আমি কাউকে বলিনি সে নাম তামান্না জেনিফার পর্ব ১

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১
_________________________

রেললাইনের উপর পা ছড়িয়ে বসে আছে রূপা ৷ আজ চাচী তাকে খুব মেরেছে ৷ চ্যালা কাঠ দিয়ে মারের সেই দাগ এখনও রূপার পুরো শরীরে ভেসে আছে ৷ সকাল বেলা মার খেয়ে বাড়ি ছেড়েছিল রূপা ৷ ইচ্ছে ছিল রেল লাইনে ট্রেনের নিচে শুয়ে পড়বে ৷ কিন্তু সারাদিনে অন্তত চার পাঁচটা ট্রেন এলো গেলো , রূপার আর সাহসই হলো না ট্রেনের নিচে শোবার ৷ এখন সন্ধ্যে নেমে এসেছে , রূপার খুব মন কেমন করছে বাড়ির জন্য ৷ জেদ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে , এখন আবার নিজ থেকে বাড়ি ফিরতেও লজ্জা লাগছে ৷ অবশ্য আর খানিকক্ষন থাকতে পারলে চাচা নিশ্চয় তাকে খুঁজতে আসবে ৷ চাচার কারখানায় ছুটি দেয় মাগরিবের পর পরই ৷ আজান দিচ্ছে কী না বোঝাও যাচ্ছে না ৷ এখান থেকে আজান শোনা যায় না , মসজিদ বেশ দূরে ৷

রূপার এখন বেশ ভয়ও করছে ৷ সবাই বলে এই দিকটা বেশি ভালো না ৷ জ্বিন ভূতের আস্তানা ৷ রূপা উঠে দাঁড়ায় , এভাবে অন্ধকারে বসে থাকা যাচ্ছে না ৷ ক্ষিধেটাও জানান দিচ্ছে ৷ আজ সারাদিনে চাচীর মার ছাড়া তো কপালে কিছু জোটেনি ৷ এখানে বসে ভূতের হাতে আর ক্ষিধেয় মরার চেয়ে বাড়ি গিয়ে চাচীর দু চারটা গালমন্দ হজম করা সহজ ৷

রূপার বয়স তেরো ৷ সদ্য কৈশোরে পদাপর্ন করা মেয়েটির বাবা মারা গেছেন তার পাঁচ বছর বয়সে ৷ এরপর মায়ের আবার বিয়ে হয়ে গেছে ৷ রূপার মা পাঁচ বছরের রূপাকে সাথে নিয়েই নতুন সংসারে গিয়েছিলেন , কিন্তু সে বাড়িতে রূপার জায়গা হয়নি ৷ এক সপ্তাহের মাথায় দুটো নতুন জামা আর একটা খেলনা পুতুল হাতে রূপা আবার এসেছিল তার জন্মদাতা পিতার পৈত্রিক বাড়িটায় ৷ অসুস্থ বৃদ্ধা দাদী নাতনীকে ফেলে দিতে পারেননি ৷ নিজে চলতে ফিরতে পারতেন না কিন্তু যতদিন বেঁচে ছিলেন রূপার একটু হলেও যত্ন ছিল এ বাড়িতে ৷ রূপার বয়স যখন ছয় তখন তার দাদী মারা গেলো , দাদী মারা যাবার পর রূপা যেন প্রকৃত অর্থেই এতীম হয়ে গেলো ৷

দূর থেকে কেউ টর্চ লাইটের আলো ফেলছে ৷ অবয়বটা রূপার চেনা মনে হচ্ছে ৷ আলোটা আরো কাছে আসতেই রূপা বুঝলো তার চাচা মানিক মিয়া আসছে ৷ বোঝার সাথে সাথেই রূপা দৌড়ে গিয়ে চাচাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো ৷ এই মানুষটা রূপাকে ভালোবাসে , স্নেহ করে ৷ কিন্তু স্ত্রী আলেয়া বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে শক্তভাবে কথা বলার মতো মেরুদন্ড তার নাই ৷ এজন্যই লুকিয়ে লুকিয়ে যতটা সম্ভব ভাতিজির খেয়াল রাখেন তিনি ৷

চাচার হাত ধরে রূপা বাড়ি যেতে লাগলো ৷

—নবাব নন্দীনিরে খুঁইজা পাইছো ! উদ্ধার করছো আমারে ! বান্দীর ঘরের বান্দী দেমাগ দেখায়া চইলা গেলো , আবার কোন মুখে ফিরলো ! মায়ে যেমন বেসাইস্তা , মাইয়্যাও হইছে এমন ! আমি বইলা রাখতাছি নয়নের বাপ , এই বান্দী একদিন তোমার মুখে চুনকালি মাখাইবো ….

—আহ আলেয়া , হইছে ৷ একদিনের জন্য যথেষ্ট হইছে ৷ বাদ দেও , ছোট মানুষ ৷

—ছোট মানুষ কারে কও তুমি ! আরো ছয় মাস আগে মাইয়্যা সেয়ান হইছে ! আমার হইছে যত জ্বালা ৷ ঘরের কামও করো আবার বান্দীর ঘরের বান্দীরে পাহারা দেও ৷ এই বান্দী বইসা রইসোস ক্যান … যা , কলপাড়ে গিয়া থালা বাটি ধুইয়া আইনা খাইতে বস ৷ আল্লাহয় প্যাটখান দিছে , প্যাট তো না যেন দরিয়া ! ছাই দিয়েও ভরন যায় না ৷

রূপা কথার পিঠে কথার উত্তরগুলো মনে মনে দিচ্ছিলো , পরিস্থিতি বেশি উত্তপ্ত জন্য মুখে কিছু বলছিলো না ৷ আজকাল সে খুব মুখরা হয়ে গেছে ৷ আজ সকালে মারও খেয়েছে এই কথার পিঠে কথা বলার জন্য ৷ সকালে আলেয়া বেগম যখন মুখ ঝামটা দিয়ে কথা বলছিলো রূপা তখন চুপ করেই ছিল ৷ কিন্তু যখন মা তুলে গালি দেওয়া শুরু করলো তখন আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে ফেলছে ” যে যেমন মাইনষেরে তেমনই ভাবে ৷ আমার মায় বিয়া করছে কুনো পাপ করে নাই …” এই একটা কথার জন্য তাকে অতগুলো মার খেতে হলো ৷ এখনও ব্যথা করছে ৷ চাচা অবশ্য একটা নাপা ট্যাবলেট দিয়েছে ৷ বলেছে ভাত খাবার পর খেতে তাহলে ব্যথা কমে যাবে ৷

বাসন মেজে রূপা খেতে বসে চুলার পাড়ে ৷ ভাত খেয়ে নিজের ঘরে শুতে যাবার সময় রূপা গুনগুনিয়ে কান্নার আওয়াজ পায় ৷ তার চাচী আলেয়া বেগম কাঁদছে ৷ এমন মাঝে মাঝেই কাঁদে ৷ যে মানুষটার ভয়ে বাড়ির সবাই তটস্থ থাকে সেই মানুষটা কোন দুঃখে কাঁদে রূপার মাথায় ঢোকে না ৷ মানুষটা ভাত পায় , মাছ মাংসের ভালো টুকরো পায় , কেউ তাকে মারে না , কেউ তাকে খোঁটা দেয় না …. তবুও কোন দুঃখে মানুষটা কাঁদে তা রূপা জানে না ৷

জগৎটা বড়ই অদ্ভুত ৷ এখানে কেউ কারো কষ্টের কারণ জানে না ৷ কারো জানার আগ্রহও নেই ৷ মুখে আহা উহু করলেও আসলে সবাই ব্যস্ত যার যার নিজের জীবন নিয়ে ৷

বিছানায় শুয়ে ব্যথায় ঘুম আসে না রূপার ৷ শরীরের ব্যথায় না , অবর্ননীয় পেটের ব্যথায় ৷ সেই অসুখটা আবার হয়েছে ৷ রূপার মনে হয় একদিন রক্ত এভাবে যেতে যেতে সে রক্তশূন্য হয়ে মরে যাবে ৷ কেউ তাকে একটু ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যায় না ৷ গত ছয় মাস হলো প্রত্যেক মাসে তার এমন হচ্ছে ৷ রূপা খুব করে মনে করার চেষ্টা করে পুকুরে গোসল করার সময় তার গায়ের মধ্যে জোঁক ঢুকে যায়নি তো ! রূপা শুনেছে গায়ের মধ্যে জোঁক ঢুকে গেলে এমন হয় ৷ পেটের সব নাড়ি ভুড়ি কেটে দেয় জোঁক , তখন এমন রক্তক্ষরন হয় ৷ সে মনে মনে নিশ্চিত হয় এটাই হয়েছে ৷ এবার তার মরণ সুনিশ্চিত ৷ আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে কিশোরী মেয়েটা !

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here