Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৪
————————————————
স্পিকারে চমৎকার সুরেলা কন্ঠে বেল্ট বাধার নির্দেশনা দিচ্ছে। আমি কতক্ষণ টানাটানি করে বেল্ট বাধতে পারলাম। তারপর সিটে মাথা এলিয়ে দিলাম। ফ্লাইটের মধ্যে প্রায় সব যাত্রী মাথা ঘুমের জন্য তৈরি হচ্ছে। সবাই যে যার যার কাজে ব্যস্ত। শুধু মাত্র এক জোড়া চোখ আমার উপর নিবদ্ধ। তাকিয়ে দেখলাম ৬/৭ বছর বয়সী একটা ফুটফুটে মেয়ে মুখে কয়েকটা আঙ্গুল পুরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পাশেই তার পিতা মাতা রয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম তার অপলক দৃষ্টিতে আমাকে দেখার কারন টা কি। কারন টা হল আমার পরনে গায়ে হলুদের শাড়ি, হাত ভর্তি মেহেদী, পুরো শরীরে গাঁদা ফুলের সাজ। প্লেনের মধ্যে কেউ এ ব্যাপার টা নিয়ে মাথা না খাটালেও বাচ্চা মেয়েটা এ ব্যাপার টিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে। কিছু একটা নিশ্চয় ভাবছে। কারন মুখে আঙ্গুল পুরে দেয়ায় মুখের এক পাশ দিয়ে একটু একটু করে লালা গড়িয়ে পড়ছে।
আমি ওই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একটু করে হাসলাম। কিন্তু আমার হাসির জবাবে মেয়েটা পাথুরে দৃষ্টিতে আগের মতই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আর কিছু না বলে শোয়ার চেষ্টা করলাম। আর তখনই মেয়েটি এক পা এক পা করে আমার দিকে এগিয়ে এলো।
বাচ্চা দের ব্যাপারে আমি মোটামুটি আনাড়ি। তারপরও ওই মেয়েটি কে এগিয়ে আসতে দেখে আমি খানিকটা ইতস্থত করে নাম জিজ্ঞেস করলাম
“নাম কি বাবু তোমার?”
মেয়েটি এবারো জবাব দিল না। শুধু ভ্রু কুচকে আঙ্গুল গুলো বের করল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে আমার হাত স্পর্শ করতে লাগল। আমি হা করে মেয়েটির তাকালাম। দেখছিলাম মেয়েটির কান্ডকারখানা। এরপর মেয়েটি আমার হাতের গাঁদা ফুলের বালার দিকে হাত বাড়ালো। গাঁদা ফুল গুলো স্পর্শ করতে করতে আমার দিকে তাকালো। সে দেখতে চাইছিল আমি কিছু বলি কিনা। আমিও কিছু না বলে চুপচাপ দেখছিলাম।
এবার আমাকে কিছু না বলতে দেখে মেয়েটি গাঁদা ফুলটা টানতে লাগলো। তাও আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
তারপর একটানে ছিড়ে নিয়ে ভৌ দৌড় দিল নিজের পিতা মাতার কাছে। হতচকিত হয়ে তাকালাম মেয়েটির দিকে।
“আরে আরেহ!”
এতক্ষনে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেছে মেয়েটার চেহারায়। হাসি টা দেখে আর কিছু বললাম না তাকে। থাক কি দরকার? একটা ফুলই তো। যথেষ্ট সাহসী মেয়ে সে।
চোখ বন্ধ করে ঘুমের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেলাম। মাঝ খানে বিমান বালা কয়েক বার ডেকেছিলো খাওয়ার জন্য। কিন্তু সাড়া দিই নি।
হালকা একটা ঝাকুনিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হচ্ছে বেশিক্ষণ হয় নি ঘুমিয়ে ছিলাম। তাই আবারো চেষ্টা করলাম ঘুমাতে। পারলাম না। স্পীকারে আবারো সেই সুরেলা কন্ঠ ভেসে এলো। আমরা দুবাই পৌছে গেছি। এরপর এখান থেকে সোজা কানাডা। আরো বেশ কিছু সময়। এয়ার হোস্টেস নাস্তা দিয়ে গেল। এই সময় টুকু কিভাবো কাটাবো ভাবতেই ব্যাগের কথা মনে পড়লো। অনুমান যদি ভুল না হয় তাহলে আম্মা আমার ব্যাগে নিশ্চয় কোনো বই দিয়েছেন। কারন এর আগেও বাড়ি থেকে ঢাকা আসার পথ টুকু তে সময় কাটানোর জন্য বই দিতেন। আমার অনুমান মিথ্যা না। আম্মা বই দিয়েছেন। তারই প্রিয় কয়েকটা বই। আমি তারানাথ তান্ত্রিক টা নিলাম। চমৎকার একটা বই। পড়তে পড়তে সময় কোন দিকে গেলো বুঝতেই পারলাম না।
.
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেন টা মাটি স্পর্শ করলো। হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালাম। তারপর চার দিকে তাকালাম। লম্বা একটা জার্নি ছিল। সবাই ধীরে ধীরে বেড়িয়ে যাচ্ছে। তাই আমিও আড়মোড় ভেঙে আমার ব্যাগ টা নিয়ে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে এলাম। বিমান থেকে পা টা কানাডার মাটিতে রাখতেই শরীরে কেমন যেন একটা শিহরন বয়ে গেল। হালকা বিশুদ্ধ বাতাস আমার ভিতর টাকে ছেদ করে ছুয়ে গেল। আমি বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিলাম। আর মনে মনে বলললাম
“আমি এসে গেছি নায়াগ্রফলসের দেশে”
যে এয়ার পোর্টে এসে দাড়িয়েছি সেটা স্বর্নের তৈরি কোনো বিশাল ম্যানশনের মত মনে হচ্ছে। যেন উজ্জল কোন সোনালি আভা ছড়াচ্ছে। নাম Winnipeg James Armstrong Richardson International Airport। এর পর আমি এই এয়ারপোর্টেরই প্ল্যাটফর্মে প্রফেসর হুডের খোজ করতে লাগলাম। উনারই আসার কথা আমার জন্য। যদিও বা কোনো প্রফেসার এভাবে কোনো ফরেন স্টুডেন্টের জন্য দাড়িয়ে থাকে কিনা আমার জানা নেই। তবে প্রফেসার হুডের সাথে আমার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। ঢাকায় হোস্টেলে থাকা কালীন উনিই আমাকে উনার ভার্সিটির এ স্কলারশিপে আবেদন করার জন্য বলেছিলেন। এবং এত সহজে স্কলারশিপ পাওয়া টা শুধু মাত্র উনার কারণে হয়েছে। এবং উনার হাত ধরেই এত দূর যাত্রা। তাই এখানে আসার ক্রেডিট টাও অনেকাংশে উনার।
.
ইতি উতি করে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছি। প্ল্যাটফর্মে অনেকেই প্ল্যাকার্ড হাতে দাড়িয়ে আছে কারো না কারো আশায়। আমি চোখ বুলিয়ে দেখলাম। নাহ! আমার নামে কোনো প্ল্যাকার্ড নেই। বিমর্ষ হয়ে প্লাটফর্মের এক কোনায় বসে পড়লাম। প্রফেসর হুড ছাড়া এখানে আমাকে কেউ চিনেনা। আর আমিও চিনিনা। সুতরাং অপেক্ষা ছাড়া কোনো পথ নেই।
দেখতে দেখতে জায়গাটা মানুষ শুন্য হয়ে গেলো। আশে পাশে ২/১ একজন কে দেখা গেলেও তারা কেমন যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল।
উপায়ন্তর না দেখে ট্রলি ব্যাগ হাতে উঠে দাড়ালাম। এরপর বেড়িয়ে এলাম। বাইরে এখনো অন্ধকার। সেই আবছা অন্ধকারে সারি সারি ক্যাব দেখা যাচ্ছে। কিন্তু একটাতেও মানুষ নেই। হতাশা ঘিরে ধরছিল আমাকে। মানু্ষ জন না দেখে আমি হাই ওয়ের দিকে হাটতে লাগলাম। মাঝে মাঝে একটা-দুটা ক্যাব ছুটে চলছিল। আমি থামার জন্য ইশারা করছিলাম কিন্তু থামছিল না। এরই মধ্যে সামনে থেকে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। তার কাছে সাহায্য পাওয়ার আশায় যেতে গিয়েও থমকে দাড়ালাম। আমার বিবেক বাধা দিল না যেতে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে ভালো করি নি। ঢোক গিললাম একটা। প্রস্তুত হতে লাগলাম মনে মনে।
লোক টি আরো কাছে এগিয়ে আসতেই দেখলাম সে খানিকটা দুলছে। পড়নের কাপড় অসংলগ্ন। কিছুটা ভয় পেলাম। এ বিদেশ বিভুঁয়ে কে কি রকম হবে বলা মুশকিল। তাই নিজেরই সাবধান হওয়া দরকার। সরে দাড়ালাম। যাতে লোকটি পাশ কাটিয়ে চলে যায়। লোকটি আরো এগিয়ে আসতেই একটা উৎকট গন্ধ নাকে লাগলো। আল্লায় জানে কিসের গন্ধ। আমি নাক চেপে ধরলাম। তারপর আরো দূরে সরে দাড়ালাম। যাতে লোক টি আমার নাগাল না পাই। কিন্তু লোকটি আমাকে পাশ কাটিয়ে কিছু দুর যাওয়ার পর থমকে দাড়ালো। তারপর পিছন ফিরে তাকালো। এবং প্রথম বারের মত হয়ত সে আমাকে খেয়াল করল। এবং আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি এই জিনিসটার ভয় করছিলাম। লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি ট্রলি টা শক্ত হাতে ধরলাম।
এরপর কোন কিছুর পরোয়া না করে সর্ব শক্তি দিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। কোন দিকে দৌড়াচ্ছিলাম জানিনা। শুধু জানি পালাতে হবে।
পা টা বার বার শাড়ির সাথে পেঁচিয়ে যাচ্ছে। ভালো করে দৌড়াতেও পারছিনা।
লোকটির অবস্থান জানার জন্য একটু পিছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম লোকটি লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে। সেটা দেখে আমার অজ্ঞান হওয়ার মত অবস্থা হল। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে রাস্তার মাঝে দৌড়াতে লাগলাম।
না জানি কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছি? হয়ত বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি সেজন্যই এত শাস্তি দিচ্ছে আল্লাহ। মনে মনে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। প্রাথর্না করতে লাগলাম এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। দৌড়াতে দৌড়াতে শুধু এই কথা ভাবছিলাম।
ঠিক সে সময় একটা উজ্জল আলোয় আমার চোখ ধাধিয়ে গেলো। কিছু একটা আমার দিকে তীক্ষ্ণ শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসছিল। কিন্তু এতটা ধারালো আলো আমার চোখ কে এফোঁড় ওফোড় করে দিচ্ছিল। ফলাফল আমি সামনের কিছুই দেখতে পেলাম না। কিছু একটার সাথে আমি ধাক্কা খেলাম। এ চরম বিপদে আমার এক মাত্র সঙ্গী ট্রলি ব্যাগ টা আগেই হাত ছুটে কোথায় যেন দৌড়ে পালাল। আর আমি শাড়ির একপাশের আঁচলের সাথে প্যাচ খেয়ে পা মচকে পড়ে গেলাম। ধারালো রাস্তায় মচকা খেয়ে পা আর হাতের তালু ছিলে গেল। যন্ত্রনায় চিৎকার দিয়ে উঠলাম। বুঝতে পারছিনা কি হচ্ছে। ছিলে যাওয়া হাতের বাহুতে ভর দিয়ে কোন রকম উঠে বসলাম। ভাগ্যিস মরে যাই নি।
বসা থেকে হাতের ছিলে যাওয়া অংশ টুকু দেখছিলাম। তখন একটা ছায়া আমার মুখের উপর পড়লো। আমি ধীরে ধীরে মুখ তুলে উপরে তাকালাম। চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবে সেই উজ্জল আলোর মাঝে বাধা হিসেবে কেউ একজন দাড়িয়ে আছে। তার পিছন থেকে আলো এমন ভাবে দ্যূতি ছড়াচ্ছে যেন মনে হচ্ছে স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো স্বর্গীয় দূত। শুধু পাখা টাই নেই পিঠে। আর একটু হলে ফেরেশতা মনে করে ভুল করে ফেলতাম। হা করে তাকিয়ে রইলাম।
“Excuse me? Are you ok?”
শুনে খানিকটা শিউরে উঠলাম। এভাবে কাউকে বলতে শুনিনি। কেমন যেন জড়ানো কন্ঠ। বেখেয়ালে ছিলে যাওয়া হাতটা মাটি তে রাখতেই তীক্ষ্ণ জ্বলুনিতে মনে পড়ে গেল আমি কোথায় আছি। ঘোর কেটে গেল। আমি তাড়াতাড়ি সেই দূতের দিকে কাতর স্বরে অনুরোধ করে বললাম
“প্লিজ-জ আমাকে সাহায্য করুন। আমি বিপদে পড়েছি”
আমি জানি না কেন তার কাছে সাহায্য চাইলাম। হতে পারে সেও খারাপ কেউ। কিন্তু আমার অবচেতন মন তাতে সাড়া দিল না। সাহায্য চেয়েই বসলো।
সেই স্বর্গীয় দূত তার স্বর্গীয় হাত খানা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। আমি তার হাতের দিকে তাকালাম। একটা রুপার মত উজ্জল স্টিলের চ্যাপ্টা বেল্ট হাতের সাথে জড়িয়ে আছে। আর তাতে তিনটা অক্ষরের ছোট একটা শব্দ জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। ভালো করে তাকাতেই শব্দ টা পড়তে পারলাম। আর সেটা হল… LEO
.
(চলবে)