আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -৪৫

0
1906

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৪৫
———————————————–
মিনিবাস যাত্রা শুরু করলো অটোয়ার দিকে। অটোয়া হল কানাডার রাজধানী আবার অন্টারিও এর ২য় বৃহত্তম প্রদেশ। আলেকজান্দ্রা সেতুর দেশ।
.
বাস টা সোজা এগিয়ে চলেছে। কানাডার রাস্তা গুলো একদম সোজা। বাংলাদেশের রাস্তার মত একদম আঁকা বাঁকা না। তাই এসব রোডে খুব দ্রুত গাড়ি চালানো যায়। মাঝে মধ্যে কাপল রা লং ড্রাইভে বের হয়।
বাসে উঠার আগে থাই রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা করে নিয়েছিলাম। তারপরও ভোরের এই শুদ্ধ বাতাসে পেটের সবকিছু হজম হয়ে গেল। খিদে পেয়ে গেলো আবারো। লিও কে বলতেই সে সিট থেকে উঠে গেছে। এর ফাঁকে আমি ডলার গুলো ঠিক মত আছে কিনা চেক করে নিচ্ছিলাম। কিন্তু বাতাসের কারনে পারছিনা। অনেক বলে কয়ে জানালার পাশের এই সিট টা আমি নিয়েছিলাম লিওর কাছ থেকে।
.
জানালার কাচ টা একটু টেনে ডলার গুলো গুনে নিলাম। নাহ্… ঠিকই আছে। কিন্তু কেউ তো আমার কাছ থেকে ট্রিপের খরচ নিতে এলো না। কেন এলো না? জিজ্ঞেস করতে হবে।
ডলার গুলো রেখে জানালার কাচ টা পুরোপুরি তুলে দিলাম। বাইরে ধীরে ধীরে অন্ধকারের ঘন চাদর টা পাতলা হতে শুরু করেছে। দূরে এক ঝাক সোয়ালো উড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। তুলোর মত পেজা পেজা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। হাত দুটো মুটোর ভিতরে নিয়ে ঘষতে লাগলাম। বেশ ঠান্ডা লাগছে। শীতকাল আসতেও বেশি দেরী নেই।
“ঠান্ডা লাগছে?”
“হাহ?”
লিও এসে পড়েছে। হাতে দুটো বক্স। একটা বক্স নিতে নিতে বললাম
“নাহ্! তেমন ঠান্ডা লাগছেনা।”
“এ আর এমন কি ঠান্ডা। কিছু দিন পর দেখবে কেমন তুষার পাত হয়। তখন ঘর থেকে বেরও হওয়া যাবে না।”
“স্নো ফলস?”
“হ্যা!”
“ওয়াও!”
“বাংলাডেশে কি স্নো ফল হয়?”
বক্স খুলে দেখলাম বক্সে গরম গরম দুটো চিকেন রোল চিলি সস দেয়া। উফফ্ জিবে জল এসে গেল। একটা রোল নিয়ে কামড় দিতে দিতে বললাম
“নাহ্! আমরা অনেক ভাগ্যবান জাতি। অনেক প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে মুক্ত বলে। যেমন তুষার পাত, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, দাবানল ইত্যাদি। তবে মাঘ মাসে মানে ডিসেম্বর-জানুয়ারির দিকে বেজায় শীত পড়ে। হাড় কাপানো ঠান্ডা। আম্মা তখন ভাপা পিঠা বানায়। আচ্ছা তুমি কি কখনো কাচা খেজুরের রস খেয়েছো?”
লিও জুসের বোতলে চুমুক দিয়ে বলল
“খেজুরের রস? তাও কাচা? খেজুরের কি রস আছে? মনে হয় না খেয়েছি!”
“আছে আছে! তোমাকে তাহলে বাংলাদেশে গেলে ঠান্ডা কনকনে শীতের মধ্যে খেজুরের রস খাওয়াবো। দেখবে কিভাবে রস পাওয়া যায়! তখন মনে হবে আহ্ এর চাইতে মিষ্টি আরো কোনো কিছুই হতে পারে না।”
“সত্যিই? তুমি কিন্তু আমাকে লোভ দেখাচ্ছো!”
“হা হা হা সত্যিই খাওয়াবো!”
“ঠিক আছে তাহলে। ওয়াদা করছো তুমি। এ কথা ভুলবেনা। আর আমার জ্যাকেট টা নাও। এখান কার ঠান্ডার কথা তোমার এখনো জানা নেই। অসুস্থ হয়ে পড়বে তুমি।”
লিও আমাকে তার হুডি জ্যাকেট টা খুলে দিতে লাগলো। আমি মানা করলাম কিন্তু শুনলো না। একদিকে অবশ্য ভালো হল। লিও জ্যাকেট বেশ উষ্ণ। এটা না পড়লে বুঝতেই পারতাম না কত যে ঠান্ডা লাগছিলো।
লিও জানালার কাচ নামিয়ে দিল। বলল এটার কারনে বাতাস ঢুকছে।
ইতোমধ্যে কে যেন হেড়ে গলায় জাস্টিন বিবারের গান গাওয়া শুরু করে দিয়েছে। নাহ্ এত খারাপ লাগছে না। ভালোই লাগছে জাস্টিন বিবারের গান।
কিন্তু বাইরের পেজা পেজা সাদা মেঘ আমাকে আনমনা করে দিল। আমি গান গুন গুনাতে লাগলাম
————————-
দূর দ্বীপ–বাসিনী,
চিনি তোমারে চিনি,
দারুচিনির দেশের,
তুমি বিদেশিনীগো,
সুমন্দভাষিণী।।
দূর দ্বীপ-বাসিনী…
.
প্রশান্ত সাগরে
তুফানে ও ঝড়ে
শুনেছি তোমারি
অশান্ত রাগিণী।।
দূর দ্বীপ বাসিনী…
.
বাজাও কি বুনো সুর পাহাড়ি বাঁ‍শিতে?
বনান্ত ছেয়ে যায় বাসন্তী–হাসিতে।
তব কবরী–মূলে
নব এলাচীর ফুল দুলে
কুসুম–বিলাসিনী।।
দূর দ্বীপ বাসিনী
——————————–
লিও খেতে খেতে এক নাগাড়ে তুষার পাত সম্পর্কে অনেক কিছুই বলছিলো। এমনকি রিদো খালে স্কেটিং করাতেও নিয়ে যাবে বলল। আমি কিছু শুনছি কিছু শুনছি না। তবে আমার ইচ্ছা স্নো ফলসের বরফ দিয়ে বড় পুতুল তৈরি করবো।
.
বাইরে সূর্যটা ধীরে ধীরে উকি মারছে। বাসে এতক্ষন শোরগোল থাকলেও এখন অনেক টা ঝিমিয়ে পড়েছে। কেউ কেউ হাই ও তুলছে। আজকে ট্রিপে যাবে বলে অনেকেরই রাতে ভালো ঘুম হয় নি। তাই বাসের ভিতরের উষ্ণ পরিবেশে সবাই ঢলে পড়ছে। লিও ও ব্যাতিক্রম নয়। এতক্ষন কথা বললেও এখন সাড়াশব্দ ও পাওয়া যাচ্ছে না। পাশ ফিরে দেখলাম সে হা করে সিটে মাথা রেখে হা করে ঘুমাচ্ছে। ঢুলু ঢুলু মাথাটা একবার এদিকে গড়িয়ে পড়ছে আরেকবার ওদিকে। হাতের মধ্যে আধ খাওয়া রোল টা। হাতের বাধন একটু আলগা হলেই যেন রোল টা নিচে পড়ে যাবে। লকেট টাও বেড়িয়ে এসেছে। জানালার ফাঁক গলে আসা একটু একটু বাতাস ওর কপালে ছড়িয়ে থাকা হালকা বাদামী চুল গুলো কে পরম মমতায় ছুয়ে দিচ্ছে।
আমি মনে মনে হাসলাম। ওকে দেখে আমার ঘুম উবে গেল। হাতের আধ খাওয়া রোল টা আস্তে করে নিয়ে নিলাম। হা করে আছে দেখে ওর থুতনি ধরে বন্ধ করে দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু বন্ধ হচ্ছিলো না। ও বার বার হা করে কিছু খাচ্ছিলো মত করছিল। আমার বেশ হাসি আসছিল। ঠিক যেন পাঙ্গাস মাছ।
.
বাইরে তাকালাম। রাস্তায় এখন গাড়ি চলাচল দেখা যাচ্ছে। পাশ কাটিয়ে সব কিছু এত দ্রুত যাচ্ছে যে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুধু সাৎ করে শব্দ হচ্ছে।
সূর্য তার সোনালী আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। এখন আর তেমন ঠান্ডা লাগছে না।
.
ওয়ার মেমোরিয়াল টা অটোয়া শহরে অবস্থিত।
আর অটোয়া শহর টা পাহাড় আর নদীর সংযোগ স্থলেই রয়েছে।
ধীরে ধীরে আমরা অটোয়া শহরে প্রবেশ করতে লাগলাম। বাস টা একটু মোড় ফিরাতেই লিও ধপাস করে আমার কাঁধে এসে পড়ল। আমি একটু চমকেই গেলাম। সে এখনো কুম্ভকর্নের মত হা করে ঘুমাচ্ছে। হাদারাম কোথাকার? পড়েও ঘুম ভাঙ্গে নি। ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারলাম না। বেশ মায়াই লাগলো। হতে পারে ট্রিপের কারনে কাল রাত সে ঘুমাতে পারে নি।
.
ওকে দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে যেমন সকল মায়ের একটা লাট সাহেব আদুরে ছেলে থাকে, যাকে শত দোষে মা কিছু করতে পারে না, দিনের চৌদ্দটায় ঘুম থেকে উঠে আরো বেশি নবাব গিরি দেখাবে ঠিক তেমন টা। শত গাল খেয়েও বলবে
.
“মা আমার কালো শার্ট টা খুজে পাচ্ছি না। তুমি খুজে দাও তো।”
.
যে হাত ওকে জাগিয়ে দেয়ার জন্য তুলেছিলাম সে হাত দিয়ে ওর মাথার চুল গুলো ঠিক করে দিলাম। কিন্তু পরক্ষনেই রোদ বেশ ঝামেলা শুরু করে দিল। আমি হাত দিয়ে মানা করছিলাম। বলছিলাম
.
“তোমরা এদিকে এসোনা! আমার লিও ঘুমাচ্ছে।”
.
কিন্তু নাহ্! রোদ আমার কথা শুনলো না। কাচের জানালা গলে রোদ আমাকে উপহাস করতে করতে ভিতরে ঢুকতে লাগলো। শুধু ঢুকলোই না বরং লিওর চেহারার উপর স্থায়ী ভাবে আসন গড়ার পরিকল্পনা করছে। আমি বিরক্ত হলাম। মনে মনে রোদ কে একরাশ গালি দিয়ে হাত দিয়ে আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলাম। হলো না। রোদ ফিচিক করে হেসে দিল। নাহ্! রোদ কে শাস্তি দেয়া দরকার। তাই রোদ কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে লিওর মাথা টা আস্তে করে ধরে আমার কোলে শুইয়ে দিলাম। এবার আমার ভীষন খুশি লাগছে। রোদ এখানে আসন জমাতে পারছে না। আহা! বেচারা রোদ! তাকে এখন লিওর সিটে আসন গড়তে হচ্ছে। গড়ো গড়ো! যত খুশি গড়ো। এবার রোদ রেগেমেগে গিয়ে তার তেজ বাড়িয়ে দিলো। তাতেও লাভ হলো না। কারন বাস ইতোমধ্যে গাছগাছালির ভিতর প্রবেশ করতে শুরু করেছে।
.
চারদিকে ভীষন সবুজ। আমরা অটোয়া শহরে প্রবেশ করে ফেলেছি। অটোয়া শহর টা দারুন আর চমৎকার একটা শহর বলে মনে হচ্ছে। একটা স্কুল বাস আমাদের সাথে সাথে যাচ্ছে। এক ঝাঁক প্রজাপ্রতির মত বাচ্চা কল কল শব্দ করতে করতে স্কুলে যাচ্ছে। আমাদের বাস দেখতেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে লাগলো। আমিও ওদের কে হাত বাড়িয়ে ফ্লাইং কিস ছুড়ে মারলাম। তারাও আমাকে এত্তো গুলো কিস দিলো। কি যে ভালো লাগছে!
আবার সবুজ বনানী। এবার আমরা একটা ব্রীজের ওপর উঠলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম বিশাল নদী। এটাই কি অটোয়া নদী? খানিকটা সন্দিহান ছিলাম। লিও ঘুম। না হলে জিজ্ঞেস করতাম। একটু মন খারাপ হল। নিচের ফিরে লিওর দিকে তাকাতেই আবার মন ভালো হয়ে গেলো। লিও এখনো অঘোর ঘুমে। আমার হাটুর উপর থাকা জামা টা সে এক হাতে মুটো করে ধরে রেখেছে। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। নিঃশ্বাস নেওয়ার ঘোরে ওর ডিম্পল টা একটু একটু ভেসে উঠতে লাগলো। মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে নিজের অজান্তে ডিম্পল টাতে হাত বুলাতে লাগলাম। বেশ সুন্দর ডিম্পল। নিঃশ্বাস টানার সাথে সাথে খোচা খোচা দাড়িওয়ালা গালের মাঝ খানে একটু করে দেবে যাচ্ছে আবার ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুদ ভালো লাগায় মনটা ভরে গেল। এভাবে যদি সারা জনম কাটিয়ে দিতে বলে তাহলে এক বাক্যে হা বলে দিব। মনে মনে হাসলাম। ইশশ এখন আমার শুধু বলতে ইচ্ছে করছে
.
“সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ!”
.
হা হা হা… আমার এখন তাই মনে হচ্ছে। লিও আমার সম্পদ। আমার প্রাণের অমূল্য সম্পদ। ধীরে ধীরে ওর কাছে এগিয়ে এলাম। এতটা কাছে যে ওর নিঃশ্বাসের শব্দটাও আমি শুনতে পাচ্ছি। ওর একটু করে দেবে যাওয়া ডিম্পল দেখতে দেখতে ঘোর লেগে গেল। আলতো করে চুমু দিয়ে বসলাম। ওর খোচা খোচা দাড়ি গুলো ঠোঁটে লাগছে। কিন্তু তারপরও একটা দিয়ে যেন নিজেকে আরো তৃষ্ণার্ত মনে হচ্ছে। আরো একটা চুমু খেতে যাবো সে সময় ঠাস করে যেন আব্বার ছবি চোখে ভেসে উঠল। আমি ঝট করে মাথা তুলে ফেললাম। বুকটা ভীষন ধর ফর, ধর ফর করছে। কি করছি আমি? ঠোটে হাত দিয়ে ফেললাম। লিও কে একটা চুমু দিয়ে বসেছি? লিও জানলে কি ভাববে? আমার শরীর কেঁপে উঠলো। আবার তাকালাম লিওর দিকে। ইশশ! কি মিষ্টি অনূভুতি! আর হয়ত এটাই শয়তানের প্রধান অস্ত্র। এটা দিয়েই সে মানুষ ঘায়েল করে থাকে। এখনো যেন অনূভুতি টা আমার ঠোটে লেগে আছে।
.
বাস টা মোড়ে এসে একটা ঝাকুনি দিয়ে ঘুরে গেল। সে সাথে লিও চোখ খুলে তাকালো। আমি তাড়াতাড়ি জানালার দিকে চোখ ফিরিয়ে ফেললাম। ও ঘুম জড়ানো একটু করে হাসলো। তারপর মাথায় বুলানো থাকা হাত টা ধরলো। ওর হাত টা বেশ উষ্ণ। সে বলল
“গুড মর্ণিং!”
ঘুম জড়ানো কন্ঠ! আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। জবাবে একটু করে হাসলাম। ফিসফিসিয়ে বললাম
“আমরা এসে গেছি! উঠো এবার!”
“আরেকটু!”
লিও আরো একটা দেবে যাওয়া মিষ্টি হাসি দেখালো। আমার আর কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না। মাথায় শুধু আলতো করে হাত বুলাতে লাগলাম। জানালা দিয়ে আসা বাতাস রোদের সাথে যুদ্ধ করে আমাদের কে ছুয়ে দিচ্ছে। স্বর্গীয় একটা মুহুর্ত! এ মুহুর্ত টা যেন দোয়া হয়ে বার বার ফিরে আসুক। আমাদের জীবনে।
.
(চলবে)
.
আমার পছন্দের একটা পার্ট ♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here