Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৫১
———————————————–
মি. র্যাবিটের একটা নাম রেখেছি। সেটা হল কাজু। ও কাজু বাদাম খেতে পছন্দ করে তাই তার নাম দিয়েছি কাজু। ওর জন্য শক্ত কার্টনের তৈরি ঘরও বানিয়েছি। সকালে যাওয়ার সময় কাজু আর টুকরো করা গাজর দিয়ে যাই। তারপর বিকেলে এসে আরেকরবার দিই। সামনের দাঁত দুটো দিয়ে সারাক্ষণ কুট কুট করে খায়। দেখলে শুধু হা করে থাকি। ওর সামনের দাঁত দুটো দেখলে আমাদের এখানকার ছেলেদের কথা মনে পড়ে। যাদের নতুন দাঁত এবড়ো থেবড়ো খরগোশের সামনের দাঁতের মত হয়।
.
কাজু কে একটা বাটিতে করে টুকরো গাজর দিয়ে তার ঘরে ঢুকালাম। যাতে আমি না থাকলে কাউকে ডিস্টার্ব করতে না পারে।
আজকে শেষ পরিক্ষা। আর আজ রাতেই লিও নিউইয়র্ক চলে যাবে। ভাবতেই মনটা কেমন কেমন করতে লাগল। লিওর সামনে তা একদম বুঝতে দেয়া যাবে না। যাওয়ার আগে পছন্দ মত পোশাক নিলাম। হোয়াইট কুর্তির সাথে ব্ল্যাক জিনস পড়েছি। স্কার্ফ নিতে হলো না। কারন শীতের কারনে কানটুপি নিয়েছি। মাফলার টা গলায় জড়িয়ে ব্যাক প্যাক কাধে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
উইনিপেগে রুক্ষ শীতেরও আলাদা সৌন্দর্য্য আছে। সেটা দেখার জন্য সেরকম চোখ থাকা দরকার। পরতে পরতে বরফ জমে আছে। ইয়ার্ডে থাকা গার্ড রা সবাই মিলে সেটা পরিষ্কার করছে। লারা আমার সাথে বেড়িয়ে ছিল। কিন্তু আমার সাথে একই পথে গেল না। আমি ফোর্ড গ্যারি ক্যাম্পাসের দিকে এগুলাম। লারা অন্যদিকে।
ফোর্ড গ্যারি ক্যাম্পাসের কাছাকাছি আসতেই রাঘবের সাথে দেখা।
“গুড মর্ণিং রাঘব!”
“গুড মর্ণিং!”
“এডি কোথায়?”
“ও ক্যাম্পাসে পৌছে গিয়েছে।”
“ওহ্! লিও কে দেখেছো? সে কি এসেছে?”
“এখনো তো চোখে পড়ে নি!”
আপন মনেই যেন বললাম
“ওর তো জলদি চলে আসার কথা!”
“আজ তো নিউইয়র্ক চলে যাবে!”
“হ্যা! এক সপ্তাহের জন্য!”
মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। আমি চাচ্ছিলাম হাসি খুশি থাকতে। কিন্তু আমার দ্বারা হচ্ছে না।
“মন খারাপ করো না তাহমিনা। এক সপ্তাহের তো ব্যাপার।”
একমাত্র রাঘবই আমার নাম কে শুদ্ধ ভাবে উচ্চারন করতে পারে। আমি একটু করে স্মিত হাসলাম।
“হেই রাঘব!”
দূর থেকে রিচার কণ্ঠ শোনা গেল। তাকিয়ে দেখলাম সবাই ক্যাম্পাস সাইড ইয়ার্ডের বেঞ্চিতে বসা।
আমরা এগিয়ে গেলাম। আজ লিওর জলদি চলে আসার কথা। কিন্তু সে আসলো লেইট করে। সকলে তাকে অনেক বকলো কিন্তু বিনিময়ে ভ্যাবলার মত একটা টোল পড়া হাসিই দেখালো। আমি কোনো কথা বললাম না।
.
শেষ পরিক্ষা বেশ ভালোই হলো। একে তো গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার আনন্দ অন্যদিকে উইনিপেগ ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট বুকে চেপে বসেছে। তার উপর শেষ মুহুর্ত গুলোতে লিও কে পাচ্ছি না। সে চলে যাচ্ছে নিউইয়র্ক। মনের মধ্যে একরাশ কথা জমে আছে। এখনো সে হল ছেড়ে বেড়ুচ্ছে না। লিও আসলো আরো পরে। হাতে কয়েকটা বড় বড় প্যাকেট। সবাইকে দিতেই হুড়মুড় করে সবাই নিয়ে নিল। দেখ গেল সব আইসক্রিম। শীতের মধ্যে আইসক্রিম! রিচা বলল
“এড! তুমি আইসক্রিম এনেছো? শীতের মধ্যে?”
লিও ঠোটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল
“যতদিন আমি বাইরে থাকবো ততদিন তোরা যেন হ্যাপি না থাকিস তাই আইসক্রিম। সবাই সর্দি তে কষ্ট পা। আমি একা কেন নিউইয়র্কে কষ্ট পাবো?”
এডালিন গলা খাকড়ি দিয়ে বলল
“বাই দ্যা রোড এড! টামিনাও কিন্তু সর্দিতে কষ্ট পাবে!”
হাসি মিলিয়ে গেল লিওর। হুট করে সে আমার দিকে ফিরলো। আমি মাত্র প্যাকেট খুলে এক স্পুন নিয়ে ছিলাম খাওয়ার জন্য। সাই করে লিও ওটা কেড়ে নিল। স্পুনের আইসক্রিম সব জামা তে পড়ে গেল। আমি আইসক্রিম খাওয়ার জন্য যে হা টা করেছিলাম ওই ভাবে হা করে রইলাম। ঝাঝড়ি মেরে লিও বলল
“তোমার খেতে হবে না!”
“আমি খাবো বলছি!”
লিও আইসক্রিম রেখে আমার সামনে পায়ের পাতায় ভর দিয়ে বসলো। এরপর হাটুর উপর কুর্তি টাই লাগা আইসক্রিম গুলো টিস্যু দিয়ে সাফ করতে লাগল।
“একদম জিদ করবেনা মিইইরা! এখানে তোমার কেউ নেই। সর্দি হলে কে দেখবে?”
“নাহ্ সবাই আইসক্রিম খাচ্ছে। আমিও খাবো।”
লিও ধমকে উঠলো
“আরেক বার খাবো বললে সোজা এখান থেকে নিয়ে নিচে ফেলে দেবো।”
অগত্য আমি আর কথা বললাম না। লিও কুর্তি টা মুছে দিয়ে আবার সিটে বসে গেল। কার্ল সুযোগ টা ছাড়লো না। সে বললো
“হে রোমিও! তোর জুলির সর্দি লাগবে। আর আমরা বুঝি এলিয়েন? আমাদের কি সর্দি লাগবেনা?”
“তোরা মরবি না। সমস্যা নাই।”
আবার হাসি ঠাট্টায় ক্যান্টিন মুখরিত হলো। কিন্তু আমি মনে মনে ফুলছি। লিও আমার সাথে কেন এমন করলো? তাও আজকের দিনে? আমি ওর সাথে আর কথায় বলবো না। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছিল। অনেক কষ্টে তা চেপে মুখ গোমড়া করে বসে রইলাম। খানিকক্ষণ পর বললাম
“আমি উঠছি। উইলিয়াম এভিনিউ তে একটু যেতে হবে। তোমরা থাকো।”
উঠে গেলাম কারো জবাবের অপেক্ষা না করে। এমন কি লিওর দিকেও তাকালাম না। ইয়ার্ডে আসতেই ঝট করে কে যেন হাত টেনে ধরলো। আমি জানতাম ও পিছু পিছু আসবে। তারপরও বেশ অভিমান নিয়ে বললাম
“হাত ছাড়ো!”
হাত ছাড়ো বলতেই হাতের মধ্যে যেন কিছু একটা গুজে দিল। “উহ্ মাগো” বলে চিৎকার করে ওটা ফেলে দিলাম। কি ভীষন ঠাণ্ডা!
দেখলাম আইসক্রিম! আমি ফেলে দিতেই লিও সেটা ক্যাচ ধরেছে। আইস ক্রিম দেখে আমি খুশি হয়ে গেলাম। সেটা নিতে হাত বাড়াতেই লিও সরিয়ে ফেলল
“শুধু দুই স্পুন খাবে!”
ভ্রু কুচকে আর্তনাদ করে বললাম
“মাত্র দুই স্পুন?”
“হুম!”
“লিও!”
“এর বেশি এক স্পুনও না!”
অগত্য ওটাই শুনতে হল। তবে খাওয়ার সময় আরো কয়েক স্পুন খেলাম। বেশ মজা করে। লিও বলল
“তুমি না উইলিয়াম এভে যাবে? চলো পৌছে দিয়ে আসি।”
জ্যাকেট টা ভালোভাবে জড়াতে জড়াতে লিও বলল। আমি বললাম
“এখন না। আরো পরে।”
“তাহলে আমার সাথে চলো।”
“কোথায়?”
“শসসসসহ… সারপ্রাইজ!”
সারপ্রাইজ তাই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। লিওর সাথে এলিস এভে ধরে প্রায় টরেন্টো স্ট্রীট পর্যন্ত চলে এসেছি। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম কোথায় যাচ্ছি সেটা দেখার জন্য। লিওর কার ছোট খাট একটা গেইটের ভিতর প্রবেশ করলো। ভিতরে যখন কার থামলো তখন উৎসুক দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাতে লাগলাম। বাড়ির মতই বিশাল বিশাল পাকা ঘর। তবে বাড়ি বলে মনে হচ্ছে না। কার থেকে নামলাম। লিও পাশে এসে দাড়ালো। চারদিক তুষার সাদা হওয়ায় বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছিলো। গাছের ডাল গুলোতে ছোট ছোট তুষারের ঝুলন্ত টুকরো গুলোকে সাদা ফুল বলে মনে হচ্ছে। শীতকে ফাঁকি দিয়ে রোদ চিক চিক করে একটু একটু আসতে লাগলো।
“কোথায় এসেছি আমরা?”
“ওই খানে এসেছি।”
লিও হাতের ইশারায় সাইনবোর্ড দেখালো।
.
“উইনিপেগ সেন্ট্রাল মসকো”
.
“উইনিপেগ কেন্দ্রীয় মসজিদ… মানে আমরা মসজিদে?”
একরাশ বিস্ময় নিয়ে লিওর দিকে তাকালাম। সে মাথা নেড়ে বলল
“হ্যা!”
আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। কতদিন মসজিদ দেখি নি, আজান শুনি নি, মুসলমান দেখি নি। আমার চোখ অল্প হলেও জুড়াবে।
লিওর সাথে ভিতরে প্রবেশ করলাম। মানুষ জন তেমন নেই। অল্প কয়েক জন আছে। তাদের বাচ্চা সহ। আশ্চর্য্য! বাচ্চা নিয়েও তারা কেমন হাসি খুশিতে আছে। মনে হচ্ছে না একদম এখানে কোনো মানুষ নেই। কলকাকলি তে মুখরিত হয়ে আছে।
কয়েকজন মহিলাকেও দেখলাম। সবার সাথে কুশল বিনিময় করলাম।
দেখতে দেখতে আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেল। একজন উঠে আযান দিল। আযান শুনে লিও ফিসফিস করে বলল
“এটা কি প্রাথর্না ছিল?”
“নাহ্! এটা কে প্রেয়ার কল বলে। মানে আযান। এটা শুনলে সবাই প্রার্থনার জন্য সব কাজ ফেলে চলে আসবে।”
“দারুন তো!”
আমি উঠে দাড়ালাম। উঠতে দেখে লিও বলল
“কোথায় যাচ্ছো?”
“আযান দিলো না? তাই প্রাথর্না করতে যাচ্ছি। তুমি বসো।”
“আচ্ছা!”
দেখতে দেখতে লোকে লোকারন্য হয়ে গেল।
আমি অনেকদিন পর আযান শুনে নামাজ পড়ছি। এমনিতেই টাইম দেখে নামাজ পড়েছি। ভার্সিটিতে নামাজ ঘর ছিল একটা। ওটাতে পড়তাম প্রায়। কিন্তু মসজিদে এসে অন্যরকম ভালো লাগছে।
ওযু করে নিয়ে নামাজে দাড়িয়ে গেলাম। অন্য মহিলারাও দাড়ালো।
নামাজ শেষে আমি লিও কে খুজতে লাগলাম। কিন্তু পাচ্ছি লাম না। এরই মধ্যে নামাজ শেষ হওয়ায় অনেকে চলে গেছে। বাকিরা বসে বসে জিকির করছে, কেউ তসবি গুনছে। আমি ইতস্থত করে লিও কে খুজতে লাগলাম।
মসজিদের এক কোনে লিও কে দেখে আমি পাথর হয়ে গেলাম। কারন লিও কে কোনো ভাবে লিও বলে ভেবে নিতে পারছিলাম না। সে আরেকজন নামাজির পেছনে দাড়িয়ে তাকে ফলো করছে। তার মত রুকু দিচ্ছে, সিজদা দিচ্ছে, সালাম ফিরাচ্ছে। এর জন্য তাকে বার বার লোকটার দিকে তাকাতে হচ্ছে। রুকু তে গিয়ে কিভাবে হাত টা হাটুতে ভর দিল তা দেখার জন্য লিও দুবার লোকটার কাছে গিয়ে চক্কর মারলো। প্রথম বার সিজদা দিতে গিয়ে লোকটা কিভাবে হাত মুড়ে সিজদা দিচ্ছে সেটা দেখলো। তারপর পায়ের বুড়ো আঙ্গুল চেপে সিজদা দিল। সিজদা দিতে গিয়ে ওর বেশ সমস্যা হল। কারন বুড়ো আঙ্গুল টা কোনো ভাবে মুড়ে থাকতে চাইছিলো না। সে হাত দিয়ে বার বার সেটাকে মুড়ে দিচ্ছিলো।
আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুলো না। ধীরে ধীরে আরেকটু পিছনে গিয়ে বসে পড়লাম। ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আর ওকে দেখছিলাম। বেশ কিছুক্ষন পর লোকটা নামাজ শেষ করে বসে কুরআন হাতে নিলো পড়ার জন্য। তার দেখাদেখি লিও উঠে দাড়ালো। কুরআন হাতে নিয়ে পৃষ্টা উল্টাতে লাগলো। আমি শিউর ও কিছুই বুঝতেছেনা। কারন সে শুধুই পৃষ্টা উল্টাছিল। অপরদিকে লোকটি গুন গুন করে পড়ছিল। আমি উঠে গেলাম। তার কাঁধে হাত রাখতেই সে একটু চমকে উঠলো। চঞ্চল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। চোখে মুখে অন্যরকম একটা দ্যুতি। প্রশ্নবিদ্ধ চেহারা। রুমাল দিয়ে সে চুলে পাগড়ী বেধেছে। রুমাল টা একটু ভেজা ভেজা মনে হল। ওযু করেছে সে? মনে মনে প্রশ্ন এলো।
জিজ্ঞেস করলাম
“ওযু করেছো?”
ও মাথা নাড়লো
“করেছি!”
“তুমি জানো করতে?”
“দেখে দেখে করেছি।”
“তাহলে কুরআন কি পড়বে?”
“কিন্তু আমি তো পড়তে জানি না!”
“আমি সাহায্য করবো?”
লিও হালকা করে হাসলো। বললো
“অবশ্যই!”
আমি লিও কে সুরা ফাতিহা পাঠ করে শুনালাম। তারপর সেটার বাংলা অর্থ বললাম। সে প্রথমে মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তারপর নিজে পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো। ওর জন্য সেটা বেশ কষ্টকর ছিল। তারপরও সে এক লাইন এক লাইন করে আওড়াতে লাগলো।
.
আমি ভাবতে পারিনি উইনিপেগের শেষ মুহুর্তে এমন চমৎকার একটা দিন পাবো। এ কয়েকবছরের সার্থকতা একদিনে আমি পেয়ে গেলাম। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম। আমার সৃষ্টিকর্তা কে।
.
(চলবে)