আরশিযুগল প্রেম❤পর্ব- ১০
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা ❤
“বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে,
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ —
আমার বাড়ি আসে সই গো,
বসন্ত বাতাসে।”
বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নেওয়ার সময়ই পাশের দোকান থেকে গানটির মৃদু সুর ভেসে এলো সাদাফের কানে। আজ পহেলা ফাল্গুন। চারদিকে রৌদ্রজ্জ্বল সকালের আলতো স্পর্শ। সেই স্পর্শে মাখামাখি হয়ে গায়ে বাসন্তী রঙের শাড়ি জড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোরীরা। মাথার খোঁপাটা গাঁদা-পলাশে আগাগোড়া মোড়া। কেউবা আবার ভালোবাসার মানুষটির হাতে হাত রেখে প্রেম নিবেদনে ব্যস্ত। শহরজুরে বসন্ত উৎযাপনের এতো হৈচৈ এর মাঝেও সাদাফ নিশ্চুপ।আত্মভুলা সাদাফের এই বিশেষ দিনটির কথা মাথাতেই ছিলো না। রিকশায় ওঠে রাস্তার মোড়ে মোড়ে রমনীদের বাসন্তী,লাল,হলুদ রঙের শাড়ি আর ফুলে ফুলে সেজে থাকতে দেখেই পহেলা ফাল্গুনের কথা মনে পড়লো সাদাফের। চারপাশে সচেতন চোখে তাকালো। বনানীর এই বিশাল রাস্তার কোনো কোনেই ফোটা ফুল চোখে পড়লো না তার। গাছে ফোটা ফুল! সাদাফ নিজের মনে হাসলো।ছেলে-মেয়েদের এতো সাজুগুজু আনন্দ দেখে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো সেও স্বীকার করতে বাধ্য হলো —- ‘ফুল ফুটুক, আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত’। অসিফে পৌঁছে নিজের ডেস্কে বসে কাজে হাত দিতেই কোথা থেকে ছুটে এলেন আবির সাহেব। সাদাফ একবার চোখ তুলে তাকালো। আবির সাহেবকে ভেতরে আসার অনুমতি দিয়ে আবারও হিসেবের খাতায় মন দিলো সে। আবির সাহেব হন্তদন্ত করে ভেতরে ঢুকেই বলে উঠলেন,
—” সাদাফ সাহেব? আজকে পহেলা ফাল্গুন মনে আছে তো?”
সাদাফ ফাইল থেকে চোখ উঠিয়ে মাথা নেড়ে বললো,
—” হ্যাঁ। মনে আছে।”
আবির সাহেব খুশিতে গদগদ হয়ে চেয়ার টেনে বসলেন। অনেকটা ফিসফিস করে বললেন,
—” বসন্ত মানেই পূর্ণতার দিন। ভালোবাসার দিন। এই দিনটা উদযাপন না করলে চলে বলুন? ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে এবার বিরাট উদযাপন হবে বুঝলেন? যাবেন নাকি একবার? চলুন না যাই।”
আবির সাহেবের শেষ বাক্যটা অনেকটা অনুরোধের মতো শোনালো। সাদাফ মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে কচুপাতা রঙের শার্টের কব্জির কাছের বোতামগুলো খুলে হাতা গোটাতে গোটাতে বললো,
—” আপনি যান আবির সাহেব। ওসব ভীর ঠেলে অনুষ্ঠান দেখার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তাছাড়া,প্রচুর কাজও জমে আছে হাতে।”
আবির সাহেব টেবিলের উপর খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন,
—” একদিন একটু কম কাজ করলে কিই বা হবে সাদাফ সাহেব? এমনিতেও এমডি স্যারের ভালো নজরেই আছেন আপনি। এ বছর আবারও প্রমোশন হবে আপনার। বছরে দু-একদিন তো ছুটি কাটানো উচিত বলুন।”
সাদাফ হেসে বললো,
—“বছরে দু’-একদিন নয় প্রায় দু সপ্তাহের মতো ছুটি কাটাই আমি। বর্ষাকালে হুটহাট পাহাড়ে ঘুরতে চলে যাওয়াটা তো ছুটির মধ্যে পড়ে। তাই কাজগুলো আগে থেকে গুছিয়ে রাখাটা ভালো। আপনি বরং যান…আমি আমার কাজগুলো শেষ করবো ভাবছি।”
আবির সাহেব মুখ গোমরা করে বললো,
—” প্লিজ সাদাফ ভাই। চলেন না। আপনার ভাবিকে কথা দিয়েছি যে আজ বিকেলে ওকে নিয়ে রবীন্দ্র সরোবরে যাবো। পরশোই তিনদিন ছুটি কাটিয়েছি আজ আবারও হাফ ডে ছুটি চাইলে বস রেগে ফায়ার হবেন নির্ঘাত। আপনাকে তো কিছুই বলে না। আপনি গেলে আপনার দোহাই দিয়ে আমিও একটু ছুটি পাই আরকি। প্লিজ ভাই। নতুন বিয়ে করছি সমস্যাটা বুঝুন একটু।”
সাদাফ স্থির দৃষ্টিতে তাকালো। কলিগদের এমন উদ্ভট ঝামেলায় বরাবরই বিরক্ত হয় সে। রবীন্দ্র সরোবর জায়গাটা তার কাছে খুব একটা খারাপ লাগে না। আশেপাশে গাছপালা আছে প্রচুর। কিন্তু আজকের দিনে সেই শান্তিটা কিছুতেই পাবে না সাদাফ। তাই কাজ ছেড়ে সেখানে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও তার নেই। তবুও রাজি হলো। আবির সাহেবের অনুরোধের ফোয়ারায় রাজি হতে বাধ্য হলো।
__________________
সকাল থেকেই বন্ধু বান্ধবদের ফোন কলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে শুভ্রতা। সেই ভোর ছয়টা থেকে চলে আসছে তাদের হাজারও পরিকল্পনা। ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরের বসন্ত উদযাপনে পাঁচ বান্ধবী মিলে দলীয় গান পরিবেশন করবে তারা। তা নিয়েই পাঁচ জনের আকাশ ছোঁয়া উত্তেজনা। যদিও শুভ্রব সেই সকাল থেকেই ভেঙিয়ে চলেছে — “তোদের সব কটার হলো কাকের মতো গলা। কোকিলের অনুষ্ঠানে তোদের মতো কাকদের মানায় না। দয়া করে কোমলমতি শিশুদের রেহাই দে।” শুভ্রতা বেশ কয়েকবার “মা! মা! ” বলে চেচিয়ে উঠলেও এখন তেমন একটা মাথা ঘামাচ্ছে না। এর আগে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে লাস্ট স্টেজ পার্ফমেন্স করেছিলো সে। তারপর আর ইচ্ছে বা সুযোগ কোনোটাই হয়ে উঠে নি। আজ আবারও তিন-চারবছর পর! ভাবতেই উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে আসছে শুভ্রতার। শুভ্রতা সারা বিছানায় হলুদ,বাসন্তী, লাল শাড়ি আর গহনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পর্যবেক্ষন করে চলেছে। এক হাত কোমরে রেখে রুমের এককোণা থেকে অন্যকোণায় পায়চারী করছে। দুই তিনবার রুমময় পায়চারী করার পর ফোনের ভাইব্রেশনে দাঁড়িয়ে পড়লো শুভ্রতা। একগাদা শাড়ি সরিয়ে ফোন খুঁজে বের করে অস্থির পায়ে আবারও হাঁটতে লাগলো সে। ওপাশ থেকে অলস গলায় বলে উঠলো শেফা,
—” ফোন দিয়েছিলি শুভি? সরি রে, ঘুমিয়েছিলাম।”
—” ফোনে কথা বলতে বলতে রাত ভোর করে ঘুমালে দশটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে না ঘুমিয়ে আর কি করবে আপু? জামাই পাইয়া এখন এই ইনোসেন্ট বোনটাকে ভুলে গেছো তুমি আপু?”
শেফা ভ্রু কুঁচকে বললো,
—” ধুর! কি সব বলছিস। জামাই জামাইয়ের জায়গায় আর তুই তোর জায়গায়। এনিওয়ে, কেন ফোন দিয়েছিলি সেটা বল।”
শুভ্রতা এবার শান্ত হয়ে বসলো। চিন্তিত গলায় বললো,
—” বাসন্তী রঙের ব্লাউজ আছে তোমার আপু? সবাই মিলে প্ল্যান করেছি বাসন্তি পাড় লাল শাড়ি পড়বো। অথচ, এন্ড মোমেন্টে এসে দেখি বাসন্তী রঙের ব্লাউজ গায়েব। কি ভয়ানক অবস্থা ভাবতে পারছো? তার ওপর তিনটাই অনুষ্ঠান। তোমার আছে নাকি আপু?”
শেফা খানিক ভেবে বললো,
—” তা তো আছে। কিন্তু আমারটা কি তোর হবে? তুই যা হ্যাংলা পাতলা মানুষ!”
শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে বললো,
—” সমস্যা নেই৷ আমি ঠিক করে নিবো।”
—” তোর সমস্যা না হলে আমারও সমস্যা নেই। এসে নিয়ে যা।”
—” আমি এতোদূর যেতে পারবো না। তুমি তো অনুষ্ঠান দেখতে আসবেই। রবীন্দ্র সরোবর থেকে আমাদের বাসা তো বেশি দূরে নয়। তুমিই একটু দিয়ে যাও না, প্লিজ! প্লিজ!”
শেফা অবাক হয়ে বললো,
—” আরে! উত্তরার মুক্তমঞ্চেও তো অনুষ্ঠান হবে। এখানে রেখে অতোদূরে ধানমন্ডি কেন যাবো বল তো?”
শুভ্রতা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে খানিক ভাবলো। মুহূর্তেই দুষ্টু হাসি খেলে গেলো তার ঠোঁটে। বিছানায় আরাম করে বসে বললো,
—” আপুউউ?? প্রেম করার জন্য ধানমন্ডি লেকের মতো দারুন জায়গা কি আর আছে? কাবিন হয়েছে মাত্র তুলে নিয়ে যেতে প্রায় সাত/আট মাস। চুটিয়ে প্রেম করার মতো এতো বড় সুযোগ হাতছাড়া করবা তুমি? আমি তোমার ছোট হলেও ছোট বোনের কথাটা একটু ভেবে দেখো। এই বিষয়ে তোমার থেকে আমিই বেশি অভিজ্ঞ আপু। আমার সব কটা ফ্রেন্ড প্রেম করে। ভাবো…ভাবতে ভাবতে এতো সুন্দর একটা আইডি দেওয়ার জন্য ব্লাউজটাও আমার পর্যন্ত পৌঁছে দাও, কেমন? এডভান্স থেংকিউ। বাই।”
নিজের কথা শেষ করেই ফোন কাটলো শুভ্রতা। শেফা যে আসবে তা বেশ ভালো করেই জানে শুভ্রতা। শেফা খানিকটা বোকা টাইপের মেয়ে। একটা কিছু ওর মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া গেলে তা সহজে বের হয় না মাথা থেকে। শুভ্রতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ালো। দূরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা প্রেমীযুগলদের দেখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে। ছেলেদের গায়ে পড়া বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি দেখে হঠাৎই সাদাফের কথা মনে পড়লো তার। মনের এক কোণে সাদাফকে দেখার সূক্ষ্ম ইচ্ছে মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো। আচ্ছা? বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবিতে কেমন লাগবে সাদাফকে? এই রঙের পাঞ্জাবির সাথে ঘন চুলগুলো কিভাবে গোছাবেন উনি?সবসময়ের মতোই? নাকি একটু অন্যরকমভাবে? এসব ভাবনায় সাদাফকে দেখার ইচ্ছেটা তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হওয়ার আগেই বান্ধুবীর ফোনের তেজে ছুটে গেলো সেই ভাবনা। মনের এককোণে হারিয়ে গেলো সেই নাম। অজানা অনুভূতি নামক মারাত্মক টানগুলো গুটিগুটি পায়ে জোরো হতে লাগলো অজানা ভালো লাগায়।
________________
বিকেল তিনটা। ধানমন্ডি লেকের ধারের রবীন্দ্র সরোবরটি সেজে উঠেছে এক নতুন সাজে। বিভিন্ন বয়সী মানুষের আনন্দের জোয়ার যেন লেগে আছে প্রতিটি সবুজ ঘাসে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাদাফও সামিল হয়েছে তাতে। একা আসে নি এসেছে ভার্সিটি লাইফের প্রিয়মুখ বন্ধুদের সাথে। প্রতিবারই “না না ” করতে করতে এবার যে রাজি হয়েছে সাদাফ তাতেই যেন খুশির বাঁধ মানছে না তাদের। সাদাফের বন্ধুদের মধ্যে একজন রবীন্দ্র সরোবর বসন্ত উৎযাপন কমিটির সদস্য হওয়ায় অনুষ্ঠানে যুগ দেওয়ার উৎসাহটা আরো বহুগুণ বেড়ে গেছে তাদের। আবারও অনেকদিন পর, ভার্সিটির সেই প্রাণোচ্ছ্বল যুবকের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে তারা। রাকিবের পকেট পুরে আছে লাল আবিরের প্যাকেট। দুষ্টুমি করার হাজারো পদ্ধতি এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের মাথায়। অথচ তাদের মধ্যে অধিকাংশই আজ বিবাহিত।
#চলবে…
(গল্প লিখতে লিখতেই হুট করে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো ফোন। সেই ফোন খুললো এতোক্ষণে। তাই লেট হয়ে গিয়েছে। দুঃখিত।)