Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৩
————————————————-
বাগান থেকে সদ্য তোলা কাচা গাঁদা ফুল সেই সাথে কাচা মেহেদির খুশবু তে চারদিকে মৌ মৌ করছে। আর আমি সেই হলুদ গাঁদা ফুলের গহনা, হলুদ শাড়ি হাতে মেহেদি দিয়ে বসে আছি। সামনে সবাই কত আনন্দ ফুর্তি করছে। আব্বা তার বন্ধু দের সাথে খোশ গল্পে মেতেছেন। আর আম্মা?
আম্মা কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আমার এক জায়গায়, পায়ের উপর পা দিয়ে বসে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা করছে। অনেক্ষন হচ্ছে বাথরুমে যাই নি। আম্মা যে কোথায় গেল?
এসময় ছোট মামা হুট করে কোথ থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে আমার কানে ফিস ফিসিয়ে বলল
“কিরে বাদঁরী? এখনো বাঁদর সেজে গেড়ে বসে আছিস যে? মনে হচ্ছে বিয়ে না করে উঠবিই না। চল চল।”
“কোথায় ছোট মামা?”
জবাবে মামা শুধু একটু করে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন। এর অর্থ কি হতে পারে বুঝতে পারলাম না।
ছোট মামা বয়সে এখনো তরুন। মাস্টার্স কমপ্লিট করেছেন কয়েক বছর আগে। বর্তমানে বেসরকারী একটা ফার্মে ভালো পোষ্টে চাকরী করেন। বিয়ে করেছেন এক বছর হল। মার বিয়ের পর থেকে মামা বেশির ভাগ সময় এখানে পড়ে থাকতেন। বিবাহিত হলেও সব সময় উল্টা পাল্টা সব কাজ আর কুকর্মে উস্তাদ ছিল। আর সেসব আকাম-কুকামের সঙ্গী থাকতে হত আমাকে। তাই আমাদের মধ্যে মামা ভাগনির চেয়ে বন্ধুত্ব টা বেশি কাজ করে। আমাকে ক্ষেপা বার ছলে মামা সোজাসুজি মীরা বা তাহমিনা না ডেকে আমাকে বাঁদরী বলেই ডাকতেন। আর তা শুনে আমি পুরো বাড়ি মামা কে দৌড়িয়ে ছাড়তাম।
কিন্তু আজ বাঁদরী ডাকার পরও আমার তেমন কিছু মনে হল না। বরং ভালোই লাগল।
মামা সবার অগোচরে আমাকে হাত ধরে একেবারে ঘরের পিছনের মোটা তালগাছ টা ঘুরিয়ে নিয়ে চললেন। এরপর কারো নজরে না পড়ার জন্য গায়ের বিখ্যাত শাল টা পেছিয়ে দিলেন যেটা সব সময় তিনি পরে থাকেন। এরপর গোয়াল ঘরের পাশের গলিতে যাওয়ার সময় আমাকে পাজকোলা করে কোলে তুলে নিলেন। আমি হক চকিয়ে বলে উঠলাম
“ও ছোট মামা! কি করছো?”
মামা কোলে নিয়ে হাটতে হাটতে জবাব দিলেন
“নতুন বউ কে কিভাবে যে গোবর গাদায় হাটতে দিই বলতো?”
বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। আমি ভেবে দেখলাম। তাই তো!
কিন্তু তিনি নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়?
মামা আমাকে কোল থেকে নামালেন একবারে কামলা দের জন্য তৈরি আলাদা ঘরের সামনে। এদিক টায় মানুষ জনের আনা গোনা একেবারেই নাই। কামলারা আসবে যখন ধান পাকবে তখন।
কোল থেকে নামতেই মামা বলল
“ভিতরে যা।”
আমি খানিকটা ইতস্থত করে ভিতরে ঢুকলাম। ঢুকতেই আমার চোখ ছানাবড়া। দেখলাম আম্মা বিশাল একটা ট্রলি ব্যাগের মধ্যে আমার প্রয়োজনীয় সব জিনিস ঢুকাচ্ছে। দেখে আমি বোকার মত দাড়িয়ে রইলাম।
আমার দিকে চোখ পড়তেই ধমকে বলে উঠলেন
“এত হা করে তাকিয়ে দেখছিস কি? জলদি হাত লাগা। দেরী হয়ে যাচ্ছে। সাড়ে সাত টা বাজে।”
ধমক খেয়ে আমার হুশ ফিরে এলো। তাড়াতাড়ি মায়ের সাথে ব্যাগ গুছাতে লাগলাম। এরই মধ্যে ছোট মামা দ্রুত প্রবেশ করে বলতে লাগল
“আপা দ্রুত কর। সবাই বাদঁরী কে খুজছে। তাই বাইরে গাড়ি দাড় করিয়ে এসেছি।”
“দাড়া ভাই আরেকটু। ওর কাপড় টা পাল্টে নিক।”
“না না আপা! কাপড় পাল্টানোর সময় নেই”
এই বলে ছোট মামা এক হাতে ট্রলি ব্যাগ অপর হাতে আমাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু আবারো আম্মার ডাকে থমকে দাড়ালাম। ছোট মামা বিরক্তি স্বরে বলল
“আবার কি হল আপা?”
“একটু দাড়া। আমার মেয়ে টাকে একটু আদর করে নিই না। এরপর তো দেখা হবে না আর।”
এই বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি এখনো জড় পুতুলের মত দাড়িয়ে আছি। যা কিছু এখন ঘটছে তা আমাকে মূর্তি বানিয়ে দিয়েছে। যেন মনে হচ্ছে সবকিছু স্বপ্নের ঘোরে হচ্ছে।
আম্মা আমার কপাল নাক গাল চুমুতে ভরিয়ে দিল। এসব দেখে মামা আবারো বলে উঠল
“উফফ্ আপা! এবার তো ছাড়ো!”
আম্মা মামার কথার ভ্রুক্ষেপ না করে আমাকে বলল
“শোন তাহমিনা, ভালো করে পড়বি আর ঘুরে বেড়াবি। তবে খারাপ বন্ধু দের সাথে থাকবি না। কোনো পার্টিতে যাবি না। আর আমার ফোনে কল করবি না। দরকার হলে তোর ছোট মামা কে করিস”
আমি হাবাগোবার মত মাথা নাড়ালাম। আম্মা এবার হাত ছেড়ে দিল। সাথে সাথেই মামা আমাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু আমার কিছুতেই যেতে ইচ্ছা করছে না। যেন কোনো চৌম্বুকীয় আকর্ষন আমাকে টানছে।
যেতে যেতে পিছন ফিরে তাকালাম। টলমল করা চোখে আম্মা মুখে জোর করে হাসি টেনে ধরেছে। এ প্রথম আমার বুকে একটা সুক্ষ ব্যাথা অনুভব করলাম। পিছন ফিরে বলতে যাব যে আম্মা আমি কোথাও যাবো না ঠিক সে সময় মামা কারে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। কথা বলার সুযোগ পেলাম না। মামা বসে পড়ল ড্রাইভারের পাশের সিটে।
মুহুর্তের মধ্যে গাড়ি চলা শুরু করল। আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম। ঘোর কাটতেই বাস্তবতা নজরে এলো।
আমি এখন গাড়িতে। নিজের গায়ে হলুদের রাতই পালিয়ে যাচ্ছি। বাড়িতে এখনো হয়ত কেউ বুঝতে পারেনি। কিন্তু ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমার খোজ পড়ে যাবে। আর ততক্ষণে আমি এয়ার পোর্টে পৌছুবো। রাত ১১ টাই ফ্লাইট। সুতরাং হাতে অনেক সময়।
হাতের মেহেদি গুলো শুকিয়ে কড় কড়ে হয়ে গেছে। ওগুলো একটু তুলতে তুলতে আম্মার কথা ভাবছিলাম। আমার ভয় হচ্ছে আম্মা কে নিয়ে। আব্বা যদি কোনো ভাবে জানতে পারে আমার পালানোতে আম্মার হাত ছিল তাহলে আম্মার আর রক্ষে নেই। আমি পালিয়ে গেছি শুনতেই আব্বা কি করবে ভাবতেই গায়ে কাটা দিচ্ছে।
কিন্তু আমিতো কোথাও পালাচ্ছি না। পড়াশুনা করতে যাচ্ছি। আবার ফিরে আসবো। প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসবো। আর তখন আব্বু নিশ্চয় আমার উপর রাগ করে থাকবেনা। গর্ব করবে আমাকে নিয়ে। সবাইকে দেখিয়ে বলবে এই দেখ এটা আমার মেয়ে।
মনে প্রশান্তি এলো। বাইরে তাকালাম। গোল থালার মত একটা চাঁদ আমার সাথে ছুটে চলছে। আচ্ছা চাঁদ টা কানাডা যাবে আমার সাথে? গেলে ভালো হবে। কারন একা যেতে ভয় করছে। অন্তত চাঁদ টা থাকলে ভয় করবেনা।
দেখতে দেখতে এয়ার পোর্ট পৌছলাম। এত ভীড় নেই চারদিকে। কোলাহল ও নেই। হয়ত আজকে আর তেমন ফ্লাইট নেই। ইমিগ্রেশনের সমস্ত প্রক্রিয়া শেষে বসে রইলাম।
১১ টা বাজতে আরো ৩০ মিনিট আছে। তাই মামা আমাকে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে দিয়ে কোথায় গেলেন। তারপর ১০ মিনিট পর একটা স্প্রাইট আর একটা বার্গার এনে দিল। বার্গার দেখেই পেটের ভিতর ক্ষুধা টা চাড়া দিয়ে উঠল। সেই সন্ধায় একটু করে নাস্তা করেছিলাম। মামা বলল
“খেয়ে নে তাড়াতাড়ি”
মাথা নেড়ে আমি খেতে যাব কিন্তু নিজেকে কিছুটা অবাঞ্ছিত মনে হল। নার্ভাস মনে হল নিজেকে। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম কয়েকজন উৎসুক জনতা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। দেখে খানিকটা ইতস্থত করতে লাগলাম। মামা আবারো তাড়া দিলেন। মামার দিকে তাকিয়ে একটু গড়িমসি করে কামড় দিতেই ফ্লাইটের ঘোষনা এল। ঘোষনা টা কানে আসতেই হুরমুড় করে বার্গার টা খেতে লাগলাম। তারপর কোনো মতে গিলে শাড়ি ধরে দৌড়াতে লাগলাম। মামাও ট্রলি ব্যাগ নিয়ে দৌড়াতে লাগল।
সামনে কাচের গেইট। দুইটা গার্ড দাড় করানো। এরপর থেকে মামা আর যেতে পারবেনা। আমাকে একা যেতে হবে। থমকে দাড়িয়ে মামার দিকে তাকালাম। আমার সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে মামা হয়ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ক্লান্তির লেশ টুকু দেখা যাচ্ছে না চেহারায়। কপালের ঘাম টুকু পাঞ্জাবীর হাতায় মুছে আমার দিকে ট্রলি ব্যাগ টা এগিয়ে দিল। তারপর হাসি মুখেই বলল
“যা বাদরী… ওহ! না তাহমিনা! ভালো করে পড়িস। কিছু লাগলে ফোন করিস”
“হুম”
আমি মাথা নাড়লাম। মুখের হাসিটার আড়ালে আমি কান্নারত দুটো চোখ দেখলাম। কিন্তু মামা খেকিয়ে উঠল
“যা না। দেরী হয়ে যাচ্ছে”
ধমক খেয়ে কিছুদুর গিয়েই আবার ফিরে আসলাম। উৎকন্ঠিত হয়ে মামা জিজ্ঞেস করল
“কি হল”
কিছু না বলে উবু হয়ে আমি মামাকে সালাম করলাম। মামা কে আমি কখনো সালাম করিনি। আজ খুব ইচ্ছা হল সালাম করার।
আমাকে সালাম করতে দেখে মামা চমকে উঠল।
“আরে আরে কি করছিস?”
“কিছু না মামা। নিজেকে ধন্য করছি।”
মামা এবার হেসে দিলেন।
“কি বলিস এগুলো? যা তাড়াতাড়ি… দেরী হয়ে যাচ্ছে তোর।”
“যাচ্ছি মামা। নিজের খেয়াল রাখিও”
“রাখবো বাদরী”
হেসে দিলাম আমি। আর এই হাসির পিছনে আমি চাপা কষ্ট অনুভব করলাম।
আমার হৃদয়ের দুনিয়াটা ছেড়ে যাচ্ছিলাম। অজানা কোন আকর্ষনে, অদৃশ্য কোন মোহের টানে, সদূরে, নিরবে।
.
(চলবে)
.
পরশু প্রাইমারীর নিয়োগ পরীক্ষা দিচ্ছি। আর কেউ কি দিচ্ছে? পরবর্তী পার্ট শনিবারে দিব।