আমি কাউকে বলিনি সে নাম তামান্না জেনিফার পর্ব ৩০

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৩০
_________________________

মুরুব্বির নাম সোবহান মির্জা , রাজনীতি করেন সক্রিয়ভাবে ৷ এলাকার যত মাস্তান টাইপের ছেলে , সবাই তার পোষ মানা ৷ দাপটের সাথে এলাকায় তার বসবাস ৷ কেউ তার সাথে বিবাদে যায় না , সবাই বোঝে তার উক্তিই অলিখিত আইন ৷

সোবহান মির্জার সামনে বসে আছেন নয়নের বাবা আর নাদের মিয়া ৷ নয়নের নাম্বার থেকে রাতেই তাদের কল করে ডাকা হয়েছিল ৷ নয়নের বাবার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ভয়ার্ত শীতল স্রোত নেমে যাচ্ছে ৷ তার বুক কাঁপছে ৷ বাড়িতে আলেয়া বেগমও সারা রাত চিন্তায় আর কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে গেছে ৷ ঠিক কোন কারণে তাদের এখানে ডাকা হয়েছে এটা এখনও জানা যায়নি ৷

নাদের মিয়া অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে , “আমাদের আসলে কী জন্য ডাকা হইছে কইলে ভালো হইতো না ? আর নয়ন রূপা ওরা কই ?”

সোবহান মির্জা কুৎসিত করে হাসে ৷ তারপর ইশারা দিয়ে একজনকে বলে নয়ন রূপাকে নিয়ে আসতে ৷

সোবহান মির্জা একটা পরীক্ষা করার জন্যই এত আয়োজন করে বসে আছেন ৷ এভাবে প্রেম করা ছেলে মেয়ে ধরে নিয়ে এসে বিয়ে দেবার কাজটা তিনি আগেও করেছেন ৷ তার এই কাজটা ভালো লাগে ৷ কিন্তু প্রত্যেকবার তিনি দেখেছেন মেয়ে বিয়েতে রাজী থাকলেও ছেলে বেঁকে বসে ৷ একবার তো একজন কিছুতেই বিয়ে করবেই না , শেষমেষ তার লাইসেন্স করা বন্দুকটা মাথায় ঠেকিয়ে বিয়ে দিয়েছেন ৷ বিয়ের সময় ছেলেগুলোর মুখ যে আমসির মত হয়ে যায় না , এটা তার খুবই ভালো লাগে দেখতে ৷ প্রেম করতে খুব মজা লাগে , আর বিয়ে করার কথা বললেই চেহারা পাল্টে যায় ৷ প্রেমের সময় সোনা , ময়না আর বিয়ের কথা বললেই শালীরে আমি চিনি না … সোবহান মির্জা হেসে উঠে ৷

কেউ কারও মাথার ভেতরটা দেখতে পায় না ৷ আপনার সামনে হাসিহাসি মুখ করে বসেই কেউ যদি মনে মনে আপনার গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলে আপনি ঘুনাক্ষরেও টের পাবেন না ৷ সোবহান মির্জার মাথার ভিতরে চলা নিউরণের অনুরণন নয়নের বাবা আর ভাইয়ের জানা না হলেও মুখে দৃশ্যমান বাঁকা হাসিটা ঠিকই দৃশ্যমান হয় ৷ তারা সে হাসির অর্থ বোঝে না , বুঝতে চায়ও না ৷ তারা শুধু নয়ন আর রূপাকে সহি সালামতে দেখতে চায় ৷

নয়ন আর রূপাকে সবার সামনে আনা হলো ৷ দুজনকে বসিয়ে সোবহান মির্জা উঁচু গলায় বললেন “ওরে কাজীসাব কদ্দুর ? হালারপোর এত সুময় লাগতাছে ক্যান ? ”

তারপর হাসিমুখে নয়নের বাবার দিকে তাঁকিয়ে বলেন

—শোনেন ভাইসাব , এলাকায় আমার নিজের কিছু আইন আছে ৷ সেই আইন আমি ভাঙতে দেই না বুচ্ছেন না ?

—ভাইসাব , ওরা আসলে কী করছে ? ওরা ছোট মানুষ , ওগো মাফ কইরা দেন ৷

—ভাইসাব , মাফ পাওয়ার মতন অপরাধ হইলে আগেই মাফ কইরা দিতাম ৷ আমরা মুসলমান না কন ? মুসলমানের বাচ্চা হইয়াও এরা শরীয়ত বিরোধী কাজ করছে ৷ প্রকাশ্যে রাস্তার মধ্যে জড়াজড়ি ছি ছি ছি ! তারপর আবার সারারাত একলগে একঘরে এক বিছানায় কাটাইছে ৷ এরা তো জেনা করছে ভাইসাব ! এরার কী মাফ দেওয়া সম্ভব আপনেই কন ! জিগান ওগো , ওরা একলগে রাত কাটাইছে কী না ?

নয়নের বাবার মাথা নিচু হয়ে আছে লজ্জায় ৷ দুজনই তার সন্তানের মতো ৷ এরা এমন কিছু করতে পারে তিনি স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারেননি ৷ এত অপমানিত তিনি কোনদিনও হননি ৷ মনে হচ্ছে কেউ যেন জুতা খুলে তার গালে বাড়ি দিয়েছে ৷

নাদের মিয়ারও কান ঝা ঝা করছে ৷ সোবহান মির্জার কথাগুলো কানে না ঢুকে সরাসরি যেন মাথায় ঢুকে চাবুকের মত আঘাত করছে ! তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে

—তাইলে আপনার কী ফয়সালা চাচা মিয়া ?

—ফয়সালা আর কী ! কাজীসাব অক্ষনি আইসা পড়বো ৷ এরারে বিবাহ দিয়া দিবো ৷ কন্যার তো শুনলাম বাপ মাও নাই , আপনেরাই অভিভাবক ৷ ঠিক আছে , মিমাংসা তো করাই লাগবো ৷ বিয়া হইলে আপনাগোই ইজ্জত থাকবো ৷ কী কন ?

— আমরা ওগো বিয়া দিমু , কিন্তু আইজ না ৷ এরারে বাড়িত নিয়া যাই , আত্মীয় স্বজন আছে সবাইরে নিয়া বিয়া দিমু ৷ আপনারাও আসবেন ৷

—তা তো হইবো না ! বিয়া আইজই হইবো ৷ আমার শ্যাষ কথা ৷ আমি তো আপনাগো নাও ডাকতে পারতাম ৷ সম্মান দিয়া ডাকছি , এখন সম্মান রাখতে চাইলে কথা বাড়াইয়েন না ৷ নাইলে অন্য ব্যবস্থাও আমি জানি বুচ্ছেন না ! হে হে হে !

নাদের মিয়া কথা বলে না ৷ চারদিকে পিনপতন নিস্তব্ধতা ৷ হঠাৎ নয়ন উঠে দাঁড়ায় ৷ তারপর বলে

“রূপার লগে আমি কোন খারাপ কাজ করিনি ৷ একঘরে আপনারাই আমাগো রাখছিলেন বাইরে শিকল দিয়া ৷ ওর সাথে আমার কোন অনৈতিক সম্পর্ক হয় নাই ৷ আমি বিয়াতে রাজী না ৷ আমারে জোর কইরাও লাভ নাই ৷ বিয়া আমি করমু না এটাই ফাইনাল কথা ৷ আমরা একে অন্যরে ভালোবাসি , সময়মতো বিয়া করমু আল্লাহ যদি আমাগো জোড়া ঠিক কইরাই রাখে ৷ আজ আমার পক্ষে বিয়া করা সম্ভব না , কিছুতেই না ”

সোবহান মির্জা খিকখিক করে হাসে অশ্লীল ভঙ্গিতে ৷ তার চিন্তা মিলে গেছে ৷ এই ছেলেও বেঁকে বসেছে ৷ সবাই হাসিখুশিভাবে রাজী হলে ব্যাপারটা ঠিক জমে না , ছেলে বেঁকে বসেছে এবার মজা শুরু হবে ৷ প্রয়োজনে তার লাইসেন্স করা যন্ত্রটাতো আছেই ৷ তার মনে আজ খুব আনন্দ হচ্ছে ৷ জীবনে বাঁচতে হলে আনন্দের দরকার আছে ৷ কারও নদীর ধারে দাঁড়িয়ে টলটলে জল খাওয়ায় আনন্দ , কারও আনন্দ জলঘোলা করে কাঁদামাখা জল খাওয়ায় আনন্দ ৷ সব আনন্দই সমান , ক্ষেত্রবিশেষে শুধু পরিস্থিতি আলাদা ৷

এত উত্তেজনার মধ্যে একটা মানুষ খুব নিশ্চুপ ৷ সে রূপা ৷ এই মুহূর্তে তার চোখে মুখে চরম অবিশ্বাস ৷ এতক্ষন যা কিছু হচ্ছিলো তাতে তার কষ্ট হয়েছে , অপমানিত বোধ হয়েছে ৷ কিন্তু এখন যা হচ্ছে তার নাম তুফান ৷ ভেতরে এক ভয়ঙ্কর তুফান চলছে ! তার ভালোবাসার মানুষটা , কৈশোরের আবেগের মানুষটা বলছে তাকে বিয়ে করবে না ! তাহলে এতদিনের দেখা স্বপ্ন কি মিথ্যে ছিল ? সে কী আসলেই শুধু তার সাথে ছলনার প্রেম করেছে ? ভালো যদি বাসবেই তবে কেন অস্বীকৃতি জানাচ্ছে বিয়েতে ! কেন স্পষ্ট গলায় জোর দিয়ে বলছে সে বিয়ে করবে না …

সোবহান মির্জার রাজত্বে অপরাধীর মতামতের মূল্য নেই ৷ তার হাতে চকচকে রিভলবার ৷ গুনে গুনে ছ’টা বুলেট তাতে ভরা ৷ বুলেট খরচ করার কোন ইচ্ছে তার নেই , যন্ত্র মাথায় ঠেকলে বুলেট খরচের দরকার পড়ে না ৷ অথচ নয়ন রিভলবারের নিচে দাঁড়িয়েও একই কথা বলতেই থাকলো ৷ সোবহান মির্জার ইশারায় একজন এসে সজোরে চপোটাঘাৎ করলো নয়নের গালে ৷ এক চড়েই ঠোঁট কেটে রক্ত ঝড়তে শুরু করলো ৷

রূপা একদম নিশ্চুপ ৷ এই নয়নকে সে চেনে না ৷ তার মনে হচ্ছে অচেনা একজন মানুষের সাথে তার বিয়ে হচ্ছে ৷

অবশেষে তিন লক্ষ একটাকা দেনমোহরানা নির্ধারণ করে বিয়ে হয়ে গেলো রূপা আর নয়নের ৷ দুজনই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত ৷ অথচ গল্পটা ভিন্ন হবার কথা ছিল ৷

*****

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here