আরশিযুগল প্রেম❤পর্ব- ১৪

# আরশিযুগল প্রেম❤পর্ব- ১৪
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা ❤

বাস ছুটে চলেছে তার গন্তব্যে। রাতের অন্ধকার আর সা সা বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে কি দূরন্ত গতি তার। বাসের ভেতরের আলো নেভানো। সবাই যেন ঘুমের রাজ্যের ব্যস্ত পথিক। কিন্তু শুভ্রতার চোখে ঘুম নেই। শরীরটা হঠাৎই ভীষণ খারাপ লাগছে তার। মাথা ঘুরছে, গা গুলাচ্ছে সেই সাথে কেমন অস্থিরতা ভরা ঘাম হচ্ছে। নিজেকে খুব বেশি অসহায় মনে হচ্ছে। শরীরের বলটাও যেন ধীরে ধীরে কমে আসছে তার। এখন কি করবে সে? সাদাফকে বলবে? সে কি বিরক্ত হবে? শুভ্রতার হঠাৎ করেই কান্না পাচ্ছে। মাকে ভীষণ মনে পড়ছে। মা পাশে থাকলে এতোটা অসহায়ত্ব কখনোই ভর করতো না তাকে। কিছু বলার আগেই সবটা বুঝে নিয়ে তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন মা। অযথা হা-হুতাশ করতেন। শুভ্রতার বদলে নিজেই কান্না কান্না ভাব নিয়ে মুখ ফুলাতেন। শুভ্রতার সব অসহায়ত্ব নিজের কাছে টেনে নিয়ে নিজেই অসহায় মুখ করে বসে থাকতেন। শুভ্রতার একটু আর্ত চিৎকারেও চমকে উঠতেন। মেয়ের থেকে বিরক্তিমাখা তিরস্কার পেয়েও আদরমাখা চুমু আঁকতেন। শুভ্রতা অযাচিত অসুস্থতায় ক্লান্ত হয়ে সিটে গা এলিয়ে দিলো। সাদাফের তখন তন্দ্রাভাব হচ্ছিলো মাত্র। অজানা কারণে হঠাৎই তন্দ্রাভাবটা ছুটে গেলো তার। বাইরের ল্যাম্পপোষ্টের এক ঝলক হলদে আলোয় শুভ্রতার মুখটা বড্ড ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে । শুভ্রতার ফ্যাকাশে মুখটা দেখেই বুকে ছোট্ট একটা মোচড় দিয়ে উঠলো সাদাফের। সব দ্বিধা সরিয়ে শুভ্রতাকে ডাকলো সে,

—” শুভ্রতা? ঠিক আছেন আপনি?”

শুভ্রতা চোখ মেলে তাকালো। সাথে সাথেই বাম চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোটা জল। সাদাফ যেন আৎকে উঠলো। এতোদিনের দ্বিধাভরা সব দেয়ালগুলো যেন মুহূর্তেই ভেঙে গুড়িয়ে গেলো। মনে শুধু একটা কথায় বাজতে লাগলো প্রতিনিয়ত ” যায় হয়ে যাক না কেন, এই মেয়েটাকে কাঁদতে দেওয়া চলবে না। কিছুতেই না।” শুভ্রতার ডান গালে আলতো করে হাত ছোঁয়াতেই চমকে উঠলো সাদাফ। শুভ্রতার শরীর অতিরিক্ত ঠান্ডা। মেয়েটা কি তবে জ্ঞান হারাচ্ছে? সাদাফ ব্যস্ত হয়ে শুভ্রতার গালে আলতো চড় দিয়ে মৃদু গলায় বললো,

—” এই শুভ্রা? এই? কি হয়েছে আপনার?”

সাদাফের মুখে “শুভ্রা” নামটা শুনে আবারও আধবুজা চোখদুটো খুলে তাকাতে চেষ্টা করলো শুভ্রতা। সাদাফের মুখে “শুভ্রা” নামটা ভীষণ আদুরে শুনালো তার। সাদাফ আবারও বললো,

—“কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? আমায় বলুন কি সমস্যা হচ্ছে। শুভ্রা?”

শুভ্রতা ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে অত্যন্ত মৃদু গলায় বললো,

—” আমার শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সাদাফ সাহেব।”

শুভ্রতার এই ধীর কন্ঠ সাদাফের কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। সাদাফ মাথাটা খানিক নিচু করে নিয়ে শুভ্রতাকে শোনার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুই শোনা হলো না। শুভ্রতার ঘন ঘন শ্বাস নিতে দেখে কিছুটা আঁচ করলো সাদাফ। নরম গলায় বললো,

—” শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে?”

শুভ্রতার আর কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। শুভ্রতার ডানহাতের কব্জিতে হাত রেখে নাড়ির গতি মাপলো সাদাফ। শুভ্রতার গালে আলতো হাতে ঝাঁকি দিলো। এতেও সাড়া না পাওয়ায় শুভ্রতার দিকে খানিকটা ঘুরে বসলো সাদাফ। ফোনের ফ্ল্যাশটা জ্বালিয়ে কাত করে নিজের কোলের উপর রাখলো। শুভ্রতার গলায় গোলাপী রঙের ওড়না পেঁচানো ছিলো। সাদাফ কিছুক্ষণ দ্বিধা ভরা চোখে তাকিয়ে থেকে শুভ্রতার পেঁচানো ওড়নাটা খুলে নিলো। ফোনের আলোটা শুভ্রতার গলা বরাবর এসে পড়ছে। ওড়নাটা সরিয়ে নিতেই ডানপাশের কাঁধের কিছুটা ওপরে ঝলমল করে উঠলো কালো তিল। সাদাফ দু’দন্ড সেদিক মোহনীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই চোখ ফেরালো। পাশের জানালাটা খুলে হাওয়া আসার ব্যবস্থা করে দিয়ে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে শুভ্রতার চোখে-মুখে পানির ছিঁটা দিলো। কিছুক্ষণ পর শুভ্রতা নড়েচড়ে উঠতেই সচেতন চোখে তাকালো সাদাফ। ব্যাগ থেকে স্যালাইনের প্যাকেট বের করে পানির সাথে মেশালো। গোলা স্যালাইন শুভ্রতার নিস্তেজ ঠোঁট জোড়া ভেদ করে পেটে চালান করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালালো। ১০ মিনিটের প্রচেষ্টায় অর্ধেকটা স্যালাইন খাইয়ে শান্ত হয়ে বসলো সাদাফ। সিটে গা এলিয়ে দিয়ে শুভ্রতার মলিন মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো সে। রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোষ্টগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় খনিকের জন্য ঝলকে উঠছিলো শুভ্রতার মুখ। কখনো বা চাঁদের ঝাপসা আলোয় হাজারও ডালপালার ছায়া নামছিলো তার মুখে। সেই আলো-ছায়ায় খেলাময় মুখটাতে সবকিছু ছাড়িয়ে গিয়েছিলো মায়া৷ এক ভালোবাসাময় বিষাদ মায়া। যে মায়াটা সাদাফকে হঠাৎ হঠাৎই ডেকে উঠে। কাছে ডাকে। খুব কাছে! সাদাফ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললো। মেয়েটার প্রেশার ফল করেছে। আচ্ছা? এই বয়সেই লো প্রেশারের পাল্লায় কি করে পড়লো মেয়েটা? নিশ্চয় ঠিকমতো খায় না। নাকি টেনশন করে? কিন্তু কি এমন টেনশন তার? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই নিজের রুমাল ভিজিয়ে নিয়ে শুভ্রতার দিকে খানিকটা চেপে বসলো সাদাফ। শুভ্রতার নাক,মুখ,গাল, গলা ভেজা রুমাল দিয়ে ধীরে ধীরে মুছতে লাগলো সে। শুভ্রতার অস্থিরতা কমাতে গিয়ে নিজের বুকেই অপরিসীম এক ধুকপুক টের পায় সে। কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় তার হাত। গভীর চাহনীতে পর্যবেক্ষণ করে শুভ্রতার মুখ। হঠাৎই কিছু একটা ভেবে ভ্রু কুঁচকে সোজা হয়ে বসে সে। সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে। বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রাখার পর চোখ মেলে তাকায় । শুভ্রতা বাসের ঝাঁকিতে সামনের দিকে হেলে পড়ছিলো। সাদাফ দ্রুত হাতে শুভ্রতাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। শুভ্রতার মাথাটা নিজের বুকে রেখে বাদ বাকি স্যালাইনটুকুও খাওয়ায়। শুভ্রতার কপাল কুঁচকে মৃদু মৃদু চুমুক দিয়ে বাচ্চাদের মতো স্যালাইন খেতে দেখে মৃদু হাসে সাদাফ। বোতলটা পাশে রেখে নিজের অজান্তেই একরাশ প্রশান্তি নিয়ে দু’হাতে শুভ্রতাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় সে। অচেতন শুভ্রতাও গুটিশুটি হয়ে পড়ে থাকে সাদাফের বুকে।

শেষ রাতের দিকে কুমিল্লায় এসে বাস থামলো। গাড়ির লাইটগুলো জ্বলে উঠার আগেই শুভ্রতাকে নিজের থেকে সরিয়ে সোজা করে বসিয়ে দিলো সাদাফ। নিজের টি-শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করে নিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। নিজেকে কেমন একটা চুর চুর অনুভূত হচ্ছে তার। আচ্ছা? সে কি কোনোভাবে শুভ্রতার অসুস্থতার সুযোগ নিলো? নিজেকে করা প্রশ্নে নিজেই ভ্রু কুঁচকালো সাদাফ। মনের মাঝে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন তৈরি হওয়ায় খানিক অবাক হলো সে। কিছুক্ষণের মাঝেই বাস কলরবমূখর হয়ে উঠলো। এই লম্বা জার্নিতে এই এতোটুকুন ব্রেকের জন্য সবারই যেন রাজ্যের হা-হুতাশ। সবাই ধীরে ধীরে নেমে যেতেই শুভ্রতাকে ডাকলো সাদাফ। আরাফ আর শেফা সিটের কাছে দাঁড়িয়েই প্রশ্ন ছুঁড়লো,

—” কি হয়েছে?”

সাদাফ স্বাভাবিক গলায় বললো,

—” তেমন কিছু নয়। শরীরটা হয়তো দুর্বল তাই গভীর ঘুমে তলিয়েছেন।”

শেফা কপাল কুঁচকে তাকালো। কয়েকপা এগিয়ে গিয়ে শুভ্রতার হাত ধরে জোরে ঝাঁকিয়ে বললো,

—” বাসে আবার গভীর ঘুম কিসের? এই শুভ্রতা? ওঠ!”

সাদাফ এগিয়ে গিয়ে শেফাকে থামাতে উদ্যত হতেই চোখ খুললো শুভ্রতা। সাথে সাথেই থেমে গেলো সাদাফ। সবাইকে নামতে বলে চুপচাপ বাস থেকে নেমে গেলো সে। শেফা শুভ্রতাকে একঝাঁক বকাঝকা করে গাড়ি থেকে নামালো। কিন্তু তার শরীরটা চললে তো? পা দুটো কেমন ভেঙে ভেঙে আসছে তার। মাথাটাও কি ভীষণ ভারি। সাদাফ কিছুটা পথ গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লো। আরাফকে তাড়া দেওয়ার অজুহাতে শুভ্রতাকে একটিবার দেখে নিলো। শুভ্রতার ফ্যাকাশে মুখটা দেখে ভেতরটাই কেমন একটা হুহু করে উঠলো। ইচ্ছে করতে লাগলো, দৌড়ে গিয়ে শুভ্রতার হাতটা ধরে। মেয়েটা হঠাৎ করে পড়ে টড়ে যাবে কি না কে জানে? শুভ্রতা পড়ে গেলো না। মলিন মুখ নিয়েই সাদাফদের সাথে চেয়ার টেনে বসলো। টেবিলে হালকা কিছু খাবার আসতেই চোখে-মুখে খাবারের প্রতি বিতৃষ্ণা দেখা দিলো তার। প্লেটের খাবারে হাত না দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে চুপচাপ বসে রইলো সে। হঠাৎই অনেকটা ধমকের সুরে বলে উঠলো সাদাফ,

—” কি হলো? খাচ্ছেন না কেন?”

শুভ্রতা চমকে উঠলো। চোখে-মুখে এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে সাদাফের মুখের দিকে তাকালো। আরাফ-শেফাও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সাদাফ নিজের এমন ব্যবহারে নিজেই হতবাক। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ব্যাপারটা সামলে নেওয়ার জন্য বললো,

—” সরি! আমি আসলে ওভাবে বলতে চাই নি। আসলে বাসে আপনাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছিলো। বান্দরবান আমরা বেশ ঘুরাঘুরি করবো। এখন তো শীতের দিন না সো গরমটা করবে প্রচুর। এই অবস্থায় আপনি ঠিক মতো না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। পরে দেখা যাবে পাহাড়ে ঘুরাঘুরি বাদ দিয়ে আপনাকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে।”

শুভ্রতা কিছু বললো না। চুপচাপ খাবার গিলতে লাগলো । সাদাফ খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে শুভ্রতাকে পর্যবেক্ষন করছে। আচ্ছা? মেয়েটির কি খেতে খুব কষ্ট হচ্ছে? খাবারটা কি তার পছন্দ হয়েছে? নাকি অন্যকিছু খেতে চায় সে?

#চলবে…

[ ঘুমে চোখ বুজে আসছে। কি লিখছি আল্লাহ জানে। রি-চেইক করা হয় নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন প্লিজ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here