আমি কাউকে বলিনি সে নাম তামান্না জেনিফার পর্ব ১২

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১২
__________________________
অর্থ এমন এক জাদু , নিমেষেই সমাধা করে দিতে পারে অনেক সমস্যার ৷ আখলাক চৌধুরি ধীর স্থির মানুষ , ঠাণ্ডা মাথায় গুছিয়ে কাজ করেন ৷ কিন্তু এখন হাতে সময় কম , চার ঘণ্টার মধ্যে বরযাত্রী ,কনে সাজন সব যোগার করা খুব সহজ কাজ না ৷ কিন্তু তিনি অধৈর্য হলেন না ৷ বরং খানিকক্ষন ভেবে ঠিক করে ফেললেন কাকে কী কাজ দিবেন ৷ এরপর ডাকলেন রসুল খাঁ কে ৷ রসুল খাঁ তার ছায়া , তার ডানহাত ৷ তার সাথে সাথেই সবসময় থাকে ৷ রোবটের মত মুখ বন্ধ করে মালিকের সব হুকুম তালিম করাই তার কাজ , সে কাজ ন্যায় অন্যায় যাই হোক তাতে কিছু আসে যায় না ৷ রসুল খাঁ আখলাক চৌধুরির নির্দেশে চলে গেল গঞ্জে , সময় স্বল্পতায় শহরে পাঠালেন না তাকে বড়মিয়া ৷ তবে বলে দিলেন গঞ্জের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জিনিসগুলোই যেন কনের সাজনে আসে ৷ এবং তা সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টার মধ্যে ৷ নির্দেশ পাবা মাত্র মাথা নিচু করে ছুট লাগালো বড়মিয়ার ছায়া ….

গয়নাপত্র দরকার , গয়না ছাড়া বিয়ে হবে কিভাবে ! আর তার মান সম্মানই বা কই থাকবে ! নতুন গয়না বানানোর সময় নাই , তবে তার স্ত্রীর অনেক গয়না ৷ মেয়েমানুষ ,গয়নার প্রতি মায়া বেশি … সেই গয়না দিবে কী না এটাই চিন্তার বিষয় ৷ হঠাৎ কী একটা মনে করে ছোট বৌমাকে ডাকলেন তিনি ৷ ডাক শুনে সামনে এসে দাঁড়ালো মেয়েটি বরাবরের মতই মাথা উঁচু করে ৷ পরিবারের সবাই , তার অধিনস্ত সবাই সচারচর মাথা নিচু করেই তার সামনে দাঁড়ায় , ব্যতিক্রম এই এক মেয়ে ! কম মার তো খায় না এই ঔদ্ধত্যের জন্য ৷ চিনে জোঁকের মত তার ছেলেটার সাথে লেগে আছে ৷ অপমান তো কম হয় না , কিন্তু কোন অপমানই সে গায়ে মাখে না ৷ হাঁসের মত গা ঝারা দিয়ে সব ফেলে দেয় ৷ নিজের মত দেখি আনন্দেই থাকে , মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথের গান ছেড়ে একা একা শোনে ! এ যে কোন আজব মেয়ে আল্লাহই ভালো জানে ৷

ডাক কানে যেতেই আখলাক চৌধুরির সামনে এসে দাঁড়ালো তার ছোট ছেলের বউ সুমাইয়া ৷

—বাবা ডাকছিলেন ?

—হ , ডাক শুইনাই তো আইলা ! নাইলে আর বুড়া শ্বশুরের খোঁজ নেওনের টাইম আছেনি তোমার !

—না , বাবা ৷ থাক সেইসব , কোনো দরকারে ডাকছিলেন বাবা ?

—দরকার ছাড়া তোমারে ক্যান ডাকমু ? তোমার গয়নাগুলান নিয়া আসো তো !

—জি , আনতাছি

আখলাক চৌধুরি খানিকটা অবাক হলেন ৷ এত সহজে কাজ আদায় হবে তিনি বোঝেননি ৷ এই মেয়েটা কোন মাটি দিয়ে গড়া ! গয়নাগাটি বোঝে না না কী ! যাই হোক , এসব নিয়ে ভাবার অনেক অবকাশ পাওয়া যাবে ৷ এখন সময় কম হাতে ৷ আর গয়না দিয়েও এমন কোন মহৎ কাজ করছে না সুমাইয়া , সব তো এ বাড়ি থেকেই দেওয়া ৷ বাপের বাড়ী থেকে দুটা সুতি শাড়ি ছাড়া তো কিছু আনেনি ! এমন না যে ওর বাবা গরিব মানুষ , পরে শুনেছেন এই পাজী মেয়েই তার বাবাকে বাধ্য করেছে যেন শ্বশুরবাড়িতে কিছু না দেওয়া হয় … সমাজে আখলাক চৌধুরির একটা সুনাম আছে , যৌতুক চেয়ে সে সুনাম তো আর তিনি নষ্ট করতে পারেন না !

সুমাইয়া গয়না এনে শ্বশুরের হাতে দিচ্ছিলো তখনই শীষ বাজাতে বাজাতে ঘরে ঢুকলো ইরফান , আখলাক চৌধুরির ছোট ছেলে ৷ বাবাকে এই সময় ঘরে বসে থাকতে দেখে একটু ঘাবরে গেল সে , বাবাকে একটু ভয়ই করে সে ৷ তার কোন কাজে কখনও বাঁধা দেয় না আখলাক চৌধুরি , এই যে কাজ কর্ম করে না তারপরও কিছু বলে না … তবুও কই যেন থেকে ভয়টা আসে ৷ বাবার সামনে তোতলানো ছাড়া একটা পুরো বাক্য বলতে পারে না সে ৷

ছেলেকে দেখে গয়নাগুলো পাশে রাখতে রাখতে গম্ভীর গলায় তিনি বলেন “গাও গোসল ধুইয়া একখান নয়া পাঞ্জাবী পইরা চুপচাপ ঘরে বইসা থাকো ৷ নামাজের পর তোমারে নিয়া একখানে যাবো ৷ ঘর থেইকা কোথাও যাবা না ৷ ”

ইরফান কোন রকমে “জি বাবা” বলে বাবার সামনে থেকে সরে পরে ৷

*********

নামাজের ঘন্টাখানেক পর দশজন বরযাত্রী সহ আখলাক চৌধুরি ছেলেকে নিয়ে আসলেন বিয়ে করাতে ৷ ইরফান তখনও ভাবছে হয়তো বিয়ের দাওয়াতে এসেছে সে , আর নিপা ওদিকে আশায় বুক বাঁধছে হয়তো আজাদের নামে শোনা কথা কথাগুলো মিথ্যা ! হয়তো তার বাবা জাদুকরের মত সব ঠিক করে ফেলেছে ! হয়তো আজাদের সাথেই তার বিয়ে হচ্ছে …বিয়ে বাড়িতে নিঃশব্দে হওয়া ফিসফিস তখনও নিপার কান পর্যন্ত পৌছায়নি ! তখনও সে জানে না রান্নাঘরে , বাড়ির চারপাশে , এমনকি বাড়ির ভিতরেও সবার আলোচনার মূল বিষয় এখন একটাই “বর পাল্টায়া গেছে”

গাজী মিয়া ভেবেছিলেন কেউ বুঝবে না বাড়ির লোক ছাড়া ৷ কিন্তু অল্পসময়ের মধ্যেই সবাই জেনে গেল , সবাই নিজেদের মত করে গল্প বানালো , সে গল্পে আরো লতাপাতা যুক্ত হলো ! তবে সবটাই নীরবে , কারণ গাজী মিয়া বা বড়মিয়া কারো সাথেই বিবাদের ফলাফল যে ভালো হবে না তা তারা জানে !

যথাসময়ে বিয়ে হয়ে গেল ৷ কাজী সাহেব যখন কনের সামনে এসে ছেলে , ছেলের বাবার নাম , মোহরানা বলে সম্মতি চাইল তখনই প্রথম ধাক্কাটা খেলো নিপা ৷ তারপরও তাকে কবুল বলতে হলো ৷ সামনে আত্মীয় স্বজন , বাবার অসহায় মুখ ,উঠান ভর্তি দাওয়াতী মানুষজন …. কবুল না বলে আর কী বা করতো নিপা ! অপেক্ষা ? কার জন্য অপেক্ষা করবে সে ? যে মানুষটাকে ভালোবেসেছিল সে তো এখন জেলে বন্দী …. যে মানুষটা তাকে মিথ্যে স্বপ্ন দেখাতো ! আচ্ছা তার বাবাও তো তাকে ধোকাই দিল ! মিথ্যে বলা আর সত্য গোপন কী সমান অপরাধের না …. নিপার মনে হচ্ছিল ও জ্ঞান হারাবে , এত চাপ মাথার মধ্যে আর কতক্ষন সহ্য করা যায় ! জ্ঞান হারালেও তো কিছুক্ষনের জন্য মুক্তি মিলতো … কিন্তু করুণাময় এতটা করুণা তাকে করেননি , তাকে জীবিত রেখেন , সজ্ঞানে রেখেছেন ! হয়তো এটাও করুণাময়ের কোন পরীক্ষা ৷ নিপা কোন প্রস্তুতি ছাড়া যে পরীক্ষায় বসেছে ৷

ইরফানও ভীষন অবাক হয়েছে , বলা যায় খানিকটা রাগও ৷ সুমাইয়ার নানান ব্যবহারে তার সাথে খারাপ ব্যবহার সে করে , কিন্তু তাই বলে সুমাইয়ার জন্য সতীন আনবে সে এটা কখনও ভাবেনি ৷ তাকে আগে বলা হলে সে কিছুতেই রাজী হত না ৷ কিন্তু এই ভরা মজলিশে বাবার ভয়ে বা বাবার অসম্মানের ভয়ে সে ও কবুল বলে ফেলে ৷ বড় মসজিদের হুজুর দুই হাত তুলে নব বিবাহীত জোড়ার বিবাহীত জীবন যাতে সুখের হয় সেই দোয়া করতে থাকে ৷ ইরফান দুই ঈদের নামাজ ছাড়া আর কোন নামাজই পড়ে না ৷ তার ধর্মের জ্ঞান এটুকুই ৷ তবুও আজ যখন হুজুর সাহেব মোনাজাত ধরতে বলেন , সে দুই হাত জড়ো করে আল্লাহকে বলে “হে আল্লাহ , সুমাইয়ারে ভালো রাইখো … ”

বিয়ের খাওয়া দাওয়ার পর আর দেরী করে না বরযাত্রী ৷ নিপাকে নিয়ে নিজ বাড়িতে চলে যান বড়মিয়া সাহেব ….

********

কনে বিদায় হয়ে গেছে এমন সময় হঠাৎই এসে হাজির হয় নয়ন ৷ বোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আর তার পরীক্ষা ! শেষে পরীক্ষাটা কোনরকমে শেষ করেই বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে সে ৷ বাড়ি পৌছাতে পৌছাতে বিকেল গড়িয়ে গেছে ৷ যে বোনের বিয়ের জন্য হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো সে তাকে একটা নজর দেখতেও পারলো না নয়ন ৷ আলেয়া বেগম অবাক হয়ে দেখলো তার নিরুত্তাপ নিশ্চুপ ছেলেটা কনের গাড়ির পেছনে ছুটছে শুধু এই আশায় যদি বোনটাকে এক পলক দেখা যায় …

না , দেখা হয় না ! দৌড়াতে দৌড়াতে গ্রামের শেষ সীমানায় এসে নিজেই থেমে যায় নয়ন ৷ তার চোখ ভেজা , সামনের সবটা ঝাপসা ৷ এমন সময় কাঁধে একটা স্পর্শ পেয়ে পেছন ফিরে তাঁকিয়ে দেখে রূপা হাফাচ্ছে … রূপাকে বড্ড অপরিচিত লাগছে ৷ বড্ড মায়াময় লাগছে ৷ রূপার হাত ধরে কেঁদে দেয় নয়ন “বইনটারে দেখতেও পারলাম না , এত ডাকলাম কেউ গাড়িখান থামাইল না ”

রূপার কাছেই অভিযোগ জানাতে থাকে বোকা ছেলেটা ৷ পরম মমতায় রূপা বলে “কাইন্দেন না , কাইল তো যামু আমরা ঐ বাড়িতে ৷ কাইল তো বাসি বিয়া …”

চোখের পানি মুছতে মুছতে নয়ন বলে “যাইস তোরা ৷ কাইল আরেকখান পরীক্ষা আছে ৷ এখনি চইলা যামু আমি…”

রূপার ভেতরটা ভেঙেচুরে খানখান হয়ে যায় ! এ যে কী ভীষণ ব্যথা , যার হয় সেই বোঝে !

চলব—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here