আমি সেই চারুলতা পর্ব-৪২

0
2867

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ৪২ (শেষ পর্বের প্রথম অংশ)
_________________________

মেঘে ঢেকে আছে সম্পূর্ণ আকাশ। আকাশে বাতাসে কান্নার ধ্বনি। ফাতেমার বাড়ির লোকেরাই কান্না করছে অথচ বেঁচে থাকতে কেউ কখনো কোনো খবর নেয়নি তার। হামিদের কালো পদ্মের গায়ে আজ সাদা কাফন। হামিদ বলেছিলো সাদা নাকি কালো গায়ের রঙে মানাবেনা কিন্তু ফাতেমাকে মানাচ্ছে। কি ভীষণ শুভ্র লাগছে তাকে! নিষ্পাপ পবিত্র কালো পদ্ম আজ সাদায় ঢেকে গেছে। হামিদ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে চৌকিতে। এখনো যেনো বিশ্বাস হতে চায়না তার, কেনো সে পদ্মের নাম মুখে এনেছিলো? ফাতেমাকে পদ্মের কথা না বললে তো আজ সে বেঁচে থাকতো। তবে কি ফাতেমা হামিদের ভালোবাসার জন্য এতটাই মরিয়া ছিলো যে নিজের জীবন ঝুকিতে ফেলতে সে দ্বিতীয়বার ভাবেনি? মাথাটা ভীষণ ফাকা ফাকা লাগছে, পানিতে ডুবে ফাতেমার মুখ সাদা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে কিন্তু এই সাদা তো হামিদ চায়না, সে তো তার কালো পদ্মই ফেরত চায়। এই সাদার কোনো প্রয়োজন তার নেই। তবে কেনো এতদিন অবহেলা করে এসেছে তাকে?
লতা কান্না করে চলেছে ফাতেমার কাছে যাওয়ার জন্য। চারু থামাতে পারছেনা তাকে। এমনকি হামিদও পারছেনা। যেই মেয়ে বাবা বলতে পাগল আজ সে বাবার কাছেই থাকতে চায়না। সন্তান যতই বাবার ভক্ত হোক না কেনো দিন শেষে মা-কে তার চাই-ই চাই। এইটুকু মেয়ে কিভাবে থাকবে মা ছাড়া?
ফাতেমাকে যখন পানি থেকে তোলা হয় তখন কি সুন্দর করে সেজে ছিলো সে। হামিদ রাতে ঠিক যেভাবে বলেছিলো ঠিক সেভাবেই সেজেছিলো ফাতেমা। কম ছিলো শুধু পদ্মফুল। তবে ফাতেমার কি আদেও পদ্মফুলে সাজার প্রয়োজন ছিলো? হামিদের এখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, “আমি ক্যান সাজতে বলছিলাম তোমারে পদ্মফুলে? আমি আগে ক্যান বুঝি নাই তুমিই আমার পদ্মফুল!” কিন্তু বলা হয়না, শোনার জন্য হামিদের কালো পদ্ম কই? হামিদ বাইরের কোনো পরপুরুষকে ভেতরে আসার অনুমতি দেয়নি। ফাতেমা অতিপ্রয়োজন না হলে কখনো বাইরের পুরুষের সামনে যেতো না সেখানে তার মৃত্যুর পর কিভাবে পরপুরুষ তাকে দেখতে পারে? আর তাছাড়া হামিদের কালো পদ্ম অন্য কেউ দেখবেই বা কেনো? হামিদ ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ফাতেমার খাটিয়ার কাছে। চুপচাপ বসে তার একহাত ধরে বললো,
– তুমি তো ভারি অভদ্র মাইয়া। একদমই আমার কথা শুনো না। আমি কি তোমারে কইছি আমারে রাইখা যাইতে? এত সাহস কই পাও যে তুমি আমারে রাইখা না ফেরার দুনিয়ায় চইলা যাও। একটুও ভয় হইলো না তোমার?
হামিদ নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলে। সে নিজেই তো বলেছিলো ফাতেমাকে ম*রে যেতে। ফাতেমা মরে গেলে ও অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে পারে, তবে আজ কেনো এত তীব্র অনুভূতি হচ্ছে? কেনো মনে হচ্ছে এই কালো মেয়েটা ছাড়া আর কাউকে জীবনে আনা সম্ভব না? তবে কি মানুষের প্রকৃতিই এমন, থাকতে মূল্য দেয়না অথচ হারিয়ে গেলে পাগলপ্রায় দশা হয়। কিন্তু এখন যে কাদতে কাদতে মরে গেলেও মানুষটা আর ফিরে আসবেনা। তীব্র অভিমান, অপূর্ণ ভালোবাসা আর একরাশ অবহেলা নিয়েই যে সে বিদায় নিলো। আর দিয়ে গেলো আকাশ সম ভালোবাসা যার মর্মতা হামিদ কখনো বুঝতেও পারেনি।
– ফাতেমা তুমি আমারে জিজ্ঞেস করছিলা না আমি তোমারে ভালোবাসি কি না? তহন উত্তর দেই নাই, উত্তর তো জানতামই না। এহন শুনো আমি ভালোবাসি তোমারে। তুমি বলছিলা না আমার ভালোবাসার জন্য তুমি সব করতে পারবা? এহন উঠো। আমি তো বলছি আমি তোমারে ভালোবাসি, এইবার তুমি নিজের কথা রাখো।
ফাতেমা উত্তর দেয়না, উঠেও না। হামিদের মনে হচ্ছে তার যেনো হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসছে,
– কি হইলো? উঠো না ক্যান? একবার উঠো, এতদিন করা সব অবহেলার প্রায়শ্চিত্ত করমু আমি। রানীর হালে রাখমু, অনেক ভালোও বাসমু। উঠো তুমি। তোমারে মাটি দিতে দিমু না আমি। আমার কালো পদ্ম আমার কাছেই থাকবো। তুমি তো আন্ধারে ভয় পাও, তুমি ক্যামনে ওই অন্ধকার ঘরে একলা থাকবা?
– আদেও কি কোনো লাভ আছে? থাকতে তো তাকে কখনো ভালোবাসনি। প্রতিনিয়ত অবহেলা করে এসেছো আর এখন তার যখন ফিরে আসার পথ নেই তখন ভালোবাসা দেখাচ্ছো? এইসব যা তা অভিনয় বন্ধ করো। আমার ভাবতেও ঘৃণা হয় তুমি আমার ভাই। তুমি মেরে ফেলেছো ভাবিকে। তোমার অবহেলা দিয়ে মেরেছো। এমনকি মৃত্যুর আগের দিনও যা তা শুনিয়েছো তাকে। তোমার আর নাজিমুদ্দিনের মাঝে কি পার্থক্য রইলো বলতে পারো? দুজনেই এমন নারীদের খু*ন করলে যারা তোমাদের নিজেদের জীবন দিয়ে ভালোবাসে। আসলে রক্ত খারাপ তো, মানুষ কিভাবে ভালো আশা করা যায়?(চারু)
– তুই অন্তত আমারে ভুল বুঝিস না৷ তুই ভুল বুঝলে আমি কই যামু। বিশ্বাস কর, আমি সত্যিই চাই নাই এমনটা হোক। আমি চাই নাই সে এইভাবে চইলা যাক।
– সে মা*রা যাক তা চাওনি অথচ তাকে কোনোদিন সুখে বাঁচতেও দাওনি। তোমরা সব পুরুষ এক। ভালোবাসার মূল্য দিতে জানোনি। শেষ কয়েকটা দিন তুমি ভাবির সাথে কেমন আচরণ করেছো তার সবটাই লক্ষ্য করেছি আমি। কেনো করেছিলে এমন? বিন্দিয়ার জন্য? তাহলে এখন কেনো ভান করছো? রাস্তা তো পরিষ্কার হয়েই গেলো তাই না?
অনেকক্ষণ যাবত মাথায় কথাগুলো ঘুরছিলো চারুর। হামিদকে একা পেয়ে কথাগুলো বলতে সে ভুললো না। মনের কথা গুলো বলার এরচেয়ে ভালো সময় কি হতে পারে? নিজের ভুল উপলব্ধি করতে হবে হামিদকে। যাকে বেঁচে থাকতে ভালোবাসেনি, মৃ*ত্যুর পর কিসের অনুভূতি তার জন্য? চারু দাঁড়ায় না সেখানে। হামিদকে আরো কিছু কথা শুনিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।

★★★

ফাতেমার কবরে মাটি দেওয়া হয়েছে ঘন্টাখানেক আগে। সবাই চলে গেছে কবরস্থান থেকে শুধু কবর থেকে কিছুটা দূরে বসে আছে হামিদ। গাছের সাথে হেলান দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফাতেমার কবরের দিকে। হামিদের কথায় মনোরমার পাশে কবর দেওয়া হয়েছে তাকে। অনেকক্ষণ একটানা চুপচাপ বসে থাকার পর হামিদ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো মনোরমার কবরের পাশে,
– কেমন আছো মা? আমি কিন্তু ভালো নাই জানো। আমি মা ছাড়া যতটা কষ্ট করছি আমার মাইয়াটারে তেমন কষ্ট পাইতে হইবো। মা ছাড়া কি বাঁচা যায় কও? আমার মাইয়াটা যতটা না বাচ্চা তার চেয়ে বেশি বাচ্চা ছিলো আমার বউটা। ও প্রচন্ড বোকা জানো মা। কিচ্ছু ঠিকমতন করতে পারেনা নইলে গ্রামের মাইয়া হইয়া কেউ কি পানিতে ডুইবা মরে বলো? পানিরে নাকি ভয় পাইতো, কি অদ্ভুত না! সেই ছোটবেলা থেইকা কত নদীতে ডুবাইছি তার হিসাব নাই। সে না অন্ধকারেও খুব ভয় পায়। একদম সহ্য করতে পারেনা অন্ধকার কিন্তু আমিই তার জীবনটা অন্ধকারে ঢাইকা দিছিলাম। তারে একটা সুন্দর জীবন আমি দিতে পারতাম মা কিন্তু আমি দেই নাই। তোমার পোলা হইয়াও একটা মাইয়ারে আমি অনেক কষ্ট দিছি। ওরে আমার আর চারুর মতো কইরা দেইখা রাইখো মা। ও-ও তো তোমার মাইয়ার মতনই। অন্ধকারে একা থাকতে ভয় পায়। তুমি সবসময় ওর সাথে সাথে থাইকো আর ওরে বইলা দিও, আমি অসময়ে ভালোবাসছিলাম আমার কালো পদ্মরে। তার শূন্যতা আমারে ভালোবাসতে শিখাইছে। ভালো তো তারে আগেই বাসতাম মা, কিন্তু আমি বুঝি নাই। সে আমারে এতই ভালোবাসতো, তার ভালোবাসায় আমি এতটাই পরিপূর্ণ ছিলাম কহনো ভাবিই নাই আমারও তারে ভালোবাসা উচিত। সেও ভালোবাসা চায়, আর আইজ যহন বুঝলাম তহন অনেক দেরি হইয়া গেলো। কিন্তু কি লাভ! ও তো জানবো না মা। চারু ঠিকই কয় জানো, আমি আসলে ওর যোগ্যই ছিলাম না। এত ভালোবাসা কি কোনো স্বাভাবিক মানুষ পায়ে ঠেলতে পারে কও? আমার না অনেক কান্না পাইতাছে মা কিন্তু আমি পারতাছি না। বারবার মনে হইতাছে ওর জন্য কান্দনের যোগ্যতাও আমার নাই। ক্যামনে থাকবো কও, ঝগড়া লাগলেই তো কইতাম তুই মইরা যা। তুই মরলে আমি বাঁচি। এহন কোন মুখে তার বিরহে চোখের জল ফেলমু। আমি সময় থাকতে ক্যান বুঝলাম না মা? আচ্ছা এইটা কি স্বপ্ন হইতে পারেনা? একটা বার আমারে সুযোগ দেওয়া যায়না ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করনের? কও না মা, যায় না? একবার খালি সুযোগ পাই, আর কোনোদিন আমি তারে অবহেলা করমু না।
হামিদ চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করতে থাকে এইগুলো যেনো শুধুই এক স্বপ্ন হয় আর এখনি ভেঙে যাক এই সর্বনাশা ঘুম। কিন্তু ঘুম ভাঙেনা। এইসবও স্বপ্ন হয়না। চোখে বাধ দিয়ে রেখেছে ঠিকই কিন্তু অন্তরের বাধ ভেঙে গুড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। সে হারিয়ে ফেলছে নিজের কালো পদ্মকে। এমন মহামূল্যবান কালো পদ্ম, যে কালো পদ্ম তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে গেছে আজীবন। সন্ধ্যা ছাড়িয়ে রাত নেমেছে ধরনীর বুকে। হামিদ কুপি জালিয়ে রাখলো কবরের পাশে,
– অন্ধকারে ভয় লাগে না তোমার? আলো দিলাম, ভয় পাইয়ো না। আমি আছি।
হামিদের আরো একবার আফসোস হয়, বেঁচে থাকতে সে কখনো ফাতেমাকে বলেনি, ভয় পেয়ো না, আমি আছি। অথচ ফাতেমা বোধহয় প্রতিবার ভয় পেলে হামিদের কাছে আসতো এই কথাটাই শুনতে। হামিদ কতক্ষণ এভাবে বসে ছিলো সে নিজেও জানেনা কিন্তু সিফাত যখন তাকে নিতে এলো তখন প্রায় মধ্যরাত।

হামিদ ঘরে প্রবেশ করতেই বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠলো। কি ভীষণ খালি খালি লাগছে ঘরটাকে। কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। লতাকে সম্ভবত চারু নিয়ে গেছে। হামিদ নিজের শার্টটা খুলে বিছানায় ছুড়ে মারলো। কোনোমতে বিছানায় বসে মাথার চুলগুলো দু’হাতে চেপে ধরলো। এ কেমন অস্থিরতাবোধ! হামিদের ইচ্ছে হচ্ছে ওর আয়ুর অর্ধেকটা দিয়ে হলেও যেনো ও বাঁচিয়ে তোলে ফাতেমাকে। সৃষ্টিকর্তা কেনো এমন সুযোগ দিলো না? কেনো নিজ ইচ্ছায় একজনের আয়ু অন্যজনকে দেওয়া যায়না। কালো পদ্মের এই হাজার হাজার স্মৃতি কিভাবে ভুলে যাবে সে? কেনো শুকিয়ে গেলো পদ্মফুল? অবশ্য শুকোনোরই কথা, পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান পদ্মটি ছিলো হামিদের। পৃথিবীর একমাত্র কালো পদ্ম, কিন্তু কালো বলে সেই পদ্মকে অবহেলা করেছে হামিদ। সঠিক জিনিসের মূল্য সে দিতে পারেনি তবে পদ্ম কেনো শুকাবে না?
ঘরে কুপি জ্বলছে। মৃদুমন্দ আলো! হামিদের মনে পড়ে কাল রাতের কথা, কালও ফাতেমা ছিলো এখানে আর আজ সে শুধুমাত্র এক স্মৃতি। অন্ধকারে ভয় পেয়ে বাতি না নেভানোর অনুরোধ করেছিলো সে। ফাতেমা কিভাবে থাকবে সেই অন্ধকার কবরে? হামিদ মনেপ্রাণে চেষ্টা করছে ঘুমিয়ে যেতে। মনে হচ্ছে যেনো ঘুম ভাঙলেই দেখা যাবে সব স্বপ্ন আর ফাতেমা জাগিয়ে তুলবে তাকে। আর একবার ফাতেমা তাকে জাগিয়ে দিক, আর কখনো ফাতেমাকে অবহেলা করবেনা সে। হামিদ কোনোমতে শুয়ে পড়লো তবে ঘুম আসছেনা। বিছানাটা কেমন খালি খালি লাগছে। কাল রাত অবধি এখানে ওর স্ত্রী ছিলো, ওর মেয়ে ছিলো কিন্তু আজ সে একা। কি ভীষণ দুর্বিষহ রাত এইটা। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফাতেমা আবদার করতো তাকে বুকে নিয়ে ঘুমানোর জন্য। আজ কেউ আবদার করছেনা। কেনো করছেনা? হামিদ তো সবসময়ই ফাতেমার কথা শুনতো তবে আজ যখন ও নিজ থেকে ফাতেমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতে চাইছে তখন সে নেই। হামিদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ফাতেমার বালিশখানি। এখনো ফাতেমার গন্ধ মিশে আছে এই বালিশে। মনে হচ্ছে যেনো ফাতেমাকেই জড়িয়ে ধরে আছে সে। হামিদ চোখ বন্ধ করতেই চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়লো। হামিদ আজ কাদেনি। পুরুষ মানুষদের তো কাদতে নেই কিন্তু নিজের সাথে কতটা যুদ্ধ করা যায়? দিন শেষে এসে সে হেরে যায় নিজেরই কাছে। চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝরে চলেছে। হামিদের চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে। বালিশে মুখ গুজে কেদে চলেছে হামিদ। তার সহ্য হচ্ছেনা এ বিচ্ছেদ। কালো পদ্মের বিরহে পাগলপ্রায় হয়ে গেছে সে।
কালো পদ্ম কেনো বিরহের নাম,
কালো পদ্ম শুধু তোমারি লাগি,
আমার সুখ আজ হারাম।
হামিদ হাজার চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছেনা। হামিদ আসার সময় কিছু ঔষধপত্র নিয়ে এসেছিলো। গ্রামে ফার্মেসি পাওয়া যাবেনা, কারোর কিছু হলে লাগতে পারে। হামিদ সেই ঔষধের বক্সে তন্নতন্ন করে খুজে চলেছে ঘুমের ঔষধ। বরাবরের মতো এবারেও হামিদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন, পেয়েও গেলো সে ঘুমের ঔষধ। কোনোকিছু না ভেবেই দুটো ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিলো। সে এখন শুধু একটু ঘুমাতে চায়। বক্সটা ব্যাগে রেখে উঠতেই যাবে এমন সময়েই চোখ পড়লো একটি ডায়রিতে। ডায়রিটা ফাতেমার। এইটা নিয়ে কখনো বিশেষ কোনো কৌতুহল দেখায়নি হামিদ তবে আজ বেশ দেখতে ইচ্ছে হলো। এখানে কি হামিদ সম্পর্কে কিছু বলেছে ফাতেমা? ফাতেমার অবশ্য ডায়েরি লেখার কথা নয়, সপ্তম শ্রেণী অবধি পড়াশোনা করেই পড়াশোনার ইতি টেনেছে সে। আবার লিখতেও পারে। হামিদ ডায়েরিটা খুললো। বেশ সুন্দর হাতের লেখা, সপ্তম শ্রেনীর ছাত্রীর হাতের লেখা এত সুন্দর তা জানা ছিলো না হামিদের। প্রথম পাতাগুলো খালি, মাঝের কিছু পাতায় লেখা ফাতেমার পারিবারিক সমস্যা গুলো আর তারপর আবার ফাকা। তারপর আবার কিছু পৃষ্ঠা পরে আরেকটা লেখা। হামিদকে উদ্দেশ্য করে লেখাটা,

সম্মোধন করে কিছু লিখছি না আপনাকে। আসলে কি সম্মোধন করবো ভেবে পাচ্ছিনা। আপনাকে কি প্রিয় সম্মোধন করা উচিত? কিন্তু আপনি তো শুধুই আমার প্রিয় নন। প্রিয়র চেয়েও আরো বেশিকিছু। আপনি আমার নিজস্ব পুরুষ। অবশ্য কি সম্মোধন করলাম না করলাম তাতে কিছু যায় আসেনা কারণ আপনি কখনো এই চিঠিটা পড়বেনই না। আমি জানি আমি আপনার কাছে বিরক্তিকর তবুও আপনি আমার কাছে ভালোবাসার চাদরে আবৃত এক পুরুষ যার জন্য আমি বিনা দ্বিধায় নিজের জীবনটা দিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করবো না। আপনি যদি কখনো এই চিঠিটা দেখেন আমি কিন্তু বেশ লজ্জা পাবো। একটা কথা জানেন, আমি যতই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি না কেনো, লেখার জন্য কিন্তু চলিত ভাষাই উত্তম। আমি জানি এইটা দেখলেও আপনি হাসবেন। আপনি আমার জন্য রূপকথার রাজপুত্রের চেয়ে কম নন জানেন!
ছোটবেলা থেকেই আমি খুব বোকাসোকা আর শ্যামবর্ণা একটি মেয়ে। আমাকে অবশ্য কেউ শ্যামবর্ণা বলে না। সকলেই কালো বলে। আপনিও বলেন। ছোট থেকেই নিজের চেয়ে অধিক সুন্দরী মেয়ে দেখলে আমার হিংসে হতো। আমার মনে হতো সৃষ্টিকর্তা আমার প্রতি অন্যায় করেছেন। তিনি চাইলে আমাকেও সুন্দরভাবে বানাতে পারতেন। গায়ের রঙ কালো হলেও আমি কিন্তু রাজপুত্রের মতোই স্বামী চেয়েছিলাম কিন্তু রাজপুত্র তো দূর, আমাকে কেউই বিয়ে করতে চাইতো না। বিয়ের জন্য ছেলে দেখা শুরু হয় সেই ক্লাস সেভেনে। তখন থেকেই পড়াশোনা বন্ধ। ভাবির কথায় ভাই আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিলো। ছোটবেলা থেকেই ভালো ছাত্রী ছিলাম। শিক্ষকদের প্রসংশাও পেতাম কিন্তু ভাবির তা পছন্দ ছিলো না। ভালো গানও করতাম কিন্তু ভাবি গাইতে দিতো না। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ভাবি আমাকে পছন্দ করতোনা। আমিও ভাবতাম, সব ভাবিরাই বুঝি ননদকে পছন্দ করেনা। ঠিক করেছিলাম বিয়ের পর বরকে গান শোনাবো কিন্তু আপনি কখনো আমার দিকে তাকানোর সময়ই পাননি আর গান শুনবেন। বছরের পর বছর পাত্র দেখার পর ভাই যখন আপনার ছবি আমার হাতে দিয়া বললো, আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম আপনার দিকে। কোনো মানুষ এতটা সুন্দর হতে পারে? আর এই সুন্দর ছেলে আমার মতো কালো একটা মেয়েকে বিয়ে করবে? আদেও সম্ভব কি? বিয়েটা হয়ে গেলো আমাদের। আমাকে দেখে আপনি সারারাতও বাসায় এলেন না। বোকা হলেও সেইদিন বুঝেছিলাম আমার ভাগ্যে স্বামীর ভালোবাসা নেই। তবে মিথ্যা বলবো না, নিজেকে যতটা অভাগা ভেবেছিলাম ততটা ছিলাম না। আপনি আমাকে পছন্দ করতেন না, ভালোও বাসতেন না তাও কখনো অসম্মান করেননি। গায়ে হাত তোলেননি। কখনো পরনারীর প্রতি আসক্ত ছিলেন না। এই ব্যাপারেই আমি সবচেয়ে খুশি ছিলাম। আপনি আমার সাথে একটু ভালো আচরণ করলেও আমার কাছে তা ঈদের খুশির মতো মনে হতো। আমার জীবনের প্রতিটা ক্ষণে আপনাকে ভালোবেসে এসেছি আমি। আজীবন বাসবোও। আপনাকে শতভাগ ভালোবাসি, বিশ্বাস করি ঠিকই কিন্তু আপনার ভাগ আমি কিভাবে কাউকে দেবো বলুন। আমার মৃত্যুর পর আপনি বিয়ে করবেন সেটা ভাবলেও আমার কলিজা শুকিয়ে যায়। আমার নিজস্ব পুরুষ কিভাবে পরনারীর কাছে সুখ খুজবে? যার প্রথম ও প্রতিটা স্পর্শ আমি ছিলাম সেখানে অন্য কারোর রাজত্ব কিভাবে মানবো আমি? আপনি যে আমার নিজস্ব পুরুষ। আমার মৃ*ত্যু সহজ, কিন্তু আপনার ভাগ কাউকে দেওয়া কঠিন। ভয়ানক কঠিন!

হামিদ স্তব্ধ হয়ে বারবার পড়ে চলেছে চিঠিটি। কি সুন্দর করে ফাতেমা লিখেছে নিজের মনোভাব। ইশ! দুই বছরে একবারও তার গানটা শোনা হলোনা। তার শখের ইচ্ছে পুরণ হলো না। শখের পদ্মফুলের মূল্য দেওয়া হলো না। হামিদ বিরবির করে কোনোমতে উচ্চারণ করলো,

– আমার শুকনা নদীতেও পদ্মফুল ফুটছিলো কিন্তু আমি তার মূল্য দিতে পারি নাই।

★★★

সকাল থেকেই চিৎকার করে কান্না করে চলেছে লতা। চারু হাজার চেষ্টা করেও তাকে থামাতে পারছেনা। রাতে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমানোর কারণে হামিদের ঘুম ভাঙলো দেরিতে। বাসায় এখনো বেশ কিছু প্রতিবেশিরা আছেন। তারা চারুকে চুলোয় আগুন ধরাতে নিষেধ করেছে। মৃ’ত বাড়িতে চারদিন অবধি আগুন জ্বালাতে হয়না। চারু প্রতিবাদ করে বলেছিলো, মনোরমার মৃত্যুর পরেও আগুন সে জ্বালিয়েছিলো। কই কিছু তো হয়নি। তখন গ্রামবাসী নাজিমুদ্দিনের নতুন বিয়ের খোড়া যুক্তি দিলো। চারু কেমন যেনো প্রতিবাদের শক্তি পাচ্ছেনা। মনটা তার এমনিতেও আজ বিশেষ ভালো নেই। ফাতেমার সাথে আর কোনোকালেই এতটা সখ্যতা গড়ে ওঠেনি কিন্তু তাও সে ভালোবাসতো ফাতেমাকে। বিশেষ করে শেষ কিছুদিন যাবত ফাতেমা চারুকে নিজের সন্তানের মতোই যত্ন করেছে, ভালোবেসেছে। এই সহজ সরল মেয়েটার মায়ায় পড়ে গিয়েছিলো চারু নিজেও। কত হাজার বার ফাতেমার পক্ষ নিয়ে হামিদকে কথা শুনিয়েছে তার হিসেব নেই চারুর নিজেরও। তার উপর লতার কান্নাকাটি। টুনির মা দুধ গরম করে এনেছে লতার জন্য। চারু হাজার চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারছেনা। কিছুক্ষণের মাঝেই হামিদের ঘুম ভাঙে। মেয়ের কান্নার আওয়াজে মুহুর্তেই ছুটে আসে সে। হামিদকে দেখেই লতা ঠোঁট ফুলিয়ে তার কোলে গিয়ে একরাশ নালিশ জানাতে থাকে। তার ভাষা অবশ্য বুঝতে পারেনা হামিদ। ফাতেমা থাকলে নিশ্চয়ই বুঝতো।
– কি হইছে আমার আম্মাজানের? কে বকা দিছে? একবার কও তারে মাইর দিয়া দিমু।
– আম মাম মাম্ম ম্মাম্মমা মামস আমাম্ম
লতার এই অর্থহীন কথার কিছুই বুঝলো না হামিদ। হঠাৎই কেনো যেনো মনে হলো লতা ফাতেমাকে খুজছে। দীর্ঘ চব্বিশ ঘন্টারও বেশি সময় মেয়েটা মা ছাড়া আছে। হামিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার মনে পড়ে যায় চারুর সেদিনের বলা কথাটি। “ভাবির কিছু হয়ে গেলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট কিন্তু তোমার মেয়েরই হবে।” সেদিন কথাটা তেমন বিশেষ পাত্তা দেয়নি হামিদ তবে আজ এভাবে তা ফলে যাবে তা কখনো কল্পনাও করেনি সে।
– মা আসবে আম্মাজান। তুমি খাইয়া নাও, তুমি খাইলেই তোমার মা চইলা আসবো।

কাল থেকে সমস্ত ঘটনাই লক্ষ্য করে চলেছে বিন্দিয়া। বেশ খারাপও লাগছে তার৷ ফাতেমাকে সে পছন্দ করতো না কিন্তু তাই বলে সে কখনোই চায়নি ফাতেমা মা’রা যাক। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে হামিদের বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে। মায়ের জন্য কতটা পাগল হয়ে আছে মেয়েটি। আরো বেশি খারাপ লাগছে হামিদের চোখে ফাতেমার প্রতি ভালোবাসা দেখে। কই আগে তো কখনো দেখেনি।
নিজের এই মনোভাবে নিজেকেই নিজে ধিক্কার জানালো বিন্দিয়া। ছিহ! কি জ’ঘ’ন্য চিন্তাভাবনা। কই ও তো এমন ছিলো না। তবে আজ ওর কি হয়ে গেলো? ভালোবাসা কি ওকে এতটাই নীচে নামিয়ে দিলো যে একজন মৃ*ত ব্যক্তিকেও ও হিংসে করছে।
এত মানুষের ভীড়ে কেউই বিন্দিয়াকে আলাদাভাবে খেয়াল করেছে না। হামিদ তো আরো আগে করছেনা। এইটাই বোধহয় ভালো হয়েছে, হামিদের চোখে চোখ রাখার সাহস আজ তার নেই। বিন্দিয়া অকারণেই নিজেকে এইসবের জন্য দায়ী করছে। আবার পরক্ষণেই মনে পড়ছে ওরই বা কি দোষ? ও তো কিছু করেইনি।

★★★

ফাতেমার মৃত্যুর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও হামিদ যেনো কেমন হয়ে গেছে। ঠিকঠাক বাসায় আসেনা, খাবার খায়না, দিনের বেশির ভাগ সময়েই কবরস্থানে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে ফাতেমার কবরের দিকে। মাঝে মাঝে আবার বলে উঠে,”তুমি ভয় পাইয়ো না, আমি আছি।” মাঝে মাঝে সেই গাছে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে সে। চারু, সিফাত কিংবা হিমেল তাকে সেখান থেকে তুলে আনে। মাঝে মাঝে নিজে নিজে কথা বলে। এমনভাবে যেনো ফাতেমার সাথেই কথা বলছে সে। চারু চিন্তিত হয়! হামিদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। হামিদের জন্য এখানে থাকাটা উচিত নয়। চারু হিমেলকে বলেছিলো হামিদকে নিয়ে শহরে চলে যেতে কিন্তু হামিদ রাজি হয়না। প্রধানত দুইটা কারণে রাজি হয়না। প্রথমত, চারুকে একা রেখে সে যেতে চায়না আর দ্বিতীয়ত, ফাতেমা একা থাকতে ভীষণ ভয় পায়। তাকে একা রেখে কিছুতেই যাওয়া যাবেনা। আর শহরের বাড়িটির প্রতি কোনায় ফাতেমার হাজার হাজার স্মৃতি। সেই স্মৃতি নিয়ে কিভাবে বাচবে হামিদ? স্মৃতি সবসময়ই মানুষকে কাঁদায়, সেটা হোক সুখের কিংবা দুঃখের। আর এত সুখ স্মৃতির মাঝে হামিদ কিছুতেই থাকতে পারবেনা।
কিন্তু হামিদের এ অবস্থাও চারু মানতে পারেনা। হিমেল আর সিফাতও হামিদকে নিয়ে চিন্তিত। এই কয়দিনে বেশ শুকিয়ে গেছে ছেলেটা। রাত জাগার ফলে চোখের নীচে কালো দাগ পড়েছে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেনা। চুল দাড়িও বেশ বড় হয়েছে। একদিন চারু খুব কৌশলে হামিদের ঘুমের মাঝে চুল দাড়ি কেটে দিয়েছিলো। চারুর এই বাচ্চামিতে ফাতেমার মৃত্যুর পর প্রথম হেসেছিলো হামিদ। অবশ্য সে মৃদু হাসি সাময়িকই ছিলো। তারপর আবার যেমনটা তেমনই।

সবসময়কার মতো কুপি জালিয়ে কবরস্থানে বসে ছিলো হামিদ। ফাতেমার সাথে আজ নিজের সুখের ভাগ করতে এসেছে। হামিদ ধীর পায়ে ফাতেমার কবরের পাশে গিয়ে বসে বললো,
– জানো ফাতেমা, আজ আমার মাইয়া প্রথমবারের মতো আমারে বাবা কইয়া ডাকছে। আমার মাইয়াটা তোমাকে অনেক মিস করে জানো? সারাক্ষণ খালি কান্নাকাটি করে। তার কান্নার ভয়ে বাসায় যাইতে পারিনা আমি। তুমি খুবই অসভ্য একটা মাইয়া। আমার ওপর অভিমান কইরা এইভাবে চইলা গেলা? একবারও নিজের মাইয়াটার কথা ভাবলা না?
ফাতেমা উত্তর দেয়না। সেই শক্তি আর এখন নেই ফাতেমার। হামিদ চুপচাপ ফাতেমার কবরের পাশে শুয়ে পড়লো। ফাতেমা থাকলে নিশ্চয়ই বলতো, “আমারে একটু বুকে নিয়া ঘুমাইবেন?”
হামিদ ঠিক কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে নিজেও জানেনা কিন্তু তার ঘুম ভাঙে চারুর ডাকে। হামিদ ভেবেছিলো প্রতিবারের মতো এবারেও চারু রাগ দেখিয়ে বলবে, যাকে জীবিত অবস্থায় ভালো বাসোনি মৃত্যুর পর তার প্রতি আদিক্ষেতা দেখাতে হবেনা তোমার। কিন্তু চারু এইবার এমন কিছুই বললো না। চুপচাপ বাসার দিকে নিয়ে যেতে লাগলো তাকে।
– তুমি যে এভাবে সবসময় কবরস্থানে এসে বসে থাকো সেইটা কি ঠিক?
– জানিনা। সব কেমন তালগোল পাকায়া যায়। মনে হয় আমি পাগল হইয়া গেছি। আমি কি সত্যিই পাগল হইয়া গেছি রে চারু?
– না তুমি পাগল হওনি। পাগল কখনো বোঝেনা সে পাগল হয়ে গেছে। এখনো সময় আছে এসব কিছু থেকে বের হয়ে এসো নইলে পাগল হয়ে যেতেও সময় লাগবেনা তোমার।
– পাগলই বরং হইয়া যাই। পাগলের তো কোনো দুঃখ কষ্ট নাই। এই কষ্ট নিয়া আর থাকতে পারতাছি না। অপরাধবোধে শেষ হইয়া যাইতাছি আমি। কখনো ভালো আচরণ করি নাই তার সাথে। সে হাজার ভালোবাসার শর্তেও তারে কেবল অবহেলা কইরা গেছি আর আজ তারে হারানোর পর বুঝলাম, নিজ পায়ে ক্যামনে কুড়াল মারছি আমি। কিন্তু এহন বুইঝাও লাভ নাই।
– এখন কি আদেও এইসব করে লাভ আছে? নিজের জীবন নতুন করে শুরু করো। মেয়েটার জন্য ভালোভাবে বাঁচতে হবে তোমাকে। ভাবি তোমার হাসিটা খুব পছন্দ করতো। সেই হাসিটাই আবার ফিরিয়ে আনো নিজের মাঝে।
– বলা যতটা সহজ, আসলে সব তত সহজ না। যার সাথে হয় কেবল সে-ই বুঝে এইটা কেমন যন্ত্রণা। আমিও আগে কত মানুষরে কত উপদেশ দিছি অথচ, নিজের ক্ষেত্রেই সেইগুলা আর কাজে লাগাইতে পারতাছি না।
– একজন মানুষের ইচ্ছাশক্তি যতটা প্রবল হয় সে ততই দ্রুত সব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়।
– আমার ইচ্ছাশক্তি প্রবল না।
– হতে হবে।
হামিদ আর কথা বাড়ায় না। লাভ নেই, চারুর সাথে কথায় পারবেনা সে। সারা শরীরে কবরস্থানের মাটি লেগে থাকায় হামিদ গোসল করে নিলো। হাজারবার চেষ্টা করেও চারু কেবল অল্প কিছু খাওয়াতেই সক্ষম হলো তাকে। তারপর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। অনেক গোপনে নিজের ব্যাগ থেকে ফাতেমার একটা ফ্রেমে বাধানো ছবি সে বের করলো। ছবির কোয়ালিটি তেমন ভালো না কিন্তু হামিদের কালো পদ্মের মুখটি স্পষ্ট। নিজের কিছু কিছু ব্যাবহারে আজ আফসোস হয় হামিদের।
– কেমন আছো ফাতেমা? নিশ্চয়ই ভালোই আছো। আমার সব সুখ তোমারে দিয়া দিলাম তাও তুমি সুখী থাকো। তোমার মনে আছে, একদিন তুমি আমারে বলছিলা, ভাই আর বাবা হিসেবে আমি আদর্শ হইলেও স্বামী হিসেবে জঘন্য, আজ আমি তা হারে হারে টের পাইতাছি। আসলেই আমি দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ স্বামী। পদ্মফুলের কোনো ইচ্ছা আমি কখনো পুরণ করতে পারি নাই। তার শখগুলা কখনো জানতে চাই নাই। শখ জানলেও কহনো পূরণ করি নাই। তুমি খুব কইরা চাইতা তোমার সাথে একটা যেনো আমার একটা ছবি হয় কিন্তু আমি তুলি নাই ছবি। তোমারে অপমান করছি। আমার মুখে নিজের প্রসংসা শুনতে চাইতা কিন্তু আমি সবসময়ই সবার কাছে শুধু তোমার দুর্নামই কইরা আসছি। আসলেই আমি জঘন্য স্বামী। কতবার কত কথায় তোমারে কষ্ট দিছি তার হিসাব নাই। কি করলে তোমারে আরেকবার পাওয়া যাইবো কও তো? আমি তোমারে আবার চাই। একবারের জন্য হইলেও চাই। তোমারে কইছিলাম না তোমার কবরের মাটি শুকাইলেই বিয়া করমু কিন্তু দেখো আমি করি নাই। আমার মন কয়, তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর কেউ কহনো আসতে পারবো না। আমি তোমারে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। তোমার হামিদ শুধু তোমারই থাকবো। তোমার নিজস্ব পুরুষ হইয়াই থাকবো। পরকালে কেউ আমার ভাগ চাইবো না তোমার আছে। আমার জীবনের প্রথম স্পর্শ যেমন তুমি ছিলা, আমার জীবনের শেষ স্পর্শও তেমনি তুমিই থাকবা। আফসোস একটাই আমার কালো পদ্মফুল, তুমি কহনো জানতেও পারলা না আমি তোমারে ঠিক কতটা ভালোবাসছিলাম। এই জন্মের ভালোবাসাটা নাহয় পরকালেই তোমার পাওনা রইলো। একবার তোমার কাছে আসি, সবটা ভালোবাসা বুঝায়া দিমু তোমারে। তুমি দেইখা নিও। ভালোবাসি আমার একান্ত ব্যক্তিগত কালো পদ্ম। পারো তো দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট তোমার এই স্বামীটারে মাফ কইরা দিও।

★★★

ফাতেমার মৃত্যুর পর প্রায় দুইমাস কেটে গেছে। সবকিছুই মোটামুটি ঠিক হয়ে এসেছে। তবে ঠিক হতে পারেনি হামিদ। আজও কালো পদ্মেই আসক্ত সে। এত ভালোবাসা কবে জন্মালো তার প্রতি? এই কয়দিনে বিন্দিয়া একবারও আসেনি হামিদের সামনে কিন্তু এইবার আর কোনো সুযোগ নেই। বিন্দিয়া সরাসরি এসে হামিদের পা চেপে ধরলো। হামিদ অনুভূতি শূন্য মানুষের মতোই বসে রইলো। বিন্দিয়ার প্রতি প্রচন্ড রাগ তার। এই মানুষটার জন্যই শেষ কয়েকটা দিন ফাতেমাকে প্রচন্ডরকম অবহেলা করেছে সে। দোষ অবশ্য বিন্দিয়ার একার ছিলো না। দোষটা তারও ছিলো, সে কেনো এই মেয়ের কথায় চলে আসবে তাই বিন্দিয়ার উপর কোনো রাগ দেখাচ্ছেনা। এই মেয়েটার চেয়েও তো বড় দোষী সে নিজেই,
– হামিদ ভাই, আপনে কিছু একটা করেন। আমি বাচমু না আপনেরে ছাড়া। কালকে আমারে দেখতে আসবো। সব ঠিকঠাক হইলে বিয়াও হইয়া যাইবো। আপনে কিছু একটা করেন।
– কি করমু? চাচিরে রাজি করামু যেনো তোমার বিয়া এমনে না দিয়া ধুমধামের সাথে দেয়?
– না আপনে মায়রে বলবেন আপনে আমারে বিয়া করতে চান। আমি আপনেরে ছাড়া কাউরে বিয়া করমু না হামিদ ভাই।
– আমিও তোমারে বিয়া করমু না।
– ক্যান করতাছেন আমার সাথে এমন? আপনি তো জানেন আপনেরে ছাড়া অন্য কেউরে বিয়া করনের কথা আমি ভাবতেও পারিনা। আপনে যদি আমারে না মাইনা নেন তাইলে গলায় কলসি বাইন্ধা নদীতে ডুইবা মরা ছাড়া আমার আর কোনো পথ নাই।
হামিদ হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেলো। কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে ঘরের ভেতরে চলে গেলো সে। অতি শীঘ্রই ঘর থেকে একটা কলস আর একটা দড়ি বের করে বিন্দিয়ার সামনে রেখে বললো,
– গলায় কলস বাইন্ধা নদীতে ডুইবা মরবা কিন্তু তোমার কাছে তো কলস বা দড়ি নাই তাই এইগুলা নিয়া আসলাম তোমার সুবিধার জন্য। যাও তাড়াতাড়ি নিয়া নদীতে ডুইবা ম*রো। তোমার মতো মাইয়া এই সমাজে প্রয়োজন নাই।
বিন্দিয়া স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো হামিদের দিকে। সে কল্পনাও করতে পারেনি হামিদ এমন কিছু বলবে বা করবে। কিন্তু হামিদ এমন কেনো করছে? ফাতেমা তো আর বেঁচেও নেই।
– এতটা পাষাণ ক্যান হইতাছেন হামিদ ভাই? একটু দয়া করেন আমার উপর। আমি বাঁচতে চাই।
– তুমি বাঁচো কি মরো তাতে আমার কিছুই যায় আসেনা।

বিঃদ্রঃ এই অংশে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি তবে দ্বিতীয় অংশে সম্পূর্ণ অংশ নতুন করে লেখা হবে। আজকের টার্গেট ১০০০+ রিয়েক্ট। তাড়াতাড়ি কমপ্লিট করে দিন আমিও দ্রুত নেক্সট পর্ব দেবো ইনশাআল্লাহ আর আগের পোস্টটি যারা কপি করে রেখেছেন তাদের ডিলিট করার অনুরোধ রইলো কারণ ওই অংশটা আমি পরিবর্তন করবো। সুন্দরভাবে সমাপ্তি টানতে চাইছি। ধন্যবাদ।

_______________________

To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here