আমার_আদরিনী
আশুথিনী_হাওলাদার (ছদ্মনাম)
পর্ব-৩৮
মাস তিনেক এক ভাবে কেঁটে গেল তিয়ানার। ফ্লাট আঁটকে মেঘালয়ের সাথে। আজকাল বেশ গাম্ভীর হয়ে গেছে তিয়ানা। মেঘালয়ের সাথে ততোটা কথা বলে না কারণ বশত। মেঘালয়ে অবশ্য খুব চেষ্টা করছে তিয়ানাকে স্বাভাবিক করার তবে পেরে উঠছে না। মেয়েটা তাকে ইগ্নোর করছে তাকে পাত্তা দেয় না। তিয়ানাকে হঠাৎ চুপ হয়ে যেতে দেখে মেঘালয় মনে মনে অস্থির হয়ে আছে। বুকের ভিতর অসস্থি হচ্ছে তার। এই তো আজ সকালের কথা। খাবার খাচ্ছিলো তিয়ানা। মেঘালয় তার পাশে বসে ছিল। তিয়ানার কিছু লাগবে কি না জানার জন্য । তিয়ানার বমি বমি পাচ্ছিলো নিজে তারাহুরো করে উঠে বাথ্রুমে যেতে গিয়ে পায়ে চোট লেগে ব্যাথা পেলেও মেঘালয়কে কিছু বলে না। ভারী অবাক হয় মেঘালয় সেই সাথে কষ্টও পায় তিয়ানার ইউনোরেন্সে। মেঘালয় এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। তিয়ানাকে এতদিন ইগ্নোর করার ফল। ইশ! কি যন্ত্রণা হয় বুকে। তিয়ানারও হয়তো হতো। মেয়েটা কেমন নির্লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে সে রাগ দেখালেও কিছু বলে না ভালোবাসলেও কিছু বলে না একটা অনুভূতি শূন্য মানুষ মনে হচ্ছে তিয়ানাকে। এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঘালয়। পাশে থাকা এপ্রোনটা হাতে তুলে নিজ কেবিন থেকে বেড়িয়ে ডিউটিতে যায় সে। তিয়ানা বাসায় একা আছে কাজ শেষে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে তার।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজ প্রতিবিম্ব দেখছে তিয়ানা। সেলোয়ার কামিজ বা শার্ট প্লাজু ছেড়ে শরীরে এখন ঢিলে ঢালা ফ্রোক জড়ানো। মৃদু হেসে নিজের প্রতিবিম্বেএ দিকে চেয়ে পেটে হাত রাখে সে। তার প্রেগ্ন্যাসির পাঁচ মাস চলছে। আর মাত্র চার মাস তারপর’ই তার কোল আলো করে একটা ছোটো পুতুল আসবে। গুলুমুলু কিউট একটা বাঁচ্চা ভেবে’ই খিলখিলিয়ে হেসে দেয় তিয়ানা। বদ্ধ ফ্লাটের হাসার শব্দ গুলো প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। নিজেকে দেখে তিয়ানা। মুটিয়ে গেছে সে চেহারায় কেমন ‘মা’ মা একটা ভাব চলে আসছে। ভাবে তিয়ানা, সেও যখন তার তুলিকাএ পেটে ছিল তখনও কি তুলিকা এভাবে তার মতো আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে এমন হাসতো? বা তার আসার জন্য তার’ই মতো অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতো?
নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজে দেয় তিয়ানা, উমহুম তুলিকা অপেক্ষা ঠিক’ই করতে তার জন্য তবে তার মতো পরম মমতায় নিজ সন্তানকে আকড়ে ধরার জন্য না। নিজের বোনকে দান করার জন্য অপেক্ষা অবশ্যই করতো।’
তাচ্ছিল্য হাসে তিয়ানা।’
“বাড়ি ফিরে তিয়ানাকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে দেখে সমস্ত দিনের ক্লান্তি গুছে যায় মেঘালয়ের। বসার রুমে থাকা ওয়াশ্রুম থেকে ফ্রেস হয়ে ঘরে আসে মেঘালয় তাই কালবিলম্ব না করে ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে তিয়ানার পিছনে গিয়ে থাকে জড়িয়ে ধরে মেঘালয়। হঠাৎ কেউ তাকে জড়িয়ে ভয়ে কেঁপে ওঠে তিয়ানা। আয়নায় তাকে জড়িয়ে ধরা মেঘালয়ের প্রতিবিম্ব দেখে ভয় কাঁটে তার। মেঘালয় কখনো আসলো প্রশ্ন জাগলেও তাকে প্রশ্ন করে না তিয়ানা। মেঘালয়ের জড়িয়ে ধরায়ও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না সে। আয়না থেকে চোখ নামিয়ে ফ্লোরে দিকে দৃষ্টি রাখে তিয়ানা। মেঘালয় ভেবেছিল তার হঠাৎ জড়িয়ে ধরা নিয়ে তিয়ানা তার সাথে ঝগড়া করবে কিন্তু তার ভাবনার বিপরীতে কাজ করলো তিয়ানা। নিজেকে নির্লিপ্ত রেখে, তিয়ানার এই চুপ হয়ে যাওয়া রি নির্লিপ্ততা সহ্য হচ্ছে না। মন খারাপ হয়ে যায় তার। তিয়ানাকে ছেড়ে দিয়ে রেগে গিয়ে খাটে লাথি মেরে বেলকনিতে চলে যায় মেঘালয়৷ তিয়ানা শান্তো চোখে একবার দেখে কিচেনে খাবার রেডি করতে চলে যায়। আজ কাল মেঘালয়ের সাথে তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মেঘালয়ের তার প্রতি সমস্ত কেয়ার তার কাছে আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে। খাবার ডাইনিং টেবিলে এ সাজিয়ে চেয়ার টেনে বসে তিয়ানা। দুটো প্লেটে খাবার নিয়ে মেঘালয়ের জন্য অপেক্ষা করে সে। মেঘালয় তাকে ভালো না বাসুক সে তো বাসে। সারাদিন খেয়ে না খেয়ে হস্পিটালে ছিল মানুষটা। খেয়েছে কিনা ঠিক নেই তাই খাবার বেড়ে রাখলো সে। মেঘালয়কে মুখ ফোটে ডাকতে ইচ্ছে করছে না তিয়ানার। তাই চামচ তুলে প্লেটে শব্দ করে সে। বেল্কনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলো মেঘালয়। হঠাৎ করে লাইফটা কেমন কম্পলিকেট হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য সেসবের জন্য তো সে নিজে’ই দায়ী তবে গত তিনমাস তিয়ানার ইগ্নোর তার মনে পীড়া দিচ্ছে তাই যন্ত্রণা কাঁটানোর জন্য সিগারেটকে বেছে নিয়েছে সে। ডাইনিং থেকে চামচ টাকানোর শন্দ পেয়ে বাঁকা হাসে মেঘালয়। এমনটা প্রতিদিন হচ্ছে । খাবার জন্য তিয়ানা তাকে নিজ থেকে না ডেকে চামচ টাকানোর পন্থা অবকলন করছে। বাঁকা শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটে শেষ টান দিয়ে। শেষ হয়ে যাওয়া অংশ টুকু বেল্কনি দিয়ে ফেলে দেয় মেঘালয়। পকেট থেকে সেন্টার ফুট তুলে কিছুক্ষন চাবিয়ে ফেলে দিয়ে মুখে সামনে হাত এনে গন্ধ হচ্ছে কিনা নিশ্চিত হয়ে খেতে যায় সে। ডাইইং এ এসে চেয়ার টেনে তিয়ানার পাশে খেতে বসে মেঘালয়। মেঘালয় পাশে বসা মাত্র ভ্রু কুচকে ফেলে তিয়ানা। মেঘালয় শরীর থেকে সিগারেটর স্মল আসছে। আজ-কাল প্রায়’ই মেঘালয়ের শরীর থেকে সিগারেটের গন্ধ পায় সে। আচ্ছা! মেঘালয় কী সিগারেট খায়? ভ্রু কুটি করে তিয়ানা সন্দেহ নিয়ে মেঘালয়ের দিকে দৃষ্টি ফেরায়। খাচ্ছিলো মেঘালয়! তিয়ানাকে তাঁকানো দেখে বোকা হাসে মেঘালয়। সন্দেহ কিছুটা গাঢ় হয় তিয়ানার। ভ্রু নাচিয়ে মেঘালয়কে প্রশ্ন করে সে,
__‘আপনি কী গার্ল্ফ্রেন্ডের শোকে ইদানিং সিগারেট খাচ্ছেন?’
তিয়ানার গার্ল্ফ্রেন্ড জড়িত প্রশ্নে মন মেজাজ খারাপ হয়ে যায় মেঘালয়ের। দাতেদাত চেপে উত্তর দেয় সে,
__‘গার্ল্ফ্রেন্ডের শোকে না বউয়ের শোঁকে।’
__কেন? বউ কি মরছে?’
তিয়ানার বলা কথা শুনে মাথায় রাগ তিরতির করে বাড়ে মেঘালয়ের। এমনিতে তিয়ানার ডেলিভারির দিন যত ঘনিয়ে আসছে তার চিন্তা ততো বাড়ছে আর মেয়েটা তার সাথে মশকরা করছে। তবে তিয়ানাকে কিছু না বলে খাবার ছেড়ে উঠে যায় মেঘালয়।’
“বসার রুমে সোফায় বসে অফিসের কাজ করছিলো তুলিকা। তিলাত তার পাশে এসে ধুপধাও শব্দ করে বসে। একবার তিলাতকে দেখে কাজে মনোযোগ দেয় তুলিকা। তিলাত ঠান্ডা স্বরে জিজ্ঞেস করে,
__‘তিয়ানার কী খবর আম্মু?’
__‘মেঘ তো বলল বেটার।’
ফাইকে চোখ রেখে উত্তর দেয় তুলিকা। তিলাত চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে তুলিকার উত্তর তার পছন্দ হয়নি। সে রাগ নিয়ে বলল,
__‘তিন মাস হয়ে গেছে আম্মু মেঘ তিয়ানাকে নিয়ে গেছে। কোথায় নিয়ে গেছে সেটা অব্দি জানি না আমরা। আর তোমরা কীনা চুপ করে আছো!’
__‘তিয়ানা তোমার বোন হলেও তার এখন বিয়ে হয়ে গিয়েছে মেঘ তিয়ানার স্বামী তাই তোমার থেকে মেঘের অধিকার বেশি। মেঘালয় তার স্ত্রীকে কোথায় রাখবে কোথায় রাখবে না সেটা তার ব্যাপার। আমরা সেখানে তাকে কিছু বলতে পারি না।’
তুলিকার কতগা পছন্দ হয় না তিলাতের। টি টেবিলের উপর থাকা মাটির ফুলের টপ তুলে ফ্লোরে আঁছড়ে মেরে রাগে ফোস ফোস করে তুকিকার উদ্দেশ্য বলল,
__‘এক্সুয়াল্লি আব্বু ঠিকি বলে আম্মু। তুমি আর তোমার সো কলড মৃতু বোন দু’জনেই এক। মেঘালয় আমার বোনকে এত কশগট দেয়ার পরও তুমি সেই মেঘকেই সাপোর্ট করছো। এটা জেনেও যে মেঘ এক প্রকার তিয়ানাকে নিজের সাথে আঁটকে রেখেছে ওর অনিচ্ছা সত্যেও। তুমিও শুনে রাখো আম্মু। আমি তিয়ানার খোজ পেলে ওঁকে আমি মেঘালয়ের কাছ থেকে নিয়ে আসবো। সেটা তোমার আদরের মেঘ না চাইলেও।’
টি টেবিলের উপর জোড়ে লাথি দিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় তিলাত। খাবার শেষে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সাদিদ।ছেলের চেচামেচি শুনে শূয়া তগেকে উঠে বসার ঘরে এসে দেখে। তুলিকা হতভম্ব হয়ে ভেঙ্গে যাওয়া টি টেবিলের দিকে চেয়ে আছে। হয়তো ভাবছে, তার শান্তশিষ্ট ছেলেটা কি করে এতটা উগ্র মেজাজের হয়ে গেল। সাদিদ তুকিকা হতভম্ব চেহারা দেখে তাচ্ছিল্য হেসে চলে যেতে যেতে মনে মনে বিড়বিড়ায়,
__‘আমার সাথে অন্যায়ের শাস্তি তুমি পাবে তুলি। আমি যেমন সারাজীবন একা থেকেছি। তুমিও ঠিক এমনটাই থাকবে একদিন সবাই তোমাকে ছেড়ে যাবে। যাকে তুমি ভালোবেসেও ভালোবাসলে না সেও যাবে। শুধু অপেক্ষা মাত্র।’
চলবে?
(রিচেক করা হয়নি।
আর বাসি ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০২২’)