Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৪৪
———————————————–
ফোর্ড গ্যারি ক্যাম্পাস ইয়ার্ডে সবাই হুলুস্থুল বাধিয়েছে। কোনো একটা বিষয় নিয়ে প্রচন্ড বাক বিতন্ডা চলছে। কেউ কিছু একটা বলছে বাকি জন থামিয়ে দিচ্ছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। রিচা কে জিজ্ঞেস করলাম
“কিসের বৈঠক চলছে?”
“ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়বার ছ্যাকা খেয়েছে সে বিষয়ে মত বিনিময় বৈঠক চলছে!”
“রিচা!”
“ওকে ফাইন বলছি। সবাই ফিল্ড ট্রিপের প্ল্যান করছে”
“কিসের ফিল্ড ট্রিপ?”
“আরে ফিল্ড ট্রিপ তো নামে। সবাই ট্রিপের নামে ঘুরতে যাবে। তাই গোলমাল বেধেছে কোথায় যাবে। কেউ জাতীয় গ্যালারী যেতে চাইছে, কেউ আলেকজান্দ্রা সেতু দেখবে বলছে আবার কেউ শাতো লোরিয়ে তে এক রাত কাটাতে চাইছে!”
আমি দাড়িয়ে পড়লাম। বললাম
“তাহলে আমাকে কেন ডাকা হচ্ছে? আমি তো যেতে পারবো না। অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে আমার।”
রিচাও পিছন ফিরে আমার সাথে দাড়িয়ে পড়লো। বলল
“একজনের যে পেটের ভাত হজম হয় না তোমাকে ছাড়া। তাই ডাকতে হলো। তুমি না গেলে সে যাবে না, সে না গেলে অর্ধেক মেয়েই কোনো ট্রিপে যাবে না। ইনফ্যাক্ট আমি আর এডিও যাবো না। এডি না গেলে রাঘবও যাবে না। আর আমরা না গেলে কার্ল ও যাবে না পাক্কা। এছাড়া এত গুলো মেয়ে না গেলে ছেলেরা কোন ছাইপাশ গিলতে যাবে?”
সরাসরি না বললেও রিচার ইশারা যে লিওর প্রতি সেটা বুঝতে কষ্ট হলো না। তাই বাড়াবাড়ি না করে পিছু পিছু চলে গেলাম।
যখন ভীড়ের মধ্যে পৌছালাম তখন আলোচনা বেশ টগবগ করে ফুটছে। একে অপরের দিকে যেন জলন্ত লাভা ছুড়ে মারছে। এদের এরকম উত্তপ্ত আলোচনা দেখে আমি ভীষন ঘাবড়ে গেলাম। চোখ দুটো ইতি উতি করে লিও কে খুজছিল। হঠাৎ কেউ একজন আমার হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে একপাশে সরিয়ে নিয়ে আসলে। প্রথমে চমকে গেলেও লিও কে দেখে আশ্বস্ত হলাম। সে মিষ্টি হেসে ফিসফিসিয়ে বললো
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। ট্রিপে কি তুমি যাচ্ছো?
“অবশ্যই! শুধু আমি না আমরা দুজনেই যাচ্ছি!”
লিওর মুখে দুষ্টুমির হাসি খেলে গেল। এ হাসিটার অর্থ ঠিক বুঝতে পারলাম না। হাসির ডিকশনারি ঘাটতে হবে বুঝতে হলে। লিও এক হাতে আমাকে টেনে নিয়ে পাশে দাড় করালো। আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম। কারন এরা যে ট্রিপ ট্রিপ করছে এরকম একটা ট্রিপের খরচ আমার দু মাসের বেতন। এত কষ্ট করে কাজ করছি সেখানে মাসের শেষে তেমন ডলার বাঁচে না বললেই চলে। যা বাঁচে তা জমাচ্ছি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী টার জন্য। তার উপর ট্রিপ খরচ? কোথা থেকে দিব এত ডলার?
আমি চুপ হয়ে রইলাম। যেখানে ট্রিপের খরচ টা দিতে পারবো কিনা জানি না সেখানে ট্রিপ নিয়ে কথা বলা অশোভন দেখায়।
একজন বলে উঠলো রিদো খালে স্কেটিং করার কথা কিন্তু কার্ল সেটাতে প্রতিবাদ করলো। রিদো খাল বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্কেটিং রিং। কিন্তু সেটাতে এ মুহুর্তে স্কেটিং করা অসম্ভব। কারন খালের পানি এখনো জমেনি। শীত কাল আসতে ঢের দেরি আছে। আবার শাতো লোরিয়ে যাওয়ার কথা উঠলে সেখানে রাত্রি যাপনের কথা ভেবে সবাই পিছিয়ে গেলো। অবশেষে অনেক ঝগড়া ঝাটি শেষে ঠিক হলো সবাই ওয়ার মেমোরিয়াল দেখতে যাবে। ওয়ার মেমোরিয়াল হচ্ছে যুদ্ধে শহীদ দের কবরস্থান ও স্মৃতিস্তম্ভ। সে সাথে দর্শনীয় স্থান আর মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
.
যেহেতু ক্লাস গ্যাপ গিয়েছে তাই সবাই ক্যান্টিনে হৈ হুল্লোর বাধিয়েছে। কে ট্রিপে কিভাবে যাবে? আমি চুপচাপ চায়ের পেয়ালা টা টেনে চা পান করছি। চায়ের প্রচলন কম হলেও তেমন অপ্রচলিত ও নয়। অনেক দিন বাদে চা পান করছি। আমার পাশে লিও বসে আছে। সে ফ্রুট সালাদ খেতেই আছে। আমি আড়চোখে তাকালাম। আজ সে ধুসর রংয়ের শার্ট পড়েছে। সে সাথে হুডি জ্যাকেট। চুল গুলো অন্যরকম এলোমেলো হয়ে কপালে বাতাসের সাথে বিদ্রোহ করছে। হাতের আঙ্গুল চালিয়ে ঠিক করতে গিয়ে সেটা যে গোছানো না হয়ে পাগলাটে এলোমেলো হয় তখন বুকের হৃদপিন্ড টা একটু জোরেই বাজতে শুরু করে। হুডি জ্যাকেট আর হাটু পর্যন্ত নামানো থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট তার ভীষন প্রিয়। এই দুইটা পোশাক ছাড়া মোটামুটি সে ঘর থেকে বেরই হয় না। টেবিলের উপর কনুই ভর দিয়ে হাতের আঙ্গুল গুলো মুটো করে রেখেছে। হাতের কব্জিতে ছাই রঙা কালো ঘড়িটা শোভা পাচ্ছে। ঘড়ির সোনালি কাটা গুলো রোমান সংখ্যার উপর চলা ফেরা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। চোখ নামিয়ে ফেললাম। এই ট্রিপে ওর উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমি না গেলে সে যাবে কিনা সেটা নিয়ে অল্প বিস্তর সন্দেহ আছে। তবুও অনেক ভরসা করে ওকে আস্তে করে ডাকলাম
“লিও!”
প্রথম বার শুনলো না। তাই আবারো ডাকলাম। এবার একটু বড় করে
“লিওও!”
সে ঝট করে ফিরলো আমার দিকে
“হা? তুমি ডাকছো?”
হঠাৎ ফেরায় থম থম খেয়ে গেলাম। তবুও নিজেকে সামলে বললাম
“বলছিলাম কি এখন তো তুমি জানোই পড়ার কত চাপ! কাজের জন্য পড়া পড়ে আমি কুল পাই না। রাতে হোস্টেলে ফিরেও পড়তে মন চাই না। গিয়ে শুয়ে পড়ি। ক্লাসে যা একটু পড়া হয়।”
লিও ভ্রু কুচকে ফেললে
“কি বলতে চাইছো?”
আমি ঢোক গিলে একটু ইতস্থত করে বললাম
“বলতে চাইছিলাম এ-এই ট্রিপে আমি না গেলে হয়না? তুমি তো জা-জানোই কত পড়া…!”
“মিইইরা!”
লিওর মুখ যেন মুহুর্তে কাল বৈশাখীর মেঘে ঢেকে গেলো। মনে হল এখনি গুড়ুম গুড়ুম শব্দে বাজ পড়বে।
চারদিক এত শোরগোলের শব্দেও আমার মনে হল পিনপতন নিরবতা নেমে এসেছে। একটু করে হাসার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু হাসি টা যেন গলায় আটকে গেল। লিও শান্ত অথচ গাম্ভীর্য্য পূর্ণ মাখনের মত নরম গলায় বলল
“আবার বলো তুমি কি বলতে চাও!”
“আমি যদি…!”
লিওর চোখ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড় হয়ে গেল। আমার শ্রবন শক্তি খারাপ না হলে ফোস ফোস শব্দ শুনলাম। তাড়াতাড়ি নিজের কথা নিজে কেটে বললাম
“কো-কোনো সমস্যা নেই লিও। প-পড়া আমি ট্রিপ থেকে এসে পুষিয়ে নিতে পারবো। কোনো সমস্যা নেই।”
এই বলে তাড়াতাড়ি চায়ের পেয়ালাতে চুমুক লাগালাম। বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে। আমি চাই না লিও এই পাবলিক প্লেসে কোনো রকম হাঙ্গামা করুক। লিওর চেহারা থেকে কালবৈশাখীর মেঘ কেটে গেল। সে গিরিখাদময় সৌন্দর্য্য টা প্রকাশ একটু হাসি দিল। আমার নাকটা একটু টেনে দিয়ে বলল
“গুড গার্ল!”
এ বলে আবারো নিজের ফ্রুট সালাদে মনোযোগ দিল। আর আমার বুক থেকে একরাশ দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে গেল।
.
পরদিন আবছা অন্ধকার ভোরে হেটে হেটে ম্যাক ডারমোট এভে পার হয়ে ব্রুডি সেন্টার ক্রস করে ইউনিভার্সিটি কে ডানপাশে রেখে টম ইয়াম থাই রেস্তোরাতে এসে হাজির হয়েছি। ট্রিপে যাওয়ার জন্য সবাই তৈরি হয়ে হাজির। কেউ কেউ সকালের নাস্তাটা এই থাই রেস্তোরাতে সেরে নিচ্ছে। ভালো ভালো থাই এন্ড কন্টিনেন্টাল ফুড পাওয়া যায় এখানে। রেস্তোরা টির সামনে ছোট ছোট প্রাইরি ক্রোকাজ ফুলের ঝোপ। লটকানো বেগুনি সাদা মিশেল অর্কিড ফুল গুলো এই ভোরে সব সৌন্দর্য্য কে হার মানিয়ে বিশ্বসুন্দরীর খেতাব জিতে নিয়েছে। প্রাইরি ক্রোকাজ ফুল গুলো এই ভোরে ধীরে ধীরে ফুটছে। ওক গাছের ডালে ধুসর পেঁচা টা বড় বড় চোখ নিয়ে ভুতের মত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কালা বাদুড় গুলো এখনো উল্টো হয়ে গাছের ডাল গুলো তে লটকে আছে। এক ঝাক সোয়ালো রাত্রি শেষের সংবাদ উড়ে উড়ে প্রচার করে চলেছে। রেস্তোরা টির সামনে একটা মিনিবাস দাড় করানো। এটাতে করে সবাই ওয়ার মেমোরিয়াল দেখতে যাবে। দূর পাল্লার পথ। শুধু দেখবেই না। আশপাশ টা বেশ ভালো ভাবে চটকিয়ে দেখবে বলে মনে হচ্ছে। আমি অনেক টা কেঁপে কেঁপে উপস্থিত হয়েছি। শীতকাল অনেক দূরে হলেও ভোর বেলায় একটু একটু শীত অনূভুত হচ্ছে। কয়েকজন বাদে প্রায় সবাই উপস্থিত। লিও ও এখনো উপস্থিতই হয় নি। আসার আগে মিসেস মারিয়াকে ইন্টারভিউ দিতে হয়েছিল। অনেক বলে কয়ে রাজি করিয়ে এসেছি। হট্টগোল বেড়েই চলেছে। সবার মধ্য কল্পনা জল্পনা চলছে ট্রিপ নিয়ে আর আমি ভাবছি খরচ নিয়ে। ঠিক কত দিন ওভার টাইম করলে আমার এ ডলার গুলো উঠে আসবে? তারপর কি রকম কৃপনতা করে থাকতে হবে? কি কি না খেয়ে থাকতে হবে? কত ডলারের বাজেটে শপিং করতে হবে? ভাবছিলাম এসব কিছু হঠাৎ কেউ যেন ঝট করে পাশ থেকে টেনে জড়িয়ে ধরলো। আমি হকচকিয়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখলাম লিও। মুখে একরাশ দিল খোলা হাসি। কিছু বুঝে উঠার আগে কপালের একপাশে ঝট করে শীতল ঠোটের উষ্ণ চুমু দিয়ে বসলো। চারদিক টা ক্যামেলিয়ার নেশাতুর গন্ধে ভরে গেল। আমার নাকের নাসা রন্ধ ভেদ করে সে সুগন্ধি টা সোজা আমার কলিজায় ঘ্যাচাং করে পোচ মারলো। আর আমি ঘায়েল হয়ে গেলাম। সে হেসে ফিসফিসিয়ে বললো
“আসসালামু আলাইকুম। গুড মর্ণিং প্রিন্সেস!”
আমি এতটাই হকচকিয়ে গেলাম যে লিও এত উৎসাহ নিয়ে আমাকে খুশি করার জন্য সালাম যে দিল তার জবাব টুকু পর্যন্ত দিতে পারলাম না। আমার ডান কাঁধ টা এখনো ওর বুকের মাঝে। ওর হৃদপিন্ডের ধুপ ধুপ শব্দ টা বেশ ভালো ভাবে অনুভব করছি। কোনো ভাবে ওর নাম টা বলতে পারলাম
“লি-লিও!”
“এত বড় হা করলে কেন? ভোমরা তো বাসা মনে করে ঢুকে যাবে!”
ভ্যাবাচাকা খেয়ে তাড়াতাড়ি মুখ বন্ধ করে ফেললাম। লিও অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাসতে হাসতে বললো
“You looking very cute… My little princes!”
কি জবাব দিবো বুঝতেই পারছিনা। খানিকক্ষন ইতস্থত করে মাথা চুলকিয়ে বললাম
“You looking very handsome… M-My Prince!”
.
(চলবে)