আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ২৯
_________________________
কারও জন্য কোন কিছুই থেমে থাকে না ৷ সময়ের প্রলেপে ঢেকে যায় পুরাতন অসুখ , নিত্য নতুন দেনা পাওনার হিসেবে জীবন জর্জরিত হয় ৷ সময় কেটেই যায় , সময় চলেই যায় ৷
*******
প্রথম প্রথম শহরে এসে রূপার মন বসতো না , বৃহস্পতিবারের ক্লাসটা করেই বাড়ির দিকে দৌড়াতো ৷ আবার শনিবারে সকালের বাসে চলে আসতো ৷ এখন আর প্রতি সপ্তাহে যাওয়া হয় না বাড়িতে ৷ পড়ার চাপ বেড়েছে , শহরের ছোট্ট মেসবাড়িতে বন্ধনও বেড়েছে ৷
কিছুদিন আগে সুমাইয়ার সাথে দেখা হলো , বেশ ভালোই আছে সে ৷ পড়াশোনা করছে , দু’চারটে বাচ্চাকেও পড়াচ্ছে বললো ৷ ইমরানের সাথে তার ছাড়াছাড়িও হয়ে গেছে বললো ৷ সে নিজেই তালাক দিয়েছে , একা একাই সে না কী বেশ ভালো আছে ৷
সুমাইয়ার সাথে দেখা হবার পর থেকে রূপার মনটা কেমন যেন ভার হয়ে আছে ৷ নিজের বোনের প্রতিও তার খানিকটা রাগ আছে — নিজে তো দিব্বি সংসার করছে , শুধু সুমাইয়ারই সংসার হলো না ৷ আবার ভালোও লাগছে , ঐ বাড়িতে থাকলে কখনই নিজে উড়াটা শিখতে পারতো না সুমাইয়া ৷ সে শক্ত ধরণের মেয়ে , নিজেকে সামলে নিয়েছে ভালোভাবেই ৷ হয়ত মনের গহীনে কোন ক্ষত থাকলেও থাকতে পারে , তবে সেই ক্ষতও সেরে যাবে একদিন নিশ্চয় ৷ যে মেয়ে ঘুনে ধরা জীবন থেকে বের হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে , সে চাইলে সবই পারবে ৷
মনকে অন্যদিকে সরাতেই রূপা নয়নকে কল করে ৷
—হ্যালো , ভালো আছো ?
—হুমম ভালো আছি ৷ তোমার মন খারাপ ক্যান ?
—কখন কইলাম আমার মন খারাপ ?
—গলার স্বর শুইনাই বুঝলাম ৷ সবই কইতে হবে না কী !
—হা হা হা ! গলার স্বর শুনে মন খারাপ বোঝা যায় না কী ? তবে আসলেই কয়দিন হলো মনডা ভালো না ৷ সুমাইয়ার সাথে দেখা হইছিল ৷ উনি ভালোই আছেন , তাও ক্যান জানি আমার খারাপ লাগতাছে ৷ খালি মনে হইতাছে নিপা আপার জন্য তার সংসার হইলো না ৷
—এই কয়দিন কল করোনি ক্যান ?
—তোমার না পরীক্ষা চলে ! পরীক্ষার সময় কথা কইয়া সময় নষ্ট করতে চাই নাই ৷ আজকে তোমার পরীক্ষা শেষ তাই কল দিছি ৷ আর একটা বছর , তারপর তোমার অর্নাস শেষ ৷
—আমার অনার্স শেষ , তোমার অনার্স শুরু ৷ আচ্ছা একটু বারান্দায় আসো তো ৷ দেখো আকাশটা কী সুন্দর আজকে !
—আকাশ দেখার জন্য বারান্দায় যাইতে মন চায় না ৷
—আরে আকাশটা দেখার সাথে সাথে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে প্রমিজ !
রূপা অনিচ্ছা নিয়ে বারান্দায় আসে ৷ আকাশের দিকে তাঁকিয়ে বলে
—হ , দেখলাম আকাশ , ভালোই
—আরে উপরের দিকে তাঁকিয়ে আকাশ দেখলে হবে ? নিচের দিকে তাঁকাও !
রূপা ইতস্তত হয়ে নিচে তাঁকিয়ে দেখে নয়ন দাঁড়িয়ে আছে ৷ কাঁধে ব্যাগ , হাতে গোলাপের তোড়া ৷ পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন নাকী বাস্তব বুঝে উঠতেই কতক্ষন চলে যায় রূপা জানে না ৷
এক দৌড়ে নিচে গিয়ে নয়নকে জড়িয়ে ধরে রূপা ৷ মফস্বল শহর , রাস্তাঘাটের মানুষ এমন দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত না ৷ সবাই বাঁকা চোখে দেখছে ! নয়ন নিজেও বিব্রত হচ্ছে ৷ রূপাকে যতই ছাড়াবার চেষ্টা করছে , রূপা ততই জোরে আকড়ে ধরছে নয়নকে ! ও যেন এখন একটা ঘোরের মধ্যে আছে , আশেপাশের কোন শব্দ ওর কানে যাচ্ছে না , আশেপাশের তীর্যক দৃষ্টিও ওর চোখে লাগছে না !
“ভাই আমাদের সাথে একটু আসেন , মুরুব্বি আপনাদের সাথে কথা বলবে ”
অপরিচিত মানুষের গলা শুনে নয়নকে ছেড়ে ওর পাশে দাঁড়ায় রূপা ৷ কতগুলো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে , রূপা এদের চেনে ৷ এরা পাড়ার বখাটে ছেলেপেলে , মেয়ে দেখলে শীষ দেওয়া যাদের প্রধান কাজ ৷ এদের বরাবরই এড়িয়ে চলে রূপা ৷ হঠাৎ এরা কেন ডাকছে মাথায় ঢোকে না রূপার ৷
“কী দরকার ভাই ?” নয়ন প্রশ্ন করে ৷
ওরা সমস্বরে হাসে ৷ তারপর ওদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরে বলে “মুরুব্বি ডাকছে আপনাদের ৷ ভদ্রভাবে বলতেছি চলেন , নাইলে অভদ্র হইতে আমাদের টাইম লাগবে না !”
ওদের সাথে না গিয়ে উপায় ছিল না ৷ ওরা চারপাশে ঘিরে হাঁটছে , কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাদের তারা জানে না ৷ খানিক দূরে একটা দোতালা বাড়ির সামনে এসে থামলো তারা ৷ গেটের বাইরে একজন দাঁড়িওয়ালা টুপি পরা মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে ৷ হয়তো এনাকেই তারা মুরুব্বি বলছিল !
“ঘরে নিয়া গিয়া দুটারে বাইন্ধা রাখ ! আমার এলাকায় রাস্তাঘাটে বেলল্লাপানা করার মজা এইবার দেখাইতেছি … যেই ফুলের মধু খাইতে খাইতে লুটায়ে পড়ছে , সেই মধুর বোঝা গলায় বাইন্ধা দিমু এইবার ! যার ঝুটা খাওন , সেই খাইবে এই আমার আইন ! ”
মুরুব্বির কথার আগামাথা কিছুই বোঝে না ওরা ! তবে একটা বিপদে যে পড়তে যাচ্ছে তা ভালো করেই বোঝে ! এতক্ষন ওদের গায়ে হাত দেয়নি কেউ , এবার দুজন লোক ওদের ধরে প্রায় টানতে টানতে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভেতর ফেলে দরজায় শিকল তুলে দেয় !
ঘরের ভেতর ভয় পেয়ে রূপা কাঁদতে শুরু করে ! এরা কী করবে তাদের ! নয়ন নিজেও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে ৷ কী করা উচিত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে ৷ মোবাইলটাও ওরা কেড়ে নিয়েছে ৷ কারও সাথে যোগাযোগ করারও উপায় নেই ৷ রূপা একেধারে কেঁদেই যাচ্ছে ….ওর কান্নার শব্দে মাথা ধরে আসছে নয়নের !
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায় ৷ ঘরের মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার ! অন্ধকারে দুটো মানুষ জড়াজড়ি করে বসে আছে নিঃশব্দে , খানিকটা ভয়ে আর খানিকটা দুঃশ্চিন্তায় ৷
সে রাতে আর দরজা খুললো না তাদের ৷ অভুক্ত , নির্ঘুম অবস্থায় একটা রাত কেটে গেল উদ্বিগ্ন এক পরিস্থিতিতে ….
চলবে