আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -৪৭

0
1750

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৪৭
———————————————–
ছন্নছাড়ার মত ঘুরে বেড়ালাম লিওর সাথে। এ কয়েকটা বসন্ত সমস্ত উইনিপেগ, অন্টারিও, অটোয়া, থম্পসন, নায়াগ্রা, পোর্টেজ লা প্রাইরি, স্টেইনবাক ইত্যাদি। ঘুরে দেখা হল হাডসন বে, নায়াগ্রফলস, আলেকজান্দ্রা সেতু, জাতীয় গ্যালারী, শাতো লোরিয়ে ইত্যাদি। লিও হয়ে উঠলো এ ভিনদেশে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। প্রেমিক কম সে আমার বন্ধু বেশি ছিল। কে যেন বলেছিল
“প্রেমিক যদি হতে চাও, তব বন্ধু হও আগে!”
কথা টা যথার্থ বলেছিলেন। ইতোমধ্যে প্রফেসর হুডও ফিরে এসেছেন। আমি দেখা ও করেছি। উনি আমাকে একটা রিসার্চ ফার্মে ইন্টার্ণ হিসেবে যোগ দিতে বেশ সাহায্য করেছেন। ভালোই চলছে দিনকাল। ও হ্যা! মার্থা হাউজের চাকরী টা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। আর লিও! সে তার পিতার সাথে অফিসের কাজকর্ম অল্প অল্প করে সব বুঝতে চেষ্টা করছিল। নিয়মিত বিজনেস সামলাচ্ছে।
বছর শেষে শীতকাল নেমে এলো। উত্তরের বাতাস সবাইকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তুষারপাত ঘটতে লাগলো। এখানকার ঠান্ডা বলতেই হাড় কাপানো ঠান্ডা না। রক্ত বরফ বানিয়ে ফেলা ঠান্ডা। আমি হাড়ে হাড়ে সেটা টের পাচ্ছি। বিরাট বিরাট দৈত্যকার পোশাক পড়ে হাটা চলা আমার জন্য বেশ অস্বস্তিকর। তারপরও এসব পড়ে হাটতে হয়।
সকাল বেলাটা আমার জন্য বেশ মজার। শিমুল তুলোর মত উড়ে উড়ে তুষার পড়তে থাকে। আর আমি এক কাপ গরম গরম ধোয়া উঠা কফি নিয়ে তুষারের উড়া উড়ি দেখতে থাকি। দেখতে দেখতে সমস্ত কিছুই তুষার পাতে ঢেকে গেলো। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করা হল। সবাই বাসায় চলে গেল। আমি যেতে পারলাম না। কারন এখানে হোস্টেলই আমার বাসা। মিসেস মারিয়া আমাকে তার বাসাতে থাকার জন্য বললেন। আমি খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু রাজি হতে পারি নি।
.

একটা শ্বেত শুভ্র শীতের সকাল। তুষারপাত তেমনটা নেই। তবুও বেজায় ঠান্ডা। বারবার রক্ত হিম হয়ে আসছে। জানালার পাশে বসে দূরের দিকে তাকিয়ে আছি। ম্যাপল গাছগুলো কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। গেইটের সাথে লাগোয়া দেবদারু গাছের পাতা গুলোতে তুষার জমে আছে। দেবদারু গাছটাতে একটা ধুসর পেঁচা থাকত। এই শীতে ওর দেখা পাওয়া বেশ মুশকিল। ঝাউগাছ গুলোতে এমন ভাবে তুষার জমেছে যে বোঝাই যাচ্ছে না এটা একটা গাছ। মনে হচ্ছে সাদা বরফের ছোট খাট একটা টিলা। প্রথমে দেখলে যে কারোই টিলা বলে ভ্রম হবে। উত্তরের তীব্র বাতাসে একটু হেলে উঠলেই যে কেউই চমকে উঠবে।
হাতে রাখা ধোঁয়া উঠা গরম কফি মগটাই চুমুক দিলাম। এই ঠান্ডা হাড় কাঁপানো শীতের সকালে গরম গরম কফি অমৃতের মতই মনে হচ্ছে। লিওর কথা ভাবলাম কতক্ষন। তুষারপাতের কারনে ওর সাথে নিয়মিত দেখা হয় না। অথচ আগে দিনে বেশ কয়েকবার দেখা হত। আবারো একটা চুমুক দিলাম। মনে হচ্ছে কেউ যেন আমাকে ডাকছে।
তীক্ষ্ণ সুরে, বহুদূর থেকে। কিন্তু কে ডাকবে? বেশ কয়েকবার শুনতে পেলাম। এদিক ওদিক তাকালাম। দূরে কাউকে অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। এটা কে হতে পারে? লিও? লিওর কথা মনে হতেই ঝট করে জানালার কাচটা তুলে দিলাম। হুড়মুড় করে একরাশ অবাধ্য ঠান্ডা রুমে ঢোকে গেল। এবার বেশ স্পষ্ট আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। আমি হাত নাড়ালাম। লিও গেইটের ওপাশের রাস্তা টাই দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে। আর দুহাত উপরে তুলে আমাকে ডাকছে। ইশারায় ওকে জানালাম আমি আসছি। বলেই কফি মগটাই শেষ চুমুক দিয়ে সবটা শেষ করে দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে গেলাম। বিরাটকায় ফোমের ন্যায় জ্যাকেট টা পড়তে পড়তে ইরিনাকে ডাকতে লাগলাম। ইরিনারও আমার মত অবস্থা। তারও যাওয়ার কোন জায়গা নেই। এই পুরো হোস্টেলে আমরা বেশ কয়েকজন আছি।
– “ইরিনা… ইরিনা!”
ইরিনা বেরিয়ে এলো। সামনেই তার এক্সাম। তাই কম্বল মুড়ি দিয়ে সে পড়াশোনা করছিল। আমাকে দেখে বলল
– “তুমি কি কোথাও বেরুচ্ছো?”
– “হুম। জলদি ফেরত আসব।”
– “তা যাচ্ছো কোথায়? বয়ফ্রেন্ডের কাছে বুঝি।”
– “একদম চুপ।”
ওকে ধমক দিতে গিয়েও পারলাম না। লজ্জায় দৃষ্টি অবনত হয়ে এল।
– “যাও যাও। আমি সব বুঝি।”
হোস্টেল থেকে বেরুতেই শীতল ধমকা হাওয়া আমাকে প্রচন্ড ভয় দেখালো। এত উষ্ণ কাপড় চোপড় পড়েও শীতকে মানানো যাচ্ছে না। লিওর কাছে পৌছতে পৌছতে আমার অবস্থা কাহিল। ওর মুখটুকু ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। সে তো একেবারে শীতের বিরুদ্ধে রীতিমতো বিশ্ব যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
– “শুভ সকাল”
– “শুভ সকাল মিইইরা।”
লিও আগাগোড়া আমার দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো।
– “একি হাল তোমার?”
আতঙ্কিত গলায় বললাম
– “কি হয়েছে?”
লিও কোন জবাব না দিয়ে তার উলের কানটুপি টা আমার মাথায় লাগিয়ে দিল। তারপর গলার উপর থেকে মাফলার টা নিয়ে আমার গলায় পেচিয়ে দিল। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। শুধু চোখ দুটোই দেখা যাচ্ছে আমার। সে একটু হেসে বলল
– “এবার ঠিক আছে।”
কানটুপি আর মাফলার নিয়ে নেওয়াই লিওর চেহারাটা এবার নজরে এসেছে। তাকে প্রথম দেখা চেহারার সাথে এ চেহারার বিন্দু মাত্রও মিল নেই। এ দীর্ঘ সময়ে তার চেহারায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রথম প্রথম ছিল একদম সদ্য যৌবনে পা দেয়া যুবকের মত। আর এখন! এখন মনে হয় টগবগে তরুন। যেন একজন পূর্ন বয়স্ক মানব। জীবনের ভার নেয়ার মত যথেষ্ট সাহস আর শক্তিশালী হয়েছে সে। তার চেহারায়ও ম্যাচুরিটি চলে এসেছে।
আগের চাইতে স্বাস্থ্যবান ও ধারালো চেহারার অধিকারি হয়েছে সে। এখন আর আগের মত সাইকেলও ব্যবহার করেনা। সবসময় কার টা নিয়ে চলাফেরা করে।
ওর দিকে তাকিয়ে একটু করে হাসলাম। মাফলারের জন্য বোঝা যাওয়ার কথা না। তারপরও লিও ধরে ফেলল।
-“হাসছো কেন?”
সাথে সাথে আমার হাসি মিলিয়ে গেল। নজর অন্যদিকে ফিরিয়ে বললাম
-“এমনি!”
-“ঠিক আছে চলো।”
এই শীতে সবার চেহারা ফ্যাকাশে আর রক্তশূন্য হয়ে গেলেও লিওর চেহারা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আয়তাকার চোখ গুলি আরো ঘোলাটে আর তীক্ষ্ণ হয়েছে। ঠোট দুটো রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে। কান টুপির কারনে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। লিও এগুতে এগুতে সেগুলো বারবার হাত চালিয়ে ঠিক করে নিচ্ছে।
– “মাফলার কোথায় তোমার? ওটা ছাড়া বের হয়েছ কেন?”
ধমক খেয়ে হুশ ফিরল। বললাম
– “মনে ছিল না নিতে। কিন্তু এখন তোমার কি হবে?”
– “কি হবে?”
– “ঠান্ডা লেগে যাবে।”
– “মিস মিইইরা… তোমার জন্য লাগবে। তুমি যে মাফলার আনো নি।”
– “আমি…আমি!”
– “একদম চুপ!”
আমাকে ধমক দিয়ে নিজের মাথায় লিও হুডি তুলে দিল। এরপর আমার বাম হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। সামনেই ওর কার টা দাড় করানো।
গাড়িতে উঠে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম
-“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
-“শসসসসহ… এটা সারপ্রাইজ!”
-“ওহ্ ঠিক আছে!”
মিররে চোখ পড়তেই গাড়ির পিছনের সিটে কিছু ছোট ছোট কার্টন নজরে এলো।
-“ওগুলো কি? দেখবো?”
বলেই হাত বাড়ালাম নেওয়ার জন্য।
লিও এক পলক মিররে তাকিয়ে বলল
-“স্টপ ইট মিইইরা! ওগুলো ধরবেনা।”
-“কিন্তু ওগুলো…!”
-“মিইইরা!”
-“ওকে!”
মুখ গোমড়া করে ফিরে গেলাম। লিও যত দিন যাচ্ছে তত বেশি খবরদারি করছে। হাসি কম, কথা কম কিন্তু গাম্ভীর্য্য বেশি। আর আমাকে ধমকায় ও বেশি। এটা করবেনা, ওটা ধরবেনা, এদিকে যাবেনা, ওদিকে যাবেনা উফ্! আমার ভালো লাগে না। আগের লিও টাকে বেশি মিস করি। আগের লিওর ডিম্পল ওয়ালা হাসি দেখে প্রেমে পড়েছিলাম। কিন্তু এখন হাসি টা দেখতেই পাওয়া যায় না। খুব খারাপ এখনকার লিও টা।
-“এটা নাও!”
-“কি এটা?”
-“খুলে দেখ!”
গাড়ি চালাতে চালাতে একটা প্যাকেট আমার হাতে দিল সে। আমি খুলে দেখলাম একটা ছোট্ট বক্স, টিফিন বক্স। আরেকটা ফ্লাস্ক।
-“কফি?”
-“হুম!”
চোখ মুখ আমার উজ্জ্বল হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি বক্স টাও খুলে ফেললাম। তাতে গরম গরম ধোয়া উঠা কয়েকটা চপ। খুশিতে জিজ্ঞেস করে ফেললাম
-“এগুলো আমার জন্য?”
-“নাহ্… টিনার জন্য।”
-“লিও!”
-“অভিয়্যাসলি তোমার জন্য! আর কার জন্য আনবো?”
-“থ্যাংকস!”
ঝটপট চপ নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলাম। এখনকার লিও টা গম্ভীর বেশি, হাসে কম, কথা কম, ধমক দেয় বেশি, মানা করে বেশি তবে… তবে আমাকে আগের চাইতে বেশি ভালোবাসে। মনে মনে লজ্জা পেলাম। ওর দিকে তাকিয়ে খেতে খেতে বললাম
-“তুমি খাবে?”
-“আমি আনলাম আর আমাকেই দিবে না? ভালো তো মিইইরা!”
-“ওকে ওকে দিচ্ছি!”
লিও আমার হাত থেকে চপ খেলো। নিজের হাতে ড্রাইভিং করছে বিধায় সে চপ ধরবেনা।
.
অনেকক্ষণ পর গাড়ি অটোয়া তে প্রবেশ করলো। এখন শীতকাল হলেও আমার চিনতে একটুও ভুল হলো না। কারন বেশ কয়েক বার লিওর সাথে এখানে এসেছি। চারদিকে তুষার জমে আছে। তবে আজ দিন পরিষ্কার। একটু একটু সূর্যের আলোর দেখাও মিলছে। তাই সবাই বেড়িয়েছে স্নো ফলস কে উপভোগ করতে। আমি জানালার কাঁচ নামিয়ে হা করে দেখতে লাগলাম। এত যে খুশি ছিলাম মনে মনে যে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি কারো সাথে আসছি।
কিছুক্ষন পর গাড়ি পার্কিং লটে থামলো। সেখানে আরো অনেক গাড়ি থামানো। এত লোক কোথায় এসেছে?
একরাশ কৌতুহল নিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। নেমে চারদিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে কোথাও উৎসব হচ্ছে। কেমন উৎসব মুখর পরিবেশ।
পিছন থেকে এসে লিও হাত ধরেই বলল
-“চলো!”
আমি একটু চমকে উঠলাম। বললাম
-“কোথায়?”
-“দেখবে সামনে!”
কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ যেতে লাগলাম। যতই যাচ্ছি ততই লোকের ভীড় বাড়ছে। সবাই কোথায় যাচ্ছে?
উত্তর মিললো একটু পড়েই। একটা রোডের সামনে এসে লিও হাত ছেড়ে দিল। রোড টাতে তুষারে ছেয়ে গেছে। সাদা ধবধবে বরফের রোড হয়ে আছে সেটা। কিন্তু এ রোড টা কেন যেন অন্য রকম। খটকা লাগলো আমার। রোড এতটা নিচু হয়না। সবাই রোডে নেমে স্কেটিং করছে। আমি জিজ্ঞাসু চোখে লিওর দিকে তাকালাম। সে তার বুদ্ধি দীপ্ত চোখ দুটি কে একটু ছোট ছোট করে ফেলল। ঠোটের কোনে একটা ডিম্পল ওয়ালা মুচকি হাসি দিল। বলল
-“চিনতে পারো নি?”
আমি মাথা নাড়লাম। নাহ্ চিনতে পারি নি। সে বলল
-“এটা ক্যানেল। রিদো ক্যানেল।”
.
(চলবে)
.
দেরি করে দেওয়ার জন্য দুঃখিত। আমি একটু অসুস্থ ছিলাম। কানে প্রচন্ড ব্যাথা ছিল। সারাদিন কান চেপে চেপে হাটতাম ব্যাথার জন্য। আশা করি বুঝবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here