Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৪৩
———————————————–
কিছুক্ষন আগেই কান্না থেমে গেছে। তারপরও গলা থেকে বেসুরো ফোপানি চলে আসছে। নাক মুখের পানি লিওর শার্টে মুছতে মুছতে আমি ফোপাচ্ছি। লিও আমাকে এখনো আলতো ভাবে পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। আমার নাক বেয়ে আবারো পানি পড়তে লাগলে সাৎ করে নাকটা লিওর শার্টে ঘষা মেরে মুছে ফেললাম। সাথে সাথে লিও আহত কন্ঠে বলে উঠল
“কি করছো মিইইরা? আমার শার্ট টা সর্দি দিয়ে ভিজিয়ে ফেলবে নাকি?”
আমি লিও কে ছেড়ে দাড়ালাম। ওর শার্টের বুকে অনেকাংশে ভিজে আছে। সব আমার নাকের চোখের নোনাজল। লিও মুখে অদ্ভুদ ভঙ্গি করে দু আঙ্গুলে শার্টের ভিজা অংশ টুকু আলগা করে ধরল। তারপর সেদিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলল
“মিইইরা… কি হাল করেছো আমার শার্টের? আমাকে যে আবারো শাওয়ার নিতে হবে!”
আমি ফোৎ করে নিঃশ্বাস টেনে বললাম
“নিলে নিবে!”
“মিইইরা!”
“তুমি না আমার জন্য সারপ্রাইজ রেখেছিলে? কোথায় সারপ্রাইজ?”
“তোমার কান্নার চোটে সারপ্রাইজ আকাশে উড়ে গেছে!”
“কোথায়?”
আমি আকাশে উকি মেরে খপ করে কিছু একটা ধরার ভান করলাম।
“দেখ উড়ে যায় নি।”
মুটো টা লিওর সামনে ধরলাম।
“কি এটা?”
“সারপ্রাইজ।”
“হা হা হা!”
লিও এবার হেসে দিলো।
“এবার বল এটার ভিতর কি সারপ্রাইজ?”
“দাড়াও একটু করে।”
এই বলে লিও আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো। আমরা মূল রাস্তা ছেড়ে এসেছি অনেক আগে। তবুও এ রোডে চারদিকে মানুষের চলা ফেরা নেহায়েত কম নয়। কৌতুহলী হয়ে আমিও তার পিছে পিছে যেতে লাগলাম। লিও আমাকে রাস্তার একপাশে নিয়ে আসলো। সেখানে লম্বা একটা কাঠের বেঞ্চি। দেখে মনে হচ্ছে চ্যাপ্টা তক্তা কে কোনো রকম পেরেক দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। রাস্তার ধারে ধারে কয়েক মিটার পর পর ল্যাম্পপোস্ট। সেখানে আলোর আকর্ষনে কত গুলো উৎসাহি উইপোকা ভীড় জমিয়ে উড়া উড়ি করছে। ল্যাম্পপোস্ট থেকে আসা ছিটকে আলো চারদিকের অন্ধকার দূর করে দিচ্ছে। কোথা থেকে বুনো ফুলের মিষ্টি সুবাস ভেসে আসছে। চারপাশে ঝি ঝি পোকার ঝি ঝি শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাতের নিস্তব্ধতাও অপরূপ ভাবে নিজেকে প্রকাশ করছে।
কাঠের তক্তাপোশের কাছাকাছি এসে লিও আমার মুখোমুখি দাড়ালো। আমার হাত দুটো তার দু হাতের মুটোয় নিয়ে নিল। আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম। সারপ্রাইজ টা কি হতে পারে? লিও মুখে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। হাসিটার মানে অনেক কিছুই হতে পারে।
আমাদের মাঝে নিরবতা বিরাজ করলো বেশ কিছুক্ষন। হাতের মুটো টা শক্ত হয়ে এলো। চারদিকে বাতাস বইছে বেশ হেলেদুলেই। লিও হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে বলল
“মিইইরা?”
“হুম!”
“তুমি অনেক ভয় পাও তাই না?”
“কাকে?”
“আমাদের ভালোবাসা কে!”
কিছুক্ষন মৌন ভাবে তার দিকে বিনা পলকে তাকিয়ে রইলাম। বললাম
“বুঝলাম না।”
লিও নিঃশব্দে হাসলো। বললো
“আমি যে ক্রিশ্চিয়ান এর জন্য তোমার ভয় হয় না? কখনো যদি এই ক্রিশ্চিয়ানিটির জন্য আমাদের আলাদা হতে হয়?”
আমার বুক হালকা কেঁপে উঠলো। কিছু বলতে গিয়েও পারলাম না। লিও আবারো বলল
“আমি সব বুঝি। এত পাথর্ক্য, বিদ্বেষ, ব্যবধান, জাতিভেদ, প্রথা সব কিছুই বুঝি। এও বুঝি এসব কিছু অচিরেই আমাদের মাঝে আসতে যাচ্ছে।”
আমি ধীরে ধীরে বললাম
“এ-এখন উপায়?”
লিও অস্পষ্ট স্বরে আবারো হাসলো। বললো
“ভয় কেন পাচ্ছো? আমি তো আছিই!”
“কিন্তু…”
“কাল কি হবে তা কাল দেখা যাবে। তাই বলে আজ নষ্ট করার কোনো দরকার আছে?”
আমি মাথা নাড়লাম। কাল কি হবে তা ভেবে আজ নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। তাছাড়া ভবিষ্যতে কি হবে সেটা কেউই বলতে পারে না এক মাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া।
আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বললাম
“সারপ্রাইজ?”
“বলছি!”
লিও বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিল। তার পর কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো।
“আ-আ-আস…!”
জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিতে তাকালাম। বললাম
“কি বলতে চাইছো?”
“শসসসসসহ মিইইরা। আমাকে বলতে দাও।”
“ঠিক আছে!”
লিও আবারো দম নিল। আমিও অপেক্ষা করতে লাগলাম ও কি বলে সেটা শোনার জন্য। লিও জিব দিয়ে তার শুকনো ঠোট কে ভিজিয়ে নিল। তারপর পরিষ্কার টানা কন্ঠে বলল
“আ-আসসালামু আলাইকুম মিইইরা!”
আমি হা করে গেলাম। নিজের কানে যা শুনলাম তা বিশ্বাস হচ্ছে না। চারদিকে পিনপতন নিরবতা নেমে এলো। এমনকি চোখের পাতাও ফেলতে আমি ভুলে গেলাম। লিও আমাকে ধরে হালকা ঝাকুনি দিল
“মিইইরা? কি হলো? গ্রীটিং হয় নি?”
আমি তব্দা খাওয়া স্বরে বললাম
“ওয়ালাইকুম আসসালাম লিও!”
লিওর মুখে লাজুক হাসি ফুটে উঠলো। লিওর গাল রক্তিম হয়ে যাচ্ছে। আর ল্যাম্পপোস্টের ঝাপসা আলোতেও বোঝা যাচ্ছিল। লাজুক দৃষ্টি অবনত করে বার বার আমার হাত দুটো নিজের মুটোয় আলতো ভাবে ঘষে যাচ্ছিল। এরকম লাজুক লিও কে আমি আগে কখনো দেখিনি। বিস্ময়ের ঘোর এখনো কেটে উঠতে পারছিনা। জিজ্ঞেস করলাম
“কোথ থেকে শিখলে এটা?”
“হুহ?”
“কে শিখালো এটা?”
“আ-আমি আজকে মস্কো তে গিয়েছিলাম।”
“মস্কো?”
“মস্কো চিনো না? তোমাদের প্রাথর্না ঘর!”
“মসজিদ!”
“ঐ টাই! ঐ খানে যে ফাদার টা ছিল উনি শিখিয়েছে।”
“উনি ফাদার না।”
“ধর্মীয় গুরু আর কি!”
“হুম!”
“কেমন হলো বলো?”
“বাহ্ খুব সুন্দর হয়েছে। কেউ একদিনে সালাম শিখে এত সুন্দর ভাবে উচ্চারন করতে পারে সেটা তোমাকে দেখে বুঝলাম। তুমি অনেক মেধাবি লিও।”
উচ্ছাস ঝড়ে পড়লো আমার কন্ঠ থেকে। লিওর মুখে আবারো সরল লাজুক হাসি। আমার ভিতরটা এক অদ্ভুদ উষ্ণতায় ভরে গেল। ভালো লাগায় ছেয়ে ছিল চারপাশ টা। মন থেকে ঝেটিয়ে বিদায় হল টিনা। প্রমানিত হল আমি লিওর ফ্যান্টাসি না, ভালোবাসা।
.
সেদিন রাতে চাঁদনী ছিল। কিন্তু চাঁদ যেন কোথাও দূরে সরে ছিল। নিস্তব্ধ এ সুন্দর রাতে আমরা দুজন উইনিপেগের এক অখ্যাত রোডে অনেক ক্ষন হেটেছি। অনেক কথা বলেছি। জেনেছি লিও সম্পর্কে। তার পরিবার সম্পর্কে। যদিও বা লিওর কোনো ভাই বোন কে আমি দেখি নি। কিন্তু সে জানিয়েছে তার আরো এক ভাই আর এক বোন আছে। বোনটা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। তাদের একটা বাচ্চা ও আছে। আর ভাইটা তাদের মায়ের আগের ঘরের। সেও আলাদা থাকে। সচরাচর খোজ খবর নেয় না।
টিনা সম্পর্কে জানালো যে সে তার পিতার বিজনেস পার্টনারের একমাত্র মেয়ে। মৃত্যুর পর লিও সবকিছুর একমাত্র উত্তরাধিকারি হবে। তাই টিনা বয়সে বড় হলেও টিনার সাথে বিয়ে নিয়ে এজন্যই এত তোরজোড় চলছে।
আমি কথা শুনতে শুনতে থমকে গেলাম। শুনলাম ভবিষ্যত সম্পর্কে লিওর ভাবনা। সে সব সময় ছোট্ট একটা ডলের মত মেয়ের আশা করে। যার ছোট্ট বাশির মত সরু নাক, ছোট্ট দুটো লাল ঠোট, ছোট্ট একটা তুলতুলে শরীর, কালো চোখের মণি হবে ঠিক আমার মত। আর এক রাশি চুল হবে পিঠে ছড়ানো। কি অদ্ভুদ ভাবনা। শুনতেই আমার শরীরে অদ্ভুদ শিহরন বয়ে গেল। আকাশের তারা গুলো ঝিক মিক করছে। বৃষ্টির দিন গুলো অনেক আগেই শেষ হয়েছে। চাঁদ টা ধীরে ধীরে দেবদারু গাছের উপরে চলে এসেছে। যেন হাত বাড়ালেই ধরা যাবে। এই সেই চাঁদ নয় কি? যেটাকে সঙ্গে করে আমি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে এসেছিলাম?
———————-
বিঘত কয়েকদিন ল্যাবরেটরি তে সময় কাটাচ্ছি। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে রিসার্চ করছি। জানি না সফল হব কিনা। তবে চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। হতে পারে সফল হতেও পারি। কয়েক দিনে আগে নোবেল কমিটি বিজয়ী দের নাম ঘোষনা করেছে। এবারো অনেক পশ্চিমা বিজ্ঞানী নোবেল ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। এশিয়ান দের মধ্যে শুধু মাত্র একজন পাকিস্তানি তরঙ্গ বিষয়ক গবেষনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় তাকে নোবেল কমিটি তাকে নোবেলের জন্য যোগ্য মনে করেছে। কিন্তু কে নোবেল পেয়েছে বা পায় নি সেটা মূখ্য নয়। মূখ্য হচ্ছে সেই পাকিস্তানি বিজ্ঞানী ড.আহমেদ আবদেল বিবিসি চ্যানেলে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছে। এবং সে ইন্টারভিউ টা আমি মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। সেই ইন্টারভিউ তে ড.আহমেদ আবদেল এমন কিছু কথা বলেছিলেন যেগুলো আমার মাথায় ফ্যানের মত ভন ভন করে ঘুরছে। আর উনার কথার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন এক আইডিয়া আমার ভর করেছে। যদি এই আইডিয়া সফল হয় তাহলে চিকিৎসা বিজ্ঞান অভূতপূর্ন উন্নতি লাভ করবে।
.
এ কয়েক দিন ধরে সেরকম একটা চেষ্টায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। পকেটে অনেক গুলো কালিজিরা। ফ্যাকাল্টিতে অনেক বলে কয়ে গ্রোসারি শপ থেকে এগুলো আনিয়েছি। শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপে চোখ লাগিয়ে একের পর এক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এত মনোযোগ দিয়ে কাজ করছি যে বাইরের কোনো কিছু সম্পর্কে আমার মনোযোগই নেই। ল্যাবরেটরিতে দু-এক জন বাদে আর কেউ নেই। যে যার যার মত কাজ করছে।
এমন সময় কেউ ভৌতিক কন্ঠে আমাকে ডাকলো
“টামিইনা!”
আমি চমকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে দেখলাম রিচা। ওকে দেখে বুকে একরাশ থু থু ছিটিয়ে দিলাম। সেটা দেখা রিচা খিক খিক করে হেসে উঠলো।
“শসসসসহ! আস্তে!”
ঠোটের উপর আঙ্গুল রেখে ইশারা করলাম চুপ থাকতে। ইশারা পেয়ে রিচা হাসি চেপে চুপ হলো। বললাম
“কি?”
“কথা আছে বাইরে চলো।”
“এখন পারবোনা। দেখছোনা কাজ করছি।”
ফিস ফিসিয়ে বললাম। রিচা ধমকে উঠল
“কি এমন কাজ করছো? চলো বাইরে। সবাই অপেক্ষা করছে।”
আমি আবারো মাইক্রোস্কোপটিতে চোখ লাগাতে লাগাতে বললাম
“আমি যাবো না। তুমি যাও। সবাই কে অপেক্ষা করতে মানা করো।”
“টামিনা!”
রিচার গলায় হুমকির সুর। আমি জবাব দিলাম না। সে আবার জানালো
“তাহলে এড কে পাঠায়! কি বলো?”
মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে রিচার দিকে তাকালাম। আমি তাকাতেই আমার দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপ মারলো। ওর ঠোটের কোনে শয়তানি হাসি ঝুলছে। অসভ্য মেয়ে!
“পাঠাবো?”
এপ্রোন টা খুলতে খুলতে মুখ ভেঙচিয়ে বললাম
“না মহারাণী ভিক্টোরিয়া। আমি আসছি! এ অসীম সাহায্য অভিনয়ের জন্য আপনাকে অস্কার ছুড়ে মারা হোক!”
শুনে মাথা নিচু করে অভিবাদনের মত ভঙি করে রিচা বললো
“ওহ্! ইটস মাই প্লেজার লেডি!”
.
(চলবে)