Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৪২
———————————————–
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু তার সাথে সাথেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে পারেনি। যতই সময় গড়িয়েছে ততই চারদিক বিভিন্ন আলোক রশ্নিতে উজ্জল হয়ে উঠেছে। কাজ থেকে ছুটি পেয়ে ক্লান্ত শ্রমিক রা বাড়ির উদ্দেশ্যে দ্রুত পায়ে হেটে যাচ্ছে। কেউ কেউ গ্রোসারি শপ থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করছে। খাবার দোকান গুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাদ্যের সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাঁশি ওয়ালারা বিচিত্র রংয়ের বাঁশি সুর করে বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে। রং বেরংয়ের মানুষ মার্থা হাউজে ভীড় করছে। আমি নিজেই অবাক হয়েছি। এরা সন্ধ্যায় এসে আনন্দ উৎসবের মত হই চই করে। দিনের বেলায় সেটা করেনা। দিনের বেলায় এখানে সবাই উপস্থিত হলেও নির্জিব বলে মনে হয়। কিন্তু সন্ধা নামতেই ভিন্ন চিত্র। আনন্দ উচ্ছাসে তারা মেতে উঠে।
কানাডিয়ান রা মূলত দুটো ভাষায় কথা বলে। ইংরেজি আর ফরাসি। ফরাসি ভাষা টাই স্থানীয় ভাবে বেশি প্রচলিত। এতদিন থাকা সত্ত্বেও ফরাসি ভাষাটা আমার কাছে জগাখিচুড়ি ছাড়া আর কিছু নয়। ঠিক যেমনটি আমার সামনের এ টেবিলের দুজন নিজেদের মধ্যে ফরাসি ভাষায় এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছে অথচ এক বিন্দু বিসর্গ বোঝা যাচ্ছে না। আমি অর্ডার পৌছে দিয়ে কিচেনে সরে এলাম।
কিচেনের আয়নায় নিজের দিকে নজর গেল। চোখ দুটো আমার লাল হয়ে আছে। অনেক চেষ্টা করছি যাতে কান্না না আসে। কিন্তু হতভাগা কান্না জোর করে চলে আসছে। কান্না লুকাতে গিয়ে বার বার চোখে পানি দিয়েছি। আর সেকারনে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।
আবারো ওয়াশ রুম থেকে চোখ ধুয়ে বের হতেই ডিন বলল
“কি ব্যাপার টামিনা? এত ঘন ঘন ওয়াশ রুম যাচ্ছো? কি ব্যাপার! কোনো সমস্যা হয়েছে?”
আমি একটু টেনে হাসতে চাইলাম। বললাম
“না ডিন! আমি ঠিক আছি। তোমাকে ধন্যবাদ!”
“ঠিক আছে তাহলে! এই নাও। এগুলো বার নম্বর টেবিলে দিয়ে আসো।”
“ঠিক আছে।”
ডিন তার হাতের ট্রে টা আমার হাতে দিল।
বার নম্বর টেবিলে খাবার গুলো সার্ভ করে আসতেই দেখলাম লিও ঢুকছে। ইশারায় সে আমাকে হাই জানালো। আমি কিছু বললাম না। শুধু একটা চাপা কষ্ট অনুভব করলাম।
ওর জন্য এক মগ কফি সাথে কিছু টোস্ট নিয়ে এলাম। সেগুলো টেবিলে রাখতেই সে একটা উষ্ণ হাসি দিলো। সে হাসি তে তার ডিম্পল গুলো স্পষ্ট ভাবে ভেসে উঠেছে। আমার বুকের কোথাও চিন চিন করে উঠলো। ওর হাসি টা দেখে মন থেকে টিনার বলা কথা গুলো ফিকে হয়ে যেতে চাচ্ছিলো। কিন্তু আমি ফিকে হতে দিলাম না।
“শুভ সন্ধা মিইইরা!”
আমি কোনো জবাব দিলাম না। চোখ মুখ শক্ত করে রইলাম। আমার জবাব না পেয়ে একটু সময়ের জন্য ওর ভ্রুকুটি কুঞ্চিত হলেও সেটা সে ঝেড়ে ফেলল। কফি মগ টা হাতে নিতে নিতে বলল
“কেমন আছো?”
আমি এবারো জবাব দিলাম না। খাবার গুলো সার্ভ করে দিলাম। ওর দিকে তাকালাম ও না। না তাকিয়ে ও আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার জবাব না দেয়াটা ওকে আহত করছে। সার্ভ করা যখন শেষ তখন নরম গলায় বললো
“আজ কাজ কখন শেষ হবে?”
আমি শুধু ওর চোখের দিকে তাকালাম। চোখ দুটো একদম আদুরে বিড়ালের মত মনে হচ্ছে। বড় বড় স্বচ্ছ ঘোলাটে চোখ। না নাহ! ওর চোখের দিকে তাকিয়ে গলে গেলে হবে না। আমাকে শক্ত হতে হবে। ওর দিকে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে আসতেই ঝট করে সে আমার হাত ধরে ফেলল। আমি চমকে গেলাম। বিস্মিত চোখে ওর দিকে তাকাতেই ও বেশ উৎসাহিত কন্ঠে বলল
“তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।”
ভ্রু কুচকে গেল আমার
“কি সারপ্রাইজ?”
“বলে দিলে কি সারপ্রাইজ হবে?”
“ওহ্! তাইতো! ঠিক আছে তাহলে!”
.
“টামিনা!”
দূর থেকে ডিন ডাক দিল। আমি জবাব দিলাম
“আসছি!”
লিওর মুটো থেকে হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে লাগলে লিও আবার ডাকলো
“মিইইরা?”
শুনে একটু করে থামলাম। কিন্তু পিছন ফিরলাম না। ও বলল
“আমি তোমার জন্য এখানে অপেক্ষা করছি!”
ও নিশ্চয় একটা হাসি দিচ্ছে। আমার দেখার লোভ হল। পরক্ষনেই নিজেকে সংযত করলাম। আর দাড়ালাম না ওখানে। ওর সামনে দাড়িয়ে থাকলে আমার কাজ নষ্ট বই অন্যকিছু হবে না।
.
লিও তার টেবিলেই বসে আছে। কতক্ষণ এটা সেটা খাচ্ছে। কতক্ষণ ফোন টিপছে, কতক্ষণ সেলফি নিচ্ছে, কে কি করছে সেটা মনোযোগ দিয়ে দেখছে, আর কোন কাজ না থাকলে ইতি উতি তাকাচ্ছে। আমি টেবিল পরিষ্কার করছি, অর্ডার গুলো সার্ভ করছি আর মাঝে মাঝে আড় চোখে লিওর দিকে তাকাচ্ছি। কি করছে সেটা দেখছি। কিন্তু চোরা ভাবে তাকাতে গিয়ে মাঝে মাঝে ধরা খাচ্ছি। ধরা পড়তেই ও আমার দিকে তাকিয়ে ভুবন ভুলানো এক টুকরো মিষ্টি হাসি দিচ্ছে। আগে জানতাম মেয়েদের হাসি ভুবন ভুলানো হয়। কিন্তু লিওর হাসি দেখে আমার কাছে সে ধারনা ভুল প্রমানিত হলো। ভাবছিলাম টিনা যে এখানে এসেছে সেটা বলবো কিনা? বললে লিও কি ভাববে? টিনা আর লিওর মাঝে দুপুরে ঝগড়া হতে দেখেছিলাম। এরপর টিনার এখানে এসে অপমান করা…
“এক্সকিউজ মি! হোয়াট আর ইয়ু ডুয়িং?”
চমকে গেলাম। দেখলাম সামনের কাস্টমার কে ভুল ভাবে সার্ভ করছি। তাড়াতাড়ি বললাম
“আ-আমি দুঃখিত!”
ভাবতে ভাবতে কি থেকে কি করে ফেলছি! উফফ্! মনে মনে নিজেকে নিজে বকলাম কতক্ষণ।
.
ডিউটি শেষ হতেই ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে এলাম। লিও এখনো বসে আছে। ফোনের মধ্যে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে।
আমি বেরুতেই লিও ফোন টা রেখে হুড়মুড় করে আমার পিছন পিছন বেড়িয়ে এলো। আমি ওর দিকে এক বার তাকিয়েই জোরে জোরে হাটতে লাগলাম। লিও বুঝতে পারছেনা আসলে কি করা দরকার? তারপরও হাসি মুখে বলল
“এখনি চলে যাবে?”
আমি তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকালাম। এভাবে আমাকে দেখতেই ও থমথম গলায় বলল
“না মানে তোমার যদি সময় হয় তাহলে এক সাথে বসে এক কাপ কফি পান করতাম।”
আমি জবাব দিলাম না। বেচারা এতক্ষন ধরে বসে আছে। আর আমি ওর সাথে এক কাপ কফি ও পান করতে পারলাম না? টিনার বলা কথা গুলো হুট করে মাথার ভিতর আবারো জ্যান্ত হয়ে গেল। কানে বাজতে লাগলো কথা গুলো। লিও কি বুঝলো জানিনা। ঝট করে পিছন থেকে সে আমার বাহু ধরে ফেলল। তারপর উদ্ভিগ্ন গলায় বললো
“কি হয়েছে তোমার? আমাকে বার বার ইগনোর করছো কেন? আমি কি কিছু করেছি?”
“লিও আমার হাত ছেড়ে দাও!”
জোর গলায় বললাম। লিও দমে গেল। হয়ত সে আশা করে নি আমি এভাবে কথা বলবো। কিন্তু নিজেকে সামলে দাঁত মুখ খিচে বলল
“ছাড়বো না। বল কি হয়েছে?”
সে আরো শক্ত করে হাত চেপে ধরলো।
আমি কথা বললাম না। লিওর এরুপ আচরনে আমার অভিমান বেড়ে যাচ্ছিলো। অভিমানে চোখ ফেটে অশ্রু গুলো ধৈর্য্য হারা হচ্ছিলো। মনে মনে টিনার কথা গুলো বুক ফেটে বেড়িয়ে যেতে চাইছিলো। ইচ্ছা হচ্ছিলো লিও কে সব বলে দিই। পাছে লিও আমার চোখের পানি দেখে ফেলে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম।
“মিইইরা!”
আর থাকতে পারলাম না। টল মল করা চোখের পানি নিয়ে লিওর দিকে তাকালাম। নাক টা ফুলে যাচ্ছে আর ফোস ফোস শব্দ বেরুচ্ছে। ওর দিকে তাকাতেই অশ্রু বাধ মানলো না। গাল বেয়ে এক ফোটা অশ্রু পড়ে গেল।
লিও হা করে তাকিয়ে রইলো। তারপর আস্তে করে আমার মুখটা দু হাতে মুটোয় নিয়ে নিল। আমি শুধু ফোৎ ফোৎ শব্দে নিঃশ্বাস টানছি। ও আমার চোখের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকালো।
“কি হয়েছে মিইইরা! কেউ কিছু বলে? ও-ওই কফি হাউজে কিছু হয়েছে? ওই দিনের ওই ছেলেটা! সে কিছু বলেছে? বলো আমাকে!”
আমি মাথা নাড়লাম। নাহ্ কেউ কিছু বলেনি।
“তাহলে কাঁদছো কেন তুমি?”
জবাব না দিয়ে কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের দুজনের মাঝে এক অদ্ভুদ নিরবতা নেমে এলো। আমি ওর হাত ছেড়ে শার্ট খামছি দিয়ে ধরলাম। ও শুধু হা করে আমার খামছি দিয়ে শার্ট ধরাটা দেখলো। বলল
“মিইইরা! এ-এভাবে ভয় দেখায়ও না। কি হয়েছে সেটা বলো!”
আমি যেটা বলতে চাইছিলাম সেটা বলতে পারলাম না। বললাম
“I-i…
লিও জবাবের আশায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
“I what?”
“I-i miss you leo! I miss you lot!”
এই বলে ঝাপটিয়ে জড়িয়ে ধরে কাদঁতে লাগলাম। লিও হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলো। এতটা বিস্মিত হয়ে গেল যে আমাকে জড়িয়ে ধরার কথাও সে ভুলে গেল। কাঁদতে কাঁদতে আমি ওর শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছি। তখনো সে কিছুই বুঝতে পারলো না। শুধু আলতো করে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল
“এ-এটার জন্য কাঁদতে হয় পাগল? বললেই তো পারো!”
আমি বুকের ভিতর থেকে ধরা গলায় বললাম
“বলতে পারবো না।”
লিও মাথা নিচু করে আমার দিকে তাকালো। বলল
“তাহলে এখন কিভাবে পারলে?”
“জানিনা!”
“কিন্তু…
“আমি কাঁদছি আর তুমি আমাকে প্রশ্ন করছো?”
বলেই আরো জোরে জোরে কান্না করতে লাগলাম। লিও থম থম গলায়
“ঠি-ঠিক আছে আর করবোনা। শসসসসহ! এবার কান্না বন্ধ করো।”
.
(চলবে)