আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১১
__________________________
রাতটা নির্ঘুম কাটলো গাজী মিয়ার ৷ ফজরের আজান হলো , গাজী মিয়া দীর্ঘ সময় নিয়ে নামাজ পড়লেন ৷ তারপর রওনা হলেন মধুখালীর উদ্দেশ্যে ৷ মধুখালীর বড়মিয়া তাকে বেশ পছন্দ করেন ৷ বিরাট অর্থবিত্তের মালিক হয়েও গাজী মিয়াকে তিনি স্নেহের চোখে দেখেন ৷ তার ধন সম্পদের কাছে গাজী মিয়া ধুলিকনা ৷ তারপরও এই বিপদের দিনে গাজী মিয়ার বড়মীয়ার কথাই মনে পড়ে ৷ উনি কিভাবে সাহায্য করবেন তা তার জানা নেই , কিন্তু মনটা বলছে ওখানে গেলে হয়তো কোন ভালো পরামর্শ পাওয়া যাবে ৷
বিশাল দোতালা বাড়ি ৷ ঢাকা শহরেও তাদের বাড়ি আছে , কিন্তু বড়মিয়া তার পরিবার নিয়ে গ্রামেই জীবন কাটিয়ে দিলেন ৷
বড়মিয়াকে বাড়ির বাইরে বাগানে পাওয়া গেল ৷ বিশাল জায়গা নিয়ে অপরূপ সুন্দর ফুলের বাগান এ বাড়িতে ৷ গ্রাম অঞ্চলে এমন ফুলের বাগান দেখা যায় না ৷ তবে বড়মিয়া সৌখিন মানুষ , তার ব্যাপার স্যাপার আলাদা ৷ টাকা থাকলে এমন অনেক শখেরই মূল্য দেওয়া যায় ৷
আখলাক চৌধুরি , আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষ যাকে সম্মান করে বড়মিয়া ডাকে ৷ আজ তার মেজাজ চরম বিক্ষিপ্ত ৷ বউটা বারোমাসী রোগী , তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলে ঢাকা শহরে বসতি গড়েছে ৷ ছোট ছেলেটা বাউন্ডুলে স্বভাবের ৷ পড়াশোনা করল না , ব্যবসা বানিজ্যেও মন নাই ৷ ছেলের মন ফেরানোর জন্য বিয়ে করালেন , সেই বউও হয়েছে একটা বাইম মাছ ৷ ছাই দিয়েও ধরা যায় না এমন পিছলা …. সারাদিন ছেলেটার সাথে অশান্তি করে ৷ কাল রাতে ছেলেটা বোধহয় দেরী করে ফিরিছে , এই জন্য অশান্তির চুড়ান্ত করলো মেয়েটা ! এ বাড়ির পাতাও যে বড়মিয়ার নির্দেশে পড়ে , সেই বড়মিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটা সাপের মত ফনা তোলে ! এর একটা বিহীত করতেই হবে , পানি নাকের উপর উঠে গেছে ৷ তাও যদি হতো নাতী নাতনীর সুখ দিয়েছে ,তবুও ক্ষমা করা যেতো ৷ বিয়ের পাঁচ বছর গড়িয়ে ছয় বছর চলছে , এখনও আতুরঘরে ঢুকলো না বউ ! না ! এই মেয়ের ক্ষমা নাই ,চরম শাস্তি এর প্রাপ্য ৷
গাজী মিয়াকে দেখে তিনি খানিকটা অবাক হলেন , আজ না তার মেয়ের বিয়ে ! সেই বিয়েতে তো তিনি যাবেন বলে মনস্থিরও করেছেন ৷
বসার ঘরে বসে চা খেতে খেতে পুরো ঘটনা শুনলেন বড়মিয়া ৷ তার মাথার মধ্যে অন্য চিন্তা ঘুরছে ৷ তার সামনে একজন কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা বসে আছে ৷ গাজী মিয়া একেবারে ফেলনা কেউ নয় , ক্ষমতা আছে ৷ এমন একজন মানুষকে হাতের মুঠোয় পুরতে পারলে সুবিধা বই অসুবিধা নাই ৷ এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায় কী না সেটাই ভাবলেন তিনি ৷ তারপর শান্ত গলায় বললেন ,
—সবই তো শুনলাম , তা এখন কী করতে চাও মিয়া ?
—বুদ্ধি পরামর্শ করতেই তো আইলাম বড়মিয়াসাব ৷ এমনেই আমার পরিবার পাগল , আইজ মাইয়্যাডার বিয়া হইবো না এই খবর রাষ্ট্র হইলে এই মাইয়্যারে নিজ হাতে বিষ দেওন ছাড়া আমার গতি থাকবো না !
—তোমারে আমি বড়ই স্নেহ করি ৷ তোমার এইরকম বিপদ দেইখা আমার দিলে বড় ব্যথা লাগতাছে ৷ আমার কাছে একখান প্রস্তাব আছে ৷ তুমি ভাইবা দেখতে পারো ৷
—কী প্রস্তাব বড়মিয়াসাব ! আপনে যা বলবেন আমি তাতেই রাজী , খালি আমার মাইয়্যাডার একটা গতি হোক … বড় দুঃখী মাইয়্যা আমার !
—আমার ছোট পোলার বউ বাঞ্জি , ছয় বচ্ছর চলতাছে , অহনও আতুরঘরে ঢুকলো না ৷ আমি ভাবছি কম বয়সী একখান মাইয়্যা দেইখা ছোট পোলারে আবার বিয়া দিমু ৷ তা তোমার মাইয়্যা অবশ্য বাড়ন্ত , বয়স তো মনে হয় বিশ ছাড়াইছে শুনছিলাম ৷ আমার অবশ্য ষোল সতের বছরের বউ আননের ইচ্ছা আছিল ৷ কিন্তু তোমার বিপদ দেইখা পরান ফাইটা যাইতাছে ! তুমি চাইলে আমার ছোট পোলার লগে ওর বিয়া দিতে পারি ৷ আইজই বিয়া হইবো ৷ গেরামের দাওয়াতী কাউরে কিছু কওনের দরকার নাই ৷ তারা আইবো বিয়ার ভোজ খাইবো , তোমার মানও থাকবো ৷ ভাইবা দেখো ! রাজী থাকলে বাদ যোহর বরযাত্রী নিয়া যামু তোমার বাড়িত !
গাজী মিয়া এতটা আশাই করেননি ৷ কথায় বলে না বড়লোকের বড় অন্তর ! বড়মিয়াকে তার এই মুহূর্তে মানুষ না বরং ফেরেশতা মনে হচ্ছে ! এই মানুষটা এত সুন্দর একটা প্রস্তাব দিলো , এতে তার মান আরও বাড়বে ৷ বড়মিয়ার কুটুম্ব হওয়া মানে এলাকায় প্রতিপত্তি আরও বেড়ে যাওয়া ! ছেলের আগে বউ আছে এটা কোন ব্যাপারই না , বড়মিয়ার যে অবস্থা দশটা বউ পালতে পারবেন রাজার হালে ৷ আর তার মেয়ের বয়স হইছে , একেতো মা পাগল তার উপর যদি বিয়ের দিন বিয়ে ভাঙ্গে তাহলে সারাজীবন বাপের ঘরে পঁচবে ৷ এরচেয়ে ভালো বড়মিয়ার ছেলের বউ হয়ে আসুক , সম্মানও থাকবে আর খেয়ে পরে মেয়েটা সুখেই থাকবে ৷
গাজী মিয়া মুখে তেলতেলে হাসি এনে বিগলিত ভঙ্গীতে বললেন
—আপনে যা বলবেন তাই হইবো বড়মিয়াসাব ! আপনের কথা আমার লেইগা হুকুম বরাবর ৷ অভাগী মাইয়্যাডা আপনের দয়ায় ভালোই থাকবো …
*******
বাড়িতে বিয়ের রান্নাবান্না চলছে ৷ সারাবাড়িতে লোকজন ছোটাছুটি করছে ৷ গাজী মিয়া নিজে পাকানীর পাশে চেয়ার নিয়ে বসে রান্নার তদারকি করছেন ৷ বারবার বলছেন “বাপের মান রাইখো মিয়া ! তোমার বাপে আছিল অঞ্চল সেরা পাকানী , তোমার রান্ধন খাইয়া জানি লোকে হাতে তালি দেয় ”
নিপা এসবের কিছুই বুঝছে না ৷ গোসল করে একটা নতুন টকটকে লাল শাড়ী পড়ে বিছানায় বসে আছে সে ৷ শ্বশুরবাড়ি থেকে লাগেজ আসলে বিয়ের সাজ শুরু হবে ৷ কিন্তু যে বিয়েটা ভেঙ্গে গেল সেই বিয়ের জন্য এত আয়োজন কেন হচ্ছে ! তার বাবার কী তাহলে মাথাটা খারাপ হয়ে গেল মায়ের মতই ? নিপা আতঙ্কে দরদর করে ঘামতে থাকে ৷
রূপা আজ আলেয়া চাচীর সাথে অনেক দেন দরবার করে একটা শাড়ী পরার অনুমতি নিয়েছে ৷ আলেয়া চাচীর আলমারির এক তাকে তার মায়ের শাড়ি আছে কয়েকটা ৷ সেখান থেকেই একটা হলুদ শাড়ি বেছে নিয়েছে ৷ হলুদ শাড়ির জমিন জুরে নীল নীল ছোট ছোট ফুল ৷ গজগজ করতে করতেই সেই শাড়ি রূপাকে পরিয়ে দিয়েছেন আলেয়া চাচী ৷ শাড়ি একটা অদ্ভুত পোশাক , এই পোশাকে একটা কিশোরীকে দেখতেও যুবতীর মত লাগে ৷ আলেয়া চাচী মুখে শব্দের বান ছোটালেও ঝাপসা চোখে মেয়েটাকে দেখেন ৷ মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে ….. কদিন পর নিপার মত রূপাও এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ৷ সারাদিন মুখে যতই বলুক “তুই গেলে আমার হাড় জুড়ায় ” অন্তরে তো তিনি জানেন মেয়েটা চলে গেলে তার মত নিঃসঙ্গ আর কেউ হবে না ….
যুগের চিরায়ত নিয়ম , আপন মানুষকে নিঃসঙ্গ করে , নিঃশ্ব করে ছোটবেলার উঠান ছেড়ে পরের বাড়িতে চলে যেতে হয় মেয়েদের …. এটাই নিয়ম , এটার নামই সমাজ ! যে বাড়িতে বেড়ে ওঠা , চোখের নিমিষে সেই বাড়িটা বাবার বাড়ি হয়ে যাবে … আলেয়া বেগম চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদেন ৷ রূপা অবাক হয়ে দেখে তার চাচীকে ৷
এই মানুষটাকে সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলো না , কেনই বা কাঁদে , কেনই বা রাগে ….
চলবে