আমি তোমাকে ভালোবাসি পর্ব-১৪

0
639

#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#চর্তুদশ_পর্ব

২১.

সারাদিন কোন কাজই ছিলো না চন্দ্রার তারপরও ক্লান্ত লাগছে। কয়দিন আগেই রাশেদ চন্দ্রাকে মাস্টার্সে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছে। তাই পড়াশোনাও করতে হয় এখন। পড়তে বসেছিল সে কিন্তু উঠে পড়েছে। মাথা ভার হয়ে আছে মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। শীত শীতও লাগছে। তাই ঘড়ির কাঁটা নয়টা পেরুতেই সে শুয়ে পড়লো। রাশেদ টিভি দেখছিল রাতের খাবারের জন্য চন্দ্রাকে ডাকতে এলে দেখে চন্দ্রা ঘুমাচ্ছে। ডাক দেওয়ার পর চোখ পিটপিট করে তাকালো। রক্তলাল হয়ে আছে তার চোখ। ক্লান্ত স্বরে বললো, আপনি আর টুকু খেয়ে নিন আমি পড়ে খাবো।

কেন কী হয়েছে তোমার?

কিছু না। ঘুম পাচ্ছে। আমি একটু ঘুমাবো।

খেয়ে নাও। আমি জানি পরে তুমি খাবে না।

প্লিজ রাশেদ জোর করবেন না।

আচ্ছা ঠিক আছে।

রাশেদ চলে গেল। টুকুকে নিয়ে খেয়ে তারপর চন্দ্রার জন্য অল্প খাবার নিয়ে এলো। ঘরে এসে চন্দ্রার গায়ে হাত দিলো। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। এতোটুকু সময়ে কী হয়ে গেল? এই তো দিব্যি ঘুরে বেড়ালো ঘরে। চা বানিয়ে রাশেদকে দিয়ে সে পড়তে বসেছিল। তাই রাশেদও একটু স্পেস দিতে টিভি দেখতে চলে গেছিলো। এই মেয়ে একটু আগে কীভাবে এতো স্বাভাবিক গলায় কথা বললো কীভাবে?

চন্দ্রাকে ডাকলো রাশেদ।

চন্দ্রা উঠো।

বললাম তো পরে খাবো খেয়ে নিন আপনি।

খেয়ে নিয়েছি।

তাহলে শুয়ে পড়ুন আমি রাতে উঠে খাবো তারপর পড়তে বসবো৷ এখন একটু ঘুমিয়ে নিই।

চন্দ্রা তোমার ভয়াবহ জ্বর। থার্মোমিটার দিয়ে মাপলে ১০৩° ডিগ্রির কাছাকাছি হবে আবার বেশিও হতে পারে। উঠো। খেয়ে ঔষধ খাবে তারপর শুয়ে পড়বে।

রাশেদ প্লিজ।

উঠো তুমি কোন কথা শুনছি না।

রাশেদ চন্দ্রাকে টেনে তুললো তারপর বসিয়ে দিলো । চন্দ্রা হেলে পড়ে যেতে নিলে আবার খপ করে ধরে ফেললো রাশেদ। রাশেদ চিন্তিত গলায় বললো, এতোটা জ্বর কীভাবে বাঁধালে বলো তো?

চন্দ্রা ঘোলা ঘোলা চোখে তাকালো। রাশেদের কথা শুনতে পারলো কিনা তা বোঝা গেল না। রাশেদ চন্দ্রার পাশে বসলো। তারপর জোর করে অল্প একটু খাইয়ে দিলো। তারপর ঔষধ দিলো। তারপর শুইয়ে দিলো। চন্দ্রার এই মুহূর্তে বাস্তব জগতে কোন জ্ঞান নেই তা রাশেদ বুঝতে পারলো। সে সব কিছু গুছিয়ে শুতে এলো। রাশেদেরও শরীর বেশি ভালো না। মাথার চোটটা একটু বেশিই লেগেছে বোধহয়। একটু পর পর চিনচিন ব্যাথা করে। চন্দ্রার দিকে ফিরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ লেগে এলো৷ চন্দ্রা জ্বরের ঘোরে উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখছে। সে দেখছে একটা সরু টানেলের ভেতর দিয়ে হাঁটছে। হঠাৎ টানেলটা পাল্টে হয়ে গেল রেলস্টেশন। একটু পর পর ট্রেন আসছে আর তা চন্দ্রার গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। চন্দ্রা যতই পাশে সরুক ট্রেন তার কাছে কীভাবে যেন চলে আসে? হঠাৎ করে আবার স্বপ্ন পাল্টে গেল। সে দেখলো রাশেদ ধবধবে সাদা কাপড় পড়ে বিছানায় শুয়ে আছে। অবিকল বারসাত যেভাবে শুয়ে ছিলো। মাথায় মোটা ব্যান্ডেজ সেখান থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। তারপর ঘটে গেল ওর খুব অপ্রিয় ঘটনা। সেই ঘরে চন্দ্রা ঢুকলো। তারপর বৃদ্ধ এক ডক্টর এলো। তার বলা প্রত্যেকটি কথা রাশেদ সম্পর্কে বলছে যা বারসাতের সময়ও বলেছিল। চন্দ্রা স্বপ্নে ছটফট করতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পর রাশেদের ঘুম ভেঙে গেল মনে হচ্ছে গরম উনুনের পাশে শুয়ে আছে। চোখ মেলে দেখলো চন্দ্রা ছটফট করছে আর বিড়বিড় করছে। রাশেদ একটু মনযোগ দিয়ে শুনতে চেষ্টা করলো। কিন্তু বুঝতে পারলো না। সে আলতো স্বরে ডাকলো, চন্দ্রা।

চন্দ্রা ঘুমের ঘোরে ফুঁপিয়ে উঠলো।

কী হয়েছে?

সব কিছু আবার শেষ হয়ে যাবে রাশেদ।

কী শেষ হবে?

রাশেদও চলে যাবে।

রাশেদ হতভম্ব হয়ে গেল। সে চট করে নিজেকে সামলে বললো, কে বলেছে তোমায়?

ঐ যে ডক্টর বলছে। রাশেদ শুয়ে আছে ধবধবে সাদা বিছানায়। মাথায় ব্যান্ডেজ।

কে বলেছে এই যে আমি? তোমার পাশে।

কোথায় আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন?

চোখ খোল দেখতে পাবে।

না।

বলেই চন্দ্রা ফোঁপাচ্ছে। রাশেদ নিজে থেকে এগিয়ে গেল। এই প্রথম সে নিজে থেকে চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরলো। চন্দ্রা শান্ত হয়ে গেল। মাত্র কয়েকঘন্টা আগের সেই স্পর্শটার সাথে সে পরিচিত হয়েছিল। এতোটুকু সময়ের মধ্যে কতটা আপন মনে হচ্ছে।

চন্দ্রা আমি তোমার পাশেই আছি। খুব কাছে। চোখ খোল তাহলেই দেখতে পাবে। আমি কোথাও যাচ্ছি না তোমাকে ছেড়ে। কখনোই যাব না। সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কারো সাধ্য নেই তোমার থেকে আমাকে আলাদা করার। এগুলো তোমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা মাত্র। শান্ত হও। কিছু হয়নি।

চন্দ্রা কী জ্বরের ঘোরে কিছু বুঝলো? হয়তো বুঝেছে না হলে সে একেবারে চুপ হয়ে গেলে কেন? রাশেদের শরীর মনে হচ্ছে পুড়ে যাচ্ছে। এতোটা উত্তাপ চন্দ্রা শরীর। চন্দ্রা রীতিমতো কাঁপছে থরথর করে। চন্দ্রাকে কাঁথায় মুড়িয়ে দিয়েছে রাশেদ। আজকের সকাল থেকে সে শুধু অবাকই হচ্ছে। চন্দ্রার প্রত্যেকটা ব্যবহার রাশেদকে অবাক করে তুলেছে। এটাই কী সেই চন্দ্রা যে দিনের পর দিন পেরিয়ে যেতো কিন্তু কথা বলতো না? ঘরের ফার্নিচার বলে মতো মনে হতো তাকে। চলন্ত ফার্নিচার যে নিঃশব্দে চলাফেরা করতো। রাশেদও তাকে তার মতো ছেড়ে দিতো। কারন তার বিশ্বাস ছিলো একদিন না একদিন ঠিক হয়ে যাবে সব। তবে কী আজকেই সেই দিন? এই যে এতো ব্যাকুলতা সব কী তার জন্য ছিল? যদি তাই হয় রাশেদের থেকে বেশি খুশি আজকে আর কেউ নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঘাম দিয়ে চন্দ্রার জ্বর নেমে গেল। রাশেদ উঠে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিলো। চন্দ্রা হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে গেল। সচরাচর পরিপাটি হয়ে থাকা মেয়েটা তার জন্য এলোমেলো হয়ে গেল, জ্বর বাঁধালো, জ্ঞান হারালো। রাশেদের ভাবতেই ভালো লাগছে। যদিও তার ভালো লাগা উঠিত নয়। তার উচিত ভয়ংকর মন খারাপ করা। কিন্তু চন্দ্রার শরীর খারাপের উপলক্ষ সে সেটাই ভাবতেই তার মনে হচ্ছে সব ঠিক হয়ে যাবে। সুস্থ, সুন্দর একটা সংসার হবে তার। পাঁচ দশটা সংসারের মতোই সাধারন হবে সেই সংসার।

চন্দ্রার ঘুম ভাঙ্গলো বেশ বেলা করে। ঘড়ি না দেখেই সে বুঝতে পারলো বেশ বেলা হয়েছে। কারন ভোর থেকে সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত তাদের বারান্দায় রোদ থাকে। এখন তা নেই। চন্দ্রা পাশ ফিরে দেখলো রাশেদ উঠে গেছে। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। বহু কষ্টে উঠে চোখে মুখে জল দিলো। যদিও তার ইচ্ছে করছে গোসল করে ফেলতে তবে এখনো শীত শীত করছে। তাই মাথার তালুতে একটু জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হলো। ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলো রাশেদ বসে বসে টিভি দেখছে।

চন্দ্রার দিকে চোখ যেতেই সে হেসে বললো, ম্যাডামের ঘুম ভাঙলো তবে।

হ্যাঁ। সরি দেরি হয়ে গেল।

কোন ব্যাপার না। জ্বর কমেছে?

হ্যাঁ।

খাওয়ার পর আবার ঔষধ খেয়ে নিয়ো।

আচ্ছা ঠিক আছে। একটু বসুন কিছু করে দেই খাননি মনে হয়ে তাই না?

না খাইনি। তোমার জন্য বসে আছি।

একটু সময় দিন কিছু বানিয়ে আনি। চা খেয়েছেন?

হ্যাঁ। এটা খেয়েছি। তোমাকে এখন আর কিছু করতে হবে না। খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

কীভাবে? আবার দোতলার চাচা খবার দিয়ে গিয়েছিলেন নাকি? চন্দ্রা অবাক হয়ে বললো।

জ্বি না ম্যাডাম। আপনার বর টুকিটাকি রান্না করতে পারে।

তাই নাকি কখনো শুনলাম না তো?

শুনতে চাওনি তাহলে বলবো কীভাবে? নিজের ঢোল তো নিজে পেটানো যায় না তাই না?

চন্দ্রা হাসলো তারপর বললো, এসবের দরকার ছিলো না রাশেদ। কেন করেছেন?

তোমার জ্বর ছিল। রাতে প্রলাপ বকছিলে। তাই অবস্থা দেখে তুমি কীভাবে ভাবলে আমি তোমাকে রান্নাঘরে যেতে দিবো?

প্রলাপ বকছিলাম সত্যি?

হ্যাঁ।

কী বলেছিলাম?

সেটা তো বলা যাবে না। সিক্রেট সিক্রেট। বলে রাশেদ মুখ টিপে হাসলো।

চলো খেয়ে নিই।

চলুন।

চন্দ্রা টেবিলে গিয়ে দেখলো আটার রুটি আর আলুভাজি করেছে রাশেদ। পার্ফেক্ট গোল হয়েছে। এতো গোল চন্দ্রাও করতে পারে না। রুটি পাতে নেওয়ার পর চন্দ্রা বুঝতে পারলো রাশেদ কোনকিছু দিয়ে কেটে রুটি গোল করেছে। সে মৃদু হাসলো। যদিও খাবারের কোন টেস্ট পাচ্ছে না তারপরও জোর করে খেয়ে নিলো। হঠাৎ করে চন্দ্রার ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে। সেদিনের সেই লেকটায়। রাশেদকে বললে কী সে নিয়ে যাবে? অবশ্যই নিয়ে যাবে। রাশেদ কোন সময়ই চন্দ্রাকে না করে না কোন বিষয়ে। এটা রাশেদের সব থেকে বড় গুন। তার থেকেও বড় গুন হলো তার রাগ খুবই কম। বিয়ের এতো মাসেও রাশেদকে হাতে গোনা কয়েকদিন রাগ করতে দেখা গেছে। কোন সময় চন্দ্রাকে কিছু নিয়ে জোর করে না। চন্দ্রা মনে মনে ভাবে এতো সুন্দর মনের মানুষের সাথে সে প্রথম প্রথম কী ব্যবহারটাই না করতো? রাশেদ ঘরে থাকলে সহজে তার সামনে আসতো না। সে আর রাশেদ রুমে একসাথে থাকলে চন্দ্রা দূরে দূরে থাকতো। এমন নয় রাশেদ খেয়াল করে নি। সে খেয়াল করতো। কিন্তু কিছু বলতো না। মাঝে মাঝে রাশেদ নিজে থেকে কথা বলতে এলে হ্যাঁ না তে জবাব দিতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পুরোই পাল্টে গেছে। চন্দ্রা এখন কথা বলে রাশেদের সাথে। রাশেদের সুবিধা অসুবিধা জানতে চায়। রাশেদ ঘরে থাকলে তার ইচ্ছে করে রাশেদের পাশে পাশে থাকতে। তবে কী চন্দ্রা আবার নতুন করে ভালবেসে ফেলেছে রাশেদকে? এক জীবনে কী ভালোবাসা দুইবার আসে? কীভাবে সম্ভব তা? পরশু রাতের কথা মনে হলে চন্দ্রার এখনো বুক কেঁপে উঠে। রাশেদের জ্ঞান ফেরার পর যখন চন্দ্রা রাশেদকে জড়িয়ে কাঁদছিলো তখনের রাশেদের করা প্রশ্নটায় সে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল। সত্যিই তো এতোটা কবে ভালবাসলো সে? তারপরই তীব্রভাবে নিজেকে তিরস্কার করলো চন্দ্রা। না না এটা ভালেবাসা না। আমি চাই না এটা ভালোবাসা হোক। ভালবাসলেই যে সে হারিয়ে যাবে। দ্বিতীয়বার হারিয়ে ফেললে সে আর সহ্য করতে পারবে না। মরে যাবে একবারে মরে যাবে। ভালবাসতেই হবে এমন তো কোন কথা নেই। এই তো বেশ আছি। অনেক ভালো আছি। না চাইতেই অনেক কিছু পেয়েছি। যে বিয়ে, সংসারের কোন মানেই ছিল না তার কাছে আজকে তার মনে হয় এই ঘরের প্রত্যেক জিনিস তার। এই ঘরের প্রত্যেকটা জিনিস নিয়ে তার ছোট্ট সংসার তবে ভরা সংসার। ভালবাসাবিহীন এই সংসারে সে যে এতোটা সুখী তাই অনেক। আর কিচ্ছু চাই না জীবনে। আর কিচ্ছু না।

চন্দ্রাকে কী বুঝতে পেরেছিল যেটাকে সে ভালোবাসাবিহীন সংসার বলেছে সেটা আদোও তা নয়। এই সংসারের প্রতিটা জায়গায় আছে রাশেদের প্রগাঢ় ভালবাসা। চন্দ্রার অজান্তেই সে ভালবাসার প্রাচীর তুলে দিয়েছে চারপাশে। আচ্ছা চন্দ্রা কী এটাও বুঝতে পারছে না যে সে কী ভীষন তীব্রভাবে তার পাশে বসে থাকা মন দিয়ে রুটি আর আলুভাজি খাওয়া মানুষটার প্রেমে পড়েছে? এই মানুষটার যখন প্রতিদিন হসপিটালের যাওয়ার সময় হয় তখন কী চন্দ্রার মন খরাপ হয় না। একবারের জন্য কী মনে হয়ে এই মানুষটা যাতে না যায়। তার কাছে বসে থাকুক। এক মুহুর্তের জন্য মানুষটা যেন চোখের আড়াল না হয়। হয় সব হয় কিন্তু তা সে বুঝতে পারে না। এগুলো কী ভালোবাসা না? সত্যিই কী দ্বিতীয়বার কেউ প্রেমে পড়ে না? কী মনে হয়?

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here