আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -৪৬

0
1770

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৪৬
———————————————–
বাস থেকে নেমে সবাই আড়মোড় ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নেমে গেলো। সুন্দর একটা সকাল। চারদিকে পর্যটক দের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সব কিছু সাজানো গোছানো।
ট্রিপের মধ্যে এসে সবাই বাস থেকে নেমে প্রথম বাথরুমের খোজে দৌড়ালো।
আমার খুব পানির পিপাসা পেয়েছিল। পানির বোতল নিতে নিতে লিওর দিকে তাকালাম। তার চোখ এখনো ঘুম জড়ানো। একটা হালকা ধাক্কা দিলাম।
“লিও?”
“হুম!”
“চোখ তো খুলো!”
চোখ একটু করে খুলে আমার দিকে তাকালো। বলল
“নাও খুললাম। বলো।
“আমার কাছে কেউ এখনো ট্রিপের খরচ নিতে আসেনি। কেন?
লিও চোখ বুজেই হাসলো।
“কারন তোমার খরচ আমি দিয়ে দিয়েছি!”
আমি একটু চমকে গেলাম। তাড়াতাড়ি বললাম
“তু-তুমি কেন দিলে আমার টা?”
“তুমি কোথ থেকে দিতে? এক মাস ওই কফি হাউজে ওয়েটার গিরি করে? নো ওয়ে।”
“কিন্তু আমি তো…”
“আমি ওয়াশ রুমে যাচ্ছি। কার্ল কোথায়? কার্ল!”
আমার কথা কেটে দিয়ে কার্ল কে ডাকতে ডাকতে সে চলে গেল।
আমার একটু মন খারাপ হল। জমিদার মেয়ে আমি। অভাব কখনো দেখি নি। যেখানে টাকা লেগেছে সময়ের আগে সেখানে দ্বিগুণ দিয়েছি। কখনো,কারো সাহায্য নিই নি। কেউ বললেও সেটা আমাদের জন্য চরম অপমান। কিন্তু আজকে তেমন টা মনে হচ্ছে না। বরং ভালোই লাগছে। না হলে এত সুন্দর স্থান গুলো দেখাই হতো না।
.
সবাই মোটামুটি খেয়ে দেয়ে বেড়িয়েছে। একজন গাইড সাথে রয়েছে। সে একই সাথে ইংরেজি আর ফরাসী দুই ভাষা তে গড় গড় করে ওয়ার মেমোরিয়াল সম্পর্কে বলে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। এডালিন আর রাঘব কে দেখাই যাচ্ছে না। কোথায় কোথায় ঘুরছে কে জানে। রিচা তার দামী ক্যামেরা টা নিয়ে এসেছে। সবার ছবি তুলছে। আমি কয়েক বার পোজ দিয়েছি। লিওর সাথে ও কয়েকটা তুলেছি।
সবাই যখন কথাতে ব্যস্ত তখন লিও আমার হাত ধরে কোথাও নিয়ে যেতে লাগলো। আমি জিজ্ঞেস করার আগেই ইশারা করলো চুপ থাকতে। অতপর আমি চুপ হলাম।
.
রৌদ্রজ্জ্বল দিন। নীল আকাশ টা পরিষ্কার। কোথাও এক টুকরো সাদা মেঘেরও দেখা নেই। এমন কি সোয়ালো পাখির ঝাক টাকেও দেখা গেল না। সবটাই যেন পাথুরে। মাটির দেখাও পাওয়া যাচ্ছেনা। কয়েকটা ছোট ছোট চেপ্টা সিড়ি পার হয়ে আমরা উপরে উঠলাম। সামনে হাত বাড়িয়ে লিও বলল
“এটাই ওয়ার মেমোরিয়াল!”
আমি হা করে তাকালাম। বিশাল উচু একটা স্তম্ভ। অনেকটা আমাদের রায়ের বাজারের বধ্যভূমি তে বানানো সৌধের ন্যায়। তবে মাঝখানে গেইটের ন্যায় খোলা। স্তম্ভের একদম উপরে দুইটা অর্ধ নগ্ন মূর্তি। একে অপরের হাত উচু করে ধরে আছে। কিন্তু ভালোভাবে তাকালে দেখা যাবে তাদের ডানা আছে। মানে তারা এন্জেল। মূর্তি গুলোর গড়ন দেখে দূর থেকে প্রথমে আমার কাছে কয়েকটা সিংহের মাথার ন্যায় মনে হয়েছিল। কিন্তু কাছে আসতেই সব পরিষ্কার।
.
সেই স্তম্ভের নিচে উচু ডিবির ন্যায় স্থান। সেখানে আরো কিছু সৈন্য মূর্তি।
এগুলো দেখতে দেখতে বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। বুঝতেই পারি নি লিও আমাকে ডাকছে।
“মিইইরা!”
“হাহ্!”
“আমাকে ফেলে কোথায় হারিয়ে গেলে?”
লিওর হালকা রসিকতায় একটু করে হাসলাম। বললাম
“কোথাও না। এইখানে আছি। তোমার সামনে!”
“দেখতেই পাচ্ছি। আচ্ছা বল এ ভাস্কর্য্য গুলো কিসের তৈরি বলে মনে হয়?”
আমি মূর্তির গুলোর দিকে তাকিয়ে বললাম
“পাথরের?”
লিও একটু হেসে বলল
“ব্রোঞ্জের মুর্তি সবগুলো। আর বাকিটা গ্রানাইট।”
আমি হা করে তাকালাম।
“ব্রোঞ্জ!”
“এটা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত কানাডিয়ান সৈনিক দের স্মৃতিসৌধ।”
“দারুন!”
.
দেখতে দেখতে সন্ধা নেমে এলো। আমার চোখ দুটো যেন তখনো অভুক্ত। দেখতে দেখতেও যেন তৃপ্ত হচ্ছিলো না। কিন্তু দিনে যা দেখলাম সন্ধা হতেই যেন তা দ্বিগুন সৌন্দর্য্য নিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। বিস্ময় যেন চোখ থেকে ঠিকরে পড়ছে। চারদিকে এত ঝলমল বাতিতে চারদিক মোহনীয় হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে এ এক স্বপ্নের রাজ্য।
সবাই জড়ো হয়েছে বাসের সামনে। গাইড কে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই গাইড কে ছেড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। বেচারা গাইড কাকে নিয়ে ঘুরছে কে জানে। অথচ গাইডের সাথে দেখা না করে উঠাও অসম্ভব।
গাইড আসল। সে সাথে রিচা। বেশ আলাপন হয়েছে দুজনের মাঝে বুঝাই যাচ্ছে। এরই মধ্য কার্ল বলে উঠলো
“ভাস্কর্য দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলে না অন্যকিছু?”
“শাট আপ কার্ল!”
এডালিন বলল
“ইটস ওকে রিচা। আমরা কিছু মনে করি নি। গড প্রমিজ।
এই বলে সমস্বরে হেসে উঠলো।
.
এত সৌন্দর্য্যের হাতছানির মায়া কাটিয়ে যখন ফেরার জন্য বাসে উঠলাম তখন রাত নেমে এসেছে অটোয়া তে। এখানকার রাত টাও বেশ জমকালো আর মায়াময়। যার মায়া কাটিয়ে উঠা মুশকিল।
ধীরে ধীরে অটোয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কমলা লেবুর কোয়ার মত এক ফালি চাঁদ আমাদের সাথে সাথে যাচ্ছে।
বেশ ক্লান্ত ছিলাম। সিটের উপর মাথা এলিয়ে দিতেই লিও বলল
“কেমন লাগলো আজকের দিনটা?”
মাথা না তুলেই ওর দিকে ফিরলাম
“দারুন!”
লিও তৃপ্তিকর হাসি দিয়ে বলল
“সবে তো শুরু। আরো কি কি অপেক্ষা করছে দেখ।”
“থ্যাংক ইয়ু!”
“এখনি থ্যাংক ইয়ু জানিও না। আরো দেখার বাকি আছে।”
“ঠিক আছে।”
লিও আমার হাত মুটোয় নিয়ে একটা চুমু খেল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। পিনপতন নিরবতা এলো আমাদের মাঝে। তারপরও যেন কথা বলছি পলকের মাধ্যমে। কয়েক সেকেন্ড বাদে লিও ফিস ফিস করে বলল
“I love you!”
হালকা উষ্ণতায় ভরে গেল চারপাশ টা। পলক ফেলে আমি ও বললাম
“I love you too Leo!”
কেন জানি না কোন অস্বস্থি বোধ হল না। বলতে পেরে যেন বুকটা হালকা লাগছে। I love you too বলতে একটুও কার্পন্য বোধ হলো না। শুনে লিওর মুখে হাসি ফুটে উঠল। সারাদিন অক্লান্ত ঘুরাঘুরিও চেহারায় ক্লান্তির চাপ ফেলতে পারে নি। বরং কপালের অগোছালো চুলে বেশ ভালো লাগছে তাকে। উজ্জল দ্যুতি তে চেহারা টা মোহনীয় লাগছে।
কিন্তু আমার চোখ বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। কখন যে রাত নেমে এলো চোখের উপর বুঝতেই পারলাম না।
.
হর্ণের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তারপরও চোখ খুললাম না। ক্যামেলিয়ার হালকা গন্ধ চারদিকে ছিটিয়ে আছে। বেশ আরাম লাগছে এভাবে চোখ বন্ধ করে থাকতে। চারদিক টা শীতলময়ী উষ্ণতায় ভরে আছে। আরো একটু গুটি সুটি মেরে গায়ের চাদর টা টেনে নিলাম। বেশ আমুদে ঘুম। হঠাৎ একটু করে বাস্তবতা চোখে উঁকি মেরে গেল। আমি তো বাসে ছিলাম। তাহলে আমি…?
চোখ খুলে গেল আপনা আপনি। চোখ খুলতেই প্রথম নজরে এল একটা থুতনি। খোচা খোচা দাড়ি ওয়ালা। কার থুতনি? লিওর? ভালো করে তাকালাম। হ্যা! লিওর থুতনি। আর আমি ওর বুকে শুয়ে আছি। যেটাকে চাদর ভেবে ছিলাম সেটা চাদর না। লিওর জ্যাকেট। আমাকে আকড়ে ধরে সিটে মাথা এলিয়ে হা করে ঘুমাচ্ছে লিও। আমি একটু করে মাথা তুললাম। পুরো বাসটা নিস্তব্ধ। শুধু ড্রাইভার জেগে আছে। আমি আলাদা হতে চাইলাম। কিন্তু এতে ওর জেগে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। তারপরেও আস্তে করে হাতটা সরালাম। বেশ সাবধানে। জ্যাকেট টা ওর গায়ে দিয়ে দিলাম। মাথা এলিয়ে দিলাম সিটের উপর। আমরা উইনিপেগের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছি। হয়তো আর কিছুক্ষনের মধ্যে পৌছে যাবো।
আমি ভাবলাম আজ পুরোদিনের কথা। ছন্নছাড়ার মত ঘুরে বেড়িয়েছি। খেয়েছি নতুন কিছু খাবার। ঘুরেছি, ছবি তুলেছি বেশ মজাও করেছি। স্মৃতি হয়ে থাকবে দিনটা।
মাথা টা একটু উপরে তুলে পুরো বাসের দিকে তাকালাম। সবাই ঘুম। তবে রাঘব জেগেছে। হয়তো এখনি জেগেছে। বুকে ঘুমাচ্ছে এডালিন। আমাকে দেখতেই রাঘব এ একটু করে হাসলো। বিনিময়ে আমিও হাসলাম। তারপর আবার নিজের দুনিয়ার কাছে ফিরে এলাম।
.
বাস থেমে গেছে। সেই থাই রেস্টুরেন্টের মুখে। রেস্টুরেন্ট টি বন্ধ হবে হবে এমন। লিও কে জাগিয়ে দিতেই বলল
“আমরা কি এসে গেছি?”
“হুম!”
লিও আড়মোড় ভেঙে উঠে দাড়ালো। আমি নেমে এলাম। এখান থেকে হোস্টেলে ফিরবো। একা একাই ফিরতে হবে।
সবাই কে বিদায় জানাচ্ছি। যে যার যার মত চলে যাচ্ছে। আমিও যাব। কিন্তু পিছন থেকে লিও ডাকলো।
“দাড়াও!”
“কিছু বলবে?”
ব্যাক প্যাক টা ঠিকমত কাঁধে নিয়ে বলল
“চল তোমাকে পৌছে দিই।”
“আমি একা যেতে পারবো।”
“আমি জানি। কিন্তু মনে আছে ওই দিন রাতের কথা?”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। লিও কে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে শ্রদ্ধা জন্মালো। তাই হাটতে লাগলাম পিছু পিছু… নিঃশব্দে।
.
(চলবে)
.
ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here