আরশিযুগল প্রেম❤পর্ব-২

# আরশিযুগল প্রেম❤পর্ব-২
#লেখিকা-নৌশিন আহমেদ রোদেলা

মাঝরাতে ট্রেন থামলো। গন্তব্যে নয় গন্তব্যের মাঝের কোনো স্টেশনে। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। একটু আগেও ঢালা বর্ষায় মুখর হয়েছে প্রকৃতি। ট্রেনের বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিস্তব্ধ রাতটির নিস্তব্ধতাকে চিরে দিতেই কাছের কোনো ডোবায় ডেকে উঠছে ব্যাঙ। প্রায় অাধাঘন্টা হতে চললো ট্রেন ছাড়ার নাম নেই। মাঝরাতে কোনো স্টেশনে এতোক্ষন ট্রেন আটকে রাখার কারণ কি হতে পারে বুঝতে পারছে না শুভ্রতা। সামনে বসা ছেলেটি হেডফোন কানে দিয়ে সিটে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। শুভ্রতার মনটা কেমন কু’ডাকছে। মাঝরাতে এভাবে ট্রেন থেমে যাওয়ার ব্যাপারটা কিছুতেই হজম হচ্ছে না তার। কই বাবা-মার সাথেও তো রাতের ট্রেনে আসা-যাওয়া করছে সে,এমন তো কখনো হয় নি! শুভ্রতা মুখ কাঁচুমাচু করে জানালাটা হালকা খুলে বাইরে তাকালো। বাইরের অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়লো না তার। খানিকবাদে সামনে বসে থাকা ছেলেটি নড়েচড়ে বসলো। হেডফোনটা কান থেকে নামিয়ে ভ্রু কুঁচকে ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর কি ভেবে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। শুভ্রতারও ইচ্ছে করছিলো বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সাহস করে উঠতে পারলো না । কেবিনে বসেই জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ব্যাপার বুঝার বৃথা চেষ্টা করলো সে। খাঁ খাঁ করা এই রাতের ভয়াবহতাকে বাড়িয়ে দিতেই যেন থেকে থেকে ডেকে উঠছে গ্রাম্য পোকা আর কোলা ব্যাঙের ছা। শুভ্রতা সিটে গুটিশুটি হয়ে বসে “কোলা ব্যাঙ” নামটা বিরবির করতে লাগলো। একটি ব্যাঙেরই কতো নাম। কোলা ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙ আরো কতো কি। এদের আবার বৈজ্ঞানিক নামও আছে —–“Hoplobatrachus tigerinus।” ইংরেজিতে একে বলে — ” Indian bull frog” শুভ্রতা ভাবে আর অবাক হয়। আচ্ছা? মানুষেরা যে তাদের এমন ভয়ানক ভয়ানক নামে চিন্হিত করে দিয়েছি, কোলা ব্যাঙ মহাশয় কি তা জানে? শুভ্রতার ভাবনার মাঝেই কেবিনে ডুকলো ছেলেটি। কালো চামড়ার ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার উদযোগ করছে সে। শুভ্রতা অবাক হলো। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে উঠলো,

— ক কোথায় যাচ্ছেন, ভাইয়া?

ছেলেটি ব্যাগ কাঁধে তুলে নিতে নিতেই শুভ্রতার দিকে তাকালো। গম্ভীর গলায়ই বললো,

— একটু আগের ঝড়ে রেললাইনে গাছ ভেঙে পড়েছে। তাতে করে রেললাইনের ক্ষতিও হয়েছে। সামনে এমন সমস্যা আরো আছে কি না জানা নেই কারো। গাছ না সরানো পর্যন্ত ট্রেন চলবে না। তাই যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।

শুভ্রতার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো, বলে কি? শুভ্রতাকে সম্পূর্ণ অগ্রায্য করে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেলো ছেলেটি। শুভ্রতা যেন অকূল পাথারে পড়লো। তাড়াহুড়ো করে ঘড়ি দেখলো সে —- ১ঃ০৩। এই মাঝরাতে কি এই ট্রেনেই থাকতে হবে তাকে? শুভ্রতা দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। এই ঝড়-বৃষ্টির রাতকে মাথায় নিয়েই ব্যাগ হাতে বেরিয়ে যাচ্ছে অনেকে। চলতি ট্রেনে থাকাটা যতটা না ভয়ের তারথেকে ভয়ের মাঝরাতে থেমে থাকা এই অনিশ্চিত ট্রেনে। শুভ্রতা একা এই অন্ধকার রাতে বেরিয়ে পড়ার সাহস যেমন পাচ্ছে না ঠিক তেমনই একা এই ট্রেনে থেকে যেতেও পারছে না। তারওপর জায়গাটাও অচেনা। কোথায় যাবে সে? শুভ্রতার এতোসব ভাবনার মাঝে তাকে চমকে দিতেই যেন তুমুল শব্দে বাজ পড়লো কোথাও। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় বড় বড় করে লেখা স্টেশনের নামটা চোখে পড়লো তার —– “আশুগঞ্জ রেলস্টেশন, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া” হঠাৎ কি মনে করে দৌড়ে কেবিনে গেলো শুভ্রতা। ভারি লাগেজটা নিয়ে ঝটপট ট্রেন থেকে নেমে পড়লো সে। বামহাতে স্কার্টটা হালকা তুলে দৌড় লাগালো ওই ছেলেটার পিছু। কিছুটা কাছাকাছি যেতেই ডেকে উঠলো শুভ্রতা,

— এইযে ভাইয়া? শুনছেন? একটু দাঁড়াবেন প্লিজ?

ছেলেটি থমকে দাঁড়ালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে পেছনে তাকাতেই শুভ্রতাকে দেখতে পেলো সে। অন্ধকারে ছেলেটির চেহারা দেখা গেলো না। শুভ্রতা হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

— আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

ছেলেটি বললো,

— তখনই তো বললাম। বাড়ি ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছি।

— না তা নয়। আপনি কোন শহরে যাচ্ছেন সেটা জিগ্যেস করছিলাম। কোথায় যাচ্ছেন?

— ঢাকায়।

ছেলেটির উত্তর পেয়ে শুভ্রতা খুশি হলেও ছেলেটির বিরক্তিভাবটাও বেশ বুঝতে পারলো সে। মনের মাঝে অস্বস্তি আর ভয় কাজ করলেও অনুরোধ গলায় বলে উঠলো শুভ্রতা,

— আমিও ঢাকায় যাবো। আমাকে সাথে নিবেন প্লিজ?

শুভ্রতার কথায় ছেলেটির মুখের ভাব কেমন হলো অন্ধকারে তা চোখে পড়লো না শুভ্রতার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ছেলেটি শান্ত গলায় উত্তর দিলো,

— এই জায়গাটুকু সেইভ নয়। তাছাড়া এখন অনেক রাত। আপনি আমার সাথে থাকলে অনেক বিপদে পড়তে হতে পারে। আই থিংক, বুঝতে পারছেন? তাই, সরি!

শুভ্রতা আকুতি নিয়ে বললো,

— প্লিজ! দেখুন আপনি আমার সহযাত্রী। তাছাড়া এজ আ পারসন , একটা মেয়েকে এভাবে ফেলে যেতে পারেন না। আমি একা এসেছি। আপনাকে যা একটু চিনি আর সবাই অপরিচিত। এতো রাতে ট্রেনে থেকে যাওয়াটাও তো রিস্ক বলুন। প্লিজ!

ছেলেটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। বিরক্তিতে সারা শরীর শিরশির করছে তার। নিজের মনে বিরবির করে বললো,”আজাইরা ঝামেলা”। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললো,

— আচ্ছা, চলুন।

শুভ্রতা খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,

— থেংক্স।

ছেলেটি কিছু বললো না। একে তো মাঝরাত তারওপর টিপটিপ বৃষ্টি। এমন একটা রাতে রাস্তাঘাটে মানুষ তো দূরের কথা দু’একটা গাড়িও চোখে পড়া দায়। গাছের পাতা বেয়ে পড়া বৃষ্টির পানির শব্দ আর দু’জনের পায়ের ছপছপ আওয়াজ যেন রাতটিকে আরো রহস্যময় আর ভৌতিক করে তুলছে ক্রমাগত। শুভ্রতার মনে হাজারও প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। অচেনা অজেনা এক ছেলের সাথে এমন নিস্তব্ধ একটি রাতে অচেনা রাস্তায় হেঁটে চলেছে ভাবতেই শরীর শিউরে উঠছে তার। শুভ্রতার মা রাদিবা আহমেদের জ্ঞান হারানোর জন্য এই ছোট্ট খবরটুকুই যথেষ্ট। শুভ্রতা ছেলেটিকে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। এই মাঝামাঝি ধরনের ফিলিংসটা খুবই বাজে। এতে না বিশ্বাস করে মনকে আত্মস্থ করা আর না অবিশ্বাস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলা যায়, “ছেলেটা খারাপ! ভয়ানক খারাপ।” শুভ্রতার ভয় আর আতঙ্ককে আরো একচোট বাড়িয়ে দিতেই কোন এক গলির ভেতর থেকে ডেকে উঠলো এক কুকুর। নিস্তব্ধতার মাঝে হঠাৎ এমন শব্দে চমকে উঠে ছেলেটির দিকে কিছুটা চেপে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলো শুভ্রতা। পরিচিত কেউ হলে নির্ঘাত শক্ত করে হাত চেপে ধরতো শুভ্রতা। কিন্তু এ তো অপরিচিত এক যুবক! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলে উঠলো শুভ্রতা,

— ককোথায় যাচ্ছি আমরা?

ছেলেটি শান্ত গলায় বললো,

— একজন বললো সামনে একটা বাজার আছে। ওখানে সিএনজি পেলেও পেতে পারি। আমরা এখন বাজারের দিকেই এগুচ্ছি। সাবধানে…সামনে গর্ত আছে।

শুভ্রতা গর্ত খেয়াল করলো। তারপর নিচু গলায় বললো,

— আর কতক্ষণ হাঁটতে হবে?

— জানি না। মনে হয় চলে এসেছি। চলুন দেখি…

কয়েক মিনিট হাঁটার পর বাজারে গিয়ে পৌঁছালো তারা। কিন্তু এই অন্ধকার বর্ষার রাতে বাজারটাকে ঠিক বাজার বলে বোধ হচ্ছে না। সব দোকানপাটের শাটার নামানো। চারদিকে মানুষের ছায়াটা পর্যন্ত নেই। ব্রেঞ্চের নিচে, কাগজ দিয়ে পেঁচানো ঠেলা গাড়ির ওমে শুয়ে থাকা একটা দুটো কুকুর শুধু মাথা উঁচিয়ে ডেকে উঠলো। দু’বার ডেকে আবারও গলা নামিয়ে আরাম করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শুভ্রতার নিজের গালেই চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে । কি দরকার ছিলো এই রাতে বাসা থেকে বের হওয়ার? বিরক্তিকর! কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই একটা সিএনজির দেখা মিললো তাদের। ছেলেটি হাত উঁচিয়ে সিএনজি থামতে বলে ড্রাইবারের দিকে এগিয়ে গেলো। সিএনজির উপর দুই হাত রেখে খানিকটা ঝুঁকে গিয়ে বললো,

— মামা, ঢাকা যাবা?

— না মামা। এই রাইতে ওতোদূরের ট্রিপ লইতাম না। তারওপর ঝড় বৃষ্টি।

— মামা যাও না একটু কষ্ট করে। তিন ডাবল ভাড়া দিবোনি মামা। তাও চলো।

— না মামা। হয়তো না। সামনে চেকপোস্ট আছে। পুলিশে আটকাইবো। আমার কাগজ পত্রও ঠিক নাই। নয়তো দিয়াইতাম মামা।

— এটা কোনো কথা? আচ্ছা এখানে কি বাস সার্ভিস কিছু পাবো মামা?

— না এই রাইতে তো পাইবেন না। এমুন ঝড়ের রাইতে বের হইছেন কেন? এখন কোনো গাড়িই ঢাকা যাইতো না। তাও দেখেন… পাইলেও পাইতে পারেন।

ছেলেটি হালকা হেসে বললো,

— আচ্ছা, ধন্যবাদ মামা৷ তুমি যাও।

সিএনজি ড্রাইভার চলে যেতেই ছেলেটি শুভ্রতার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় ছেলেটির কপালের চিন্তার ভাজটি স্পষ্ট দেখতে পেলো শুভ্রতার। আবারও বিদ্যুৎ চমকিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। দু’জনেই দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো একটি দোকানের দাওয়ায়। দোকানের ভাঙাচোরা অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দোকানটা একটি চায়ের স্টল। এদিক সেদিক চোখ ঘুরিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো শুভ্রতা। শীতে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সে। এমন একটা বাজে পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়ে নি সে। এই ছেলেটা যদি এখন ওর ওপর হামলেও পড়ে তবুও কিছুই করার নেই শুভ্রতার। ভয়ে, অসহায়ত্বে পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। ডান হাতে বামহাতের বাহু ঘষতে ঘষতে কাঁপা গলায় বলে উঠলো শুভ্রতা,

— এখন কি হবে? কিভাবে যাবো আমরা?

ছেলেটির সহজ স্বীকারোক্তি,

— জানি না। (একটু থেমে) আপনার বেশি ঠান্ডা লাগলে আমার জ্যাকেটটা নিতে পারেন।

শুভ্রতা হাসার চেষ্টা করে বললো,

— থেংক্স বাট লাগবে না। আমি ঠিক আছি।

আরো কিছুক্ষণ নীরবে বৃষ্টির শব্দ শুনলো দু’জন। টিনের চালে ঝনঝন করে বেজে চলেছে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা। দু’জনের মনেই উদ্বেগ, “বাড়ি কি করে ফিরবো এবার?” প্রায় আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর নিজের ফোনটা বের করে কাউকে ফোন লাগালো ছেলেটি। দু’বার রিং হওয়ার পর ফোনটা রিসিভ হলো,

— হ্যালো, আরাফ?

ওপাশ থেকে ঘুমুঘুমু গলায় বলে উঠলো কেউ,

— হ। কে?

— আমি সাদাফ। এই তুই না ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার?

— হ। কেন বল তো? এই রাইতে তুই জাস্ট এই কথা জিগানোর জন্য ফোন দিছিস?

— অলওয়েজ বেশি কথা না বললে চলে না তোর? এনিওয়ে, এখন তুই কই? ঢাকায় নাকি ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায়?

— ঢাকায় আছি দোস্ত। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া যাই না প্রায় পাঁচমাস হইলো। কিন্তু কাহিনীডা কি?

— আরে আশুগঞ্জ এসে ট্রেনে প্রবলেম হইছে। নেমে আসছি ভাবলাম সিএনজি নিয়ে চলে আসবো ঢাকায়। এখন তো সিএনজির চুচাও চোখে পড়তেছে না। তারওপর এই বৃষ্টি!

আরাফ উদ্বেগমাখা গলায় বললো,

— এখন কই আছিস তুই?

— বুঝতাছি না। মনে হয় আশুগঞ্জ বাজারে।

— হায় আল্লাহ! অতো রাতে তো ওইখানে সিএনজি পাবি না দোস্ত। তারওপর বলতেছিস বৃষ্টি।

— তোরে সমস্যা বলতে বলি নাই ব্যাটা, সমাধান বল। কি করবো এখন?

— আমি ওইখানে থাকলে না হয় কিছু করতে পারতাম। এইখান থেকে তো কিছু করতে পারতাছি না দোস্ত।

— আচ্ছা ঠিক আছে। ফোন রাখ!

কথাটা বলেই ফোন কাটলো সাদাফ। শুভ্রতা আড়চোখে অন্ধকারে ঢাকা ছেলেটিকে দেখছে। ও ভাবতেই পারে নি ছেলেটি এতো কথা বলতে পারে। শুরু থেকেই কেমন গম্ভীর গম্ভীর ভাব!

(নায়ক-নায়িকার নাম নিয়ে হল্লাহল্লি না করে গল্প সম্পর্কে গঠনমূলক কমেন্ট করুন।)
#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here