Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৩৭
———————————————–
মার্থা হাউজে পৌছতে অল্প লেইট হলো। সেজন্য মিস মার্থা বিশাল তাওয়াতে ফিশ ফ্রাই এর সাথে আমাকেও ফ্রাই করতে লাগলো। কিন্তু হুমকি গুলো আমার কান বরাবরও যাচ্ছে না। আমি নিশ্চিন্ত মনে সালাদ কাটছি। পরক্ষনে মনে হল মিস মার্থা আমাকে এত বার হুমকি দিলেন কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো আমার স্যালারি থেকে একটা ডলার ও কাটেন নি তিনি। শুধু হুমকিই দিয়ে গিয়েছেন। মনটা আমার এমনিতেই ভালো ছিল। এবার আরো ফুরফুরে হয়ে গেল। হাসি মুখে মিস মার্থার দিকে তাকালাম। তিনি এখনো আমার উপর চিল্লাচ্ছেন। আধা ইংরেজি আধা স্থানীয় ভাষার জগাখিচুড়ি মিলিয়ে কি সব বলে যাচ্ছেন বোঝা যাচ্ছে না। ফর্সা মুখটা থকথকে লাল হয়ে আছে চিল্লানোর কারনে। কপালে দগদগে রগ দুটো ফুটে উঠেছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে সেখানে। আমি ব্লেন্ডার মেশিন টা নিয়ে চট করে ঠান্ডা এক গ্লাস কমলার জুস বানিয়ে তাতে কয়েক খন্ড বরফ ডুবিয়ে উনার হাতে ধরিয়ে দিলাম।
“নিন! মাথা ঠান্ডা হবে!”
তার চিল্লানোর মাঝে হঠাৎ করে বাধা পাওয়ায় তিনি অপ্রতিভ হয়ে গেলেন। থমথমে মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে উনার এপ্রোনের ফিতা টা বেধে দিলাম। একটু মোটা হওয়ার কারনে প্রায়শই হাটা চলার সময় সেটা খুলে যায়। তারপর খুন্তিটা হাতে নিয়ে নিজেই ফিশ ফ্রাই করতে লাগলাম।
.
এই সময় ডিন আমাকে ডাক দিল অর্ডার নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি অর্ডারের খাবার গুলো ওর হাত থেকে নিতে গেলেই ডিন মিট মিট করে হাসতে লাগলো। আমার বুঝতে বাকি রইল না সে কি জন্য হাসছে। কারন মিস মার্থা চুপচাপ টুলের ওপর বসে জুস টা পান করছে।
.
বিকেল বেলায় একটু করে সূর্যের মুখ দেখা গেল। সেখান থেকে আলোক রশ্নি টা কাচের জানালা দিয়ে ছিটকে আসছে। পড়ন্ত রোদে মার্থা হাউজে কাস্টমারের সংখ্যা বেড়ে গেল। বেশির ভাগই ফ্যামিলি নিয়ে এসেছে। সাথে তাদের কিচ মিচ করা বাচ্চারাও আছে। একজন ব্যাক্তি এসেছেন তিনটা জমজ কন্যা সন্তান নিয়ে। বেচারা তিনটাকে সামলাতে গিয়ে হাপিয়ে উঠছেন। অথচ উনার স্ত্রী বিন্দু মাত্র উনাকে সাহায্য করছেনা। বরং কফি মগ হাতে শুধু নির্দেশনা দিচ্ছেন। বেচারা স্বামী!
আমি মনে মনে হাসতে লাগলাম।
মার্থা হাউজ বাচ্চাদের কলরবে ভরে উঠেছে। অনেকটা স্বর্গীয় মুহুর্ত। সবকিছু তে ভালো লাগা ছেয়ে আছে।
খুশি মনে খালি ট্রে হাতে ফিরে যাচ্ছি। তাই নিজেই খেয়াল করি নি। একটা ধাক্কা খেলাম। তাকিয়ে দেখলাম আনা। ধাক্কা খেয়ে সে কাঁধ টা ডলছে। আমি বললাম
“স্যরি আনা!”
আনা কিছু বললো না। তবে বির বির করে চলে যেতে লাগল। আমি ঠোট নাড়ানো দেখে স্পষ্ট বুঝলাম ও আমাকে বি* বলে গালি দিচ্ছে। কিন্তু আমার মোটেও মন খারাপ হল না। বরং পিছন থেকে আনা কে ডাক দিলাম
“আনা!”
আনা পিছন ফিরে ভ্রু কুচকে বলল
“হোয়াট?”
আমি একটু স্মিত হেসে বললাম
“আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।”
শুনে আনার কুচকানো ভ্রু সোজা হয়ে গেল। আনা কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি পিছন ফিরে কিচেনে চলে এলাম।
আমার এত ফুরফুরে মেজাজ আর হাসি খুশি মন বেশিক্ষন রইলো না। অর্ডার পৌছে দিয়ে কিচেনে ঢোকার আগে কিচেনের দরজার আয়নায় লিওর ছবি প্রতিফলিত হয়ে ভেসে উঠলো। আমি একটু চমকে উঠলাম। মার্থা হাউজের প্রবেশ দরজা প্রায় কিচেন দরজার মুখোমুখি হওয়ায় যারা ঢুকবে তাদের চেহারা আয়নায় প্রতিফলন ঘটবে। সেটা স্বাভাবিক বিষয় ছিল। কিন্তু মুহুর্তে অস্বাভাবিক মনে হল। ধুসর শার্ট ও গাঢ় চকলেটের থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট পরিহিত অগোছালো মাথায় লিও ভিতরে ঢুকছে। রেড সানগ্লাসের আড়ালে লিওর ঘোলাটে চোখের মণি আমার নজর এড়াতে পারলো না। কিন্তু তাকে দেখে বুক টা ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো। আমি কখনো চাই নি এভাবে সামনে পড়তে। ওকে দেখে আমি দ্রুত কিচেনে ঢুকে গেলাম। কিচেনে এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করছি। অর্ডারের জন্য ডাক আসছে অথচ যেতে পারছি না। শেষে মাথায় নড়বড়ে একটা বুদ্ধি এলো। নিজের ব্যাগ থেকে রুমাল নিয়ে মুখটা বেঁধে ফেললাম। শুধু চোখ দুটোই দেখা যাচ্ছে। এরপরই গেলাম অর্ডার নিতে। একটু দূরত্ব বজায় রেখে অর্ডার নিচ্ছি। আর যার কাছ থেকে দুরত্ব বজায় রেখেছি তার কাছ থেকে অর্ডার নিচ্ছে ফ্রান্সিস।
আমি আড়চোখে বার বার ওই দিকে তাকাচ্ছি। লিও কি কি যেন অর্ডার করল। তার সান গ্লাস টা মাথায় লাগিয়ে ফোনে কারো সাথে ভিডিও চ্যাট করতে লাগলো। হাতে একটা বড় সড় প্যাকেট। নিশ্চয় কিছু কিনতে গিয়েছিলে।
এদিকে লিওর দিকে তাকাতে তাকাতে আমি যাকে সার্ভ করছিলাম সে খেকিয়ে উঠল।
“কি করছো এসব?”
আমি চমকে সামনে তাকালাম। উনার শার্টে লাল রংয়ের ছোপ ছোপ দাগ পড়ে আছে। ওই দিকে তাকাতে তাকাতে কখন ক্যারামেল সস টা উনার উপর ঢেলে দিয়েছি বুঝতেই পারলাম না। জিবে কামড় দিয়ে তাড়াতাড়ি মাফ চাইলাম
“আমি দুঃখিত স্যার। এটা এক্ষুনি পরিষ্কার করে দিচ্ছি!”
এই বলে তাড়াতাড়ি কয়েকটা টিস্যু পেপার নিলাম। কিন্তু এর আগেই লোকটা দাড়িয়ে গিয়ে ধমকে উঠলো। সেই সাথে উনার সাথে থাকা মেয়েটাও। নিশ্চয় গার্লফ্রেন্ড হবে। ডেটে এসেছিল হয়তো।
ধমক খেয়ে আমি কাচু মাচু করতে লাগলাম।
কোনো আওয়াজ করতে পারলাম না। মনে মনে দোয়া করছিলাম যাতে লিওর নজর এদিকে না পড়ে। চিৎকার চেচামেচিতে ডিন দৌড়ে এলো। সে আমার হয়ে মাফ চাইলো এবং সার্ভ করার দায়িত্ব টা ফ্রান্সিস কে দিয়ে দিল এবং ফ্রান্সিসের টা আমাকে।
আসন্ন বিপদ দেখে আমি ঢোক গিললাম। একটু হেসে ডিন কে বললাম আরেক টেবিলে আমাকে ট্রান্সফার না করার জন্য। কিন্তু ডিন শুনলো না। সে আরো একটা জোরে ধমক দিল।
দুরু দুরু বুকে কিচেনে চলে এলাম। তারপর ট্রে তে লিওর অর্ডারের খাবার নিয়ে চলে আসলাম। লিও এখনো ভিডিও চ্যাটে কথা বলছে। কানের মধ্যে ইয়ার ফোন গুজে দেওয়া। এ জন্য বোধ হয় চিৎকার হট্টগোলের আওয়াজ তার কানে পৌছায় নি।
টেবিলে খাবার রেখে সার্ভ করে দিলাম। তারপর ট্রে হাতে নিয়ে মাথা একটু নিচু করে জিজ্ঞেস করলাম
“আপনার আর কিছু প্রয়োজন স্যার!”
“না! ধন্যবাদ!”
লিও খাওয়া শুরু করতে করতে বলল। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। দ্রুত পিছন ফিরে চলে আসতেই…
“এক্সকিউজ মি!”
শুনে আমার কলিজা শুকিয়ে গেল। দাড়ানো অবস্থায় আমার হাত পা শির শির করতে লাগলো। বুঝতে পারলাম না এ সামান্য ব্যাপারে কেন এত ভয় পাচ্ছি? লিও কোনো বাঘ বা ভাল্লুক না যে আমাকে খেয়ে ফেলবে।
মুখে হাত দিয়ে দেখলাম। নাহ্! রুমাল টা ঠিক ঠাক আছে। এরপর লিওর দিকে ফিরে এক কদম সামনে এসে জিজ্ঞেস করলাম
“আ-আপনার আ-আর কিছু প্রয়োজন স্যার?”
গলায় কথা আটকে যেতে লাগলো। লিও আমার দিকে তাকালো। তাকিয়েই কিছু বলতে গিয়ে তার মুখেও কথা আটকে গেল। সে নিশ্চয় কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে। সে হা করে তাকিয়ে রইল। কি জন্য ডেকেছে আমি নিশ্চিত সে ভুলে গিয়েছে। ওর তাকানো দেখে আমি বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। আরেক বার বললাম
“আপনার আর কিছু প্রয়োজন স্যার?”
সে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। তার কিছু প্রয়োজন নেই। সুতরাং ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুত ওইখান থেকে কেটে পড়লাম।
কিচেনে এসেই বড় একটা নিঃশ্বাস নিলাম যেটা এতক্ষন বুকের খাঁচায় আটকে ছিল। ডিন এসে হড় বড় করে কোনো কিছু বলল। যত টুকু বুঝলাম ক্যারামেল ফেলা কান্ড নিয়ে আমাকে বকছে। এতটুকু বোঝাতে চাইছে যে কাজের সময় আমার আন্তরিকতা কোথায় থাকে? হাউজে আসা প্রত্যেকটা কাস্টমার কে অনুভব করাতে হবে তারা আমাদের স্পেশাল কাস্টমার।
আমি চুপচাপ মাথা নাড়লাম।
এরপর কফি সাজাতে লাগলে আবার আমার ডাক পড়লো। আট নম্বর টেবিলের কাস্টমার আমাকে চাইছে। আট নম্বর টেবিলের কাস্টমার হচ্ছে লিও। আমি অস্থিরতায় পড়ে গেলাম। এই মুহুর্তে ডিন আমার ওপর চটে আছে। বললেও কোনো লাভ হবে না। সুতরাং চুপচাপ গিয়ে দেখে আসি কি প্রয়োজন।
টেবিলে গিয়ে একটু ইতস্থত করে জিজ্ঞেস করলাম
“স্যার আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? কি প্রয়োজন আপনার?”
লিও আমার দিকে তাকালো না। খেতে খেত বেশ গম্ভীর ভাবেই জবাব দিল
“ম্যাশড পটেটোস, কিউবান গ্রিল্ড স্যান্ডউইচ উইদ চিলি সস!”
“শিওর স্যার! আর কিছু?”
“না!”
“ধন্যবাদ স্যার!”
আমি অর্ডার নিয়ে দ্রুত চলে এলাম। লিও একদম নিশ্চুপ।
সবকিছু সার্ভ করে দিলাম। এবারো আমার দিকে তাকালো না। মনে মনে উস খুস করতে লাগলাম।
সন্ধা পার হয়ে রাত্রির কালো অন্ধকার ছেয়ে গেলো। কিন্তু লিওর খাওয়া শেষ হচ্ছে না। এভাবে প্রায় কয়েক ঘন্টা ধরে নিজের জন্য খাবার অর্ডার করে যাচ্ছে। কিছু খাচ্ছে কিছু নষ্ট করছে। কিন্তু ওখান থেকে উঠছে না। ব্যাপার টা ডিনের কাছেও অস্বাভাবিক লাগলো। সে আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো ওর সাথে কোনো বেয়াদবি করেছি কিনা? উত্তরে না জানালাম।
এভাবে ওর অর্ডার টানতে টানতে আমি প্রায় হয়রান। এক পর্যায়ে ওকে সার্ভ করতে গিয়ে খেয়াল করলাম চিলি সসের জন্য যে বোতল টা ছিল সেটা তলানিতে ঠেকছে। ব্যাপার টা কি? এটা তো প্রায় অর্ধেক এর বেশি ছিল। তার মানে…!
.
আমি লিওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। সে অল্প ঝাল ও সহ্য করতে পারে না। গ্রীন চিলি সসের মত ঝাল সস কি ও খেতে পারে? তাও এত বেশি পরিমাণ?
ওর ঠোঁট অল্প অল্প কাঁপছে। বার বার নাক মুছছে। আমার মনে পড়ল আমি কয়েক বার এখানে ওয়াটার বোতল এনে দিয়েছিলাম।
লিও আমার সামনেই আবারো সসের দিকে হাত বাড়ালো। তারপর উপুর করে ফ্রাইড বানের উপর সসটা ঢেলে নিল। সবুজ সস গুলো দেখেই আমার গাল জ্বলতে লাগলো। আর লিও এত ঝাল কিভাবে খাচ্ছে? মনে মনে আমার কিছুটা সন্দেহ হল। যেটা ভাবছি সেটা যদি সত্যি হয়? ভাবতেই আমার বুক টা ধুপ ধুপ শব্দ করতে লাগল।
লিও নাইফ দিয়ে এক টুকরো বান কেটে মুখে নিতেই আমি ঝট করে হাতটা ধরে ফেললাম।
ওর হাতটা বেশ গরম হয়ে আছে। সে সাথে অল্প অল্প কাপছে। হাত ধরে ফেলতে দেখে ও আমার দিকে ধীরে ধীরে তাকালো। ও তাকাতেই আমি চমকে উঠলাম। ফর্সা মুখমন্ডল টা প্রায় রক্ত বর্ণ ধারন করেছে। চোখ দুটো টল টল করছে। আমি শিউর ওর ঝাল সহ্য হচ্ছে না। তারপরও জোর করে খাচ্ছে। হয়ত আমাকে দেখানোর জন্য।
সে আবার আমার কাছ থেকে হাত টেনে নিতেই চাইলে আমি করুন স্বরে বললাম
“লিও প্লিজ! আর-র নাহ্!”
সে মূর্তিমান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমি তাড়াতাড়ি পানি এগিয়ে দিলাম। কিন্তু সে নিলো না। পানি না নিলে মুহুর্তে আমার মাথা রাগে ঠাস ঠাস করতে লাগলো। মনে হচ্ছে এ লাল চেহারা টা নিয়ে নান রুটির চুলায় ঢুকিয়ে রেখে আরো লাল বানায়। এমন কি দোষ করেছি যার জন্য এত রাগ দেখাতে হচ্ছে? এভাবে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলতে হচ্ছে! অসভ্য, ইডিয়ট, বেকুব, গাধা, উল্লুখ, পান্ডা কোথাকার! সামান্য বিষয়ে এতটা অভিমান কিসের?
.
(চলবে)