আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -৩৪

0
1888

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৩৪
———————————————–
রাতে দেরি করে ঘুমালেও ভোরে জলদি ঘুম ভেঙে গেল। শরতের খোলা আকাশের ন্যায় ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে কান হেডফোন লাগিয়ে বেশ খানিক টা সময় এক্সেরসাইজ করলাম। তারপর সকালের নাস্তা করে অনেক ক্ষন ধরে আয়নার সামনে দাড়িয়ে ট্রাই করছিলাম কোন পোশাক টা পড়ে যাবো? লাল টা পড়বো নাকি সবুজটা? হলুদ টা কি বেশি ফর্মাল হয়ে যাবে? কালো টা পড়লে কি বেশি গর্জিয়াস হয়ে যাবে?
ইভিলিন হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকাতে শুকাতে রুমের এ মাথা ও মাথা ঘুরছিল। ইলির হয়ত আজ তেমন তাড়া নেই। তাই সে এক কোনে কোন একটা বুক পড়ছে। স্কাই আর রেইন বেশ কয়েক দিন ধরে নেই। ক্লাস না থাকার কারনে তারা বাড়িতে গিয়েছে। এ জন্য রুম অনেক টাই শান্তি তে। মিসেস মারিয়া বেশ কিছুক্ষন আগে রুম সম্বন্ধীয় কিছু লেকচার দিয়ে গেলেন। সেটা উনার নিত্যদিনের কাজ।
আমি লাল রঙের ডোরা কাটা ফতুয়া সামনে ধরে আয়নায় দেখছি। বেশ কয়েক বার এটা পড়ে ক্যাম্পাসে গিয়েছি। তেমন সমস্যা হয় নি। কিন্তু আজ হঠাৎ করে কেন যেন এটাকে ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে এটা বেশিই লাল। ইভিলিন হয়ত এটা খেয়াল করলো। তাই সে আমাক হুট করেই ডাক দিল
“টামিনাহ?”
আমি গভীর মনোযোগে ধূসর ফতুয়া টা নিজের সাথে ধরে চেক করছিলাম। তাই হঠাৎ নিজের নাম শুনে একটু চমকে গেলাম।
“হাহ!”
“কি করছো?”
“কই? কিছু না!”
“প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরেই এত গুলো পোশাক ট্রাই করে যাচ্ছো। কিন্তু একটা পোশাকও পছন্দ করতে পারো নি। ব্যাপার খানা কি!”
“হাহ! ওহ্ নাহ্! তেমন কিছু না। আমি একটাও ভালো জামা পাচ্ছি না আজকে ভার্সিটিতে পড়ে যাওয়ার জন্য।”
“প্রতিদিন তো পাও। তাহলে আজ কি হলো?”
“কই কিছু না!”
“আচ্ছা বাদ দাও। কাল রাতে দেরি কেন হল সেটা বল!”
কাল রাতের কথা মনে হতেই একটু শিউরে উঠলাম। কি হাঙ্গামা না হয়ে গিয়েছিল কাল। উফফ্! কাউকে বলা যাবে না। বললে টিটকারি হজম করতে হবে।
“টামিনাহ!”
“হাহ!”
“বল!”
“কিছু না। ওভার টাইম কাজ করেছিলাম। তাছাড়া হুট করে কালকে কাস্টমার বেশি এসে গিয়েছিল। তাই মিস মার্থা আমাকে ছাড়েনি।”
“সত্যি বলছো তো?”
“একদম সত্যি! আচ্ছা এসব বাদ দাও। এখান থেকে আমাকে কোন টা ভালো মানাবে বল!”
.
হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালাম। ক্লাস শুরু হতে এখনো অনেক দেরী। আমি জলদিই বেরুলাম। আকাশ টা আজ অনেক ঝরঝরে। মনে হচ্ছে না আর বৃষ্টি হবে। ঝিরি ঝিরি বাতাস বইছে। আবহাওয়া ঠান্ডা হলেও আমার বেশ গরম লাগছে। কারন আমি লিও দের বাড়ির বিশাল তোরনের বাইরে দাড়িয়ে আছি। তোরনের পাশে লম্বা রেইন ট্রি গাছটিতে দুটো নাইটিঙ্গেল একসাথে গাইছে। বেগুনী রংয়ের বেল ফ্লাওয়ারস গুলো বেশ ভালো ভাবে নিজেদের সৌন্দর্য্য প্রকাশ করছে। কিন্তু এত সব আমার বুকের দুর দুর শব্দের কাছে হার মেনে যাচ্ছে। বহু চেষ্টা করেও নিজেকে শান্ত করতে পারলাম না।
তাই ভিতরে অনেক সাহস নিয়ে ঢুকে গেলাম।
বাইরে গার্ডরা সবাই আমাকে গুড মর্ণিং বললেও আমার মনে মনে কেমন যেন ভয় হচ্ছিল। এ সকালে আমাকে দেখে লিওর ফ্যামিলি না জানি কি রিএ্যাক্ট করে। অনেক টা সাহসের সাথে এখানে চলে এসেছি। বাকিটা উপরওয়ালার হাতে।
শাকিরা বারান্দায় আরাম করে তার ব্রেকফাস্ট ডগ ফুড খাচ্ছিলো। আমি গিয়েই মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। উত্তরে সে আমার হাত চেটে দিতে চাইলো। কিন্তু হাত সরিয়ে ফেললাম। কুকুর সমাজে জিহ্বা দিয়ে চেটে দেয়াটা ভদ্রতা ও ভালোবাসার প্রকাশ হলেও আমার কাছে এখনো বেশ ঘিন ঘিন করা অভ্যাস এটা। তারপরও ইদানিং বেশ সখ্যতা হয়েছে শাকিরার সাথে।
শাকিরার সাথে আলাপ চারিতা শেষে ভিতরে প্রবেশ করলাম। চারদিকে ঝলমলে উজ্জল আলো। তারপরও জমাট বাধা গুমোট অস্বস্তিকর পরিবেশ। আমি এগিয়ে গেলাম। ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করেই বেশ ঘাবড়ে গেলাম। কারন ড্রয়িংরুমে শুধু পরিচিত না কয়েকটা অপরিচিত মুখও রয়েছে। লিওর মম মিসেস উইলিয়াম, মি. উইলিয়াম সহ আরো সাত/আট জন। রিচার্ডও রয়েছে। সবাই বেশ করে নিজেদের মধ্যে গুরুত্ব পূর্ন আলোচনা করছিল। গাম্ভীর্য্য পূর্ন পরিবেশ। এদের মধ্যে দু-তিন জন কে লিওর বার্থ ডে তে দেখেছিলাম। এতক্ষন একটু নার্ভাস হলেও খারাপ লাগছিল না। কিন্তু একজনের উপর চোখ পড়তেই আমার কেমন যেন ভালো লাগলো না। আর কেউ না। সে হল লিওর ফিয়ঁসে টিনা। সোফার এক কোনে বসে কিছু একটা পান করছিল সে। তার উপর চোখ পড়তেই সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। কিন্তু কিছু বলল না। সবাই কথা বার্তা থামিয়ে দিল। আমি সবকিছু একটু সহজ করার জন্য একটু হেসে উইশ করলাম
“গুড মর্ণিং!”
কিন্তু বিনিময়ে কেউ আমাকে গুড মর্ণিং উইশ করল না। শুধু তড়িগড়ি করে মিসেস উইলিয়াম মানে লিওর মম উঠে এলেন। এরপর তিনি আমাকে এক পাশে টেনে নিয়ে এলেন।
তারপর চিন্তিত মুখে বললেন
“টামিনা তুমি এখানে? মানে এই সকালে কি মনে করে…”
আমি উনার দুশ্চিন্তা বুঝতে পারলাম। তাই বললাম
“ম্যাম আমি লিও কে নিয়ে যেতে এসেছিলাম। ভার্সিটিতে। সে অনেক দিন ধরেই যাচ্ছে না। ফ্যাকাল্টি থেকে বার বার খবর পাঠানো হচ্ছে।”
“ওহ্!”
মিসেস উইলিয়াম আমাকে আর তেমন কিছু বললেন না। মৌন সম্মতি দিলেন। শুধু বললেন
“লিও উপরে আছে।”
এরপর একজন মেইড কে ডেকে আমার সাথে দিলেন।
লিওর রুমে নক করলাম। কয়েকবার করার পরও সাড়া আসলো না।
মেইড জানালো লিও নাকি ঘুম থেকে এখনো উঠে নি। আমি কি ভেবে আবার নিচে চলে এলাম। কড়া করে লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে আসলাম। ঘুম থেকে উঠলে পাক্কা এটা দরকার হবে।
.
লিও এখনো ঘুমাচ্ছে সত্য। ডেকে দেওয়ার পরও সে শরীর মুচড়ে অপর দিকে কোল বালিশে পা তুলে দিয়ে ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করে ঘুমাতে লাগল। ঘোৎ ঘোৎ শব্দ শুনে রুমে থাকা মধ্য বয়স্ক মেইড মিসেস সামান্তা হেসে দিলেন। তারপর ন্যাকড়া টা রেখে এগিয়ে আসলেন। লিওর মাথার কাছে বসে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে লিও কে ডাকতে লাগলেন। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। যেভাবে উনি ডাকলেন আমার মনেই হলো না যে ইনি লিওর মম না। আমি নিশ্চিত শিউর লিওর মম কখনো এভাবে ঘুম থেকে তুলে নি। নিশ্চয় মিসেস সামান্তা লিওর জন্মের আগে থেকে এখানে আছেন। তাই লিও তার কাছে নিজের সন্তান তুল্য। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে সামান্তার ডাকে লিও আড়মোড় ভেঙে উঠে বসলো। সে উঠে বসতেই আমি লিও কে উইশ করলাম
“গুড মর্ণিং লিও!”
লিও কোনো ভাবে চোখ টেনে খুলে আমার দিকে তাকালো। একবার তাকিয়েই চোখ কচলালো। তারপর মুরগীর ডিমের ন্যায় চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো
“মিইইরা! তুমি! কখন এলে?”
আমি হেসে দিলাম। বললাম
“এই তো এখন!”
লিওর পড়নের গত রাতের পোশাকই। পাল্টানো হয় নি। তার অবস্থা দেখে আমি শরবত টা এগিয়ে দিয়ে বললাম
“নাও!”
“কি এটা!”
“খেয়েই দেখ!”
“কিন্তু আমার কফি?”
এবার আমার পিছনে সামান্তার দিকে তাকিয়ে বলল
“সামান্তা আমার কফি কই! আমার কফি চাই!”
সামান্তা ফ্লোর মুছতে মুছতে বলল
“এডি আগে এটা নাও। এ মুহুর্তে তোমার এটা প্রয়োজন!”
মিসেস সামান্তার কথায় লিও আমার হাত থেকে গ্লাস টা নিল। কিন্তু এক চুমুকে শেষ করতে পারলো না। ভ্রু কুচকানো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতে তাকাতে শরবত টা শেষ করলো।
শরবত শেষ হলে আমি লিও কে বললাম
“লিও উঠো। ক্যাম্পাসে যাবে তৈরি হও!”
লিও উঠলো না। সন্ধিগ্ন চোখে আমার দিকে তাকালো।
“লিও উঠ!”
“মিইইরা!”
“হুম!”
“আ-আমি কি কাল কিছু করেছি?”
আমি ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকালাম। সে জেনে বলছে নাকি না জানার ভান করছে বুঝলাম না। বললাম
“তুমিই জানো!”
“আ-আমার কিছুই মনে পড়ছে না!”
“রিয়্যালি?”
লিও চুপ হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত তার সব মনে আছে। আবার বললাম
“তুমি যাবে না? ঠিক আছে তাহলে আমি চলে যাচ্ছি!”
এ বলে পিছু ফিরতেই লিও তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আমার হাত ধরে ফেলল। তারপর একটু হেসে বলল
“এই তো তৈরি হচ্ছি। শুধু পাঁচ মিনিট অপেক্ষা কর।”
এ বলে নিচে নেমে এল। এরপর তড়িগড়ি করে সোজা ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। আমি ইতস্থত করে একটু ফিরতেই সে আবার ঝট দরজা খুলে বেড়িয়ে এল। হঠাৎ করে বেড়িয়ে আসায় আমি একটু চমকে উঠলাম। সে ভ্যাবলা মতন হাসি দিয়ে বলল
“জাস্ট ফাইব মিনিট মিইইরা! কোথাও যাবে না। ওকে?”
আমি জবাব না দিয়ে হা করে তাকিয়ে রইলাম। আমার কাছ থেকে জবাব না পেয়ে লিও সামান্তার দিকে কিছু একটা ইঙ্গিত করল। ইঙ্গিতে একটু হেসে সামান্তা জবাব দিল
“ওকে ডিয়ার। আমি দেখবো!”
এরপর লিও আবারো আমার দিকে তাকিয়ে আগের মতন ভ্যাবলা হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে দরজা আটকে দিল। সামান্তা হেসে আমাকে বলল
“কিছু মনে করো না। ও একটু এমনই! পাগল পাগল”
আমি বললাম
“পাগল না শুধু হাই কোয়ালিটির পাগল!”
.
(চলবে)
.
আপনাদের রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করার জন্য আমাকে কোনো মেসেজ দিতে হবে না। আমি নিজেই সুযোগ পেলে সবার রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করে নিব। দয়া করে রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করার জন্য মেসেজ দিয়ে লজ্জা দিবেন না। নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here