#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#ষষ্ঠ_পর্ব
১০.
ছুটির দিন। চন্দ্রা রান্নাঘরে কাজ করছে। রাশেদ ঘরেই আছে। এমন সময় কলিংবেল বাজলো। চন্দ্রা রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে এগুলো দরজার দিকে।
রাশেদ চন্দ্রা আসতে দেখে বললো, আমি দেখছি।
চন্দ্রা মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে আবার রান্নাঘরে চলে গেল। চন্দ্রা জানে এই বাসার মালিক এসেছে। উনি যদি খেয়াল করেন রাশেদ বাসায় তাহলে প্রায় সময় আসেন। চন্দ্রা গিয়ে চুলায় চায়ের জল বসালো। একটু পরেই রাশেদ এসে বলবে চা দিতে। দরজা খুলতেই রাশেদ দেখলো ছোট একটা বাচ্চা ছেলের সাথে শাহাবুদ্দিন সাহেব দাঁড়িয়ে।
রাশেদের বাড়ির মালিক আট নয় বছরের একটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে চন্দ্রাদের ড্রয়িংরুমে বসে আছে। ছেলেটিকে তিনি মাটিতে বসতে দিয়েছেনরাশেদ দরজা বন্ধ করে এসে দেখে।
রাশেদ বললো, তুমি সোফায় বসো। মাটিতে বসেছো কেন?
শাহাবুদ্দিন সাহেব বিজ্ঞের মতো বললেন, আরে রাশেদ সাহেব এদের এতো সম্মান দিতে নেই। সম্মান দিলেই দেখবেন এরা আপনার পশ্চাৎদেশে লাথি দিয়ে চলে গেছে।
না না। সেটা হয় না। এই বাবু তুমি সোফায় বসো। উঠো মেঝে থেকে।
সে সোফায় বসলো। তা দেখে শাহাবুদ্দিন সাহেবের মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি বললেন, এই পোলা সালাম দে স্যাররে। বল আসসালামু আলাইকুম।
ছেলেটি রোবটের মতো বললো, আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো তুমি?
জ্বে ভালা।
শাহাবুদ্দিন সাহেব বললেন, তুমি কইছিলা মাইয়া খুঁইজা দিতে কিন্তু আমি পাইনাই । তাই এটারে নিয়া আইলাম।
আচ্ছা। কিন্তু ও তো বেশ ছোট। কোন সমস্যা হবে না।
কিসের সমস্যা?এরা দেখতে ছোট কিন্তু কাজ ভালো পারে। শোন এরে বেশি পাত্তা দিবা না। পরে দেখবা এখন ঘাড়ে উইঠা নাচতেসে আর পরে জিনিসপত্র নিয়ে ভাগছে।
আচ্ছা দিবো না। তোমার নাম কী?
জাহাঙ্গীর আলম টুকু।
দেখছো রাশেদ কারবারটা। ওর বাপ মাটি কাটে আর হে পোলার নাম রাখছে রাজা বাদশাগোর নামে।
রাশেদ খুবই বিরক্ত হলো। এই লোক মাঝে মাঝে খুবই বাজে ভাবে কথা বলে। মানুষকে ছোট করে উনি খুবই আনন্দ পান। সেই আনন্দ পাবার জন্য উনি নিজের ছেলেদেরও বাদ দেন না। রাশেদ তবুও হাসি মুখে কথা বলতে লাগলো। একসময় উনি উঠলেন। রাশেদ তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল।
উনি দরজার কাছে এসে রাশেদকে আবারও ফিসফিস করে বললেন, রাশেদ ওকে দেখে রেখো। ব্যাটা এক নাম্বারের চোর। এখন থেকে টাইট না দিলে পরে কিন্তু জিনিসপত্র নিয়ে ভাগবে।
রাশেদ সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো, ঠিক আছে।
উনি চলে যেতেই রাশেদ চন্দ্রাকে ডাকলো। রান্নাঘর থেকে ড্রয়িংরুমের দূরত্ব রয়েছে বেশ। তাই সে কথাবার্তা কিছুই শুনেনি। চন্দ্রা ভেতরে এসে দেখে দেবশিশুর মতো একটা ছেলে অতি আগ্রহে তাদের ঘর দেখছে। গায়ের রং যত্নের অভাবে ময়লা হয়ে গেছে। চোখেমুখে তার বিম্ময়। তাদের ঘর দেখে বিস্মিত হবার কোন কারন চন্দ্রা খুঁজে পেল না। তার পরনে লুঙ্গি আর কনুইয়ের কাছে ছেড়া পুরাতন ময়লা একটা শার্ট। হয়তো এটাই তার কাছে থাকা একমাত্র ভালো কাপড়। ছোট্ট একটা পুঁটলি তার হাতে। যে কাপড়টা দিয়ে পুঁটলিটা করা সেটাও ময়লা। চন্দ্রা কাছে গিয়ে বললো, তোমার নাম কী?
টুকু খুব আগ্রহ নিয়ে তার নাম বললো।
চন্দ্রা আজ থেকে ও আমাদের সাথে থাকবে। তোমার কাজে সাহায্য করবে।
চন্দ্রা মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।
তারপর টুকুর দিকে তাকিয়ে বললো, টুকু ইনি হচ্ছেন চন্দ্রা মানে চাঁদ ইংরেজিতে মুন। বুঝেছো?
টুকুও মাথা নাড়লো মানে সে বুঝছে।
চন্দ্র টুকুর দিকে তাকিয়ে বললো, এই বাবু কেমন আছো তুমি?
জ্বে ভালা। আফনে কেমন আছেন আম্মাজান?
আমিও ভালো৷ কিন্তু তুমি আমাকে আম্মাজান বললে কেন?
কেন? আমার আম্মায় তো কইয়া দিলো যে বাসায় কাম করতে যাইমু হেই বাসার মালকিনরে আম্মাজান আর মালিকরে আব্বাজান ডাকতে।
আমাকে আপা বলে ডাকবে। ঠিক আছে?
জ্বে আইচ্ছা।
আসো তোমাকে ঘর দেখিয়ে দেই।
বলেই চন্দ্রা টুকুর হাত ধরলো। ধরে বাসার ছোট্ট স্টোররুমে নিয়ে গেল।
রাশেদ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলো চন্দ্রা খুবই স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। টুকুও খুব জড়তা নিয়ে বসে ছিল শাহাবুদ্দিন সাহেবের সামনে। কিন্তু উনি চলে যেতেই সে স্বাভাবিক হয়ে গেল।
সেই টুকুকে নিয়ে চন্দ্রা কী খুশি? সে সারাক্ষণ তার সাথে গল্প করে। টুকুও তার সাথে কথা বলে। তবে তার সব কথা তার ছোট “ভইন” টুকিকে নিয়ে। টুকির বয়স একবছর। কিন্তু এই বয়সে সে টুকুকে ভাইজান বলে ডাকে এবং টুকু যখন আসবে তখন নাকি তাকে বলে দিয়েছে, ভাইজান আসার সময় আমার লাইগা মজা নিয়া আইসো।। টুকুর কথা যে আদোও বিশ্বাসযোগ্য না তা রাশেদ জানে। কিন্তু চন্দ্রা খুব সহজেই তা বিশ্বাস করলো এবং আগ্রহ নিয়ে টুকুর কাছে টুকির গল্প শুনছে এবং তাকে আশ্বাস দিয়েছে বাড়ি যাবার সময় টুকির জন্য সে অবশ্যই চকলেট কিনে দিবে। রাশেদ তাকিয়ে রইলো অসহায় ভাবে। এই মেয়ের মাথায় কী? সে এই কথাটা কীভাবে বিশ্বাস করলো তা রাশেদের মাথায় ধরছে না? যাক কিছু তো কথা বলছে এটাই অনেক। না হলে কদিন পর দেখা যেত সে কথাই বলতে ভুলে গেছে। কথা বলতে শুরু করলেও তার সম্পর্ক রাশেদের সাথে আগের মতোই আছে।
শাহাবুদ্দিন সাহেব খুব সম্ভবত ভবিষ্যৎবানী করতে পারেন। কারন পাঁচদিনের মাথায় এক ভোরে টুকু পালালো। সাথে কিছু নিয়েছে কিনা বুঝতে পারছে না রাশেদ। কারন ঘরের সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। তবে পালালোর কারন কী তাও রাশেদ বুঝলো না। শাহাবুদ্দিন সাহেব খুবই রেগে গেলেন।
তিনি রেগে বললেন, হারামজাদারে আমি জেলের ভাত খাওয়ামু। কত বড় সাহস। নাক টিপলে দুধ বাইর হইবো। আমার বাড়ি থেকে চুরি করে পালাইলো।
রাশেদ খুবই বিরক্ত হয়ে বললো, চাচা সে চুরি করেনি। করলে ঘরের জিনিসপত্র মিসিং থাকতো। তা কিন্তু নেই।
যদি নাই করবো তাইলে না কইয়া গেলো কেন?
সেটা অন্য কারন হতে পারে। তার বাবার কাছে কল করুন। দেখুন সে সেখানে কিনা?
তার বাবার কাছে কল করা করা হলো কিন্তু ফোন বন্ধ। রাশেদ খুবই চিন্তিত। পরের ছেলের কিছু হলে এর দায়ভার তার উপর পড়বে। তাই সে ঠিক করলো টুকুর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে কালই সেখানে গিয়ে খোঁজ করবে। চন্দ্রা খুবই মন খারাপ করলো। তার মনে হচ্ছে কোন কারনে টুকু তার উপর রাগ করে চলে গেছে।
নানা কারনে রাশেদ দুইদিন আটকে গেল। তৃতীয় দিন যেদিন রাশেদ যাবে সেদিন ভোরে টুকু এসে হাজির তার ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে। রাশেদ এনে দিয়েছিল সেটা। কিছুই হয়নি এমন ভাব করে করে নিজের ঘরে গিয়ে ঘুম দিলো। চন্দ্রা এমনই মেয়ে রাশেদকে কিছুই বললো না। সকালে রাশেদ খেয়ে চলে গেল তখনো সে জানে না টুকু ফিরে এসেছে। রাশেদ যখন রাতে বাসায় ফিরলো তখন টুকু দরজা খুলে দিলো তারপর ঝাড়ু হাতে নিয়ে ঘর ঝাড়ু দিতে লাগলো। রাশেদ বিস্মিত। সে টুকুর হাত থেকে ঝাড়ু ছাড়িয়ে তাকে নিয়ে সোফায় বসলো। তারপর না রেগে শান্তস্বরে কথা বললো যাতে সে ভয় না পায়।
কখন এলি তুই?
আইজকা ভোরে।
রাশেদ অবাক হলো। চন্দ্রা একবারও বললো না এই কথা। অথচ আজ রাতে ও খেয়ে টুকুর খোঁজে যেত।
কোথায় ছিলি তুই এই দুইদিন?
ভাইজান ভইনরে দেখতাম গেছিলাম।
একা একা গিয়েছিস কেন? আমাকে বললে আমি কী না করতাম?
ভাইজান খুবই খরাপ খোয়াব দেকছি ভইনরে নিয়া। তাই কোন কিছু না ভাইবা চইলা গেছি।
একা একা গেলি কিছু হলে কী হতো? তোর বাবা মাকে আমি কী বলতাম?
ভাইজান এতো ডরের কিছু নাই। আমি আমার মামার বাস দিয়া গেছি।
তোর মামা মানে?
আমগো বাড়ির সামনে দিয়া যে বাস ঢাকা আয়ে ওই বাস আমার এক মামার।
তোর মামা কী বাস চালায়?
জ্বে না। বাসে সবার কাছ তে ভাড়া নেয়।
এত সকালে কীভাবে এলি?
আব্বায় বাসে তুইলা দিছে।
তোর আপা যে কষ্ট পেয়েছে তুই জানিস? সে মনে করেছে তার কোন ব্যবহারে তুই কষ্ট পেয়ে চলে গেছিস।
আপার উপর রাগ করুম কে? আপা আমার আম্মার লাহান। আমারে কত আদর করে। কিন্তু ভাইজান আপা আমার লগে কতা কইতাছে না। আফনে একটু বলেন তারে আমি খুবই কষ্ট পাইতাছি।
তার রাগ ভাঙে নি এখনো?
জ্বে না।
আচ্ছা আমি বলে দিব। আর তুই কখনো এমন করবি না। কোথাও যেতে হলে আমাকে বলবি। কাল আমার সাথে গিয়ে তোর মামার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি।
আইচ্ছা।
রাশেদ গেল ফ্রেশ হতে। অনেক টেনশনে ছিল সে। আজ কমলো। শাহাবুদ্দিন সাহেবকে বলতে হবে টুকু ফিরে এসেছে। চন্দ্রা যে মেয়ে সে তাকেই বলেনি শাহাবুদ্দিন সাহেবকে তো আরো আগে বলবে না। চন্দ্রা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদ চন্দ্রার কাছে গেল। চন্দ্রা আগেই কলিংবেলের শব্দ শুনে বুঝতে পেরেছে রাশেদ এসেছে। পরিচিত পারফিউম গন্ধ পেয়ে পেছন না ফিরেই বললো, ফ্রেশ হয়ে নিন খাবার খেয়ে নিবেন।
চন্দ্রা, তুমি নাকি টুকুর উপর রাগ করেছো আর রাগ করে থেকো না। ছোট মানুষ বুঝতে পারেনি। তার উপর তুমি কথা বলছো না সে খুবই কষ্ট পাচ্ছো। যাও ওর সাথে কথা বলো।
চন্দ্রা রাশেদের কথা মতো চলে গেল ড্রয়িং রুমে। রাশেদ ফ্রেশ হয়ে খেয়ে এসে দেখে চন্দ্রা আর টুকু গল্প করছে। তাদের মান অভিমান ভেঙেছে তবে। টুকু হাত নাড়িয়ে গল্প করছে আর চন্দ্রা শুনছে। রাশেদ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে চন্দ্রার দিকে।
চলবে……..