আমি কাউকে বলিনি সে নাম তামান্না জেনিফার পর্ব ২৩

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ২৩
_________________________
অবশেষে গাড়ির ব্যবস্থা হলো ৷ জেলা শহর থেকে নয়নের বন্ধু গাড়ি জোগার করে নিয়ে আসলো ৷ সেই গাড়িও বাড়ি পর্যন্ত এলো না , রাস্তা চিকন জন্য ৷ ভ্যানে করে মূল সড়কে গিয়ে গাড়িতে উঠতে হলো …. নিপা ততক্ষনে শরীর ছেড়ে দিয়েছে , ব্যথায় আর চিৎকারও করছে না ৷ মাঝে মাঝে অর্ধেক চোখ খুলে কী যেন দেখছে ! নাদের নয়ন আর সুমাইয়া গেলো নিপার সাথে ৷ বাকীরা বাসের অপেক্ষায় রাস্তাতেই বসে রইলো ৷

হাসপাতালে পৌছার পর জরুরি ভিত্তিতে তার সিজার করানো হলো ৷ বাচ্চাটাকে দিয়ে দিলো আগেই … এতকষ্টে জন্মানো নিপার পুত্র আকাশ ফাঁটিয়ে কাঁদছে … সুমাইয়াও কাঁদছে বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে …নিপাকে তখনও বের করা হয়নি ৷ প্রায় একঘণ্টা পর নিপাকে নিয়ে গেলো আই সি ইউ তে ৷ সে কেমন আছে জানা গেলো না , তবে সবার ছোটাছুটিতে বোঝা যাচ্ছে অবস্থা বেশি সুবিধার না !

বাইরে ততক্ষনে বাকীরা এসে গেছেন ৷ নিপার শ্বশুরবাড়ি থেকেও লোকজন আসছেন ৷ ছেলে জন্ম দিয়েছে নিপা , তার শাশুড়ির তাই এগাল ওগাল হাসি ৷ অবশেষে তার বংশে প্রদীপ জ্বললো .. পুরো হাসপাতালে মিষ্টি বিলালেন বড়মিয়া সাহেব ৷ শুধু নয়ন আর নাদের গলা দিয়ে সেই মিষ্টি নামলো না কিছুতেই ৷ তাদের বোন এখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে , সেই চিন্তা আর কারও না হলেও তাদের তো হচ্ছে !

মেয়ে মানুষের না কী কই মাছের প্রাণ , কেটে ধুয়ে তেলে দেবার পরও লাফ দিয়ে বলে “মরি নাই এখনও “… সাতদিন যমে মানুষে টানাটানি শেষে নিপা বেঁচে ফিরলো ৷ এ কয়দিন বাচ্চার সব দায়িত্ব একাই সামলেছে সুমাইয়া ৷ কৌটার দুধ খাওয়া শিখে ফেলেছে , তাই মায়ের অভাব তেমন বুঝছে না শিশুটি ৷

বাচ্চার দশ দিন বয়সে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিলো ৷ নিপার শাশুড়ি কিছুতেই আর নাতীকে আলাদা রাখতে পারবেন না , নাতী তার চোখের মনি … তাই এ পক্ষের সকল অনুনয় বিনয়ের না শুনে তারা নিজেদের বাড়ি নিয়ে গেলো বাচ্চা আর মা কে ৷ নিপাও অমত করলো না , ছেলে জন্ম দিয়ে তার কেমন যেন পায়ের তলায় মাটি হয়েছে এমন অনুভূতি হচ্ছিল ৷ তাকে ঘিরে সবার এত উচ্ছ্বাস , এমনটা কখনই হয়নি এ জীবনে ! বিয়ের পর থেকে স্বামীর ভালোবাসা সে পায়নি , এখন তার স্বামীও তার যত্ন করছে , সারাক্ষন কী লাগবে না লাগবে ভেবে অস্থির হচ্ছে ! নিপার খুব ভালোলাগে , শান্তি শান্তি লাগে …

তবে শান্তি কখনও একপেশে হয় না , কিছু জ্বালা থেকেই যায় ৷ বাবুর আকিকার যেদিন হলো ইমরান রাতে গেলো সুমাইয়ার ঘরে …. কোনদিন যে অনুভূতিটা নিপার হয়নি আজ তার সেটাই হচ্ছে ৷ বুকের ভেতরে যেন আগুন জ্বলছে … বিয়ের এতদিন পরে , এক সন্তানের মা হবার পরে তার মনে হচ্ছে স্বামীর ভাগ সে কাউকে দিতে পারবে না ৷ তার স্বামী অন্য কারও ঘরে যাচ্ছে , এটা মেনে নেওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না ৷ আজকাল সুমাইয়াকেও তার অসহ্য লাগে ৷ সুমাইয়া এসে তার বাচ্চাকে কোলে নিতে চাইলে নানান অযুহাতে এড়িয়ে যায় সে …

সারারাত এক ফোঁটা ঘুম হয়নি তার ৷ সকাল বেলায় দুধের বোতল নিয়ে সুমাইয়া নিপার ঘরে আছে ৷ ওর মাথায় গামছা পেচানো , সদ্য গোসল করে এসেছে বোঝা যাচ্ছে ৷ ওকে দেখে নিপার ভেতরের রাগ যেন আগ্নেয়গিরির লাভার মত বাইরে বেড়িয়ে আসতে চায় …

—বাবারে ফিডার দিছিলা রাতে ? ফিডার বানায়ে আনছি , বাবার মুখে ধরো ৷

—আমি খাওয়াইছি , দুধ নিয়া যাও ! আর ওরে আমি ফিডার ছাড়ানোর চেষ্টা করতাছি , বুকের দুধই খাওয়ামু ৷

—হ চেষ্টা করো ৷ আল্লাহ দিলে পাবে ৷

—তোমরা ইচ্ছা কইরা পোলাটারে ফিডারে অভ্যাস করাইছো , যাতে আমার কাছ থেকে সরায়া নিতে পারো ! এখন আর দুধ মুখে নিতে চায় না ৷

—এ কেমন কথা বলো নিপা ! তুমি যে অবস্থায় ছিলা , বাঁচা মরার যুদ্ধ করতাছিলা .. ডাক্তারই বলছে বাবারে তোলা খাবার দিতে !

—মইরা গেলেই ভালো হইতো , তোমাদের এই সব নষ্টামি আর আমার সহ্য করা লাগতো না !

সুমাইয়া আর কোন উত্তর দেয় না ৷ ও আসলে কী উত্তর দিবে এটাই খুঁজে পায় না ৷ বাচ্চা হবার পর মায়েদের নানান রকম ডিপ্রেশন হয় , সুমাইয়া একবার পেপারে পড়েছিল … নিপারও বোধহয় তেমন কিছুই হচ্ছে , নয়তো এভাবে কথা তো সে বলার মানুষ না !

নিজের ঘর থেকে বের হয় না তেমন নিপা আজকাল ৷ বের হলেই সুমাইয়াকে দেখতে হবে , এটা ভেবে ভেবেই আগুন জ্বলে শরীরে ৷

রাতে ইমরান আবার রেডি হয় সুমাইয়ার ঘরে যাবার জন্য …. আজ প্রথমবার তার পথ আটকে দাঁড়ায় নিপা !

—যাওয়া হইবো না আপনের

—আরে বউ কী কও ! সুমাইয়ার ঘরে যাই , ছাড়ো ৷

—না , রাতে একলা একলা ডর করে আমার ৷ বাবা সারারাত একটু পর উঠে , আমি একলা সামলাইতে পারি না ৷

—আচ্ছা মায়েরে বলতাছি তোমার লগে শুইবো

—মা বুড়া মানুষ , তারে কষ্ট দিমু ক্যান ! পোলা কী আমার একলার আপনের না ? আপনি আমার লগেই থাকবেন , কারো ঘরে যাইতে দিমু না ৷ আপনি ঘর থেইকা বাইর হলে আমিও পোলা নিয়া ঘর থেকে বাইর হয়া যামু ৷ নিরুদ্দেশ হমু , তখন থাইকেন আপনে আপনের বাঞ্জি বড় বউ নিয়া !

নিপার কথায় ইমরান অবাক হয়ে যায় ! এসব সে কী বলছে ! তবুও কথা বাড়ায় না , চুপচাপ ছেলের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে ৷ স্বামীকে আটকে দিয়ে জয়ীর মত নিপাও গিয়ে ছেলের আরেক পাশে শুয়ে পড়ে ৷

********

সুমাইয়া নিজেকে আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে ৷ আজকাল অন্যায় দেখলেও প্রতিবাদ করে না ৷ চুপচাপ সেখান থেকে সরে যায় ৷ নিপার শাশুড়ি যে ফোঁসফোসানি স্বভাবের জন্য সুমাইয়াকে খানিকটা ভয় পেতেন , সেটা আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে ৷ প্রতিউত্তর না পাওয়ায় আজকাল তিনিও উঠতে বসতে তাকে কথা শুনাচ্ছেন ৷ এসব কারও কথা সুমাইয়ার গায়ে লাগে না , ওর বুক ফেঁটে যায় নিপার অবহেলায় …. ইমরান এখন আর সুমাইয়ার ঘরে যায় না , অশান্তি এড়াতে নিপার ঘরেই থাকে সে ৷ নিজের ভেতর হাজার খানেক প্রশ্ন নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে সুমাইয়া ৷ অনেকবারই নিপার কাছে জিজ্ঞাসা করবে ভেবেছিল , কিন্তু নিপা তাকে কোন কথা বলারই সুযোগ দেয় না , মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয় ৷

বারান্দায় বসে বাবুর গায়ে তেল ডলছিল নিপা ৷ সুমাইয়া গিয়ে তার পাশে বসে ৷ সুমাইয়াকে দেখেই মুখটা শক্ত হয়ে যায় তার ৷

—তোমার কী হইছে নিপা ?

—কী হইবো ! কিছু হয় নাই

—আমার সাথে কথা কও না যে

—কথা কওনের মত কথা খুঁইজা পাই না তাই কই না ৷

—বাবারেও একটু কোলে নিতে দেও না !

—বাবা আমার কোলেই বেশি শান্তিতে থাকে ৷ আর বাবারে কারো কাছে দিয়ে আমি শান্তি পাই না ৷

—ইমরানও আজকাল আসে না …

—ও ! এতক্ষনে আসল কথা পাড়ছো ! তা তোমার স্বামী তোমার ঘরে ক্যান যায় না আমি ক্যামনে কমু ৷ নিজের স্বামীরে আটকায়া রাখতা , আবার বিয়া করতে দিছিলা ক্যান ! এখন তার আরেক পরিবার হইছে সন্তান হইছে , এখন সে তোমার কাছে ক্যান যায় না তার হিসাব আমি কেমনে দিমু ! শোনো , এইসব আউল ফাউল প্যাচাল নিয়া আমার কাছে আসবা না ! এখন যাও , বাবারে গোসল করামু ৷

সুমাইয়ার মাথার ভেতরটা ফাঁকা মনে হচ্ছে ৷ এই মেয়েটাকে সে বোন ভেবেছিল ৷ এই মেয়েটার জন্য সবার সাথে লড়েছে সে ৷ এই কী তবে তার প্রতিদান ?

ছেলে কোলে নিয়ে গটগট করে চলে যায় নিপা ৷ সুমাইয়া উঠতে পারে না ৷ তার পায়ে আর মনে কোথাও নতুন করে উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই ৷
চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here