আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -৩৩

0
1896

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৩৩
———————————————–
মার্থা হাউজ থেকে বেড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশের অবস্থা বেশি ভালো না। তারা একটাও দেখা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি হোস্টেলে ফিরতে হবে। চারদিকে ঝলমলে তারার বাতি গুলো ঝুলছে। প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে। মার্থা হাউজে সামান্য নাস্তা করেছিলাম। কিন্তু সেটা এতক্ষনে পেটে নেই।
বাতাস বইছে। হালকা হালকা বৃষ্টির ফোটা সুচের মত শরীরে বিঁধছে। বৃষ্টি শুরু হতে বেশি দেরী নেই। দ্রুত পা চালালাম। বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাধাবার মত ইচ্ছে আমার নেই।
হোস্টেলের কাছাকাছি আসতেই কিছুটা হট্টগোলের আওয়াজ পেলাম। কি হয়েছে? এত আওয়াজ কেন?
এমনিতেও হোস্টেল সিকিউরিটি বাড়ানো হয়েছিল। সব কিছুতেই কড়াকড়ি নিয়ম করেছে। তাই পান থেকে চুন খসলেই হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। সেদিনও কোনো এক ছাত্রীর সাথে তার এক আত্মীয় দেখা করতে আসলে উনাকে বাইরে এক ঘন্টা দাড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। এখনও নিশ্চয় তেমন কিছু হবে। কিন্তু এত রাতে? আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম। গার্ড দের সাথে আরো এক জনকে দেখা যাচ্ছে। চার/পাঁচ জন গার্ড মিলে কাউকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।
আরেকটু সামনে গিয়েই আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কারন গার্ড রা যাকে জোর করে ধরে রেখেছে সে আর কেউ না। লিও!
সে এখানে কি করছে? সে কি আমার সাথে দেখা করতে এসেছে? কিন্তু এভাবে দেখা করার মানে টা কি? সে চাইলে স্বাভাবিক বা যে কোনো ভাবে হোস্টেলে ঢুকতে পারে। কিন্তু এভাবে কেন…?
লিও প্রাণপনে হোস্টেলে ঢোকার চেষ্টা করছে। কিন্তু গার্ড রা দিচ্ছে না। আর গার্ড রা দিচ্ছে না বিধায় সে চিল্লাচিল্লি শুরু করেছে। তার চিল্লাচিল্লি শুনে আমার কিছুটা অসংলগ্ন লাগলো। কারন লিও এক জায়গায় স্থির হয়ে দাড়াচ্ছিলো না। আর সে চিল্লাচিল্লি করার মত ছেলে ছিলো না। কিন্তু ওকে টাল মাটাল অবস্থায় মনে হচ্ছে।
লিও মুখে যা আসছিলো তাই বলে চিল্লাচিল্লি করতে লাগলো। এরই মধ্যে গার্ড একজন ফোন নিয়ে কল দিতে লাগলো। আমি পাক্কা শিউর পুলিশ কে ফোন দিচ্ছে। তাই তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলাম। গিয়েই গার্ডের হাত থেকে ফোন টা কেড়ে নিলাম। নিয়েই একটু করে হেসে বললাম
“ও আমার ফ্রেন্ড! আমি দেখছি ওকে। প্লিজ পুলিশ দরকার নেই!”
গার্ড মাছি তাড়াবার মত ভঙ্গি করে বলল
“হ্যাঁ নিয়ে যাও আপদ টাকে। গত এক ঘন্টা ধরে মাথা খাচ্ছে মাতাল টা!”
“আমি দুঃখিত তার জন্যে।”
লিও আমাকে পিছন থেকে ডাক দিল
“মিইইরা!”
এমন ভাবে ডাক দিল যেন বেশ কৌতুক করছে। তারপর হেসে দিল পাগলের মত। আমি কি করবো ভেবে কুল পাচ্ছিলাম না। বললাম
“তুমি এখানে কি করছো লিও?”
“আমি… এখানে… শসসসসহ!”
লিওর মুখ থেকে উৎকট একটা গন্ধ পেলাম। আমি স্কার্ফ দিয়ে নাক মুখ চেপে ধরলাম। ইয়া খোদা! ছেলেটা একেবারে মাতাল হয়ে এসেছে।
আমি লিও কে টেনে নিয়ে আসলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম
“কেন এসেছো এখানে?”
লিও কতক্ষণ মাথা কে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে আমার কানের কাছে এসে বলল
“আ-আমি টোমাকে ভা-ভালুবাসি!”
পুরো টা বাংলায় বলল। শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আর সে পাগলের মত হো হো করে হাসতে লাগল।
“লি-লিও বা-বাসায় চল। কার কোথায় তোমার!”
“উহু! আ-আমি যাবো না!”
“কেন যাবে না?”
“আ-আমি টোমাকে ভালুবাসি!”
বলেই আবার খিক খিক হাসি। আমি হাল ছেড়ে দিলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে ওর কার টা খুজতে লাগলাম। কারটা পেয়েও গেলাম। তবে দূর্ভাগ্য বশত গাড়িটা একটা গাছের সাথে ঠুকে আছে। একটা হেডলাইট ভেঙে গিয়েছে। আর ডেকীর উপর কিছুটা এবড়ো থেবড়ো হয়ে গিয়েছে। রাতের অন্ধকার না হলে এই এ্যাকসিডেন্ট এর জন্য পাক্কা জরিমানা খেত।
গাড়ির ভেতরে উঁকি দিলাম। ভিতরে মদের বিশ্রী উৎকট গন্ধ। ছিইই! কেমনে এইসব গিলতে পারে এরা?
আমি আবার লিও কে টেনে এনে বললাম
“লিও গাড়িতে উঠো। আর সোজা বাড়িতে যাও!”
আমি গাড়ির দরজা খুলে ধরলাম। কিন্তু ওর মধ্যে গাড়িতে উঠার কোনো লক্ষনই দেখলাম না। কি সব আবোল তাবোল বকছে সে?
এবার চিৎকার করে ডাকলাম
“লিও!”
ডাক শুনে এবার সে আমার দিকে তাকালো। তারপর হাসতে হাসতে বলল
“মিইইরা!”
“গাড়িতে উঠো লিও। তুমি অনেক ড্রিংক করেছো! তোমার এখন কোন হুশ নেই। বাড়িতে যাও।”
লিওর মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখলাম না। বরং সে আমার কথায় বিদ্রুপ করেই যেন হাসলো। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল
“আমার কোন হুশ নেই মিইইরা? তুমি বলছো! তুমিই নিয়েছো সব! তুমি নিয়েছো!”
এ বলে কান্নার মত মুখ করে নিজের বুক চাপড়াতে লাগল। আমি হাত ধরে ফেললাম
“কি করছো এসব?”
লিও আর্তনাদের মত আমাকে ডাকলো
“Mira! My princes!”
মাই প্রিন্সেস শুনে আমার বুক টা ধক করে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে শক্ত করেছিলাম। কিন্তু লিওর সামনে আবারো দূর্বল হয়ে যাচ্ছি।
লিও আমার দু বাহু ধরলো। তারপর আবার ডাকলো
“My princes!”
“কি করছো লিও! ছাড়ো!”
কিন্তু লিও ভ্রুক্ষেপ করলো না। সে আরো এগিয়ে এসে বলল
“I want to kiss you mira! I want to just kiss you!”
আমি পাথর হয়ে গেলাম। লিওর মুখ থেকে উৎকট গন্ধ ভেসে আসছিলো। তাকে ধাক্কা দিতে লাগলাম।
“ছাড়ো লিও আমাকে। ছাড়ো বলছি।”
কিন্তু লিও ছাড়লো না।
আমার দিশেহারার মত অবস্থা। চোখ ঠেলে কান্না চলে আসছে। লিওর বুকে থাপ্পর দিতে দিতে বললাম
“I hate you Leo, I hate you!”
লিও থমকে দাড়ালো। পলক না ফেলে শক্ত পাথুরে দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকালো। তারপর ঠিক দুইবার চোখের পাতা ফেলে বলল
“Y-You hate me mira?”
আমি চুপ করে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখলাম। সে আরো শক্ত করে ধরে চিৎকার করে বলল
“Tell me!”
আমি কিছু বললাম না। শুধু চোখ ফেটে পানি বেড়িয়ে আসতে চাইছে। কোনো রকম নিঃশ্বাস চেপে রাখলাম।
হঠাৎ লিও হাত ছেড়ে দিয়ে ঝট করে দু হাতে আমার মুখ চেপে ধরলো। আমি ভয়ানক ভাবে চমকে গেলাম। লিও যে আমার সাথে কি করতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে প্রাণ পনে ধাক্কা দিতে লাগলাম। কিন্তু তার শক্তির সাথে কুলাতে পারছিলাম না।
এতক্ষন একজন/দুজন পথচারী আমাদের ভ্রুক্ষেপ না করলেও আমি সাহায্যের আবেদন করতেই দুজন এগিয়ে আসলো। তাদের সহায়তায় আমি লিও কে ধাক্কা মারলাম। ধাক্কা খেয়ে লিও রোডে পড়ে গেল। আমি হাঁপাতে লাগলাম। সাহায্য করার জন্য পথচারী দুজন কে ধন্যবাদ জানালাম। তারা আমাকে পুলিশে ইনফর্ম করার কথা বলল। কিন্তু আমি ওকে সামলাতে পারবো বলে তাদের বিদায় জানালাম।
লিও এখনো রোডে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। কিছু একটা বক বক করে যাচ্ছে। ভয়ে দ্বিতীয় বার তাকে ডাকলাম না। একটা ক্যাব ডেকে লিও কে ডাকতে লাগলাম।
মাথায় আঘাত পেয়েছে। সেখানে খানিকটা ছিলে রক্ত বেরুচ্ছে। হাতেও একটু ছিলে গেছে। সেখানে নিশ্চয় অনেক জ্বলছে। আমি ওর গালে হাত দিয়ে ডাকলাম
“লিও?”
লিও জবাব দিল না। কেমন গা ছাড়া ভাব। অগত্য ক্যাব ড্রাইভার কে ডেকে লিও কে টেনে তুললাম। তারপর ক্যাবে উঠে বসলাম।
ঠিকানা দিতেই ক্যাব চলতে শুরু করল। লিও এবার চুপচাপ। কোনো কথা বলছে না। শুধু পিট পিট করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে। আমার খুব কষ্ট লাগল। লিওর এমন অবস্থা দেখবো কখনো আশা করি নি। বাস্তবে আমি মনে করেছিলাম পশ্চিমারা প্রেম বা ছাড়াছাড়ির ক্ষেত্রে নিজেকে সামলাতে পারে। কিন্তু লিও কে মনে হচ্ছে তার উল্টো। মনেই হচ্ছে না সে আগে কখনো কোনো রিলেশনে ছিলো।
লিও ঢুলে আমার কাঁধের উপর পড়লো। আমি একটু চমকে উঠলাম। লিও পড়ে যেতে লাগলে তাড়াতাড়ি সামলে নিলাম। বেশ কিছুক্ষন পর মনে হল লিও কিছু একটা বলছে। ভালো করে কান পাতলাম। সে গুন গুন করে ভাঙা গলায় কিছু একটা গাইছে। পুরোটা বুঝলাম না। যে টুকু বুঝলাম তা হল
“I Cry… When angels deserve to die!”
কোন একটা গান হবে। বেশ অন্তর্বেদি গান।
আমি লিওর হাত শক্ত করে মুটোয় চেপে ধরলাম। নিজের বুক টায় ফেটে যাচ্ছে। দোটানায় পড়েছি আমি। কি করবো বুঝতেই পারছি না।
.
গেইটের ভিতর প্রবেশ করতেই গার্ডরা দৌড়ে এলো। লিও কে বের করতেই শাকিরা কোথ থেকে এসে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো।
বাইরে সবাই বেড়িয়ে আসলেন। মি. উইলিয়াম, মিসেস উইলিয়াম সে সাথে আরো কয়েক জন অপরিচিত মুখ। আমি লিও কে ছেড়ে দাড়ালাম। লিওর মা হাউ মাউ করতে লাগলেন। আমি তাকে বললাম সে ঠিক আছে। শুধু মাত্রারিক্ত ড্রিংক করায় এ অবস্থা হয়েছে। মি. উইলিয়াম আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। কাঁচা পাকা চুলে মিশেল এক মাথা চুল। সৌষ্টব গড়ন। দেখেই বুঝলাম লিও তার পিতার গড়ন পেয়েছে। শুধু মাত্র ঘোলাটে চোখ টাই তার মায়ের পেয়েছে।
.
মি. উইলিয়াম আমাকে কিছুক্ষন জেরা করলেন। আমি ভয়ে ভয়ে জবাব সব জবাব দিলাম।
লিও কে রুমে নিয়ে যাওয়া হল। সে মুহুর্তে আমার চলে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি বেহায়ার মত পিছু পিছু গেলাম। সবাই বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালেও কিছু বললো না।
ফোমের মত নরম শ্বেত শুভ্র বিশাল কিং সাইজ বেডে লিও শুয়ে আছে। একদম শিশুর মত দু হাত বুকের কাছে নিয়ে জড়ো করেছে। মুখে কিছু একটা জপছে। আমি শিউর সে এখনো গানটাই জপছে।
সবাই চলে আসলে আমি লিওর দিকে এগিয়ে গেলাম। এ কয়েক দিনে সে ভীষন শুকিয়ে গেছে। চোয়ালের হার দুটো বেড়িয়ে এসেছে। চোখ দুটো কোটরাগত হয়ে এসেছে। চোখের নিচে একরাশ কালি জমেছে।
আমি আস্তে করে তার অগোছালো চুলে হাত বুলিয়ে ঠিক করে দিলাম। তারপর চলে আসার জন্য পিছু ফিরতেই লিও হাত ধরে ফেলল। আমি ওর দিকে তাকালাম। একটু একটু করে সে চোখ খুলেছে। বুকটা হালকা হালকা নিঃশ্বাসে উঠা নামা করছে। আমি তাকে ডাকলাম
“লিও? কিছু বলবে?”
সে আমার দিকে তাকালো। তারপর বলল
“তুমি কি আমাকে ঘৃণা কর মিইইরা?”
“না লিও! আমি তোমাকে ঘৃণা করি না!”
সে একটু করে হাসলো। তারপর ফিস ফিস করে বলল
“Don’t leave me mira! Don’t leave me!”
আমার চোখ ছল ছল করে উঠলো। কোন রকম সামলে সায় জানালাম। আমি যাবো না তোমাকে ছেড়ে। কোথাও যাবো না।
.
(চলবে)
.
“যদি তুমি হাতটা ধরো, আমি হবো না আর কারো”
গান টা কার কার প্রিয়?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here