আমি তোমাকে ভালোবাসি পর্ব-৫

0
801

#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#পঞ্চম_পর্ব

৯.

রাশেদ হাসপাতাল থেকে ফিরে ফ্রেশ চন্দ্রার খোঁজে ছাদে এলো। এই মেয়ে রাতবিরাতে ছাদে এসে বসে থাকে। দরজা খোলা রেখেই মাঝে মাঝে চলে আসে।

চন্দ্রা এতো রাতে ছাদে কী করছো?

হঠাৎ পেছন থেকে কথা শুনে চন্দ্রা চমকে উঠলো। চন্দ্রা পেছন ফিরে দেখলো রাশেদ ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

রাশেদের কথার উত্তর না দিয়ে চন্দ্রা বললো, নিচে চলুন খেয়ে নিবেন। অনেক রাত হয়েছে।

বলেই সে রাশেদকে পাশ কাটিয়ে নিচে চলে গেল। রাশেদ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো। সে অনেক চেষ্টা করছে সম্পর্কটা ঠিক করার জন্য। কিন্তু এটা ঠিক করার জন্য তার পাশাপাশি অপরজনকেও কো-অর্পারেট করতে হবে। যা চন্দ্রা করছে না। সে চাইছেই না সম্পর্ক এগিয়ে যাক। রাশেদের পক্ষে একা সবকিছু ঠিক করা সম্ভব না। এদিকে সে তাকে সময়ও দিতে পারে না। ডাক্তারি পেশায় নতুন জয়েন করায় তাকে অনেকটা সময় হাসপাতালে দিতে হয়। সবাই মনে করে ডাক্তারি পড়া শেষ হবার পরেই মোটা অঙ্কের টাকার বেতনের চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা কতটা ভুল তা কেউ জানে না। অনেকের তো চাকরি পেতেই কষ্ট হয় সেদিক থেকে রাশেদ ভাগ্যবান তাকে চাকরি নিয়ে এতো খাটতে হয়নি। হয়ে গেছে কিন্তু এতে বেতন মোটামুটি তারপরও সে করছে। রাশেদ নিচে নেমে গেল। খেতে বসে দেখলো অনেক আইটেম।

রাশেদ বললো, এতো খাবার রান্না করেছো কেন?

আমি করিনি। দুইতলার চাচা দিয়ে গেছেন।

ওহ আমি তো ভুলেই গেছিলাম আজ উনার ছোট ছেলের ঘরের নাতির আকিকা ছিল। আমাদের তো দাওয়াত ছিল। তুমি যাওনি?

না।

ও আচ্ছা। আমিও ভুলে গেছিলাম। মনে থাকলে বাবুটার জন্য কিছু কিনে আনতাম। কাল আসার সময় নিয়ে আসবো তুমি গিয়ে দিয়ে আসবে।

আমি যেতে পারবো না আপনি দিয়ে আসবেন।

কেন? উনি তোমাকে কত স্নেহ করেন তুমি ওদের বাসায় গেলে উনি খুশি হবেন।

যাব না তো বললাম।

আচ্ছা যেতে হবে না।

বলেই রাশেদ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার খাওয়ায় মন দিল।

দুইতলায় রাশেদদের বাসার মালিক থাকে। চন্দ্রাকে সাথে করে রাশেদের হাসপাতালের কাছাকাছি একটা বাসায় উঠেছে। ভাড়া বাসা। চারতলা বিল্ডিং। দুতলায় মালিক শাহাবুদ্দিন খান নিজে থাকে তার পরিবার নিয়ে, নিচতলায় গ্যারেজ তার উপরে তিনতলায় রাশেদ বাসা নিয়েছে। ছোট্ট একটা বাসা। একটা বেডরুম ড্রয়িং ডাইনিং রুম একসাথে তারপাশে একটা স্টোররুম, রান্নাঘর, বাথরুম আর ছোট্ট একটা বারান্দা। হাসপাতাল থেকে রাশেদের বাসা খুবই দূরে ছিল তাই হাসপাতালের কাছাকাছি এই বাসাটা নেওয়া।

এই বাড়ির মালিক কোন একটা কারণে চন্দ্রাকে খুবই পছন্দ করে। নাহলে কোন বাড়ির মালিক বাসার ছাদের চাবি ভাড়াটিয়ার কাছে দিয়ে বলে না,

মা এটা তুমি রেখে দাও। যখন ইচ্ছে ছাদে যাবে। আমি প্রায়ই দেখেছি তুমি ছাদে গিয়ে বসে বসে আকাশ দেখো। আকাশ দেখা ভালো। আকাশ দেখলে মানুষের মনও আকাশের মতো বিশাল হয়। প্রত্যেক মানবসন্তানের উচিত ভাত খাওয়ার মতো তিন বেলা আকাশ দেখা। ঠিক বলেছি না? নাও চাবি নাও আমার দরকার লাগলে আমি তোমার কাছ থেকে চেয়ে নিব। অবশ্য আমাদের বাসার কেউ ছাদে উঠে না। নিচে উঠোন থাকার সেখানেই কাপড় শুকায়।

বুঝলেন রাশেদ সাহেব আপনাদের আমার খুবই মনে ধরছে। আপনার বিবিও খুব ভালো মানুষ। মাটির মানুষ আপনারা। বৃহস্পতিবার দুপুরে আপনারা এই গরীবের বাসায় দুইটা ডাল ভাত খাবেন। এইটা এই গরীবের আবদার।

ওইদিন কী কোন অনুষ্ঠান?

জি আমার ছোট ছেলের ঘরের নাতির আকিকা।

আমি তো যেতে পারবো না। হাসপাতালে থাকবো। চন্দ্রা যাবে ঠিক আছে?

বুঝলেন রাশেদ সাহেব আপনারা হচ্ছেন শিক্ষিত মানুষ। জ্ঞানের কথা জানেন। আপনাদের কথা বলতেই ভালো লাগে তাই আসি। আর চন্দ্রা মাকে নিয়ে কী বলবো! কী মিষ্টি চেহেরা মাশাল্লাহ! কথাও সুন্দর। আমি শুনলাম সে সিলেটি কিন্তু ভাষায় কোন সিলেটি টান নাই। একদম ফকফকা শুদ্ধ বলে।

আসলে ওর মা বাবা সবসময় ওদের সাথে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতো। তাই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে গেছে তবে এমন না যে সিলেটি জানে না। সিলেটি ভাষায়ও কথা বলতে পারে।

ও আচ্ছা। দেছেন তো কত সুন্দর কথা বলেন আপনারা! কথা বললে বলতেই মন চায়। আমার ঘরে তো এমন কথা বলার কোন জো নাই। বুঝলেন আমার ঘরে আছে দুই গাধা পুত্র। এরা গাধা এরা আনছেও গাধা বউ। একটারও বুদ্ধি নাই। এইযে আমারে দেখেন এই বয়সেও কাজ করতে হয়। এরা কাজ করে কিন্তু একটাকা সংসারে দেয় না। সব টাকা যে কী করে কী জানে? বুঝলেন শুধু মান ইজ্জতের ভয়ে কিছু করি না। না হলে কবেই এদের দুই ভাইরে বউসহ লাথি দিয়া বাইর কইরা দিতাম।

যে ছেলেদের দেখতে পারেন না তার ছেলের জন্য আকিকা দেন ব্যাপারটা কেমন দেখায় না?

আরে ওই যে বললাম এলাকায় মান ইজ্জত আছে তাই না চাইতেও দিতে হয়। আচ্ছা, এখন উঠি। আপনার বিবি কোথায় গেল? তাকে ডাক দিন রাশেদ সাহেব। তাকেও বলে যাই।

চন্দ্রার শরীর বেশি ভাল না তাই বোধহয় শুয়ে আছে। আমি ডেকে দিচ্ছি আপনি বসুন।

না না ডাকতে হবে না। আপনি বলে দিয়েন। আচ্ছা রাশেদ সাহেব আমি এখন উঠি।

আচ্ছা। চাচা একটা কথা আপনি আমাকে তুমি করে বলুন আর শুধু রাশেদ ডাকেন। আপনি আমার বাবার বয়সী।

ঠিক আছে।

বলেই হেসে উঠে চলে গেলেন। ভদ্রলোক এম্নিতে ভালোই কিন্তু প্রত্যেক কথা একবার করে রাশেদ সাহেব বলেন এটা রাশেদের কাছে ভালো লাগে না।

রাশেদ খাবার শেষ করে শুয়ে আছে। রান্নাঘর থেকে টুকটাক শব্দ আসছে। বোধহয় চন্দ্রা কিছু করছে। ওর জন্য একটা কাজের মেয়ে ঠিক করে দিতে হবে। ছোট কম বয়সী যাতে সে চন্দ্রার সাথে কথা বলে সারাদিন। টুকটাক কাজও করে দেয়। শাহাবুদ্দিন সাহেবকে বলে দেখতে হবে। উনি খুজে দিতে পারেন তার অনেক অনেক চেনা জানা। কালই বলতে হবে। চন্দ্রা শুতে এলো আধাঘন্টা পর। রাশেদ তখনো সজাগ। তার খুব ইচ্ছে করছে চন্দ্রার সাথে কথা বলতে, গল্প করতে। হাতপাতালে রোজ কত ঘটনা ঘটে সেসব বলতে অথবা চন্দ্রাকে বলতে, জানো তোমার মতো একজন আমার জীবনেও ছিল। তোমার সে চলে গেছে চাইলেই তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না কিন্তু আমার সে আমাকে স্বইচ্ছায় ছেড়ে চলে গেছে আমি তাকে নিজের কাছে রাখতে পারিনি। রাশেদের চোখ লেগে গেল। হঠাৎ করে তার ঘুম ভেঙে গেল তার মনে হচ্ছে চন্দ্রা কাঁদছে। তার পাশ ফিরে তাকালো। চন্দ্র অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে।

রাশেদকে চন্দ্রাকে ডাক দিয়ে বললো, চন্দ্রা তুমি কী কাঁদছো?

কান্নার শব্দ থেমে গেল। কিন্তু ড্রিম লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চন্দ্রা কেঁপে উঠছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চন্দ্রা আবার আস্তে আস্তে শব্দ করে কাঁদছে।

রাশেদ চন্দ্রা কাঁধে হাত দিয়ে আবার বললো, চন্দ্রা তুমি কী কাঁদছো? কাঁদছো কেন?

চন্দ্রা জবাব দিলে না।

চন্দ্রা আমি শব্দ পাচ্ছি তুমি কান্না করছো। কান্নার কী হয়েছে বলো?

চন্দ্রা আচমকা পিছন ফিরে রাশেদকে হতভম্ব করে দিয়ে জরিয়ে ধরলো। উষ্ণ কোমলতা অনুভব করলো রাশেদ। কান্না শব্দ বাড়তে লাগলো। হেঁচকি তুলে কাঁদছে সে। রাশেদ কী বলবে বুঝতে পারছে না। চন্দ্রার শরীর সামান্য গরম।

সে নিজেকে সামলে রাশেদকে বললো, চন্দ্রা কী হয়েছে? বাড়ির কথা মনে হচ্ছে?

চন্দ্রা মাথা নাড়লো দু’দিকে। যার অর্থ না।

তাহলে কী হয়েছে?

চন্দ্রা হেঁচকি তুলে বললো, কষ্ট হচ্ছে।

কেন?

আমাকে একজায়গায় নিয়ে যাবেন?

যাব। কিন্তু তার আগে কান্না থামাও।

চন্দ্রা তা না শুনে বললো, আমাকে বারসাতের কাছে নিয়ে যাবেন?

রাশেদ তার হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠেছিল। কিন্তু আবার হতভম্ব হয়ে গেল। এই প্রথম কোন স্ত্রী তার স্বামীকে বলছে তাকে তার প্রেমিকের কাছে নিয়ে যেতে। যে প্রেমিক মৃত।

কী বললেন না নিয়ে যাবেন কিনা?

হ্যাঁ। নিয়ে যাব। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিয়ে যাব। এবার ঘুমাও।

বারসাত বলেছিল সে আমাকে ছেড়ে যাবে না কেন গেল তবে? ও স্বার্থপর তাই না?

আমার জানা নেই চন্দ্রা।

আমাকে নিয়ে যাবেন?

হ্যাঁ।

সত্যি?

হ্যাঁ।

চন্দ্রা নিমিষেই ঘুমিয়ে গেল। রাশেদকে চন্দ্রার হাত ছাড়িয়ে ঠিক করে শুইয়ে দিলো। রাশেদ জানে এই জ্বরের ঘোরের কথাগুলো সকালে চন্দ্রার কিছুই মনে থাকবে না। রাশেদ নিজের জায়গায় এসে শুয়ে পড়লো। মনে মনে ভাবতে লাগলো, আচ্ছা তানিয়া কী আমাকে চন্দ্রা যেমন বারসাতকে ভালোবাসে তেমন ভাবে ভালেবাসতে পারতো না। আজকাল তানিয়ার কথা মনে পড়ে না। তবে যখন দেখে চন্দ্রা বারসাতের কথা ভাবে বা ভেবে কাঁদে তখন বুকের ভেতর কেমন জানি চিনচিন করে ব্যাথা করে। বারসাতের কথা ভাবলে রাশেদের খুব হিংসে হয়। চন্দ্রা নামের এই মেয়েটা তার সমস্ত ভালোবাসা বারসাত নামের মানুষটিকে উৎসর্গ করে দিয়েছে যার অস্তিত্ব অনেক আগেই হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। তানিয়া তার জীবন থেকে নিজ ইচ্ছায় চলে গিয়েছিল। তবে রাশেদ তাকে সত্যিই খুব ভালোবাসতো। কিন্তু তাই বলে যাবার সময় আটকায় নি। কারন যে থাকবে না তাকে আটকে রাখার কোন মানে হয় না। রাশেদের তানিয়াকে শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত একটা উক্তি বলতে ইচ্ছে করছে,

“আমি ঠকিনি, কারন আমি ভালোবাসতে পেরেছিলাম
কিন্তু ঠকেছে সে কারন সে ভালবাসতে পারেনি ”

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here