আমার ভিনদেশি তারা পর্ব-৫৪

0
1709

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৫৪
———————————————–
যখন এয়ারপোর্টের বাইরে বেড়িয়ে এলাম তখন বাংলাদেশে ভরদুপুর। সবকিছু ঝিমিয়ে আছে। দোকান থেকে কিছু খাবার আর পানির বোতল কিনে নিয়ে অটো ডাকলাম। কিন্তু আশ্চর্য্য! একটা অটোও যেতে রাজি হল না। কেউ গামছা মুখে দিয়ে ঘুমাচ্ছে, কেউ ভাত খাচ্ছে আর কিছু অটো তে ড্রাইভারের দেখাও পেলাম না। এভাবে প্রায় আধা ঘন্টা অটো ওয়ালা দের পিছনে ঘুরলাম। শেষমেষ একটা অটো পেলাম। ড্রাইভার মাত্র ভাত খেয়ে উঠেছে। তাকে বলতেই ভাড়া চাইলো তিনগুণ। এরা বাইরে থেকে আসা মানুষ দের কি ভাবে আল্লায় জানে। এরা মনে করে বাইরে থেকে আসা মানু্ষরা টাকার বস্তা হাতে নিয়ে হাটে। অগত্য রাজি হলাম। কারণ ভর দুপুরে আমার ঝগড়া করার ইচ্ছা একদম নেই। উপরন্তু অনেক ক্লান্ত। খিদেয় পেট চো চো করছে।
অটো তে বসে সিটের পেছনে আমার ব্যাগ গুলো রাখলাম। তারপর প্রথমেই বোতল থেকে পানি খেয়ে নিলাম। পানি গুলো যেন কেমন কেমন মনে হচ্ছে। হয়ত অনেক দিন আগের পানি তাই। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। চারদিকে ভ্যাপসা গরম। হাঁসফাস করছি অনেক টা। কিছু নাস্তা নিয়েছিলাম খাওয়ার জন্য। কিন্তু গরমের চোটে খেতে পারছিনা। এখন প্রচন্ড মিস করছি উইনিপেগের শীত টাকে। বার বার স্কার্ফ দিয়ে মুখ আর গলা মুছতেছি। ড্রাইভার হয়ত খেয়াল করলো। তাই সে নিজ থেকেই বলল
“আপার কি বেশি গরম লাগতেছে?”
“হ্যাঁ! প্রচন্ড গরম পড়ছে!”
“পাংখা টা দিব?”
“কোথায় পাংখা?”
ড্রাইভার ইশারা করে ওর সামনের ছোট একটা ফ্যান দেখালো। যেটা অবিরত বাতাস ড্রাইভারের গায়ে পড়ছে।
“এটার বাতাস গায়ে লাগবে?”
“লাগবে মানে আপা! আপনি একবার খায়া দেখেন।”
ড্রাইভার গাড়ি টা একপাশে থামিয়ে ছোট ফ্যান টা আমার দিকে ফিরিয়ে দিল। বাতাস আসছে। খারাপ না। যদিও বা গরম বাতাস তারপরও নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।
এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি জেলা সদরের রাস্তা হয়ে উপজেলা সদরে পৌছলাম। দুপুরের রোদের তেজ কিছুটা কমে এসেছে। দুপুরের রোদের কারনে যে কাজের গতি যেটা ঝিমিয়ে গিয়েছিল সেটা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
কাঁধে মোটা সোটা একটা ব্যাগ আর হাতে আমার মায়ের দেয়া ট্রলি ব্যাগ টা। পায়ে হোয়াইট সু। সু পড়ার অভ্যাস টা ওখান থেকেই তৈরি হয়েছিল। এখনো সেটা আছে। পড়নে আকাশী রংয়ের ঢোলা ফতুয়া। তার উপর জিন্সের কালো কুটি। সাদা স্কার্ফ। এ পোশাকে সচরাচর শহরের মানুষ জন না তাকালেও গ্রাম সাইডের মানুষ রা ঘুরে ঘুরে তাকাবে।
আমার বাড়ি পর্যন্ত যেতে আমাকে বেশ ধকল পোহাতে হবে। প্রথমে লাইনের গাড়ি ধরতে হবে। প্রায় আট থেকে দশ কিলোমিটারের পথ। এরপরের রাস্তাটা কাচা রাস্তা। থুরথুরে বুড়ির ন্যায় দু মাস ভালো থাকে বাকি দশ মাস কাদা পানি থাকে। তারপর ওখান থেকে হাটতে হবে। ভাগ্য ভালো থাকলে রিকশা পেতে পারি।
.
লাইনের টেম্পো গাড়িতে উঠে বেশ অস্বস্থিকর অবস্থায় পড়লাম। ধুলা বালিতে আমার সমস্ত কাপড় চোপড় যাচ্ছে তাই অবস্থা। সাদা সু গুলো ধুলায় হলুদ হয়ে আছে। কিছুক্ষন পর পর হাঁচি দিচ্ছি। তার উপর ভাঙা রাস্তা। টেম্পো টা একবার এদিকে লাফাচ্ছে আরেক বার ওদিকে লাফাচ্ছে। মিথ্যা না। বাংলাদেশের জন প্রতিনিধি রা আসলেই বসে বসে ঘাস কাটে। আমি স্কার্ফে মুখ চেপে বসে আছি। আর সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। বিশেষ করে মহিলা গুলো। বোরকায় আবৃতা হলেও ওদের নজর যে আমার উপর তা আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম। আমার অবস্থা শোচনীয় হলেও অন্যান্য যাত্রীরা ছিল নির্বিকার। যেন এটা সাধারন ঘটনা।
যখন কাচা রাস্তার মুখে পৌছলাম তখন আমার অবস্থা আধা মরা। ট্রলি ব্যাগ টা নিয়ে হাটতে লাগলাম। কাঁধের ব্যাগ টাও বেশ ভারী লাগছে। কাচা রাস্তা টা নিয়ে আমি বেশ ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখি সেখানে ইট বসিয়ে পাকা রাস্তার ন্যায় করা হয়েছে। পাশে বিরাট বিল। বিলের পাশেই ঝিল। বিল দিয়েও সরাসরি আমার বাড়িতে যাওয়া যায়। কিন্তু আমি গেলাম না।
এ পাশে প্রকান্ড এক গাব গাছ ছিল। সেটা কোথায়? কেটে ফেলেছে নাকি?
ভীষণ ভয় পেতাম এ গাব গাছ টিকে। মনে হত সর্বক্ষণ ওখানে পেত্নিরা বসে আছে। আমাদের বাড়ির পিছনে বিশাল বড় এক তাল গাছ আছে। অনেক দূর থেকেও সেটা দেখা যায়। আমি দেখার চেষ্টা করলাম। আরেকটু গেলেই সেটা দেখা যাবে।
রাস্তার মধ্যে অনেকের সাথে দেখা হল। তবে আমি আগ বাড়িয়ে কারো সাথে কথা বলতে গেলাম না। কারণ এখান থেকে শেষবার আমি পালিয়ে বের হয়েছিলাম। এই কাচা রাস্তায় মামা গাড়ি ভাড়া করে এনেছিল আমি পালানোর জন্য।
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মামা কেমন আছে কে জানে?
দু একটা উৎসুক বাচ্চা আমার পিছু লেগেছে। গৃহস্থ বাড়ির উঠানের মধ্য হতে সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে তৈরি পর্দার আড়ালে উকি ঝুকি মারছে মহিলারা। দূর থেকে কার যেন গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। গান গেয়ে গেয়ে আসছে। কাছে আসতেই চিনতে পারলাম। ভোলা! ওর ভোলা ভালা চেহারা দেখে আমার দাদীই নাম টা দিয়েছিল। ছয় বছর বয়স থেকে আমার দাদীর সাথে থাকত। দাদী মারা যাওয়ার বেশির ভাগ সময় বাবার সাথেই থাকে। আমি চলে যাওয়ার সময় ও পনের/ষোল বছরের কিশোর ছিল। এখন কিছুটা প্রাপ্ত বয়স্কদের মত লাগছে। দাড়ি গোঁফ গজিয়েছে। পড়নে লুঙ্গি আর হাত কাটা গেঞ্জি। গলায় ঝুলানো নতুন গামছা। সে আমাকে দেখে থমকে গান থামিয়ে দিল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে পরখ করতে লাগল। হয়ত চিনতে পেরেছে। আমার কাছাকাছি এসে গতি থামিয়ে দিল। আমি ডাকলাম
“ভোলা!”
সে ভ্রু কুচকে গামছা শক্ত করে ধরল। তারপর সন্দিহান গলায় বলল
“মীরাপা?”
“হুম! কেমন আছিস?”
চোখ মুখ উজ্জল হয়ে উঠল ভোলার। লাফিয়ে উঠে গামছা টা কোমড়ে বাঁধতে বাঁধতে বলল
“আপনে আইছেন! আমি খালাম্মারে খবরডা দিয়া আসি!”
এই বলে দৌড় দিতে চাইলে আমি তাড়াতাড়ি তাকে ডাক দিলাম।
“ভোলা দাড়া!”
ও দাড়ালো। আমি কাঁধের ব্যাগ টা নামিয়ে ওর দিকে দিয়ে বললাম
“এ ব্যাগ টা নিয়ে যা।”
ব্যাগ টা মাথার উপর নিতে নিতে ভোলা বলল
“আইচ্ছা!”
“মা কোথায় রে? কেমন আছে?”
“খালাম্মা? খালাম্মা ভালা আছে। তয় একডু শইল ডা খারাপ। অহন আপনে আইছেন না, ভালা হইয়্যা যাইবো।”
“আর আব্বা!”
“খালু বাইত নাই। সদরে গ্যাছে। তয় বড় মামা আছে। বাজারে গ্যাছে।”
“বড় মামা?”
“হ”
“ভোলা আমাকে একটা কথা বল সত্যি সত্যি।”
“আমি কি মিছা বলমু নাকি! বলেন মীরাপা।”
“আমি যেদিন চলে গেছিলাম সেদিন কি হইছিল।”
“আপনের বিয়ের সময় আমি গেছিলাম বাজারে। বাজার থাইক্যা আসি শুনি আপনে নাই। খালু আর মামু আমারে সহ খুজতে পাঠাইলেন। পুরা গেরাম খুজছি। আপনারে পাই নাই। বড় মামু পুলিশে ফোন দিলেন। পুলিশ আইলো। খালাম্মা আর খালুর মধ্যে ঝগড়া হইলো। ছোড মামারে অনেক পিটাইলো।”
আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো
“বলিস কিরে?”
“হ মীরাপা!”
“ছোট মামা এখন কই।”
“আছে তবে এই হানে আর আসে না।”
“ওহ্!”
আমি আর কথা বললাম না। ভোলার কথায় আন্দাজ করতে পারছি কি হয়েছিল। আমার অতিসত্বর মায়ের সাথে দেখা করা দরকার।
বাড়িতে পৌছতেই প্রায় সন্ধা হয়ে এলো। পাশের মসজিদ থেকে মাগরিবের আযান শোনা যাচ্ছে। চারদিকে বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করছে। উঠানে ঢুকে আমি চারদিকে তাকালাম। প্রথমে আমার নজর গেল শরীফা খালার দিকে। উঠান থেকেই রান্না ঘরে তাকে দেখা যাচ্ছে। উঠানের একপাশে খড়ের গাদার নিচে বসে উসমান চাচা বাঁশের বড় ঝুড়ি বানাচ্ছেন। একটা বাচ্চা মেয়ে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। এটা শরীফা খালার মেয়ে মনে হয়। ভ্যা ভ্যা করে কোন কিছুর জন্য কাঁদছে।
আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম। তৈয়ব চাচা নামাজ পড়ার জন্য বেড়ুচ্ছে মাত্র। আমাকে দেখেই থমকে দাড়ালেন। আমি গিয়ে পায়ে ধরে সালাম করলাম।
“তাহমিনা নাকি!”
“হ্যা চাচু!”
“কিরে কেমন আছিস? কখন এলি?”
“এখন এলাম।”
“ভিতরে যা। তোর আম্মার সাথে দেখা করে আয়। আমি নামাজ পড়ে আসতেছি।”
ভোলা ততক্ষণে আম্মার কাছে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে। তাই আম্মা দৌড়ে চলে এলেন। তাকে ভালো করে দেখার সুযোগও পেলাম না। আম্মা আমাকে “আমার তাহমিনা, আমার তাহমিনা” বলে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। আমিও জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে। চাইছিলাম না কান্না করতে। তবুও কান্না চলে আসছিল। শরীফা খালা, উসমান চাচা, ছোট চাচী, ভোলা সবাই আমাকে ঘিরে ধরলো। মুহুর্তে এক প্রস্থ কান্না কাটির বহর চলল।
.
রাতে আব্বা আর বড় মামা একসাথে আসলেন। বড় মামা, আব্বা আর তৈয়ব চাচা এক সাথে খেতে বসলেন। খিদে ছিল বলে আমি আগেই খেয়ে নিয়েছিলাম। আমার রুমে বসে ব্যাগ থেকে বিভিন্ন জিনিস বের করছি। রুম টা আগের মত গোছানোই আছে। নিশ্চয় আম্মার কাজ। ব্যাগ থেকে জিনিস বের করতে ছোট চাচী আমাকে সাহায্য করছিলেন। ছোট চাচী যথেষ্ট শিক্ষিত মহিলা। এস এস সি পাশের পর তৈয়ব চাচুর সাথে বিয়ে হয়েছিল উনার। একটা ছেলে আছে। নাম তৈমুর। সেও এই রুমে ঘুর ঘুর করছে। কয়েকবার ডেকেছিলাম। লজ্জায় আমার কাছে আসছেনা। চাচীর সাথে বিভিন্ন কথা হচ্ছিল। কোথায় ছিলাম, কি কি দেখেছি, কি কি খেতাম? আমি বড্ড ক্লান্ত ছিলাম এসব উত্তর দিতেও আমার কষ্ট হচ্ছিল। চাচী হয়ত বুঝতে পারলেন। বললেন
“তাহমিনা তুমি শুয়ে পড়। আমি বাতি নিভিয়ে দিচ্ছি। কাল সকালে কথা হবে।”
আমি সায় জানিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আমার বিছানার অনেক পুরোনো গন্ধটা নাকে ধাক্কা দিল। একটা প্রশান্তি ছুয়ে গেল সারা শরীরে। নিজের সাথে মুড়ে নিলাম আমার প্রিয় নকশী কাঁথা টাকে। হয়ত কাল অনেক কথা শুনতে হবে। সেটা কাল দেখা যাবে। এখন ঘুমানোর দরকার। আচ্ছা লিও কেমন আছে? সে কি নিউইয়র্ক থেকে ফিরেছে? হাতের আংটি টার দিকে তাকালাম। ওর কথা সবাইকে কিভাবে জানাবো? কেউ কি মেনে নিবে এ সম্পর্ক কে?
ভালো কথা! মিসেস মারিয়া কেও ফোন করা হয় নি। ফোন টা কোথায় আমার? খানিকক্ষণ খুজলাম। পেলাম না। হয়ত কোথাও আছে। ক্লান্তির কারণে উঠে খুজে দেখলাম না। সকালে দেখা যাবে ভেবে চোখ বন্ধ করলাম। ভাবলাম আমি এখন বাংলাদেশে। আমার প্রিয় দেশে। ভাবতেই একটা উষ্ণতা ঘিরে ধরলো আমাকে। নিদ্রা ছুটে এলো চোখে। বেড়িয়ে পড়লাম নিদ্রার সাথে নিদ্রার দেশে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here