আমি সেই চারুলতা পর্ব-৩০

0
2001

(১৮+ এলার্ট। রোজা রাখা অবস্থায় পর্বটা পড়বেন না)

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ৩০
_______________________

– আপনার কাছে পাঁচ মিনিট সময় আছে ভাবার জন্য। আপনি যদি আমাকে বিয়ে করতে চান তাহলে এখনি এই মুহূর্তে বিয়ে করতে হবে।
কলেজ থেকে ফেরার সময় চারুর কথায় হকচকিয়ে গেলো সাজিদ। তার ঠিক বোধগম্য হলোনা চারু ঠিক কি বলতে কিংবা করতে চাইছে।
– আপনার কথার মানে বুঝতে পারলামনা চারুলতা।
– সোজা বাংলাতেই তো বললাম। আপনি যদি আমাকে বিয়ে করতে চান তো এখনই কাজি অফিসে চলুন। আজই আমাদের বিয়ে হবে এবং আজ বিয়ে করেই আমরা বাসায় ফিরবো আর যদি এমনটা নাহয় তাহলে আর কখনোই আমাদের বিয়েটা হবেনা। এখন সিদ্ধান্ত আপনার।
– কিন্তু বিয়ের জন্য তো মা-কে প্রয়োজন। তাকে নিয়ে তারপর,,
– না। বিয়ে হলেই একমাত্র ওনি বিয়ের সম্পর্কে জানবে। তার আগে নয়।
– কিন্তু চারুলতা,,
– পাঁচ মিনিট থেকে অলরেডি দুই মিনিট পার হয়ে গেছে সাজিদ। আপনার কাছে আর তিন মিনিট সময় আছে।
চারু কিছুটা অদ্ভুত সেটা সাজিদ জানে কিন্তু তাই বলে চারু তাকে এমন গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে তা ছিলো সাজিদের কল্পনাতীত। সাজিদের মনে হলো এমনিতেই তার মা চায় চারুর সাথে ওর বিয়েটা হোক তাই তার আপত্তি করার কোনো কারণ নেই। সাজিদ চারুর কথায় সম্মতি জানালো। চারুর ঠোঁটে দেখা মিললো দুর্ভেদ্য, রহস্যময়ী এক হাসির।
– আমি কি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি সাজিদ?
– শতভাগ পারেন।
– আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন?
– বিশ্বাস না করলে আপনাকে আমার জীবনসঙ্গিনী হওয়ার প্রস্তাব করতাম না চারুলতা।
– তাহলে আমার সাথে চলুন।
– কোথায় যাবো?
– এক্ষুনি তো বললেন আমাকে বিশ্বাস করেন। বিশ্বাস করেই নাহয় আমার সাথে কিছুক্ষণ চলুন।
সাজিদ চারুর দেখানো পথে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলো। বেশ অনেকটা দূরে একটা গলির সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে বললো চারু।
– আপনাকে একজনের সাথে দেখা করাতে চাই সাজিদ। দেখা করবেন?
কথাটা বলে চারু সাজিদের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো না৷ চুপচাপ নিচে নেমে গেলো। সাজিদও চারুর সাথেই নীচে নেমে গেলো। কিছুটা দূরেই সাজিদ একজন ছেলেকে দেখলো। বয়স সম্ভবত ২২-২৩। শুভ্র গায়ের রঙে শুভ্র রঙের শার্ট দারুণ শোভা পাচ্ছে। সাথেই পরনে একটি কালো রঙের জিন্স প্যান্ট। সবচেয়ে নজরকাড়া যেই ব্যাপারটা সেটা হলো চারুর সাথে তার মুখের অদ্ভুত রকম মিল। সত্যিই যেকেউ দেখলেই বিশ্বাস করতে বাধ্য এরা ভাই-বোন। জমজ বললেও হয়তো কেউ অবিশ্বাস করবেনা। ছবিতে অনেকবার সাজিদ দেখেছে এই যুবকটিকে কিন্তু সামনাসামনি এই প্রথম,
– বিয়েতে আমি আমার পক্ষের সাক্ষী হিসেবে আমার ভাইকেই রাখবো। আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?
– আপত্তি থাকার কি আছে? কেমন আছো হামিদ?
– ভালোই আছি। আপনে কেমন আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ। তোমার মেয়ে আর স্ত্রী কেমন আছে?
– তারাও ভালাই।
– গাড়িতে উঠে পড়ো তোমরা দুজন। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। (চারু)
সাজিদ আর চারু সামনে বসে পড়লো আর হামিদ বসলো পেছনে। সাজিদ ভাবতেও পারেনি সে এখানে হামিদকে দেখবে।
– হামিদের সাথে কি আপনার রেগুলার যোগাযোগ ছিলো চারুলতা?
– না।
– মাঝে মাঝে হতো?
– না।
– তাহলে হামিদকে কিভাবে ডেকে নিলেন আপনি?
– বলবো না।
সাজিদ কথা বাড়ালো না। সময় করে নাহয় জানা যাবে। এখন চারুকে ঘাটানোর অভিপ্রায় হলো না তার। সাজিদের ধারণা ছিলো না চারু আদেও তাকে বিয়ে করতে রাজি হতে পারে কিন্তু আচমকা এমন কিছু হওয়ায় কিছুটা ভড়কে গিয়েছিলো সে। চারুর অদ্ভুত ব্যাবহারে সাজিদের মনে কিছুটা ভীতি সঞ্চারিত হচ্ছে। সে পারবে তো মেয়েটাকে আবার আগের মতো স্বাভাবিক করে নিতে। সাজিদ জানে একটু ভালোবাসা দিয়েই চারুলতাকে স্বাভাবিক জীবনে আনা সম্ভব কিন্তু সে কি এইটা করতে সক্ষম হবে? চারু কি আদেও তাকে ভালোবাসবে? না বাসলে ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। মোট কথা, চারুলতা নামের এই মায়াবতীকে ভালোবাসায় বাধতে হবে। বাধতেই হবে! কে জানে কখন মেয়েটার প্রতি অমোঘ এক টান সৃষ্টি হয়েছে মন পিঞ্জরায় কিন্তু টান যখন অনুভব হয়েছে মেয়েটাকে তখন নিজের ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে একটা সুন্দর জীবন দেবে বলেই সাজিদ নিজের কাছে দায়বদ্ধ হলো। আজ যেই হাতটি সে ধরবে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি সে হাতটা সে ধরে রাখবে বলে আবারও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো নিজেরই কাছে।

★★★

বিরহ দহনে দগ্ধ করবি আর কত আর,
তুই কি দেখিস না এ হৃদয়ের এত হাহাকার?
তোর বিরহে মোরে পুড়তে হবে আর কতকাল,
তুই কি দেখিস না এ হৃদয়ের সুপ্ত চিৎকার?

চারুর ছবিটি এই নিয়ে কমপক্ষে তিনবার একে ফেললো শিহাব। তিনবারই নিখুঁত আর স্পষ্টভাবে সে আঁকতে সক্ষম হয়েছে নিজের স্বর্ণলতাকে। উপরোক্ত বাক্যগুলো শুধুই শিহাবের দেওয়া তার ভালোবাসার, অতি আকাঙ্ক্ষিত স্বর্ণলতাকে। শিহাবের ভালোবাসার কষ্ট প্রকাশ করে যাচ্ছে এই শব্দগুলো কিন্তু শোনার জন্য শিহাবের স্বর্ণলতা কই? শিহাব ভিতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে৷ নেই! তার স্বর্ণলতা কোথাও নেই। তার দুঃখগুলো শোনার কেউ নেই তাকে ভালোবাসারও কেউ নেই। কেনো সে আটকে গেলো সেই কিশোরীতে? স্বল্পক্ষণের পরিচয়ই তো ছিলো। ভালোবাসা কেনো মুছে না গিয়ে দিনকে দিন আরো গভীর হয়? কেনো ভালোবাসার তৃষ্ণা মিটতে চায়না? শিহাবের আফসোস হয়, চারুলতা কেনো শুধুই তার আবেগ হলো না। আবেগ হলে নিশ্চয়ই এতদিনে ভুলে যেতো কিন্তু ভালোবাসা তো ভোলা যায় না। গভীর মায়ায় জড়িয়ে পড়তে হয় নিজের অনিচ্ছায়। এতটাই গভীর সে মায়া, যেখানে একবার পড়লে সেখানে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। চাইলেও আর সেই ভালোবাসা নামক অতল গহ্বর থেকে বের হওয়া সম্ভব না।
শিহাবের কিছুতেই শান্তি লাগছেনা। এই গ্রামে আসলেই নিরলসভাবে মস্তিষ্কটা শুধু শিহাবকে তার মায়াবতীর কথা মনে করায়। একটুখানি দুদণ্ড শান্তিতে বসার জো নেই। প্রেয়সীর বিরহে কি ভয়ংকর কষ্ট হয় তা কেবল এক ভালোবাসায় পাগল প্রেমিক পুরুষই বর্ণনা করতে সক্ষম। সে ছাড়া আর কারো সাধ্য নেই সে যন্ত্রণার কিয়দংশ অনুভব করার। শিহাব ব্যাগ গোছানো শুধু করলো, এ গ্রামে আর এক মূহুর্ত নয়। স্বর্ণলতার স্মৃতি যে বড্ড পীড়াদায়ক! শিহাবের ব্যাগ গোছানোর মুহূর্তেই ঘরে আগমন ঘটলো জমিদার গিন্নির। শিহাবকে জামাকাপড় গোছাতে দেখেই ভ্রু কুচকালেন তিনি,
– এইগুলা ব্যাগে ঢুকাইতাছস ক্যান বাপ?
– আমি আজ রাতেই গ্রাম ছাড়বো মা।
– আইজ রাইতে গ্রাম ছাড়বি মানে? ক্যান কি হইছে?
– কিচ্ছু হয়নি মা। তার স্মৃতি যে আমাকে বড্ড পোড়ায়। আমি মেনে নিয়েছি মা। যে ভালোবাসবে, ভালোবাসার আগুনে পুড়ে তাকে ছাই হতেই হবে। আমিও হচ্ছি! এই হওয়াটাই স্বাভাবিক বরং না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।
জমিদার গিন্নি ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শিহাবের সামনে। চক্ষুদ্বয় ছলছল করে ওঠে অশ্রুজলে। শিহাব দেখেনা। জমিদার গিন্নি নিজের অজান্তেই অভিসাপ দেয় চারুকে। তার জন্যই ছেলেটার আজ এ দশা। আবার চারুকে অভিসাপ দেওয়ায় নিজ মনেই তওবা করেন। মেয়েটারই বা কি দোষ? সেও যে আরেক পোড়াকপালি, নইলে বাপের বয়সী একটা লোকের সাথে কি এমন মেয়ের বিয়ে হয়? কি ছিলো না এই মেয়ের মাঝে? রুপে গুনে অনন্য।
– শিহাব! একটা কথা কই বাপ?
– বলো মা। তোমার কি আমার অনুমতির প্রয়োজন আছে?
– তুই যাইস না। আমার কথা মান। বিয়া কইরা নে। দেখবি তারে ভুইলা গেছস।
– আমার মায়াবতীর জায়গা কেউ দখল করতে পারবে না মা। আমার হৃদয়ের সিংহাসন অনেক আগেই আমি তার নামে করে দিয়েছি। সেখানে অন্য কারোর বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ আমি মানতে পারবো না। এ যে আমার মায়াবতীর সাথে অন্যায় করা হবে।
– ওর মনে তো ঠিকই অন্যকেউ আছে।
– থাকুক। সে তো আর আমায় কথা দেয়নি তার মনের জায়গাটুকু শুধুই আমার।
– এমনে কইস না বাপ। দেখ কিছু মাইয়ার ছবি আনছি। অনেক সুন্দর। ওই মাইয়ার চেয়ে কম না। তোর নির্ঘাৎ পছন্দ হইবো। তুই খালি একবার দেখ।
শিহাব মুচকি হাসলো। কিছু বললো না, ছবিগুলোও দেখলো না। শিহাব জানেনা ভালোবাসা কি? কিন্তু শিহাবের কাছে ভালোবাসা মানেই স্বর্ণলতা, বিরহ মানেই স্বর্ণলতা, অপেক্ষা মানেই স্বর্ণলতা, কান্না মানেও শুধুই শিহাবের স্বর্ণলতা। স্বর্ণলতাই তার ভিতরের সর্বস্ব দখল নিয়েছে, হৃদয় থেকে প্রতিফোটা ভালোবাসা শুষে নিয়েছে কিন্তু হৃদয়ের সেই খরার জমিনে সে ভালোবাসার ফসল ফলায়নি। অন্যায় করেছে স্বর্ণলতা, ঘোর অন্যায় করেছে কিন্তু এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাধ্য শিহাবের নেই। জমিদার গিন্নি নিশ্চয়ই অনেক বেছে বেছে শিহাবের জন্য মেয়ে দেখেছেন কিন্তু ওনাকে কে বোঝাবে শিহাবের মনের দখল অনেক আগেই শিহাব অন্য কারোর নামে করে দিয়েছে। চাইলেও শিহাব অন্য কাউকে আর সে জায়গা দিতে পারবে না। শিহাবের চিৎকার করে পুরো দুনিয়াকে বলতে ইচ্ছে করছে,

ভালোবাসি আমি যারে ও যারে,
এই জনমে আমি পাই যেনো শুধুই তারে।
যদি তারে না পাই,
এই দুনিয়ায় আমার আর কাউরে চাওয়ার নাই।


জমিদার গিন্নির কথা না মেনে রাতেই গ্রাম থেকে শহরে ফিরেছে শিহাব। সম্পূর্ণ রাস্তাতেই সে অনুভব করেছে তার স্বর্ণলতাকে। কি যাদু করলো কে জানে, শিহাবের নিজেকে বিরহে জর্জরিত কবি বলে মনে হয়। ভালোবাসায় ব্যর্থ এক কবি! শিহাবের অবশ্য আফসোস হয় না। থাক না কিছু ভালোবাসা গোপনে। সব ভালোবাসা কি প্রকাশ করতে হয়? চারুলতা কখনো জানবেও না শিহাবের তার প্রতি এ অদম্য ভালোবাসা। যদিও বা কখনো জানে তাও বোধহয় শিহাব হারিয়ে গেলো সে তাকে খুজবে না। এক মূহুর্তের জন্যেও শূন্যতা অনুভব করবেনা কিন্তু শিহাবের সর্বশ্ব সে দখল করেই নিয়েছে। শিহাব স্থির করলো, কাল সে গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং সম্পন্ন করবে কিন্তু এও খেয়াল করলো সেই মিটিং-এ অংশ নেওয়ার মতো ভালো কোনো জামাকাপড় তার নেই। শিহাব বেড়িয়ে পড়লো নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে। কিছু কেনাকাটা করার প্রয়োজন আছে।

★★★

– এইটা কোথায় নিয়ে এলেন? দেখে তো কাজি অফিস বলে মনে হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে কোনো সপিং মল।
– ঠিকই ধরেছেন।
– আমরা সপিং মলে কেনো এসেছি?
– বিয়ের সপিং করবেন না?
– প্রয়োজন নেই।
– প্রয়োজন আছে চারুলতা। বিয়ে তো দু একদিনের ব্যাপার না, সারাজীবনের ব্যাপার। ছোট্ট ছোট্ট কিছু স্মৃতি থাকা প্রয়োজন।
– এমন হঠাৎ বিয়েই সবচেয়ে বড় স্মৃতি। অতিরিক্ত স্মৃতির প্রয়োজন নেই।
– আচ্ছা বেশি কিছু কিনবো না। নিউ মার্কেটে আমার একজন পরিচিত বিক্রেতা আছে৷ তার কাছ থেকে শুধু একটা শাড়ি কিনবো। হামিদ তুমি বলো না।
– আমার কথা ও শুনে কোনদিন যে আইজ শুনবো?(হামিদ)
– আচ্ছা ঠিক আছে চলুন তবে মনে থাকে যেনো বেশি সময় যেনো না লাগে। (চারু)
– ঠিক আছে বেশি সময় নেবো না।
তিনজনই প্রবেশ করলো মার্কেটের ভিতর। সাজিদের ইচ্ছে পরিচিত সে দোকান থেকে দ্রুত একটা শাড়ি কিনে কিছু প্রসাধনী কিনে নেওয়া তাই সাজিদ সরাসরি সে দোকানের কাছে চলে গেলো যার পাশের দোকানেই শিহাব তার মায়ের জন্য একটা শাড়ি দেখছিলো। কাতান শাড়িতে বেশ সুন্দর ও মায়াময়ী লাগে জমিদার গিন্নিকে। শিহাব খুব পছন্দ করে মায়ের এমন মমতাময়ী রূপ। শাড়িটি দেখে কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো শাড়িটা তার মায়েরই জন্য তৈরি করা হয়েছে তাই শিহাব কোনো চিন্তাভাবনা না করেই শাড়িটি কেনার উদ্দেশ্যে দোকানটিতে যায়।
সাজিদ চারুর জন্য দেখছে লাল রঙের জামদানি শাড়ি। জামদানি শাড়িতে সে আরও একবার চারুকে দেখেছে তাই জামদানি শাড়ি কিনবে বলেই মনস্থির করলো। লাল শাড়িতে সত্যিই চারুকে অসম্ভব মানায়, অবশ্য চারুকে সবকিছুতেই মানাবে বলে সাজিদের ধারণা।
– আপনার কোন রঙ পছন্দ চারুলতা?
– আমার পছন্দের কোনো রঙ নেই। আমার জীবনটাই যেখানে বিবর্ণ সেখানে আবার পছন্দের রঙ!
– কোন শাড়িটি পছন্দ হয় দেখুন। যেটা পছন্দ হয় সেটাই কিনবো।
– আমার কোনো পছন্দ নেই সাজিদ। আপনার যা ভালো লাগে তাই কিনুন।
সাজিদ অসহায় দৃষ্টিতে হামিদের দিকে তাকালো। এমন দৃষ্টির অর্থ বোধহয় হামিদের কাছে সাহায্য চাওয়া।
– আমরা দুজন মিলাই পছন্দ করি। আমার চারুরে সবকিছুতেই মানাইবো। (হামিদ)
– হ্যাঁ সেটাই ঠিক হবে। দেখো তো লালটা ভালো হবে নাকি গোলাপি টা।
– বিয়ার জন্য হইলে লালটাই সুন্দর।

শিহাব মাত্রই শাড়িটি কিনেছে কিন্তু তখনই শিহাবের ফোনে একটি কল এলো। শিহাবের বাবা এক্সিডেন্ট করেছে। কথাটা শুনে এক মুহুর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো সে। কোনোমতে তড়িঘড়ি করে বের হতে চাইলো সেখান থেকে তখনই অনিচ্ছাকৃত ধাক্কা লাগলো এক মেয়ের গায়ে। শিহাবের মাথা সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেছে। তার মাথায় কিছুই আসছেনা সে মেয়েটার চেহারা না দেখেই কোনোমতে দুঃখিত বলে সেখান থেকে সরে আসে।

সাজিদ আর হামিদ মিলে শাড়ি কিনছে বেশ দেখেশুনে। চারুর বেশ দমবন্ধ লাগছিলো দোকানের ভিতর তাই সে বেড়িয়ে এলো কিন্তু দোকান থেকে বের হতে না হতেই কারোর সাথে ধাক্কা লেগে হাত থেকে কলেজ ব্যাগটা মাটির পড়ে গেলো। ছেলেটাকে কিছু বলার আগেই সে কোনোমতে দুঃখিত বলে সেখান থেকে সরে যায়। চারু বুঝতে পারলো আসলেই ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত ছিলো না, তাড়াহুড়োয় ছেলেটা খেয়াল করেনি৷ চারুকে দোকান থেকে বের হতে দেখে তৎক্ষনাৎ হামিদও বেড়িয়ে আসে। সে না বলে বের হওয়ার কারণে একপ্রকার ধমক দিয়েই চারুকে আবার দোকানের ভিতরে নিয়ে গেলো।

কিছুটা দূরে গিয়ে হঠাৎই থমকে গেলো শিহাব। কেনো যেনো মনে হলো ধাক্কা খাওয়া মেয়েটির সাথে সে পূর্বপরিচিত। মেয়েটির শরীর থেকে অদ্ভুত এক সুগন্ধি বেড়িয়ে আসছিলো যা শিহাব পেতো চার বছর আগে নিজের স্বর্ণলতার শরীরে। নাহ! শিহাবের ভুল হয়নি, সে নিশ্চিত এইটা স্বর্ণলতার গায়েরই গন্ধ ছিলো। শিহাব পেছনে ফিরে তাকালো কিন্তু সেখানে দেখা গেলো না কাউকেই। শিহাব আরেকটু এগিয়ে এদিক সেদিক খুজতে শুরু করলো কিন্তু এরই মাঝে দ্বিতীয় বার কল এলো শিহাবের ফোনে। জমিদার সাহেবের রক্ত প্রয়োজন। রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। ও নেগেটিভ রক্তের গ্রুপে এখন কাউকেই পাওয়া যাচ্ছেনা কিন্তু শিহাবের রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। তাকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে বলা হলো নইলে বড় কিছু হয়ে যেতে পারে। আঘা*ত গভীর, মৃ*ত্যুর আশংকা অবধি রয়েছে। শিহাবও হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলো মার্কেট থেকে আর এরই সাথে সে দ্বিতীয় বারের মতো হারিয়ে ফেললো নিজের স্বর্ণলতাকে। বুকটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে কিন্তু এত কিছুর ভীড়ে এই শূন্যতার কারণ খোজার বিশেষ সময় পেলো না শিহাব।

★★★

তিন কবুল পড়ার মাধ্যমে সাজিদকে নিজের স্বামী হিসেবে গ্রহণ করলো চারুলতা। সাজিদের এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা সত্যিই চারুলতার সাথে তার বিয়ে হয়েছে তবে চারুর মধ্যে কোনো রকম অনুভূতি দেখা যাচ্ছেনা। এমন একটা ভাব যেনো সব স্বাভাবিক। সিঁদুররাঙা জামদানি শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে চারু৷ মুখমন্ডলে প্রসাধনীর লেশমাত্র নেই তাও অপূর্ব স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। সাজিদ কাজিকে তার সম্মানি দিতে গিয়েছে। চারু আর হামিদ দাঁড়িয়ে আছে কাজি অফিসের বাইরে,
– আমরা কি ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম চারু?
– জানিনা।
– যদি ভুল হয়?
– আমার সাথে যা খারাপ হয়েছে তারচেয়ে বেশি খারাপ হওয়ার আছে বলে আমি মনে করিনা। আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে সাজিদ ও নাজমা বেগম কোনো না কোনোভাবে বসের সাথে সম্পর্কিত।
– মানে? তাইলে তুই সাজিদরে বিয়া করলি ক্যান?
হামিদ অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে কথাটা বললেও চারু খুব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো।
– বসের সাথে সম্পর্কিত মানে এই নয় তারা বসের দলে। আমার মনে হচ্ছে তাদের পরিবারটির সাথে কোনো না কোনোভাবে বস নামক সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিটির যোগসূত্র রয়েছে। আমার রহস্যের জট খোলার আগে এই পরিবারের রহস্য জানা প্রয়োজন।
– তারাও যদি খারাপ হয়?
– আমি মানষিক ভাবে প্রস্তুত। এখন আমি সব ধরনের ঘটনা সামলাতে পারবো। সহজে ভেঙে পড়বোনা আমি। আজ যেই চারুলতাকে তোমরা দেখছো তাকে অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে তৈরি করেছি আমি। আমি এমনই এক চারুলতা যার ভিতরে হাজার ঝড় বয়ে গেলেও মুখে তার ছিটেফোঁটা অবধি প্রকাশ পাবেনা।
– আমি তাইলে ঠিকই ধরছিলাম। তুই অনুভূতিহীন না। তুই শুধু অনুভূতি গুলা লুকায়া রাখিস।
চারু কিছু না বলে মুচকি হেসে আকাশ পানে চাইলো। জীবনের এক নতুন মোর শুরু হয়েছে চারুর। কে জানে এই জীবন তাকে কোথায় নিয়ে যাবে? তবে চারুর ভয় লাগছেনা, এই জীবন থেকে তার যেমন কিছু চাওয়ার নেই তেমনি কিছু হারানোরও নেই।
– চারু!
– হুম।
– সাজিদরে দেইখা মনে হইলো সে আসলেই তোরে চায় কিন্তু তুই খুব সহজেই তার প্রস্তাবে রাজি হইলি। দুনিয়ায় সহজের মূল্য নাই। সাজিদ যদি তোরে সহজে পাইছে ভাইবা অবহেলা করে?
– অবহেলা অনেক পেয়েছি। এই অবহেলার ভয়ে আমি নিজের লক্ষ্য থেকে সরতে পারিনা। তাছাড়া সাজিদ আমাকে অবহেলা করলে যে আমার কষ্ট হবে এমনটাও না। যদি আমি তাকে ভালোবাসতাম তাহলে বোধহয় কষ্ট হতো, যেহেতু ভালোবাসি না তাই কষ্ট হওয়ারও সুযোগ নেই।
– তুই নিশ্চিত ওরা বসের সাথে সম্পর্কিত?
– না। আমি শুধু অনুমান করছি।
– অনুমানের উপর ভিত্তি কইরা এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া কি উচিত হইলো?
– শুধু অনুমান না। আমি অনেকাংশে নিশ্চিত তবে পুরো নিশ্চিত না। সবচেয়ে বেশি ঘাপলা আছে নাজমা বেগমের মাঝে। ভদ্রমহিলা আমাকে দেখলে একটু বেশিই ভালোবাসা দেখান। কথায় আছে না, “অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ” ব্যাপারটা ঠিক তেমনি। বসের সাথে সম্পর্ক থাক বা না থাক আমি নিশ্চিত নাজমা বেগম সুবিধার না।
– সাবধানে থাকিস চারু। তোরে নিয়া আমার চিন্তার শেষ নাই।
– হুম, চিন্তার চিন্তায় তোমার পেটের ভুড়িটাও কমে গেছে।
হামিদ একবার নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে চারুর দিকে তাকালো। চারু এখনো মুচকি হাসছে। প্রশান্তিকর দৃশ্য! এই দৃশ্য সামান্য থাকলে অন্তত চারুকে বকা যায়না। হামিদ মনে প্রানে চায় চারু ভালো থাকুক। সাজিদের সাথে বিয়ে তো হয়ে গেলো, এই বিয়ে কি চারুকে ভালোবাসার দিশা দিয়ে সুন্দর একটি জীবন উপহার দেবে নাকি চারুর অন্ধকার জীবনটা আরো বেশি অন্ধকারে ঠেলে দেবে? নাহ! চারুর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। সব খবরাখবর রাখতে হবে। চারুকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে হামিদ নারাজ। কিছুক্ষন পরেই সাজিদ ফিরে এলো। ভাগ্য ভালো সাজিদের কাছে সবসময়ই নিজের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকে তাই কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই বিয়েটা মিটে গেছে।
– হামিদ তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি সত্যিই আমাকে আজ অনেক হেল্প করেছো।
– ধন্যবাদ লাগবো না আপনে শুধু আমার চারুরে দেইখা রাইখেন। আমার মা গত হওনের আগে ওর দায়িত্ব আমারে দিয়া গেছে। আমি পুরাপুরি পালন করতে পারি নাই। পারলে ওর জীবনটা অনেক সুন্দর হইতো। আপনের কাছে অনুরোধ যেইটা আমি পারি নাই সেটা আপনি কইরেন। আপনে হয়তো ওরে অনুভূতি শূন্য ভাবতে পারেন কিন্তু ওরে একটু ভালোবাসা দিয়েন দেখবেন ও নিজের সব ভালোবাসা আপনারারেই দিবো। ভালোবাসার মানুষের বড্ড অভাব তার।
– তুমি চিন্তা করো না হামিদ। তোমার বোনের সব দায়িত্ব আজ থেকে আমার। আজ আমি যেই হাত ধরেছি, জীবন শেষ দিন অবধি সুখে, দুঃখে আমি এই হাত ধরে রাখবো। নিজের সবটা দিয়ে খুশি রাখার চেষ্টা করবো চারুলতাকে।
– আপনি খুবই অদ্ভুত সাজিদ। আমাকে আপনি সম্মোধন করেন আর আমার বড় ভাইকে তুমি।
– আপনারা দুজনেই আমার অনেক ছোট তবে হামিদের চেহারায় বাচ্চা বাচ্চা একটা ভাব আছে। তাকে সহজেই তুমি সম্মোধন করা যায় আর আপনার চেহারায় এক ধরনের গম্ভীর্য আছে যা আপনার বয়সটা আড়াল করে আপনাকে অনেক বেশি ম্যাচুয়র দেখায়।
– আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আমার ভাই ইতিমধ্যেই এক বাচ্চার বাবা হয়ে গেছে।
সাজিদ এবং হামিদ দুজনেই মুচকি হাসলো। হাসির আড়ালেই চাপা পড়ে গেলো আরো অনেকগুলো প্রশ্ন। চারুলতার ভিতর থেকে অনিচ্ছাকৃত একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। অপ্রাপ্তির খাতায় আরো একটা কিছু যোগ হলো। কি যেনো একটা পাওয়া হলো না। সেই অপ্রাপ্তির নাম কি শিহাব? এই অযাচিত প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারলো না চারুলতা নিজেও।

★★★

বধু বেশে চারুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলেন নাজমা বেগম। আরও বেশি অবাক হলেন সাজিদকে পাশে দেখে। চারুলতা নাজমা বেগমের পা ছুয়ে সালাম করতেই তিনি হালকা বাধা দিলেন।
– এইসব কি মা? তোমার এই সাজপোশাক কেনো?
– মা আমি আর চারুলতা আজ বিয়ে করেছি।
নাজমা বেগম অবাক হলেও ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।
– বিয়ে করেছিস? কখন? আমাকে জানালি না কেনো?
– আমরা দুজনেই এডাল্ট আন্টি। আমাদের অভিভাবক প্রয়োজন নেই।
নাজমা বেগমের মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেলো, সাজিদও স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। সে ভাবতেও পারেনি চারু এমন একটা জবাব দেবে। চারু মূলত নাজমা বেগমকে একটু বাজিয়ে দেখতে চাইছে। তার আচার আচরণ পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
– এসো তোমরা ভেতরে এসো।
দুজনেই ভেতরে প্রবেশ করলো। চারু সোফায় বসলেও সাজিদ নিজের ঘরে প্রবেশ করলো। কাগজপত্র গুলো আগে ভালো করে রাখা প্রয়োজন।
– তুমি কি আমার উপর কোনো কারণে রেগে আছো মা?
– না তো। রাগ করবো কেনো?
– না মানে আমাকে না জানিয়েই বিয়ে করলে এর জন্য জিজ্ঞেস করলাম।
– না আন্টি আসলে হঠাৎ করেই,,
– থাক মা বলতে হবেনা। বিয়ে করে নিয়েছো ভালো কথা। আমিও চাইতাম তোমাকে আমার ছেলের বউ করবো। কি যে খুশি লাগছে আমার, তোমাকে বোঝাতে পারবো না মা।
নাজমা বেগমের খুশিটা স্পষ্ট। তিনি সত্যিই খুশি হয়েছেন। কোনো বায়োনাট কথা বা খুশি তিনি প্রকাশ করছেন না কিন্তু খুশি হওয়াটাই অস্বাভাবিক লাগছে চারুর কাছে। তিনি কেনো খুশি হবেন? না জানিয়ে বিয়ে করার কারণে একটু হলেও তো মন কষাকষি হওয়ার কথা।

দুপুর বেলা চারুর সকল জিনিসপত্র ছাদের সেই ঘরটার থেকে সাজিদের ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। মাঝে মাঝে দু একজন প্রতিবেশী এসে দেখে যাচ্ছেন চারুকে। মোটামুটি সকলেই প্রসংশা করছে চারুর। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার চারু যে এখানে এতদিন যাবত আছে তা তারা কেউই জানতো না। নাজমা বেগমও সবাইকে বলেছেন তিনি নিজেই সাজিদকে বিয়ে করিয়ে চারুকে ঘরে তুলেছেন। চারুও মোটামুটি হাসি মুখেই সকলের সাথে কথা বললো। সারাদিন ক্লান্তি শেষে চারু ঘরে যাওয়ার সুযোগ পেলো। ক্লান্তিতে শরীর অবসাদ হয়ে আসছে। শরীরে বিন্দুমাত্র জোর পাওয়া যাচ্ছেনা তার উপর আজ থেকে অন্য আরেকজনের ঘরে থাকতে হবে তাকে। অন্য আরেকজন পুরুষের সাথে থাকতে হবে। জামাল হোসেনের কথা মনে আসতেই ঘৃণায় চোখমুখ কুচকে এলো চারুর। সাজিদও কি এমন ব্যবহার করবে? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। যা কিছুই হতে পারে। চারু লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হতেই সাজিদকে দেখা গেলো। কিছু ফাইল নিয়ে কাজ করছে সে। চারুর সাথে চোখাচোখি হতেই একটু মুচকি হাসলো তবে চারু হাসলো না। অকারণ হাসা পাগলের লক্ষণ।
– রাতে কিছু খেয়েছেন চারুলতা?
– খেতে ইচ্ছে করছিলো না।
– অনেক সময় ইচ্ছের বাইরেও অনেক কিছু করতে হয়। সারাদিন নিশ্চয়ই সকলের সাথে হাসি মুখে কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। আপনি তো আবার হাসতে পছন্দ করেন না।
কথাটা বলে হাসলো সাজিদ নিজেই তবে চারু হাসলো না। সাজিদ একটা প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে এলো তবে চারুর কেনো যেনো খেতে ইচ্ছে হলো না।
– খেয়ে নিন চারুলতা।
– বিশ্বাস করুন আমার সত্যিই খেতে ইচ্ছে করছেনা।
– ওইযে বললাম অনেকসময় ইচ্ছের বাইরেও অনেক কিছু করতে হয়। আমার কিন্তু অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো বউয়ের হাতে খাবার খাওয়া। এই আশায় আমিও আজ রাতে খাইনি।
– কেনো, আপনার প্রাক্তন স্ত্রী কি আপনার সেই আশা পূরণ করেনি?
সাজিদ কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করলো। চারুর এমন উত্তর সে আশা করেনি।
– সায়মার কাছে এইসব ন্যাকামি মনে হতো চারুলতা। তার কাছে এসবের জন্য সময় ছিলোনা। আজকে আমাদের দিনে তার কথা না টানি?
– হুম। তবে আপনার আশা রাখতে আপনাকে খায়িয়ে দিতেই পারি তবে আমি খাবো না।
– আমার জন্য নাহয় আজকে একটু কষ্ট করলেন।
চারুলতা কথা না বাড়িয়ে খাবারের প্লেট নিয়ে বসলো।
– আপনার নিজের স্বামীকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন ছিলো না চারুলতা?
– স্বামীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার আগেই আমার বিয়ে হয় আর বিয়ের পর তার জঘন্য রূপ দেখে আর স্বপ্ন দেখাটা হয়ে ওঠেনি।
– দেখতে ইচ্ছে হয়না?
– সত্যি বলতে হয়না তবে ছোট বেলায় আমি নৌকায় চড়তে খুব ভালোবাসতাম। আমার ভাই সবসময় নৌকায় চড়লেও আমাকে কখনো নেয়নি। তখন মা বলতো আমার স্বামী নাকি আমাকে নিয়ে নদীতে জোৎস্না বিলাস করবে। এই শব্দটা আমার কাছে নতুন ছিলো তাই ভাবতাম সে আমাকে নিয়ে রাতের বেলায় নৌকায় উঠবে। অনেকদিন পর্যন্তই এ ইচ্ছে ছিলো আমার। অবশ্য অন্যান্য ইচ্ছের মতো এই ইচ্ছেও মরে গেছে অনেক আগেই।
– জোৎস্না বিলাস করবেন চারুলতা?
– আমার জানামতে ঢাকা শহরে এই মস্ত বড় বড় বিল্ডিংয়ের মাঝে জোৎস্না বিলাস হয়না।
– কে বলেছে হয়না? করলেই হয়। চলুন খাওয়া শেষ করে জোৎস্না বিলাস করবো।
চারুলতা কথা বাড়ালো না। খাওয়া শেষ হতেই সাজিদ চারুকে নিয়ে গেলো ট্যারেসে। সৌভাগ্যক্রমে আজ পূর্ণিমা। পূর্ণ চন্দ্র নিজের আলো ছড়িয়ে চারদিক মোহময়ী মায়ায় আবৃত করে দিয়েছে। চাঁদের নরম আলোয় ঢাকার এই মস্ত বড় বিল্ডিং গুলোও সুন্দর লাগছে। আসলেই কিছু জিনিস সবসময়ই আশেপাশের সবকিছুকে মায়াময়ী করতে সক্ষম। আকাশের চাঁদ পরিবেশকে মায়াময়ী রূপ দান করছে আর সেটার দিকে তাকিয়ে থাকা চারু মুগ্ধ করছে সাজিদকে। এই মেয়েটা সত্যিই অনন্যসাধারণ। হাজারো খারাপ কাজ করার পরেও হয়তো মেয়েটার প্রতি কেউ ঘৃণার অনুভব আনতে পারবেনা। এমন মায়াবী চেহারা কি আদেও ঘৃণা করা যায়?
– একটা কথা বলি চারুলতা?
– বলুন।
– বললে বিশ্বাস করবেন?
– বিশ্বাস করার মতো হলে করবো।
– আমি আপনাকে ভালোবাসি চারুলতা। বিশ্বাস করেছেন?
– পুরোপুরি করতে পারছিনা। সে যোগ্যতা কি আদেও আমার আছে।
– আপনি নিজেও জানেন না আপনার মাঝে ঠিক কি আছে। হাজারো অস্বস্থির ভীড়ে এক টুকরো প্রশান্তি আপনি। আপনাকে হাজার বার ভালোবাসি বললেও আমি ক্লান্ত হবো না চারুলতা।
– গুছিয়ে কথা বলতে জানেন আপনি।
– আপনার চেয়ে বেশি সম্ভবত নয়।
– আমাকে ভালোবাসা সহজ না সাজিদ।
– আমি যে সেই কঠিন কাজ করে দেখিয়েছি চারুলতা। শেষ পর্যন্ত আপনার হাত ধরে থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি। আমার ভালোবাসা দ্বারা আপনার জীবনের বিষাদময় কাটাগুলো আমি দূর করে দেবোই চারুলতা।
– মিথ্যা আশা দেবেন না সাজিদ। আমি যে ভালোবাসা প্রচণ্ড ভয় পাই।
– আমি জানি না আপনার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা কি তবে আমি আপনাকে আমার সকল ভালোবাসা দিতে চাই। আমার ভালোবাসায় বিলীন হয়েই নাহয় আপনি ভালোবাসার নতুন সংজ্ঞা দেবেন।
চারু কোনো উত্তর দেয়না। দিতে ইচ্ছে হয়না। আসলেই চারুর বাঁচতে ইচ্ছে হয়। খুব করে বাঁচতে ইচ্ছে হয় কিন্তু বাঁচার জন্য তার কোনো কারণ নেই। আজ খুব করে ইচ্ছে করছে কারোর জন্য বাঁচতে।
– চারুলতা!
– হুম।
– আমি কি আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারি।
– পারেন।
সাজিদের ধারণা ছিলো চারু লজ্জায় মুখ লুকাবে কিন্তু এমন কিছুই হলোনা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনুমতি দিলো সে। অবশ্য সাজিদের আগেই ভাবা উচিত ছিলো সে অন্য কোনো মেয়ে নয় বরং চারুর সাথে আছে৷ এই মেয়ে তো ভিন্ন হবেই। সাজিদ এক হাত দিয়ে জড়িয়ে নিলো চারুকে। কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে সে কিন্তু চারুর মাঝে এমন কিছুই লক্ষণীয় নয়। সাজিদ ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলো চারুর। চারু বাধা দিলো না। চারুর বাধা না পেয়ে আরো একটু কাছাকাছি সে চলে গেলো। নিজের অধোর জোড়ার স্পর্শ দিলো চারুর কাধে। চারুর কেমন অনুভূতি হচ্ছে তার জানা নেই কিন্তু নিজের ভিতর অন্য এক সাজিদকে অনুভব করছে সে। সেই সাজিদ খুব করে কাছে পেতে চায় তার কাছে বসে থাকা রমণীকে যার সাথে আজই সে আবদ্ধ হয়েছে এক পবিত্র বন্ধনে। কাধ ছাড়িয়ে সেই অধর জোড়া নেমে পৌছালো গলাতে। একের পর এক এলোমেলো স্পর্শ দিয়ে চললো সেখানে। নিজের অজান্তেই তার একহাত শাড়ির ভিতর দিয়ে জাপটে ধরলো চারুর কোমড়ে। আরেক হাতে মাথার পেছনে যেখান থেকে সে কাছাকাছি আনতে চাইছে অপরূপ সুন্দরীর এলোমেলো কেশ। নিজেকে মিশিয়ে নিতে চাইছে তার সাথে। ধীরে ধীরে দুই জোড়া অধর মিলিত হলো পরষ্পরের সাথে। সাজিদ এলোমেলোভাবে চারুকে চাইলেও চারু কেমন যেনো নিশ্চুপ। সে আবারও গভীর আবেগ নিয়ে অধর ছোয়ালো আরেকজোড়া অধরে। গভীর আবেগে প্রকাশ করতে চাইছে নিজ আকাঙ্ক্ষা কিন্তু পরক্ষনেই থেমে গেলো অপরদিকের নিশ্চলতা দেখে।
– কি হলো চারুলতা?
– কি?
– আপনি রেসপন্স করছেন না কেনো? আপনি কি আমাকে চান না?
– আমি কিছু অনুভব করতে পারছিনা সাজিদ।
মুহূর্তের মাঝেই এক ধাক্কা খেলো সাজিদ। মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো,
– আপনি আমাকে ভালোবাসেন না চারুলতা। আপনি আমাকে ভালোবাসেন না।
– হুম বাসি না।
– তাহলে আমাকে বিয়ে কেনো করলেন?
– আগেই তো বলেছিলাম আমাকে ভালোবাসা ওত সহজ নয়। তবে আপনাকে আপনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবোনা সাজিদ। আপনি নিজের প্রাপ্য বুঝে নিতে পারেন। আমি বাধা দেবোনা।
– আমি আপনার দেহের দখল নয়, মনের দখল চাই। দেহের দখল তো সবাই নিতে পারে। মনের দখল না নেওয়া অবধি নাহয় আমি অপেক্ষা করলাম।
– করতে পারবেন?
– আমি জামাল হোসেন নই যে আমার কাছে শরীরই সব। আমি সাজিদ৷ আমি আপনাকে চাই চারুলতা। সম্পূর্ণ আপনিটাকেই আমার চাই।
– আমিটাকে পাওয়া যে এত সহজ না। এত অপেক্ষা সহ্য হবে তো?
– আমি অপেক্ষার বিষ পান করতে চাই চারুলতা। আমার আপনিটাকেই চাই। পুরোটা চাই।
– দেখা যাক!
– চারুলতা!
– হুম।
– আপনার শরীরে মোহনীয় বেলি ফুলের সুভাষ ভেসে আসে কেনো? আমি কি আপনাকে বেলি ফুল বলে ডাকতে পারি?
চারুর ভিতরটা হঠাৎই কেমন করে উঠলো। মস্তিষ্কের এক কোণে নাড়া দিলো ছোট্ট এক স্মৃতি, ছোট্ট এক অনুমতি বাক্য, “আমি কি তোমাকে স্বর্ণলতা বলে ডাকতে পারি?” চারুর জানা নেই হঠাৎই কেনো তার এ কথাটি মনে পড়ে গেলো। চারু অত্যন্ত সুকৌশলে নিজেকে সামলে নিলো। নাহ! শিহাবকে ভাববেনা সে। সে এখন অন্য কারো স্ত্রী। শিহাবকে ভাবা তার শোভা দেয়না। শিহাবকে সে স্বর্ণলতা ডাকার অনুমতি দেয়নি কিন্তু সাজিদকে দেবে। সাজিদই এর আসল হকদার।
– হুম ডাকতে পারেন।
সাজিদের ঠোঁটে ভালোবাসাময় প্রাপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।

#শুভ্রা_আহমেদ_প্রিয়া

বিঃদ্রঃ বড় পর্বে রিচ কম হয়। যারা পড়বেন প্লিজ রেসপন্স করবেন।

_______________________

To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here