা এসব সম্পর্কে জড়িয়ে লাভ কি?”
আমি হা করে রইলাম। তিনি ঠিক কোন সম্পর্কের কথা বলছেন আমি বুঝতে পারছিনা। তিনি আবারো বলল
“আমি রিচার্ডের কাছে সেদিনের ঘটনা শুনেছি। এমন কি তোমার সাথে রিচার্ডের সাধারন ডিনারের কথায় এডের ক্ষেপে যাওয়া। এর পরের কয়েক দিন গুলো উদভ্রান্তের ঘুরে বেড়ানো আমার কাছে মোটেও স্বাভাবিক মনে হয় নি।”
“ম্যাম আমি…”
“টামিনা এড তোমাকে পড়ায় সাহায্যে করছে, নিয়মিত তোমার পাশের সিটে বসছে, বার্থ ডে পার্টি তোমাকে ছাড়া নাকচ করছে, তোমার হাতের রান্না খাচ্ছে, তোমার জন্য রান্না করছে এমন কি রিচার্ড কেও বাড়ি থেকে বের করিয়েছে। এসবে তোমার কি একটু ও ধারনা হচ্ছে না যে এডের তোমার প্রতি ফিলিংস জন্মাচ্ছে?”
মিসেস উইলিয়াম প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। আমি তাড়াতাড়ি পানি এগিয়ে দিলাম
“শান্ত হোন ম্যাম!”
মিসেস উইলিয়াম পানির গ্লাস টা ঢক ঢকিয়ে পানি পান করল। কথা বলতে বলতে পুরো ঘেমে গেছেন। গ্লাস টা টেবিলে সশব্দে রাখলেন। তারপর বললেন
“এড আমাদের একমাত্র ছেলে। সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারি সে। বিজনেসের খাতিরে আমরা তার এনগেজমেন্ট করিয়ে রেখেছি। সুতরাং আমি চাইবো তুমি আমার ছেলের কাছ থেকে দূরে থাকবে। কারন এখানে ওর ভবিষ্যত জড়িত। আশা করি তুমি ওর ভবিষ্যতের পথে আসবেনা।”
মিসেস উইলিয়ামের কথা বার্তা সব খাপছাড়া। তেমন কিছুই বুঝতেছিলাম না। এতটুকু বুঝেছিলাম উনি চাইছেন না আমি আর লিওর সাথে কথা বলি। তাই তাকে খুশি করার জন্য বললাম
“অবশ্যই। আপনি যেটা বলবেন সেটাই হবে।”
মিসেস উইলিয়াম খুশি হয়ে গেলেন। বললেন
“তোমার কাছে এটাই এক্সপেক্ট করেছিলাম। ভালো থেকো!”
“হুম!”
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here