আমি তোমাকে ভালোবাসি পর্ব-১২

0
587

#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#দ্বাদশ_পর্ব

১৮.

আজ রাশেদ খুব সকালে বেরিয়ে গেছে। ইমারজেন্সি থাকায় না খেয়ে বেরিয়ে গেছে। চন্দ্রা খুব তাড়াতাড়ি রান্না করে নিলো। যদিও রাশেদ বলেছে কেন্টিনে খেয়ে নিবে তারপরও চন্দ্রার খারাপ লাগছে। তাই ঠিক করলো রাশেদের হাসপাতালে যাবে। চন্দ্রা চট করে তৈরি হয়ে নিল। তারপর লাঞ্চবক্স নিয়ে বেরিয়ে গেল। হাসপাতালে ডুকে সে কনফিউজড হয়ে গেল। রাশেদের কেবিনটা যেন কোথায়? ভুলে গেল নাকি? কোন ফ্লোরে জানি? সব ফ্লোর তো দেখতে একই রকম। চন্দ্রা রিসেপশনিস্টের কাছে গেল। গিয়ে দেখলো অত্যাধুনিক এক রমনী বসে আছে। তার মুখে চড়া মেকআপ এবং ঠোঁটে মেরুন রংয়ের লিপষ্টিক। চন্দ্রা অবাক হলো। হাসপাতালে কেউ এভাবে সেজে আসতে পারে। রমনীকে একনজর দেখে চন্দ্রা নিজের দিকে তাকালো। এতো সাধারণভাবে এসেছে তো ওর নিজেরই লজ্জা লাগছে। ভার্সিটি লাইফের পারফেক্ট মেয়েটি যে যেকোন কারো সাথে প্রফেশনালি কথা বলতে পারতো, সবথেকে ভালো প্রেজেন্টেশন দিতো আজকে তাকে কিছুটা…না না কিছুটা না বেশ কনফিউজড দেখা যাচ্ছে। চন্দ্রার কাছে মনে হচ্ছে সে কথা বলতে ভুলে গেছে। রিসেপশনের কাছে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। রমনী অনেকক্ষণ চন্দ্রাকে খেয়াল করেছে।

এবার সে চমৎকার ইংরেজি অ্যাকসেন্টে উচ্চারণ করে চন্দ্রাকে বললো, ম্যাম হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?

চন্দ্রাী ঘোর ভাঙলো। সে ইতস্তত করে বললো, রাশেদ আছে?

কোন রাশেদের কথা বলছেন জানতে পারি?

ডক্টর রাশেদ।

রাশেদ নামে আমাদের এখানে তিনজন ডাক্তার আছেন।

রাশেদ আহমেদ, চাইল্ড স্পেশালিষ্ট।

ম্যাম তিনতলায় আছেন।

থ্যাংক ইউ।

ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম মেম।

চন্দ্রা তরতর করে ওপরে চলে গেল। রাশেদের কেবিনের সামন এসে নক করলো। কিন্তু ভেতর থেকে কোন আওয়াজ এলো না তাই সে নিজেই ডোর ঠেলে ঢুকে পড়লো। ভেতরে গিয়ে দেখে কেবিন ফাঁকা কেউ নেই। চন্দ্রা সোফায় বসে রাশেদের অপেক্ষা করছে। হাসপাতাল জায়গা বিশেষ পছন্দ নয় তার। তারপরও এখানে আসতে হলো। হয়তো এখন থেকে প্রায়ই আসতে হবে। না হলে দেখা যাবে সে না খেয়েই থাকবে। রাশেদ কেন্টিনের খাবার পছন্দ করে না। তাই না খেয়েই থাকে যেদিন খাবার না আনে। কথাটা চন্দ্রা জানতো না রাশেদের মা সেদিন কথায় কথায় বলেছিল তাই জানলো। কিছুক্ষণের মধ্যে রাশেদ ভেতরে এলো। চন্দ্রা রাশেদের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

রাশেদ অবাক হয়ে বললো, তুমি কখন এলে?

এইতো কিছুক্ষণ হলো।

হঠাৎ? কোন দরকার ছিল?

দরকার ছাড়া কেউ আসতে পারে না?

না কারন হাসপাতালে কেউ দরকার ছাড়া আসে না।

দরকারেই এসেছি।

সেটা কী?

দুপুরে খেয়েছেন?

না খাবো না। ক্ষিদে নেই। বাসায় গিয়ে খাবো একবারে।

খাবার নিয়ে এসেছি। খেয়ে নিন।

রাশেদ হা করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, সত্যি?

মিথ্যে বলার মতো কী কিছু বলেছি?

সিরিয়াসলি?

হ্যাঁ।

রিয়েলি?

হ্যাঁ।

আসলেই?

এখন কিন্তু আমি চলে যাবো।

বলেই চন্দ্রা রাগ করে উঠে চলে যেতে রাশেদ হাত ধরে টেনে কাছে আনলো, তারপর ফিসফিস করে কানের কাছে বললো, আরে বোকা মজা করছিলাম।

চন্দ্রা ফিক করে হেসে বললো, আমিও।

বলেই হাত ছাড়তে চাইলো। রাশেদ ছাড়লো না উল্টো আরো শক্ত করে ধরলো। তারপর বললো, চন্দ্রাবতী আপনি কী প্রেমেটেমে পড়েছেন নাকি?

আপনার কী মনে হয়?

মনে তো হচ্ছে আমি ঠিকই ধরেছি।

তা আপনি কী খুশি নন?

খুব। এখন চলো খাবো। ক্ষিদে পেয়েছে।

এতোক্ষণ বকবক করলেন কেন?

আচ্ছা আর করবো না। আসো।

খুব তো বলছিলেন ক্ষিদে পায়নি।

আরে ওইটা ফর্মালিটির জন্য বলেছিলাম।

আচ্ছা চলুন। আমি বেড়ে দিচ্ছি। গ্লাস, প্লেট কোথায় আছে?

তুমি সোফায় বসো আমি নিয়ে আসছি চট করে।

আচ্ছা।

রাশেদ সবকিছু এনে চন্দ্রাকে দিলো। চন্দ্রা সুন্দর করে খাবার বাড়লো। এই মেয়ে খুবই অর্গানাইজ থাকতে পছন্দ করে। সব কাজ গুছিয়ে করে। এতো গুন তার বউটার! কিন্তু বউটার কপাল খারাপ। কারন তার বর নিজেও গুছিয়ে কাজ করে। তাই তার কাজ করার সুযোগ খুব কম। কিন্তু যতটুকু করে সুন্দর করে করতে চেষ্টা করে।

চন্দ্রা রাশেদের দিকে তাকিয়ে বললো, বসুন।

চন্দ্রা তুমি খেয়েছো? রাশেদ ভাত মাখাতে মাখাতে বললো।

না। গিয়ে খাবো।

হাঁ করো।

আমি খেয়ে নিবো বাসায় গিয়ে। আপনি খান।

এখান থেকে তুমি খেলে আমার ভাগে কম পড়বে না।

অবশ্যই পড়বে। এখানে একজনের খাবার।

কিছু হবে না। নাও।

রাশেদের জোরাজুরিতে চন্দ্রা খাবার মুখে নিল। তারপর রাশেদ নিজে খেলো। খাওয়া শেষে চন্দ্রা আবার সব গুছিয়ে নিল রাশেদের কাছে গিয়ে বললো, এবার যাই।

এখনই চলে যাবে? একটু বসো আমি নিয়ে দিয়ে আসবো।

আপনি এখন চেম্বারে বসবেন না?

না এখনো সময় হয়নি। আরো পরে। চলো তোমাকে দিয়ে আসি।

না না লাগবে না। আমি যেতে পারবো আপনি রেষ্ট নিন।

রেষ্ট নেওয়ার কী হলো? রেষ্ট নিতে হবে না।

আমি কিন্তু একা চলাচল করতে পারি। এই শহরে চার বছর ছিলাম।

সেটা অন্য ব্যাপার ছিল। তখন আমি ছিলাম না। এখন আমি আছি।

কেন জেদ করছেন?

জেদের কী হলো? আচ্ছা ঠিক আছে। সিএনজিতে অন্তত তুলে দেই। সেই পর্যন্ত যাই? নাকি সেটাও করা যাবে না?

চন্দ্রা ফিক করে হাসলো রাশেদের কথার ধরনে।

সেটা করা যাবে।

তাহলে চলো।

রাশেদ ইচ্ছে করলো চন্দ্রাকে আরো কিছুক্ষণ থাকতে বলতে। কিন্তু বললো না কারন সে খেয়াল করে দেখেছে চন্দ্রা হাসপাতালে ঢোকার পর থেকে নাক কুঁচকে রেখেছে। কড়া ফিনাইলের গন্ধ হয়তো সে সহ্য করতে পারে না। যদিও কেবিনের ভেতর এতোটা ফিনাইলের গন্ধ নেই তারপরও রাশেদ বেশ কয়েকবার ঘরে এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করলো। কিছুক্ষণ সে স্বাভাবিক থাকছে কিন্তু তারপরই আবার নাক কুঁচকে ফেলছে। তাই জোর করলো না।

চন্দ্রাকে সিএনজিতে তুলে দিয়ে রাশেদ চন্দ্রাকে বললো, সাবধানে যাবে। ঠিক আছে?

চন্দ্রা মিষ্টি করে হাসলো। যার অর্থ আচ্ছা।

তারপর বললো, আপনিও সাবধানে যাবেন।

তারপর রাশেদ বয়ষ্ক সিএনজির ড্রাইভারকে বললো, চাচা ওকে সাবধানে নিয়ে যাবেন।

বয়স্ক ড্রাইভার পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসলো। রাশেদ ভাড়া দিয়ে দিল। তারপর পাশে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লো চন্দ্রার উদ্দেশ্যে। চন্দ্রা চলে গেল।

১৯.

দুইদিন পরের কথা। রাশেদদের নাইট ডিউটি ছিল।সকাল বেরিয়েছিল তারপর রাত হয়ে গেল ফিরে নি। চন্দ্রার ঘুম আসছিল না বলে বারান্দার দাঁড়িয়ে ছিল। রাত দুইটা নাগাদ চন্দ্রার ফোনে ছোট্ট একটা মিসকল এলো। মিসকলের শব্দ শুনে ফোন নিয়ে আবার বারান্দায় এলো। রাশেদের ফোন থেকে মিসকল দেখে অবাক হলো। কেন জানি ভয় লাগছে? সে কাঁপা কাঁপা হাতে রাশেদের ফোনে কল করলো। পরপর তিনবারের মাথায় কেউ একজন ফোন ধরলো। অচেনা কন্ঠটি থেকে হ্যালো শুনে তার বুকের রক্ত জমে গেল। ঘোর ভাঙলো অচেনা কন্ঠটির কথায়।

হ্যালো আপনি নিশ্চয় মিসেস আহমেদ? তাই না?

চন্দ্রা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, হ্যাঁ। আপনি কে? রাশেদ কোথায়?

উনি একটু অসুস্থ। আপনি কী একবার হাসপাতালে আসতে পারবেন?

চন্দ্রার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কী হয়েছে তার? কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কী হয়ে গেল?

কী হয়েছে উনার?

তেমন কিছু না মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। আপনি চলে আসুন।

বলেই ফোন কেটে দিলো। চন্দ্রা কথা বলতে ভুলে গেল। মনে পড়ে গেল চৌদ্দ মাস আগের সেই কালো রাতের সূচনা পর্বের কথা। সেই একই ঘটনা, একটা ফোনকল আর তারপর? তারপর সব শেষ হয়ে গেছিলো। চিরদিনের মতো কেউ একজন চলে গেছিলো। তবে কী এবারও সবকিছু শেষ? কেন বারবার তার সাথেই এমন হয়? চন্দ্রা অনুভূতি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আঁধারে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে যেন এখনো বুঝতে পারছে না কী হয়েছে? সে বারান্দায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো এতটুকুও নড়তে পারলো না। পা দুটো যেন অসাড় হয়ে আছে। পৃথিবী সমান ভার হয়ে রইলো তার বুক। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে চেতনা হারানোর পূর্বে সে সম্মতি ফিরে পেলো। না তাকে এভাবে থাকলে চলবে না। একজনকে সে হারিয়েছে। কিন্তু এই মানুষটাকে হারিয়ে ফেললে পৃথিবীতে যে সে নিজেই হারিয়ে যাবে। তার ভালো থাকার মানুষকে সে কিছুতেই যেতে দিবে না। পরর্বতী কিছু সময় চন্দ্রা ঘোরের মধ্যে ছিল কীভাবে হাসপাতালে আসলো তার কিছুই তার মনে নেই। শুধু এতটুকু মনে আছে বাড়ির মালিক শাহাবুদ্দিন সাহেবের দরজার একাধারে কলিংবেল বাজানোর পর যখন শাহাবুদ্দিন সাহেব দরজা খুললেন চন্দ্রা কান্নাভেজা কন্ঠে বলছিল, আমার খুব বিপদ একবার হাসপাতালে নিয়ে যাবেন? রাশেদের কাছে। তারপর আর তাকে কিচ্ছু করতে হয়নি নি। শাহাবুদ্দিন সাহেব নিজ দায়িত্বে নিয়ে এসেছিলেন। চন্দ্রার একবারও মনে রইলো না রাশেদের পরিবারকে একটা কল দিয়ে রাশেদের কথা জানাতে।

রিসেপশনে গিয়ে জানলো কোথায় আছে রাশেদ। তারপর এক প্রকার ছুটে চলে গেল সেখানে। ছোট্ট একটা কেবিনে রাশেদ শুয়ে আছে। তার চোখ বন্ধ। মাথায় ব্যান্জেজ। হাতে স্যালাইন চলছে। সে ভেতরে যেতে চাইলো। কিন্তু নার্স ভেতরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বের করে দিলো আর বললো, ডাক্তার এখন দেখছেন। একটু পরে আসুন। বলেই এক প্রকার ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দিলো। চন্দ্রা বাইরে এসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো কেবিনের ভেতরে। চন্দ্রা দিশেহারা হয়ে দরজার পাশে মাটিতে বসে পড়লো। পা দুটো অসাড় হয়ে গেছে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। ফুপিয়ে উঠলো সে। একটা বিশ্বস্ত কাঁধ যে এই মুহূর্তে তার খুবই দরকার।

কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বের হয়ে এলো। চন্দ্রা চোখ ভর্তি পানি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

ডাক্তার বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো চন্দ্রার দিকে। রাশেদের কিছুই হয়নি সামান্য একটা ঘটনায় চন্দ্রা এভাবে কাঁদছে।

ডক্টর, রাশেদ কেমন আছে? কী হয়েছে ওর?

রিলাক্স। সিরিয়াস কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে।

তাহলে ওর মাথায় ব্যান্ডেজ কেন?

ও সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল।

কেন পড়েছে? অস্থির কন্ঠে চন্দ্রা বললো।

ডক্টর চন্দ্রার অবস্থা বুঝতো পারলো। উনি বললেন, রাশেদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছিল। আর ঠিক তখনি সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়। তাই কিছুটা চোট পেয়েছে।

কিন্তু উনার তো ডায়াবেটিস নেই।

মিসেস আহমেদ, এটা ঠিক রাশেদের ডায়াবেটিস নেই কিন্তু হাইপোগ্লাইসেমিয়া ওর হয়েছে। হয়তো অনেকক্ষণ ধরে না খেয়ে ছিল। তাই এমনটা হয়েছে। চিন্তার কারন নেই ঠিক হয়ে যাবে। গ্লুকোজ দেয়া হয়েছে। আর এখন আপনি ভেতরে যেতে পারেন। যান ভেতরে গিয়ে দেখা করে আসুন। চাইলে থাকতেও পারেন।

চলবে……

ছয়দিন পর গল্প দিলাম। কেউ কী আমাকে মিস করেছেন? মনে হয় তো না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here