Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৫৩
———————————————–
কোনমতে টলতে টলতে হোস্টেলে এসে পৌছলাম। পৌছেই ওয়াটার বোতলে সরাসরি মুখ লাগিয়ে ঢক ঢক করে পানি পান করতে লাগলাম। এক নিঃশ্বাসে শেষ করে দিলাম পুরো বোতল। বোতল রেখেই ধপ করে বিছানায় বসে গেলাম। ভয়ে শরীর টা এখনো কাপঁছে। কি করেছি আমি? এত ভয় লাগছে কেন? হুট করে আবার উঠে দাড়ালাম। এপাশ থেকে ওপাশ, ওপাশ থেকে এপাশ পায়চারী করতে লাগলাম। বুঝতে পারছিনা কেন এমন লাগছে।
আমার দেরি দেখে মিসেস মারিয়া পিছু পিছু এসেছিলেন। কিন্তু এসেই আমাকে এরকম পায়চারী করতে দেখে তিনি হয়ত কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। দুশ্চিন্তার কারনে আমি তাকে খেয়ালই করলাম না। পায়চারি করতে করতে আবারও বসে গেলাম। বসতেই তিনি আমার কাঁধে হাত দিয়ে নরম স্বরে ডাকলেন
“টামিনা!”
আমি তখনো ভাবনার জালে। তিনি একটু ধাক্কা দিয়ে জোরে ডাকলেন
“টামিনা!’
“হাহ?”
“কি হয়েছে তোমার?”
আমি হা করে উনার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম। যেন তিনি কি বলছেন সেটা আমি বুঝতেই পারছিনা।
“টামিনা!”
তিনি আবারো আমাকে ঝাকি দিলেন। এবার ঝাকি খেয়ে আমার কিছুটা হুশ আসলো। ওই অবস্থায় আমি মিসেস মারিয়া কে জড়িয়ে ধরলাম। উনি আরো ঘাবড়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি আমাকে ডাকতে লাগলেন
“টামিনা… তোমার কি হয়েছে? বল আমাকে?”
আমি কিছু বললাম না। শুধু বললাম
“আ-আমার ঠাণ্ডা লাগছে মারিয়া! আমার ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছে!”
এবার মিসেস মারিয়া আর কোন কথা বললেন না। চুপচাপ আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। যতটা সম্ভব ঠিক ততটাই নিজের সাথে চেপে ধরলেন।
আমি একটা উষ্ণতা পেলাম। যে উষ্ণতা টা আমি মিস করছিলাম। তন্দ্রা নেমে এলো চোখে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম মিসেস মারিয়ার বুকে।
ঘুম ভাঙলো ভোরে। তাও খিদের তাড়নায়। পেট চো চো করছে। থাকতে পারলাম না। গোগ্রাসে যা পেলাম তাই খেলাম। খাওয়ার পর কিছুটা শান্তি লাগছে। লিও কে কল করার উদ্দেশ্যে ফোন হাতে নিতেই দমে গেলাম। এক সাথে অনেক গুলো মিসডকল। সব বাংলাদেশী নাম্বারের। বুকটা আবারো দুরুদুরু করতে লাগলো। নিশ্চয় মা করেছে। নয়তো মামা। আমি তাড়াতাড়ি কল দিলাম। একবার রিং পড়ল। কিন্তু দ্বিতীয় রিং এ কেউ একজন ফোন উঠালো।
“হ্যালো!”
“কে তাহমিনা?”
কন্ঠ শুনে আমি দমে গেলাম। ভেবেছিলাম মা নয়তো ছোট মামার ফোন কিন্তু এটা তো বড় মামার গলা। বড় মামা আমার ফোন নম্বর পেলো কোথ থেকে?
“তাহমিনা!”
“জি-জি মামা! আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম মামা! অনেক দিন পর তোমার কন্ঠ শুনতেছি। কেমন আছো?”
“আমি ভা-ভালো আছি মামা!”
“শুধু নিজে ভালো থাকলে তো হবে না মামা। আমাদের ও ভালো থাকতে দিতে হবে।”
“মা-মামা আপনারা কেমন আছেন?”
“কেমন রেখে গিয়েছিলে আমাদের? তুমি তো ফেলে চলে গিয়েছিলে মামা। আমাদের কথা একবারও ভাবো নি।”
“আ-আমি…”
“একবারো ভেবেছিলে? এভাবে পালিয়ে যাওয়া হলে সমাজে আমরা মুখ কিভাবে দেখাবো? কি বলবে সকলে? যে আশিকুল্লাহর ভাগনি নিজের বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গিয়েছে।”
“মামা আমি কানাডা…”
“আমি জানি তুমি কানাডায় গিয়েছো। কিন্তু লোকে তো সে কথা বলবে না মামা। বলবে অন্য ছেলের সাথে লাইন আছে তাই পালিয়েছো। একটা বারও আমাদের কথা ভেবেছো? আমাদের কথা বাদ দাও। তোমার বাবার কথাও তো এক বারও ভাবলে না। এমন পেশার ওয়ালা মানুষ কিভাবে বাঁচবে বল এ ঘটনার পর?”
“বা-বাবা কেমন আছে?”
“ভালো নেই তাহমিনা। তুমি যত জলদি পারো বাংলাদেশে চলে আসো।”
“মা-মামা আ-আমি কিছুদিন পরেই চলে আসবো।”
“তা তো হবে না মামা। তোমার বাবা ভীষণ অসুস্থ। তোমাকে একনজর দেখতে চাই। কানাডায় লোকও পাঠিয়েছি। কিন্তু তুমি ঠিক কোন জায়গায় আছো সেটাই তারা ধরতে পারে নি। অনেক কষ্টে তোমার এ নাম্বার যোগাড় করেছি। তুমি আজই চলে আস।”
“মামা আ-আমি…”
“তাহমিনা মামা আমার, তোমার বাবা যদি আজই মারা যান তাহলে কাল এসে তুমি কি করবে? আমি আর কিছু বলবো না মামা। তুমি যদি পার আজই চলে আসো। তোমার বাবা তোমাকে এক নজর দেখার আশায় বিছানায় পড়ে আছেন!”
বিছানায় পড়ে আছেন – ধক করে কথাটা আমার বুকের কোথাও লাগলো। আমি ফোন টা শক্ত করে ধরে বললাম
“আ-আমি আসছি মামা। আজই আসছি।”
ফোন রেখে আমি দ্রুত দৌড়ে মিসেস মারিয়া কে খুজতে লাগলাম। ইভিলিন আমাকে ঝট করে আমার হাত ধরে ফেলল
“কি হয়েছে? পাগলের মত দৌড়াচ্ছো কেন?”
“ই-ইভি বাবা অসুস্থ। আমাকে এক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে।”
“এখনি যাবে? কদিন পরে গেলে হতো না?”
“ওটা পারছিনা ইভি। আমার এখনি যাওয়া দরকার।”
ইভির হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচে চলে এলাম। মিসেস মারিয়ার কাছে। উনি কোনো এক গার্ডের সাথে কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া করছিলেন। আমাকে দেখতেই থেমে গেলেন।
“ডিয়ার কি হয়েছে তোমার? তুমি ঠিক আছো?”
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম
“কিছু ঠিক নেই মারিয়া, কিছু ঠিক নেই।”
আমার কান্না চলে আসছিল। জোর করে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিলাম। মিসেস মারিয়া বললেন
“কি হয়েছে? কান্না করছো কেন?”
“আ-আমি বাড়ি যাবো মারিয়া, আমি বাড়ি যাব।”
“হঠাৎ বাড়ি? কিছু হয়েছে?”
“রো-রোজ বা-বাবা অসুস্থ। আমাকে এক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে। দয়া করে তুমি আমাকে সাহায্য কর।”
“তুমি কি সত্যিই এক্ষুনি যাবে?”
আমি মাথা নাড়লাম। আমি এক্ষুনি যাবো। মিসেস মারিয়া এক মুহুর্ত ভাবলো। তারপর বলল
“ঠিক আছে চলো।”
ব্যাগ গুছিয়ে যখন ক্যাব ডাকলাম তখন সূর্য আমার মাথার উপর।
শীতকাল ও প্রায় শেষের দিকে। হালকা হালকা গরম লাগছে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজাচ্ছে। সোয়ালো পাখি গুলো আবার ফিরে এসেছে। বেড়ে গিয়েছে কর্ম ব্যস্ত মানুষের প্রাণ চঞ্চলতা। ক্যাবে উঠার আগে এক মুহুর্ত থমকে গেলাম। পিছন ফিরে তাকালাম আমার হোস্টেলের দিকে। মিসেস মারিয়া দাড়িয়ে আছে। চোখ টা পানিতে টইটম্ভুর। তার পিছনে দাড়িয়ে আছে লারা আর ইভিলিন। এ দুইটা মেয়ে যাদের কাছে আমি সবচেয়ে বেশি সাহায্য পেয়েছি।
উপরে হোস্টেলের আমার রুমের জানালার কাচ তুলে স্কাই আর রেইন দাড়িয়ে আছে। ওদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কখনো কথা হয় নি। তবুও এ বিদায় বেলায় তারা আমাকে শেষ বারের মত দেখছে। আমি মিসেস মারিয়া কে জড়িয়ে ধরলাম। হালকা সোনালী চুলের স্বাস্থ্যবতি এই জাদঁরেল মহিলার কারনে আমি আমার মায়ের অভাব বোধ করি নি। কড়া শাসনে যেমন রেখেছিলেন ঠিক তেমনি আমাকে স্নেহ ও করেছিলেন।
শক্ত করে জড়িয়ে ফিস ফিস করে বললাম
“তোমাকে আমার খুব মনে পড়বে রোজ। খুব বেশি মনে পড়বে।”
হালকা পিঠ চাপড়ে মারিয়া বলল
“তোমার বাবা অসুস্থ না হলে আমি তোমাকে কখনো যেতে দিতাম না মাই ডিয়ার টামিনা। এয়ার পোর্টে পৌছেই আমাকে ফোন করবে কিন্তু।”
জড়ানো কন্ঠে আমার কিছুটা হাসি পেল। বললাম
“আচ্ছা!”
মিসেস মারিয়া বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে পিছনে তাকালাম
“বাই ইভি, বাই লারা। আমি তোমাদের কে খুব ভালোবাসি। অনেক মিস করবো তোমাদের।”
ওরা সমস্বরে বলল
“বাই টামিনা।”
আমি ধীরে ধীরে ক্যাবে উঠে বসলাম। স্কাই আর রেইনের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে বাই জানালাম। তারাও আমাকে বাই জানালো।
ক্যাব ছুটতে লাগলো। আর আমার গাল বেয়ে বেয়ে উষ্ণ অশ্রুর ধারা ছুটতে লাগলো। কি আশ্চর্য্য! কাল রাত পর্যন্ত আমি ভাবিনি আমাকে আজ বাংলাদেশ ফেরত যেতে হবে। আর আমি তো তাই চেয়েছিলাম। হযত ভাবি নি এত দ্রুত যেতে হবে। দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো বুক ছেড়ে। যেতে যেতে লিওর ফোনে অনেক বার ট্রাই করলাম। কিন্তু কোনো ভাবে কল যাচ্ছে না। ওকে না জানিয়ে ফিরতে হচ্ছে বলে অজানা আশঙ্কায় বুকে কেমন যেন যেন করছে।
এয়ারপোর্টে পৌছতেই আমি আবারো থমকে দাড়ালাম। কারণ এডালিন, রাঘব, রিচা, কার্ল, এমিলি দাড়িয়ে আছে। আমিই তাদের খবর দিয়েছিলাম। কিন্তু ভাবি নি ওরা আমার জন্য এয়ারপোর্টে চলে আসবে। ওদের কে দেখে আর থাকতে পারলাম না। আবেগে ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিলাম।
অনেক আনন্দ করেছি তাদের সাথে। অনেক স্মৃতি বুকে গেঁথে থাকবে আমার। হয়ত সময়ের স্রোতে কোথাও না কোথাও ভেসে যাব। কিন্তু আমি কিছুতেই তাদের ভুলবোনা। কখনোই না।
টিকিট কেটে প্লেনে বসতে বসতে বিকাল হয়ে এলো। স্পিকারে ঘোষণা দিচ্ছে। হয়ত কালকের মধ্যে বাংলাদেশ পৌছে যাব। কিন্তু আফসোস রয়ে গেল লিওর জন্য। তাকে আমি জানাতে পারলাম না। লিওর দেয়া হাতের পাথরের আংটি টার দিকে তাকালাম। জ্বল জ্বল করে জ্বলছে ওটা। ঠোঁট দিয়ে একটু করে স্পর্শ করলাম ওটা। যেন নিজেকে মিছে আশ্বাস দিচ্ছি।
.
হালকা ঝাকুনি দিয়ে কেঁপে উঠলো প্লেনটা। আমি বাইরে তাকালাম। প্লেন রানওয়েতে ছুটতে শুরু করেছে। সে সাথে আমার ভিতর টা বেশ খচ খচ করছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা জ্বলছে। তাড়াতাড়ি বোতল খুলে বেশ খানিক টা পানি পান করে ফেললাম। তারপরও জ্বলুনি কমলো না। মনে হচ্ছে কিছু একটা ফেলে যাচ্ছি। কিন্তু কি ফেলে যাচ্ছি?
হ্যাঁ… আমার হৃদয় টা ফেলে যাচ্ছি। সোনালী রংয়ের ম্যাপল পাতার এই উইনিপেগে।
.
দুবাই তে ট্রানজিট। সেখান থেকে সোজা বাংলাদেশ। এখন গভীর রাত। হয়ত বাংলাদেশ পৌছতে পৌছতে সকাল হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুতেই ঘুমাতে পারছিনা। উইনিপেগে গিয়ে আমি বেশ কফির পাগল হয়েছি। তাই কফির উপর কফি পান করেই যাচ্ছি। কিছুতেই কলিজার খচ খচ টা থামছেনা। বার বার শুধু দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসছে। আর কয়েক ঘন্টা পর বাংলাদেশ পৌছে যাব। কিন্তু একটুও আনন্দ বোধ হচ্ছে না। পুরো মাথা জুড়ে দুশ্চিন্তার পাহাড় বসে আছে। ব্যাগ হাতড়ে কিছু মেডিসিন পেলাম। আমি জানি এটা মারিয়ার কাজ। মাথা ব্যাথার কারণে আমার ঘুম আসবেনা ভেবে সে এটা দিয়েছে। মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ট্যাবলেট খেয়ে নিলাম। তারপর হেলান দিয়ে মাথা পিছনের সিটে রাখলাম। প্লেনের মধ্যে সব যাত্রীই ঘুমিয়ে আছে। কেউ জেগে নেই। আমার পাশের মধ্য বয়স্ক লোকটি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এয়ার হোস্টেস একটা পাতলা কম্বল আমাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। সেটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম। ভাবতে ভাবতে নিদ্রার সম্রাট কখন আমার চোখ জুড়ে বসে গেল বুঝতেই পারলাম না।
.
(চলবে)