আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -৩০

0
1872

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৩০
———————————————–
ক্লামেটো জুসের গ্লাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে লিওর দিকে তাকালাম। সে স্যুপের পেয়ালায় চামচ টা নাড়াচাড়া করছে। টেবিলে হরেক রকমের সী ফুড। সব লিওর পছন্দের। শরীর টা এখানে পড়ে থাকলেও দেখে বোঝা যাচ্ছে তার মনটা এখানে নেই। দেবে যাওয়া চোখ দুটো তার বিনিদ্র রজনীর সাক্ষী দিচ্ছে। আমি ডাকলাম
“লিও?”
লিও জবাব দিল না। হয়ত শুনতে পাই নি। আমি আবার ডাকলাম
“লিও!”
সে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো
“হাহ!”
“কি হয়েছে?”
“কোথায় কি হয়েছে?”
“এই যে আধা ঘন্টা ধরে বসে আছি অথচ তুমি সামান্য এক পেয়ালা স্যুপ শেষ করতে পারো নি!”
লিও একটা শুষ্ক হাসি দিল। তারপর বলল
“ওহ্! এইতো খাচ্ছি!”
এই বলে লিও স্যুপ পান করতে লাগলো। আমি অধৈর্য্য হয়ে গিয়েছিলাম। কিছু একটা তো হয়েছে। যার জন্য লিওর এমন অবস্থা। সেটা কি শুধুই টিনার সাথে বিয়ের কারনে নাকি অন্য কিছু?
“লিও তুমি কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছো?”
লিও আমার সাথে নজর মিলালো না। নিচের দিকে তাকিয়ে স্যুপ নাড়াচাড়া করতে করতেই বলল
“হুম! কই নাহ্। কি লুকাবো?”
“মন খারাপ করো না। আগামীবার আবারো তুমি টপ হবে।”
লিও নিঃশব্দে হাসলো।
“হাসছো যে?”
“কিছু নাহ্। তোমার রেজাল্ট কেমন হয়েছে?”
“অবশ্যই ভালো। দেখতে হবে না আমি কার স্টুডেন্ট!”
“হা হা হা!”
লিও এবার প্রাণ খোলা হাসি দিলো। হাসতে হাসতে বলল
“রাইট। দেখতে তো হবে তুমি কার স্টুডেন্ট!”
.
মার্থা হাউজে পৌছতে পৌছতে লেইট হয়ে গেল। ঘন্টা হিসেবে আমি এক ঘন্টার জন্য বারো ডলার পাই। এটা যথেষ্ট কম। তারপরও মিস মার্থা এখান থেকে ও বেতন কেটে ফেলার হুমকি দিলেন। আমি কিছু বলি নি। এপ্রোন টা নিয়ে সোজা ওয়াশ রুমে চলে এলাম। লিওর সাথে লাঞ্চ করে আসতে আসতে একটু দেরী হয়েই গেল।
.
বাইরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। টেবিল মুছতে মুছতে বার বার আনমনা হয়ে পড়ছিলাম। টিভি তে স্থানীয় সংবাদে কানাডার বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পরিস্থিতি দেখাচ্ছিলো। অতিরিক্ত বর্ষা হলেই এখানে বন্যা দেখা দেয়। তবে এই জায়গায় একটু ব্যাতিক্রম। ঝড় হলেও বন্যা এখনো দেখা দেয় নি।
ঠাস করে একটা শব্দ হলো। আমি চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখলাম একটা জুসের গ্লাস নিচে পরে টুকরো টুকরো হয়ে আছে। আর সমস্ত জুস এক সাদা চুলের মধ্যবয়স্ক লোকের শার্ট ছুয়ে ছুয়ে পড়ছে। এটা অন্যমনষ্ক হয়ে কাজ করার ফল। লোকটি আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম
“স্যরি স্যার। আ-আমি এ-এক্ষুনি এটা পরিষ্কার করে দিচ্ছি।”
এ বলে তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করার জন্য ন্যাকড়া আর ছোট বালতি আনতে গেলাম। বালতি এনে দেখি লোকটি নেই। চলে গিয়েছে। বুক ধর ফর করতে লাগলো। আমার কারনে এক কাষ্টমার বেড়িয়ে গেল। এটা শুনলে মিস মার্থা যে কি করবে?
সব পরিষ্কার করে ফেলে আসার সময় দেখলাম মিস মার্থা অগ্নি মুর্তিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ঢোক গিললাম।
“মি-মিস মা-মা-মা…!”
কথা কেটে গেলো মিস মার্থার আওয়াজের চোটে। এ মহিলা এত জোরে চিল্লাতে পারে যে প্যারেড গ্রাউন্ডের সৈন্যরা হার মানবে ইনার কাছে। কান বন্ধ করে ধৈর্য্য ধরে সমস্ত দোষ মাথায় নিলাম। কথা হল গ্লাসের ক্ষতি পুরন আমার বেতন থেকে কেটে নেয়া হবে। হতাশ হয়ে গেলাম। কি আর করা।
মার্থা হাউজ থেকে বৃষ্টি মাথায় করে আসতে হল। এখনো একটা ছাতা কিনি নি। সামনে ওভার টাইমে কিছু ডলার জমিয়ে ছাতার কেনার প্ল্যান করলাম। কিন্তু সেই চিন্তা ফ্লপ হল। কারন যতদিনে একটা ছাতা কেনার জন্য ডলার জমাবো ততদিনে বৃষ্টি থাকবেও না।
হোস্টেলে ফিরে গোসল করেই বিছানায় মাথা এলিয়ে দিলাম। এখন তেমন আর ক্লাস নেই। তাই সকালে দৌড়াদৌড়ি ও হবে না। কেউ ফিল্ড ট্রিপে যাবে, কেউ রিসার্চ করবে, কেউ ফ্যাকাল্টি অনুযায়ী ঘুরবে এসাইনমেন্টের জন্য। এ ফ্রি সময় টুকুতে ওভার টাইম কাজ করা যাবে। আমি চিন্তা করলাম এটা। সবাই অবশ্য একটা ফিল্ড ট্রিপের কথা বলেছিল। কিন্তু আমি গা করিনি।
ঘুম চলে এল। সারাদিন পরিশ্রম করে বিছানায় মাথা রাখতে নিদ্রার সম্রাট আমাকে জড়িয়ে ধরে। তাকে সরিয়ে দিতে পারি না। এমন শক্তি নেইও। তাই গভীর আলিঙ্গনে সেই সম্রাট কে স্বাগত জানিয়ে চলে আসি নিদ্রার রাজ্যে।
রাত বেশ গভীরই হবে। গালে কারো স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল। উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে মুখের উপর। চোখ খুলতেই কেউ ঠোটের উপর আঙ্গুল রাখল। তারপর ফিস ফিস করে বলল
“শসসসহ মিইইরা! ইটস মি!”
নিঃশ্বাসের সাথে ভেসে আসছে মিনটের পরিচিত গন্ধ। ডিম লাইটের আবছা আলোয় লিও কে দেখলাম। সে ঝুকে আছে মুখের উপর। তার চোখ দুটো সত্যিকারের ভুতের চোখের মত ভয়ঙ্কর লাগছে। আমি ঢোক গিললাম।
“লি-লিও?”
লিও মুখের উপর থেকে আলতো করে এলোমেলো হয়ে থাকা চুল সরিয়ে দিল। তারপর বলল
“উঠে আসো!”
“কি-কিন্তু…”
“কিচ্ছু হবে না। বিশ্বাস কর আমার উপর। শুধু কিছু কথা বলবো।”
অগত্য উঠতে হল। কারন গত বার মানা করায় হাত মুখ বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল। আমি চাই না এবারো এমন টি হোক। তার উপর আমার অগাধ বিশ্বাস। আমি অস্বস্থি বোধ করব এমন কাজ সে কখনো করে না।
.
লিও আস্তে করে সরে দাড়ালো। আমি চুল গুলো বেঁধে নিলাম। তারপর বাদামী স্কার্ফ টা গলার সাথে পেচিয়ে নিলাম। ধীরে ধীরে ওর সাথে রুমের বাইরে বেড়িয়ে আসলাম। বেড়িয়ে আসতেই জিজ্ঞাসু চোখে বললাম
“লিও আ-আমরা…?”
আমার কথা কেটে দিয়ে লিও নিঃশব্দে হাসলো। তারপর বলল
“এক জায়গায় যাবো। তুমি সহ। প্লিজ মানা করো না। খুব জরুরি সেটা।”
আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। আমার মন বলছে যাও আবার অন্যদিকে মনে হচ্ছে এ শেষ রাতে লিওর সাথে যাওয়া কি ঠিক হবে?
শেষে মনের কথায় শুনলাম। কারন কয়েক বার একা পেয়েও যখন আমার ক্ষতি করে নি এবারো করবেনা। নিশ্চিত এখানে অন্য কোনো ব্যাপার আছে যেখানে সে আমার সাহায্য চাইছে।
.
বাইরে হোস্টেল ইয়ার্ডে আজও কোনো গার্ড দেখলাম না। আশ্চর্য্য!
শুধু দুজন অপরিচিত ব্যক্তি দাড়িয়ে আছে। লিও তাদের দিকে ইশারা করলো। বুঝলাম গার্ড গায়েব হওয়ার পিছনে লিওর যথেষ্ট হাত আছে। লিওর দিকে তাকালাম। ফ্ল্যাশ লাইটের আলোতে লিও কে ভালো করে দেখতে পেলাম না। শুধু মাত্র হুডি ওয়ালা জ্যাকেটে মাথায় হুডিটা তোলা। আমার হাত টা মুটোয় ধরা অপর হাতে প্যান্টের পকেটে ঢোকানো।
হোস্টেল গেইটের বাইরে কোনো গাড়ি দেখলাম না। আরো একটু হেটে যেতেই দেখলাম সাইকেল। লিওর সাইকেল।
সাইকেলের কাছাকাছি গিয়ে লিও আমাকে উঠতে বললো। আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। এর আগে কখনো এভাবে সাইকেল চড়ি নি। তাই একটু ভয় করছিল। লিও সেটা লক্ষ্য করে বলল
“ভয় নেই। আমি আছি তো।”
আমি নার্ভাস ভাবে হাসলাম। লিও উঠে বসে পড়লে আমি তার পিছনে বসলাম। দু হাতে ওর জ্যাকেট টা শক্ত করে ধরলাম। ভয় হচ্ছিলো তাই। লিও হেসে বলল
“মিইইরা! তুমি আমাকে জড়িয়ে ধর। তারপরও প্লিজ আমার জ্যাকেট টা ছিড়ো না! ওটা আমার প্রিয়!”
এহেন মুহুর্তে ও লিওর রসিকতা আমার সহ্য হলো না। দুম করে লিওর পিঠে কিল বসিয়ে দিলাম। লিও আর্তনাদ করে উঠলো।
“কি করছো মিইইরা। মেরে ফেলবে নাকি!”
জবাব না দিয়ে সিটে বসাতে ধ্যান দিলাম। লিও যেভাবে সাইকেল চালায় সেভাবে এখন চালালে আমি রাস্তায় পড়ে নির্ঘাত কিমা হয়ে যাবো। পা টা ঠিক করে রাখতে রাখতে বললাম
“লিও?”
“হুম!”
“আস্তে চালায়ও সাইকেল!”
“কেন ভয় পাও?”
“লিওওও!”
“হা হা হা!”
লিও হো হো করে হাসতে শুরু করলো।
.
অন্ধকার ভেদ করে শা শা শব্দে সাইকেল টা চলতে লাগলো। এখনো অন্ধকারের ঘন চাদর পাতলা হয় নি। ঝড় থেমে গিয়ে বাতাস বইছে বেশ জোরালো ভাবে। ভোর হতে এখনো বেশ সময় বাকি আছে। প্রথমে সাইকেলে উঠতে ভয় লাগলেও এখন তেমন ভয় লাগছে না। বরং ভালোই লাগছে। বৃষ্টির কারনে রাস্তা টা ভীষন পিচ্ছিল। দক্ষ চালক ছাড়া কেউ এখানে সাইকেল চালাতে পারবেও না। আর লিও বেশ ভালো সাইকেল চালাতে জানে। এ কথা টা আগে জানলেও এখন তার অতি দক্ষতার সাথে সাইকেল চালানো দেখে ভরসা হল।
হু হু করে হাড় কাপানো ঠান্ডায় শরীর ক্ষনে ক্ষনে শিউরে উঠছে। এই অন্ধকার শেষ রাতে এমন কি কথা রয়েছে যা বলতে হবে? দিনেও বলতে পারতো! রাতে এভাবে পাইপ বেয়ে চুরি করে এসে বলার এতই কি প্রয়োজন? কি এমন মহা পাপ হবে দিনে বললে? উত্তর পেলাম না।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here