Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৩৯
———————————————–
গো গো করে লোকটির গোঙানির শব্দ পাওয়া গেল। লোকটির হুশ ফিরে আসছে। তড়াক করে আমি আর লিও লাফিয়ে উঠলাম। চেহারা টা আমার রক্ত শূণ্য হয়ে যাচ্ছিলো। কোনো রকম লিও কে ডাকলাম
“লি-লিও?”
কোনো জবাব এলো না লিওর। জবাব না এলে লিও কোথায় সেটা দেখার জন্য মাথা ফিরানোর আগে সাই করে বাতাসের শব্দ পেলাম। কিছু একটা অতি দ্রুত গেল। তাকিয়ে দেখলাম লিও হাপাঁচ্ছে। হাতে সেই লাটি টা। লাটি কিনা অন্য কিছু বোঝা গেল না। বুঝতে চাইলামও না।
সামনের লোকটা আবারো বেহুশ হয়ে আছে। ব্যাপার টা এত দ্রুত ঘটলো যে ভালো করে দেখতেই পেলাম না।
ভাগ্য ভালো লিও পিছন থেকে আঘাত করেছিল। না হলে এ ষন্ডা মার্কা লোকের সাথে লিও পেরে উঠত বলে মনে হয় না।
.
আমি হা করে তাকিয়ে ছিলাম লোকটার রক্তাক্ত কপালের দিকে। শরীর যে এখনো বিন্দু বিন্দু কাঁপছে অনুভব করছি। কিছু বোঝার আগে লিও আমার হাত হেচকা টান দিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। সম্বিৎ ফিরে পেলাম। লিও খুব দ্রুত হাটছে। তার সাথে তাল মিলানো বেশ মুশকিল। রাস্তায় উঠেও আমাদের মধ্যে কোনো কথা হলো না। চুপচাপ লিওর দেখানো পথে এগিয়ে যেতে লাগলাম।
.
বেশ কিছুক্ষন পর হোস্টেলের কাছাকাছি এসে লিও আমার দিকে ফিরলো। আমি তাকাতে পারলাম না ওর দিকে। মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। লিও আমার হাত দুটো আলতো করে স্পর্শ করলো। প্রায় নিঃশব্দে বহু সেকেন্ড কাটলো। তারপর লিও ধীরে ধীরে ডাকলো
“মিইইরা!”
আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। সে আবারো ডাকলো
“Mira I am sorry! Please forgive me!”
চোখ টা আবারো ঝাপসা ঝাপসা হয়ে এলো। নাক খানিকটা জ্বলতে লাগলো। ধীরে ধীরে উপরে তাকালাম। কাতর দৃষ্টিতে লিও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ড্যাব ড্যাব করা ঘোলা দৃষ্টি অনেক কিছুই বলছে।
“লি-লিও!”
“মিইইরা তুমি যা চাইবে তাই হবে। আমি কখনো বাধা দিব না।!”
আমি সজল চোখে বিনা পলকে তাকিয়ে রইলাম। সে আবারো বলল তবে এবার ফিসফিসিয়ে
“কিন্তু ওয়াদা কর!”
লিও আমার হাত কে তার মুটোর ভিতর শক্ত করে চেপে ধরলো। ভ্রু কুঞ্চিত হল আমার। প্রশ্ন বিদ্ধ চোখে তাকালাম ওর দিকে
“কখনো এভাবে আমার পিছন গায়েব হয়ে যাবে না। ওয়াদা কর মিইইরা। কখনোই তুমি আমার পিছন থেকে আমার অজান্তে চলে যাবে না বল!”
হা করে রইলাম ওর দিকে!
“মিইইরা!”
বাহু ধরে হালকা ঝাকুনি দিল সে।
“হাহ!”
“বল!”
“কখনোই না। কখনোই যাবো না।”
লিওর ঠোটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। কপালের কুঞ্চিত রেখা গুলো দূর হয়ে গেল। বলে উঠলো
“I love you my princes! I love you too much!”
তৃপ্ত চোখে আমি কিছু বুঝে উঠার আগে আমার মাথা ধরে কপালে চটাস করে সশব্দে চুমু দিয়ে দিল। তারপর আর কোন কথা না বলে গট গট করে চলে গেল। এমন কি পিছন ফিরে তাকালো না। আমার শরীর টা মৃদু মৃদু কাপছে। কানের মধ্যে এখনো তার বলা লাইন টা বাজছে
“I love you my princes!”
আশ্চর্য্য! ভাবতেই শিহরন বয়ে গেল পিঠের শিড়দাড়া বেয়ে। উষ্ণ একটা আবেশ সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। নিজেকে সত্যিকারের একজন প্রিন্সেস বলে মনে হচ্ছে। দু হাতে নিজেকেই জড়িয়ে ধরলাম।
ওর চুমু দেওয়া স্থান টা আলতো করে স্পর্শ করলাম। কেমন যেন ভেজা ভেজা মনে হচ্ছে। হাত দিয়ে দেখলাম। ইয়াক্! চুমুর নামে লিও আমার কপাল টা ওর লালা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। একটানে ভালোবাসা সব উবে গেল। বির বির করে কপাল মুছতে মুছতে হোস্টেলে ঢুকে গেলাম।
দেরিতে আসার জন্য আমাকে কৈফিয়ত দিতে হল অনেক। তবে স্টুডেন্ট দের জন্য এখানে পার্ট টাইম চাকুরির স্বীকৃতি থাকার কারনে আবারো বেঁচে গেলাম।
গোসল করার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত নিজের শরীরের আঘাত সম্পর্কে ধারনা ছিল না। কিন্তু গোসল করার পর পুরো শরীরে তীব্র ব্যাথা দেখা দিল। বিশেষ করে পিঠের মেরুদন্ড টাতে। এছাড়া ওই খবিশ লোকটা আমার হাত টা মুচড়ে ধরেছিল যে কারনে হাতের ব্যাথাও চাড়া দিয়ে উঠলো। মনে হল মচকে গেছে। কানের কথা না বলায় ভালো। থাপ্পড় টা কান বরাবর পড়ায় এখন মনে হচ্ছে যন্ত্রনায় কান টাই ছিড়ে ফেলে দিই।
.
পুরো রাত অসম্ভব যন্ত্রনায় কাটালাম। এছাড়া ছোট খাট কাটা গুলো বিষের ন্যায় শরীরে বিধছিল।
জানিনা রাত কিভাবে পার হয়েছিল। সকালে উঠতেই পারছিলাম না। মাথা ভারী হয়ে এসেছে। হাত পায়ের শক্তি যেন কোথায় হারিয়ে ফেলেছি। বুড়ো মানুষের মত সব কিছু ধরে ধরে হাটতে হচ্ছে। মিসেস মারিয়ার সাথে দেখা হলে তিনি সন্দিগ্ন চোখে তাকালেন। বললেন
“ডিয়ার তুমি কি ঠিক আছো?”
মনে মনে একটু ভয় পেলাম। মিসেস মারিয়া কিছু বুঝে গেল নাতো? কিন্তু মুখে একটু হাসি টেনে বললাম
“না নাহ্ মারিয়া! আমি ঠিক আছি!’
মিসেসে মারিয়া আমাকে নিরীক্ষণ করে একটা ভ্রু উপরে তুলে ফেললেন। বললেন
“আমার তো ঠিক আছো বলে মনে হচ্ছে না। কি হয়েছে তোমার?”
“ক-কই তে-তেমন কিছু না!”
“কি তেমন কিছু না? এই মারিয়ার চোখ কে ফাঁকি দিতে পারবে মনে করছো? মনে রেখ হোস্টেলের অনেক ডেভিল ডেভিল মেয়েকে এ মারিয়া কুপোকাত করেছে। নির্বোধ ভেবোনা মারিয়াকে। আমি চোখ দেখলেই বুঝতে পারি কার মনে কি চলছে!”
আমি একটু দমে গেলাম। হৃদপিন্ড টা জোরে জোরে শব্দ করছে। মিসেস মারিয়ার কাছে ধরা পড়ে গেলাম নাতো?
“কি-কি বুঝতে পারলেন?”
“এদিকে আসো!”
উনি আমাকে টেনে টুলের উপর বসিয়ে কপালে হাত দিলেন।
সে সাথে গলা আর হাতের বাহুও স্পর্শ করতেই চোখ বড় বড় করে আমাকে ডাকলেন
“টামিনা!”
“হাহ!”
আমি উনার দিকে বিস্মিত চোখে তাকালাম। উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বোমা বর্ষন করে কিছু না বলে চলে গেল।
কিন্তু আবার কয়েক সেকেন্ড বাদেই ফিরে এলো। হাতে মেডিসিন বক্স।
“মা-মারিয়া?”
“একদম চুপ মেয়ে!”
মিসেস মারিয়া বক্স খুলে থার্মোমিটার টা মুখে দিয়ে দিলেন। ধরন দেখে মনে হচ্ছে যেন আমার জ্বর এসেছে। সত্যিই কি আমার জ্বর এসেছে? নিশ্চয় এসেছে। না হলে মিসেস মারিয়া মুখে থার্মোমিটার গুজে দিত না। মারিয়া বক বক করে বলতে লাগলো
“এলে তো রাতে অনেক দেরিতে। ভোরে ফিল্ডে ও গেলে না। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটিয়েছো।”
“নো মারিয়া! আ-আমি কিছু করি নি! মার্থা হাউজে কাজ করতে করতে…!
“একদম চুপ!”
মিসেস মারিয়ার ধমকের চোটে আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। রেইন বেড়িয়ে যাচ্ছিলো পাশ দিয়ে। মিসেস মারিয়া আমাকে ধমক দিতেই সে খিক খিক করে গেসে উঠলো। আমি তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকালাম।
“ফাজিল মেয়ে! আমি কি বুঝি না? এত রাতে কোন কফি হাউজ টা খোলা থাকে? সেটা কি বার যে এত রাত পর্যন্ত খোলা থাকবে?”
“নো নো মা-মারিয়া! আমি কোনো বারে…!”
“আবার!”
“ফাইন!”
আমি পরাজিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম।
.
সাধারন জ্বরের ট্যাবলেট খেয়ে বেডে শুয়ে রইলাম। মিসেস মারিয়ার নির্দেশ। কড়া একটা স্যুপ বানিয়ে এনেছিল। পান করতেই পুরো মুখ বিষাদে ভরে গিয়েছিল। কিন্তু মিসেস মারিয়ার কড়া চোখের চাউনিতে চুপচাপ পান করতে হল। না জানি কি খাইয়ে দিয়েছে!
.
শুয়ে শুয়ে লিওর কথা ভাবছিলাম। ভার্সিটিতে যাওয়ার দরকার আছে। না হলে সে এখানে চলে আসবে। তাই শরীর দূর্বল হলেও চুপচাপ উঠে তৈরি হয়ে নিলাম। যেতে যেতে নিশ্চয় ঔষুধে কাজ করবে। জ্বর নেমেও যেতে পারে।
মিসেস মারিয়া বাধা দিয়েছিল। উনাকে বুঝিয়ে বললাম আমার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসের কথা।
ম্যানিটোবা গবেষনা ধর্মী ইউনিভার্সিটি। ক্লাস কম রিসার্চ বেশি হয়ে থাকে। অনেক কিছুই জেনেছি, রিসার্চ করেছি! ফ্যাকাল্টি ঘুরে ঘুরে নতুন নতুন উদ্ভাবন দেখেছি। যদি মনোযোগ দিয়ে এখানে অধ্যয়ন করা যায় তাহলে ছোট খাট বিজ্ঞানী হতে আমার সময় লাগবে না। মনে মনে একটা অবাস্তব কল্পনা করে ফেললাম। আমি এইডসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে ফেলেছি। পুরো ইউনিভার্সিটি… না নাহ্ পুরো বিশ্ব ব্যাপী হইচই পড়ে গেল। বাংলাদেশী মেয়ে এইডসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে জেনে বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা আমার কাছে আসতে লাগলো। তারা ফর্মুলা জানার জন্য আগ পিছ ঘুরতে লাগলো। বাংলাদেশ থেকে একদল প্রতিনিধি আমার সাথে দেখা করতে চলে এলো। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি আমাকে আহ্বান করতে লাগলো তাদের ভার্সিটিতে জয়েন হওয়া জন্য। স্বয়ং ট্রাম্প আর পুতিন আমাকে আমন্ত্রণ জানালো অভিনন্দন জানানোর জন্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এমন অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তাড়াহুড়ো করে আমার জন্য নোবেলের ব্যবস্থা করা হলো। টিভিতে আমাকে দেখে আব্বাও এলেন। সজল চোখে আমাকে নিয়ে গর্ব বোধ করতে লাগলেন।
“আ-আ আ!”
“কোথায় ডুবে আছো টামিনা!”
ইভির চিমটি দেয়া স্থান টা ডলতে ডলতে আমি হা করে ইভির দিকে তাকালাম। জ্বরের ঘোরে এতক্ষন তাহলে স্বপ্নই দেখছি। ধ্যাত!
.
হোস্টেল থেকে বেড়িয়ে কিছু দূর আসতেই দেখলাম লিও দাড়িয়ে। তার সাইকেল স্ট্যান্ডে রেখে হেলমেট উপরে ছুড়ে মারছে। আবার ধরছে। আমাকে এখনো খেয়াল করে নি।
আমাকে নজরে আসতেই একটা হাসি দিয়ে হাত উপরে তুলে হাই জানালো। সে সাথে উপরে ছুড়ে মারা হেলমেট টা ঠাস করে তার মাথার উপর পড়লো।
“হা হা হা!”
অসুস্থতার মাঝেও আমার হাসি পেল অনেক। হেলমেট টা কুড়িয়ে নিয়ে মাথা ঢলতে ঢলতে বলল
“খেয়াল করি নি তো তাই পড়লো।”
“হুম!”
.
(চলবে)