#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Ahmed_Priya
#পর্বঃ১৪
_______________________
চারুলতা আর দেরি করেনি। পরেরদিনই জামাল হোসেনকে নিয়ে ও বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছে। ও বাড়িতে আর কখনোই সে যাবেনা। বিয়েটা নতুন হয়েছে এখন জামাল হোসেন মোটমুটি ওর কথা শুনেই চলে তাই চারু সিদ্ধান্ত নিলো তাকে স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা বলবে। আগের স্কুলেই ভর্তি হতে পারবে কারণ সে স্কুলটি ছিলো চারুর গ্রামের একেবারে শেষের দিকে। চারুর বাড়ি থেকে স্কুলের দুরত্ব যতটা ছিলো, এবাড়ি থেকে প্রায় একই দুরত্ব। জামাল হোসেনের মেজাজ মর্জি ভালো দেখে চারু একদিন কথাটা তুললো,
– আমি তো এইবার ক্লাস নাইন পাশ করলাম। স্কুলে প্রথম হয়েছি। ক্লাস টেইনে ভর্তি হই?
– এতো লেহাপড়া কইরা কি করবা? হুদাই টাকা নষ্ট।
– আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো এস এস সি পাশ করা।
– ম্যাট্রিক পাশ করনের পর তো আবার কলেজ যাইতে চাইবা।
– না চাইবো না। আপনি শুধু আমাকে এস এস সি পাশের সুযোগ টুকু করে দিন।
– স্কুলে ভর্তি করলে তুমি খুশি হইবা?
– খুব বেশি খুশি হবো।
– আইচ্ছা। কাল সকালে নিয়া ভর্তি করায়া দিমু। এহন আমার কাছে আসো।
চারু প্রথমে খুশি হলেও শেষাংশ টুকু শুন মুখ মলিন করে ফেললো। আরো এক যন্ত্রণাময় রাত।
★
সকালে উঠে জামাল হোসেন নিজের মত বদলালো কয়েকবার। সে একবার চারুকে ভর্তি করতে চাইছে তো একবার চাইছেনা। শেষ পর্যন্ত চারুর অতিরিক্ত উৎসাহ ও খুশি দেখে সে চারুকে ভর্তি করতে রাজি হয়ে গেলো। মাস্টারমশাইও বেশ খুশি হলো চারুর আবার পড়াশোনা শুরু করায়। মেয়েটা অন্তত এস এস সি তো পাশ করতে পারবে। স্কুলে ক্লাস করার সময়ে বিন্দিয়ার সাথে বসলো চারু। বিন্দিয়া চারুর বেশ ভালো বন্ধু তবে আজ বিন্দিয়া চারুকে কিছুটা এড়িয়ে চলছে। এর কারণ চারু বুঝতে পারছেনা। অনেকক্ষণ জোড়াজুড়ি করে বিন্দিয়া যা বললো তার সারমর্ম এইরূপ যে সে কেনো জামাল হোসেনকে বিয়ে করলো? শাওন কি অবস্থায়, কিরূপে আছে না জেনে সুন্দর করে স্কুলে চলে এলো। শাওনের জন্য চিন্তিতও নয় সেটা কেনো? চারু অবশ্য কিছু মনে করলোনা। ওকে ভুল বোঝাটাই স্বাভাবিক। শিহাব এত বিচক্ষণ হয়েও তো ভুল বুঝেছিলো ওকে তাহলে বিন্দিয়ার কি দোষ?
– কথা কস না ক্যান চারু? তুই ওই লোকটারে ক্যান বিয়া করলি?
– বাধ্য ছিলাম। আমার হাতে আর কিছুই ছিলোনা রে বিশ্বাস কর।
– শাওন ভাইয়ের সাথে পালায়া যাইতি।
– সময় পাইনি। যেতে চেয়েছিলাম।
– তার জন্য কষ্ট হয় না তোর?
– সত্যি বলবো?
– অবশ্যই। মিথ্যা বলবি ক্যান?
– সত্যি বলতে যতটা কষ্ট হওয়ার কথা ছিলো ততটা হচ্ছেনা। কে জানে কেনো হচ্ছেনা। অবশ্য আমি যেই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছি আমি যে এখনো পাগল হয়ে যাইনি সেটাই অনেক। নিজেকে কেমন অনুভূতিহীন বলে মনে হয়।
– জামাল হোসেনরেই যদি বাধ্য হইয়া বিয়া করলি তাহলে শিহাবরে করলি না ক্যান? তাইলে তো তোর মায় বাইচ্চা থাকতো।
– তখন পরিস্থিতি ভিন্ন ছিলো। শিহাবকে মানা করতে পেরেছি কারণ তখন আমার মা ছিলো আর আমার ভাই ছিলো কিন্তু এই বিয়েতে আমার পাশে কেউ ছিলো না। আমি শুধুই এক নিরব দর্শক। আর কারোর কাছে সাহায্যও চাইতে পারতাম না কারণ তাদের গ্রাম থেকে বের করে দিলে আমার কি হতো? দিনে ভদ্রবেশে থাকা মুখোশধারী মানুষগুলোই রাতের বেলা আমার ক্ষতি করতো। তাছাড়া আমি চলতামই বা কিভাবে? আমি তো টাকাপয়সা রোজকার করিনা।
– তোর সত্যিই শাওন ভাইয়ের জন্য কষ্ট হচ্ছেনা? আমার তোরে খুবই স্বার্থপর বইলা মনে হচ্ছে। আচ্ছা তুই কি শিহাবকে বিয়া না করার জন্য আফসোস করিস?
– দুটো প্রশ্নের উত্তরই না।
বিন্দিয়া চুপ করে যায়। এই কয়েকমাসে চারু যেনো কেমন অপরিচিত হয়ে গেছে। একই গ্রামে থাকায় চারুর সকল খবরাখবরই তার কানে সবসময় আসতো। চারু কতটা বদলে গেছে।
– তোর ভাই আসেনা কেনো চারু? সে আসলে তো আর তোকে এসব কিছু সহ্য করতে হতোনা।
★
জামাল হোসেনের সাথে বিয়ের ছয়মাস কেটে গেলো। এর মাঝে আর কখনো গ্রামে ফিরে যায়নি চারু। প্রতিদিন স্কুলেও যায়না কিন্তু বাসায় বসেই পুরোদমে পড়াশোনা করে। জামাল হোসেনের মাঝেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তন অবশ্য চারুকে বেশ স্বস্তি দেয়। সে আর আগের মতো চারুকে ব্যাবহার করে না। সপ্তাহে দুই কি একবার। কিন্তু মদ খাওয়া সে ছাড়তে পারেনি। চারুর এই গন্ধ সহ্য হয়না বিধায় চারু মাঝেমাঝে মাটিতে বিছানা করে ঘুমায়। এই লোকটার সাথে চারুর এখন আর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। সে শুধু বাজার করে দিয়ে তার দায়িত্ব পালন করে। আর চারু রান্নাবান্না করে নিজের সকল কাজ শেষ করে তার দায়িত্ব পালন করে। মাঝেমাঝে শুধু প্রয়োজনীয় দু একটা কথা হয়। আর দুজন যার যার মতো থাকে। তবে আজকাল সবুজ আলীকে খুব একটা ভালো লাগছেনা তার। লোকটার দৃষ্টি কেমন যেনো। প্রতিদিনই এই লোকটা এসে এখানে পড়ে থাকে। চারু কথা বলতে না চাইলেও গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে। চারু মুখের উপর বিরক্তি প্রকাশ করলেও সে থেমে যায়না, নতুন উদ্দমে কথা বলতে আসে।
– আপনার বন্ধুকে এই বাড়িতে আসতে মানা করে দিবেন।
– ক্যান? সে আবার কি করলো?
– তার দৃষ্টি খুবই খারাপ। আমার সহ্য হয়না।
– কি কও এইগুলা? সবুজের মতো মাটির মানুষ দুইটা খুজে পাইবা?
– আপনার মাটির মানুষ আপনিই দেখেন। সে যেনো আর আমার সামনে না আসে।
– আস্তে কথা কও। মাইয়াগো আস্তেধীরে কথা কইতে হয়। কি সুন্দর চেহারা তোমার। গলার স্বরটাও সুন্দর। ধীরে ধীরে কথা কইলে ভালো লাগবো। তুমি দিনে দিনে কেমন যেনো খিটখিটে হইয়া যাইতাছো।
– আমি বলে দিচ্ছি আপনাকে সে যেনো আমার চোখের সামনে না আসে। তার দৃষ্টি খুবই বাজে।
– দৃষ্টি খারাপ হইবো ক্যান? ও তো তোমাকে বইনের নজরে দেখে।
– আমার ভাই আছে। ভাইয়ের নজর চিনি আমি। ভাইয়ের নজরে স্নেহ থাকে। এমন লালসা থাকেনা। তাকে এ বাড়িতে আসতে মানা করবেন।
– তুমি ওরে ভুল বুঝতাছো। ওর কেউ নাই দেইখা আমাদের সাথে সময় কাটাইতে আসে। আচ্ছা তুমি পছন্দ না করলে ওরে আসতে মানা কইরা দিমু।
– সময় কাটাতে হলে আপনি তার বাড়ি চলে যাবেন। সে যেনো এখানে না আসে।
– আচ্ছা আমি কইয়া দিমু। তুমি চিল্লাচিল্লি কইরো না। আমার মায়েরে দেখতাম। সবসময় আমার বাপজানরে ভয় পাইয়া আসছে। সব কথা মানছে। আর তুমি? তোমার রান্নাও আমার মায়ের মত হয় না তোমার আচরণও আমার মায়ের মতো হয়না।
– আমি আমার মতো। আমি কারোর মতো হতে চাইনা। আর শুনেন।
– বলো।
– এই মাসের ২৩ তারিখ আমার ডেট। আমি প্রতিমাসে এমন যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবোনা। আপনি আমাকে কালই ডাক্তারের কাছে নিয়া যামু।
– কাল ২০ তারিখ। এত তাড়াতাড়ি যাইবা ক্যান? আর প্রতিমাসে সব মাইয়ারই ওমন ব্যথা হয়। ওইডা ব্যাপার না।
– আপনি নিয়ে যাবেন কি না সেটা বলেন।
– হাতে টাকাপয়সা নাই। পরের মাসে নিয়া যামু।
– তাহলে ভুলেও আর আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না। আপনি আমার কষ্ট দেখবেন না তো আমি কেনো আপনার চাহিদা পুরন করতে যাবো?
– অতিরিক্ত আদর দিয়া মাথায় তুলছি না তোমারে? কয়টা বউ এমন জামাইর উপর চিল্লায়? এমন মুখে মুখে কথা কয়? একদম আমারে রাগ দেখাইতে আসবা না।
– আমি অন্যকেউ না। আমি চারুলতা। আমার উপর অত্যাচার করলে আমি চুপ থাকবোনা।
– বাপের বাসায় তো ঠিকই চুপ থাকতা। ওইখানে মারধর করার মানুষ ছিলো তাই চুপ থাকতা? এইহানে নাই বইলা জবান ফুটছে?
– না। সেখানে ফুলের মতো নরম আর কোমল ছিলাম বলে চুপ থাকতাম। এখন শক্ত হয়েছি। এখন আমাকে কেউ ভাঙার সামর্থ্য রাখেনা।
– আইচ্ছা আইচ্ছা বুঝছি। একটা কথাও মাটিতে পড়েনা। ডাক্তার দেখাইতে হইলে শহরে নিতে হইবো। কাল নিয়া যামু। তাও এমন মুখে মুখে তর্ক কইরো না।
চারু আর কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। প্রতিমাসেই সে বলে পরের মাসে নিয়ে যাবে। পরের মাস করতে করতে ছয় মাস পেড়িয়ে গেলো। এই এক যন্ত্রণা আর কত সহ্য করা যায়? পরেরদিন সকালে জামাল হোসেন একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাকে শহরে নিয়ে গেলো কিন্তু শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাই সে ঠিক করলো আজকের রাতটা কোথাও থেকে কাল সকালে চারুকে ডাক্তার দেখিয়ে এখান থেকে ফিরে যাবে। চারু মূলত দুটো উদ্দেশ্য নিয়ে শহরে এসেছে। প্রথমত, নিজের চিকিৎসা করা আর দ্বিতীয়ত হামিদকে খোজা। তবে শহরে এসে চারুর চিন্তাভাবনাই বদলে গেলো। ও ভেবেছিলো শহর বোধহয় গ্রামের মতোই ছোটখাটো জায়গা হবে কিন্তু সে বিষ্ময়ে খেয়াল করলো দশ গ্রাম একত্রিত করলেও বোধহয় শহরের অর্ধেকও হতে পারবেনা। এত বড় জায়গায় কি আদেও হামিদকে খুজে পাওয়া সম্ভব? জামাল হোসেন বেশ ভালো একটা হোটেলেই ঘর ভাড়া করলো রাতের জন্য। শহর দেখে বেশ অবাক হচ্ছে চারু। গ্রামের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ।
– আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?
– কি প্রশ্ন?
– আমি যদি শহরে আসি, তাহলে শহরে থাকা পরিচিত কারোর সাথে কি আমার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
– খুব কম।
– মানে দেখা হতে পারে?
– হুম পারে তবে বেশিরভাগ সময়ই হয়না। তুমি কি কাউরে খুজতে চাইতাছো?
– না এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।
– ওহ। শোনো কাইল সকাল সকাল ডাক্তার দেখাইয়া আমরা গ্রামের উদ্দেশ্যে বের হবো।
চারু সম্মতি জানিয়ে শুয়ে পড়লো। হামিদকে আর তার খোজা হলোনা। ডাক্তার দেখানো শেষেই জামাল হোসেন চলে যাবে। এই অল্প সময়ে এত বড় জায়গায় কাউকে খোজা অসম্ভব। সকাল হতেই জামাল হোসেন চারুকে নিয়ে গেলো ডাক্তারের কাছে। সমস্ত ঘটনা খুলে দেওয়ার পরে ডাক্তার কিছু টেস্ট দিয়ে জরুরি দেখাতে বললো। চারুর টেস্ট করানো হলো। জরুরি ভিত্তিতে রিপোর্ট দুপুরের মধ্যেই চলে আসলো। ডাক্তার রিপোর্ট গুলো দেখে বেশ অবাক হলেন,
– আপনার এ অবস্থা আর আপনি এখন ডাক্তার দেখাচ্ছেন? এত অসচেতন কেনো বলুন তো আপনারা?
– ক্যান কি হইছে ওর?
– আপনি ওনার কে হন?
– ওর স্বামী।
ডাক্তার কিছুটা অবাক হলো। এইটুকু একটা মেয়ের স্বামী এই লোক? তিনি অবশ্য এ ব্যাপারে মাথা ঘামালেন না।
– আপনার স্ত্রীর জরায়ুতে ইনফেকশন হয়েছে। অনেকদিন হওয়ায় রোগটা সিরিয়াস হয়ে গেছে। দ্রুত চিকিৎসা না করালে কখনোই বাচ্চা হবেনা এমনকি ক্যান্সারের ঝুকিও আছে। তাছাড়া আরো কিছুদিন পরে আসলে বোধহয় জরায়ু কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলোনা।
– ওইটা কাইট্যা ফেললে কি হয়?
– উনি আর কখনো মা হতে পারবেন না।
– তাহলে ওইটাই কইরা দেন। আমার বাচ্চার দরকার নাই। কত খরচ পড়বো?
চারু বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে জামাল হোসেনের দিকে তাকালো। বাচ্চা চায়না মানে কি? পশুপাখি পর্যন্ত নিজের বংশবৃদ্ধি করতে চায় আর ও কি না বলছে বাচ্চা চায় না? ডাক্তার ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন,
– আপনাদের কয়টা বাচ্চা?
– কোনো বাচ্চা নাই।
– কোনো বাচ্চা নেই আবার আপনি বাচ্চা চাচ্ছেন না?
চারু জামাল হোসেনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললো,
– আসলে ওনার মাথায় কিছু সমস্যা আছে। আপনি ঔষধ লিখে দিন। আমি আমার চিকিৎসা কন্টিনিউ করবো।
বেশ অবাক হয়েই ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখলেন। আর ছয় মাসের মধ্যে আবার দেখা করতে বললেন। চারু কোনোমতে সেটাকে নিয়ে চেম্বার থেকে বেড়িয়ে এলো।
– ওই ডাক্তারের সামনে তুমি আমারে পাগল কইলা?
– তো কি বলবো?
– আমি পাগল? আমি তো তোমার ভালোর জন্যই কইছিলাম। বাচ্চা হইলে তো অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। তুমি তো মাসিকের ব্যথাই সহ্য করতে পারোনা আবার বাচ্চার কষ্ট কেমনে সহ্য করবা? তাছাড়া ওইটা কাটলেই ব্যাপারটা সহজে মিটতো। এহন ঔষধ কিনতে কত টাকা খরচ হইবো।
চারু হতভম্ব হয়ে গেলো জামাল হোসেনের কথায়। সে বাচ্চা চায়না? কিন্তু কেনো? এমনকি চারু লক্ষ্য করেছিলো যখন ডাক্তার বলেছে জরায়ু কেটে ফেললে ও আর মা হতে পারবেনা তখন জামাল হোসেন বেশ খুশিই হয়েছে। কিন্তু এমনটা কেনো? এর পেছনে কি কোনো অজ্ঞাত রহস্য লুকিয়ে আছে যা চারু জানে না?
★
ঔষধ পত্র নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা হলো তারা। জামাল হোসেন বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য একটা সিএনজি ভাড়া করলো। সিএনজিতে উঠে কিছুদূর যাওয়ার পরেই চারুর চোখ আটকে গেলো একজায়গায়। সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরহিত এক সুদর্শন যুবক। মুখে চাপ দাঁড়ি, রোদের আলোয় ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। কপাল থেকে ঘাম বের হচ্ছে আর শার্টের হাতা দিয়ে দিয়ে যুবকটি সেটা মোছার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কাউকে জোরে চিৎকার করে কিছু একটা বলছে। চারুর ছেলেটাকে চিনতে ভুল হলোনা। এইটা হামিদ। নিঃসন্দেহে এইটা হামিদ। চারু চিৎকার করে গাড়ি থামাতে বললো। গাড়ি থামাতেই সে দৌড়ে সেদিকে ছুটে গেলো কিন্তু এত লোকের ভীড়ে সে খুজে পাচ্ছেনা হামিদকে। চারু হাল না ছেড়ে এদিক সেদিক দৌড়াতে লাগলো কিন্তু জামাল হোসেন পেছন থেকে এসে থামিয়ে দিলো তাকে।
– কি হলো? কি করতাছো?
– ভাই। আমার ভাইকে দেখেছি আমি এখানে। ও এখানেই আছে।
– তোমার ভাই এইহানে কোথা থেকে আসবো?
– আছে। আমার ভাই আছে। আমি দেখেছি।
– চলন্ত সিএনজিতে তুমি ক্যামনে তোমার ভাইয়েরে দেখলা?
– আমি দেখেছি। বিশ্বাস করুন আমাকে আমি দেখেছি।
– তুমি হয়তো তোমার ভাইয়ের মতো কেউরে দেখছো আর চলন্ত গাড়িতে তারেই হামিদ ভাইবা নিছো। তাছাড়া আমি শুনছি মন যেইটা ভাবে ওইটাই কল্পনা করে ফেলে। তুমিও মনে হয় হামিদরে দেখতে চাইছিলা তাই তাকে দেখছো।
চারু চুপ করে গেলো। জামাল হোসেনের কথা মিথ্যা না। সে আসলেই হামিদকে দেখতে চাইছিলো। তাহলে এখন যেটা দেখলো সেটা কি আসলেই ওর অবচেতন মনের কল্পনা? হামিদ সত্যিই এখানে ছিলোনা? চারু একবার ভালো করে জায়গাটা দেখে নিলো। কারেন্টের অফিস এইটা। এইবার আর চারুর সন্দেহ রইলো না ও হামিদকে দেখেনি। হামিদ সবসময় একটা সামান্য বাতি পরিবর্তন করতেও ভয় পেতো। তার মনে হতো সে বিদুৎস্পৃষ্ট হয়ে যাবে তাই সে সবসময় এসবের কাছ থেকে দূরে থাকতো। আর যাই হোক, হামিদ এখানে কাজ করেনা। চারু জামাল হোসেনের সাথে ফিরে গেলো সিএনজিতে। ইশ! চারু যদি আর একটু অপেক্ষা করতো তাহলেই পেয়ে যেতো হামিদকে। চারু জানলোও না হামিদ যে এখন বড় হয়েছে। সে আর ভয় পায়না।
★
সকালে নিজের সকল কাজ করে স্কুলের উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়লো চারু। আজ অনেকদিন পর স্কুলে যাচ্ছে। তাও যদি পরীক্ষা না হতো তাহলে যেতো না। চারু শুধু পরীক্ষাগুলো নিয়মিত দেয়। ক্লাসে একেবারে যায়না বললেই চলে। ক্লাসরুমে পৌঁছাতেই তার কাছে ছুটে এলো বিন্দিয়া।
– তোর পড়াশুনার কি অবস্থা চারু?
– ভালোই তো মনে হয় চলছে। পরীক্ষা দেই আগে রেজাল্টের পরে বোঝা যাবে।
– এতদিন স্কুলে আসিস নাই কত কিছু যে মিস করছস তার হিসেব নাই। তোর জন্য একটা খবর আছে।
– কি খবর?
– এহন বলমু না। বললে তুই পরীক্ষা দিতে পারবিনা। আগে পরীক্ষা দে তারপর জানামু।
চারু বিন্দিয়ার কথা কিছুই বুঝলো না তারপরও মেনে নিলো। কি এমন কথা আছে বিন্দিয়ার যে সেটা শুনলে চারু পরীক্ষাই দিতে পারবেনা?
৩ ঘন্টার পরীক্ষা। বেশ ভালো ভাবেই সম্পন্ন হলো। বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তরই চারুর জানা। বাসায় তাহলে ভালোমতোই পড়াশোনা হচ্ছে। পরীক্ষা শেষে চারু বিন্দিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ও কিছু বলতে চাইছিলো। বিন্দিয়া তার সামনে এসে প্রথমে উত্তরগুলো মেলালো।
– তুই না কিছু বলতে চেয়েছিলি।
– হুম। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। আমার মাথায় হাত দিয়া কসম কর কাউরে বলবি না যে কথাটা আমি তোরে বলছি।
– আচ্ছা করলাম। এখন বল।
– তোর ভাই গ্রামে আসছিলো তোরে খুজতে।
চারুর হাতে থাকা কাগজপত্র গুলো সব মাটিতে পড়ে গেলো। পাশেই দেওয়াল ধরে কোনোমতে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলো সে। বিন্দিয়া তার অবস্থা বুঝে একটু পানি এগিয়ে দিলো তার দিকে।
– ক কবে এসেছিলো?
– একমাস আগে। সে মোট চারবার এসেছিলো। তোরে খুজতাছিলো। প্রথম যেদিন আসে ওইদিন আমি দেখছিলাম তারে। তার মাথায় হাতে পায়ে রক্তমাখা ব্যান্ডেজ ছিলো। ঠিকমতো হাটতে পারতাছিলো না। চোখ লাল হইয়া ছিলো। আমার মনে হয় তার বড় কোনো এক্সিডেন্ট হইছিলো। কোনোরকম সুস্থ হওয়ার আগেই সে তোরে খুজতে আসছে।
চারুর গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। তার মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। এখনি ঘুম ভেঙে যাবে আর দেখা যাবে বিন্দিয়ার কথা মিথ্যা।
– একমাস আগে এসেছে তো এখনো আমার সাথে দেখা করেনি কেনো?
– প্রথম যেদিন আসলো ওইদিন যখন শুনছে চাচা তোর বিয়া দিয়া দিছে তাও চল্লিশের উপর বয়সী একজন লোকের সাথে তহন হামিদ ভাই প্রচন্ড রাগে জিনিসপত্র ভাঙচুর শুরু করে আর তোর ঠিকানা চায়। বলে এখনি গিয়া তোরে নিয়া আসবো। আর চাচী সবাইরে ভুল বুঝায়া কইছে হামিদ ভাই তোর সংসার টা ভাঙতে চায়। তারে যেনো কেউ তোর ঠিকানা না দেয়। চাচি এমন ভাবে অভিনয় কইরা সবাইরে কইলো যেনো তুই তার নিজের মাইয়া আর মাইয়ার ঘর বাচানোর জন্য একটা মা আর্তনাদ করছে। তার কথায় সবাই গইলা গেলো আর হামিদ ভাইরে কেউ কোনো ঠিকানা দিলো না। এরপরও সে তিনবার আসছে কিন্তু কেউই তারে ঠিকানা দেয় নাই। সে সকাল থেইকা রাইত পর্যন্ত তোরে এইহানে ওইহানে খুজে। কোনো ঠিকানা ছাড়াই খুজে। রাইতের বেলা না পায়া চইলা যায় তাও বারোটার আগ পর্যন্ত তারে কোনোদিন কেউ যাইতে দেখে নাই।
– তুইও তাকে বলিস নি বিন্দিয়া?
– সুযোগ পাই নাই। একদিন কইতে গেছিলাম। আম্মায় দেইখা ফেলছে। আর কইছে আমি আমার বান্ধবির ঘর নাকি ভাঙতে চাই তাই হামিদ ভাইরে তোর কথা কইতে গেছি। আর যেনো সে আসলে আমি বাইরে না যাই আম্মায় কইয়া দিছে। তারপর আরো একদিন সুযোগ কইরা একটা কাগজে সব কিছু লেইখা তার সামনে মাটিতে ফালাইলাম কিন্তু সে ফেলনা কাগজ ভাইবা ওইটার দিকে তাকায়ও নাই। আর বাকি দুইবার আম্মায় আমারে চোখে চোখে রাখছে যেনো হামিদ ভাইয়ের সাথে আমি কথা না কইতে পারি। মা মনে করে আমি কথা কইলেই তোর সংসার ভাঙবো। আমার মায় অনেক আদর করে তরে কিন্তু মায়েরে আমি বুঝাইতে পারলাম না তার এই আদর তোর কত বড় সর্বনাশ করলো। শোন চারু হামিদ ভাইরে যেমন তোর কথা কওয়া নিষেধ তেমনি তোর কাছেও হামিদ ভাইয়ের কথা বলা নিষেধ। তুই কেউরে কইস না আমি তোরে হামিদ ভাইয়ের কথা বইলা দিছি।
চারু স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। হামিদ তার কথা রেখেছে সে ফিরে এসেছে কিন্তু এখন খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে। এখন দেরী হলেও সব ঠিক করা সম্ভব। যেভাবেই হোক হামিদকে খুজে বের করতেই হবে। চারু দ্রুত বাড়ির দিকে ছুটতে লাগলো। সেখানে স্কুলের জামাকাপড় ছেড়েই নিজের গ্রামের দিকে যাবে। গ্রামে ঢুকতেই এক মহিলা তাকে দাঁড় করিয়ে দিলো,
– এই মাইয়া তুমি জামাল ভাইয়ের বউ না?
চারু থমকে গেলো। দাঁড়িয়ে চুপচাপ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো।
– তুমি এইভাবে দৌড়ায়া কই যাও?
– বাসায় যাচ্ছি।
মহিলা একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারুর দিকে তাকিয়ে বললো,
– মাইয়া তো তুমি মাশাল্লাহ ভালোই সুন্দরী কিন্তু এত সুন্দরী হইয়া কি হইবো যদি জামাইরে আচলে নাই বাধতে পারলা?
কথাটা বলেই মহিলাটি চলে গেলো। চারু বুঝতে পারলো না সে ঠিক কি বলতে চেয়েছিলো। এখন এতকিছু ভাবার সময় নেই। চারু দ্রুত পোশাক পরিবর্তন করে আবারও ছুটে গেলো নিজের গ্রামের দিকে। এদিক সেদিক সে খুজতে শুরু করলো হামিদকে। সে হয়তো আজ আসেনি। চারুর মাথা কাজ করলো না। হতে হঠাৎই মনে হলো হামিদ হয়তো বাসায় কিছু ক্লু রেখে গিয়েছে ওকে খোজার। চারু দৌড়ে বাড়ির দিকে চলে এলো। বাসায় নাজিমুদ্দিন বা শেফালীকে দেখা যাচ্ছেনা। চারু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। দ্রুত নিজের ঘরে চলে গেলো। এদিক সেদিক তন্নতন্ন করে হামিদের দেওয়া কিছু ক্লু খুজে পেলো না। ঘরের কোথাও কিছু খুজে না পেয়ে ইটের ফাকার দিকে এগিয়ে গেলো। ছোটবেলায় মনোরমার কাছ থেকে লুকিয়ে সবকিছু ওরা দুজন এখানেই রাখতো। ইটের ফাকাটাও ওরাই করেছে। মনোরমা মৃত্যুর আগ অবধি এই বিষয় জানতো না। চারু চুপিসারে ওখানে এগিয়ে গেলো। চারু আবারও হতাশ হলো। এখানেও কিছু নেই। চারু সবকিছু আগের মতো করে দিয়ে বাসা থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ঘর থেকে বের হতেই অন্য ঘর থেকে শেফালীর আওয়াজ কানে ভেসে আসলো। কিসব অশ্লীল শব্দ করছে। ছিহ! এই মেয়ের বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। শব্দগুলো চিনতে দেরি হয়নি চারুর। সে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে চলে আসতেই যাবে এমন সময় উঠোনে একজোড়া জুতা দেখে থমকে দাঁড়ালো চারু। জুতো জোড়া গুলো চিনতে ভুল হয়নি তার। জামাল হোসেনের জুতো কিন্তু তার জুতো এখানে কি করছে? অচেনা এক ভয় বাসা বাধলো চারুর ভিতর। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজাটা হালকা খুলেই চারু দেখতে পেলো পৃথিবীর জঘন্যতম দৃশ্য। তারই স্বামী বিছানায় অন্তরঙ্গ মূহুর্তে আছে শেফালীর সাথে। চারু স্তব্ধ হয়ে গেলো। সব ধরনের বোধ শক্তি লোপ পেলো তার। এমন কিছু দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে। চারু কোনোরকমে বেড়িয়ে এলো সে বাড়ি থেকে।
হাটতে হাটতেই গেলো বাড়ির উদ্দেশ্য। আজ চাইলেই সে তাদের হাতেনাতে ধরতে পারতো কিন্তু কোনো লাভ হতো না। উপরন্তু জামাল হোসেন এখন যে ভালোমানুষের নাটক টা করছে সেটাও আর করবেনা। এখন লুকিয়ে করছে পরবর্তীতে প্রকাশ্যে করবে। এরচেয়ে বোধহয় ভালো চুপ করে যাওয়া। নাজিমুদ্দিনও শেফালীর বিচার করবেনা। এমন হওয়াটা কি সত্যিই খুব বেশি দরকার ছিলো? কেনো ওর জীবনটা এমন হয়ে উঠলো? সৃষ্টিকর্তা আর কত খেলবেন ওর সাথে। বিছানায় গিয়ে নিজের গা এলিয়ে দিলো চারু। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার কিন্তু সে কাদবেনা বলে মনস্থির করলো। এমন জঘন্য লোকেদের জন্য কিসের কান্নাকাটি? হামিদ যখন একবার ফিরে এসেছে সে আবার আসবে। চারু অপেক্ষা করবে তার জন্য। একবার শুধু হামিদ ফিরে আসুক, এভাবেই চারু ছেড়ে দেবেনা সবাইকে। হামিদের সাথে যাওয়ার আগে সবাইকে সব সত্য জানিয়ে তাদের গ্রাম থেকে বিতারিত করে তারপর যাবে। শেফালীর শাস্তি হওয়া উচিত। জঘন্য শাস্তি। জামাল হোসেন আর নাজিমুদ্দিনও সেই একই শাস্তির ভাগিদার। কিছুক্ষণ পরেই জামাল হোসেন ফিরে এলো। তাকে দেখেই গা ঘিনঘিন করে উঠলো চারুর।
– এই অসময়ে শুইয়া রইছো ক্যান?
– আমার মন চাইছে আমি শুয়ে আছি। তাতে আপনার কি? যান গিয়ে নিজের কাজ করেন। আমি যেমনি আপনার কাজে নাক গলাই না আপনিও তেমনি আমার কাজে নাক গলাবেন না। অসহ্য লাগে আমার আপনাকে। ঘেন্না হয়।
– ক্যান? ঘেন্না হয় ক্যান? আমি তোমারে এত ভালোবাসি তাও আমারে তোমার ঘেন্না হয়?
বিঃদ্রঃ যারা মূল কাহিনির কথা বলছেন তাদের জন্য জানাই আপনারা মূল কাহিনিতেই আছেন। শুধুমাত্র একটা বিষয় নিয়েই চারুলতা সবাইকে খু’ন করে নি। সব গুলো মিলিত কারনই চারুকে এসব করতে বাধ্য করেছে। ধন্যবাদ, হ্যাপি রিডিং।
#স্নেহা_ইসলাম_প্রিয়া
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)
To Be Continued….