আরশিযুগল প্রেম❤পর্ব- ৭

আরশিযুগল প্রেম❤পর্ব- ৭
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা ❤

উত্তরার চিরচেনা ক্যাফেতে বসে আছে শেফা আর শুভ্রতা। শুভ্রতাকে বেশ কসরত করেই এই অব্দি টেনে এনেছে শেফা। ভার্সিটি শেষ করে ধানমন্ডি থেকে উত্তরা আসতে কিছুতেই রাজি ছিলো না সে। তাও আবার আরাফের সাথে দেখা করার জন্য? নো ওয়ে! অন্যের প্রেমালাপে শুভ্রতার কি কাজ? কিন্তু শেফাকে তা বুঝানো দায়। মুখে যত কিছুই বলুক না কেন আরাফের সাথে একা দেখা করতে খুবই অস্বস্তির সম্মুখীন হচ্ছে সে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই সাথে আসতে রাজি হয়েছে শুভ্রতা। ক্যাফেতে এসে পৌঁছানোর পাঁচ মিনিটের মাথায় বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো শুভ্রতা,

—” তোমার হবু বর যে আস্ত একটা হাদা তা আজ আবারও প্রমাণিত আপু।”

শেফা গরম চোখে তাকালো। মুখ ফুলিয়ে বললো,

—” এ তোর ভারি অন্যায় শুভি। তুই বারবার ওর পেছনে কেন লাগছিস বল তো? তোর হবু দুলাভাইকে অবশ্যই তোর রেসপেক্ট করা উচিত। কি এমন করেছে সে, যার জন্য তুই ওকে হাদা বলছিস?”

শুভ্রতা অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,

—” কি করেছে? তুমি তো দেখছি বিয়ের আগেই বরের প্রতি ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে গেছো আপু। কয়টা বাজে দেখেছো?”

কথাটা বলে ঘড়ি পড়া বামহাতটা শেফার দিকে এগিয়ে দিলো শুভ্রতা। ইশারায় ঘড়ি দেখিয়ে যথাযথ যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করলো সে,

—” দেখো, সন্ধ্যা ৭ঃ২০। অলমোস্ট রাত হয়ে এসেছে। এই টাইমে কোন ভদ্রলোক পাত্রীর সাথে গোপন আলাপ সাড়তে চায় বলো?”

শেফা ক্ষেপা গলায় বললো,

—” তোর সবকিছুতে বাড়াবাড়ি শুভি। “গোপন আলাপ” বলতে কি বুঝাতে চাইছিস তুই? নিশ্চয় কোনো কারণ আছে তাই এই সময়টা সিলেক্ট করেছে ও। তাছাড়া, এমন তো কোনো নিয়ম নেই যে এই সময়ে কারো সাথে দেখা করা যাবে না, আছে কি?”

শুভ্রতা কিছু বলবে তার আগেই স্বচ্ছ কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো আরাফ। শুভ্রতা দরজার মুখোমুখি বসেছিলো। শেফার কথার উত্তর দিতে গিয়ে বেখেয়ালিভাবে দরজার দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার। হঠাৎই সটান দাঁড়িয়ে গেলো সে। শেফা অবাক হয়ে বললো,

—” শুভি? এই শুভি? কি হয়েছে? এভাবে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? ”

শুভ্রতা ঘন ঘন ঢোক গিলে ভ্রু জোড়া খানিকটা কুঞ্চিত করে ভয়মাখা চোখে তাকিয়ে আছে। শেফা প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে শুভ্রতার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছন ফিরে তাকালো। আরাফ আর সাদাফকে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে অল্প হাসলো। সাথে সাথেই তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো শুভ্রতা,

—” আপু?ভাইয়া তো চলেই এসেছে। তুমি থাকো, আমি যাই হ্যাঁ? এখানে আমার কি কাজ বলো?”

কথা শেষ করেই পার্সটা হাতে তুলে নিয়ে পা বাড়ালো শুভ্রতা। ডানহাতে শুভ্রতার ডানহাতটা চেপে ধরে জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো শেফা,

—” পাগল তুই? এভাবে চলে গেলে কি মনে করবে বল তো? একটু কথা-টথা বলে তারপর যা। প্লিজ।”

শুভ্রতাকে প্রতিবাদের সুযোগ না দিয়েই সামনে এসে দাঁড়ালো দুই বন্ধু। দুইদিন ব্যাপী সাদাফের পেছনে ঝুলে ঝুলে আজ সন্ধ্যায় তাকে সাথে আসার জন্য রাজি করিয়েছে আরাফ। ক্যাফেতে ঢুকে শুভ্রতাকে দেখে নিজেও খুব একটা কম চমকায়নি সাদাফ। কয়েক সেকেন্ডের জন্য পা’দুটো মাটির সাথে সিটিয়ে গিয়েছিলো তার। নিজেকে সামলে নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলেও বুকের মাঝে অচেনা এক ধুকপুক শব্দ অল্প বিস্তার জ্বালাচ্ছে তাকে। শুভ্রতা যে খুব বেশি সুন্দরী, তা তো নয়। সাধারণ বাঙালি মেয়েদের মতোই গোলগাল হলদে ফর্সাটে মুখ, চাপা নাক। শুভ্রতার থেকেও কতো শতো সুন্দরী মেয়ের সাথে পরিচিয় আছে সাদাফের,প্রোপোজাল পেয়েছে ,এড়িয়েও গেছে তবুও শুভ্রতার প্রতিই এতো অস্থিরতা কেন? অলৌকিক এক বন্ধনে বেঁধে গেছে বলে? নাকি অন্যকোনো রহস্য? অচিন্তনীয় বিষয়গুলোই চিন্তার ছাঁচে ফেলে একদফা চিন্তা করে নিলো সাদাফ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদু হেসে শেফার দিকে তাকালো। মিষ্টি গলায় বললো,

—” আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন ভাবি?”

সাদাফের মুখে “ভাবি” ডাক শুনে লজ্জায় রাঙা হলো শেফা। মাথা নিচু করে মাথা হেলিয়ে বললো,

—” ভালো আছি, ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?”

সাদাফ শুভ্রতার পাশের চেয়ারটায় বসলো। শেফার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো,

—” আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনাদের মাঝে হাড্ডি হতে চলে এলাম। তবে,আমার কিন্তু কোনো দোষ নেই ভাবি। আরাফ আমায় জোর করে এনেছে।”

শেফা হাসলো। আরাফ শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—“কেমন আছো শুভ্রতা? হবু শালী বলে তুমি করেই সম্মোধন করলাম। রাগ করো নি তো?”

শুভ্রতা ইতস্তত গলায় বললো,

—” একদমই না ভাইয়া। তুমিটাই সুইটেবল।”

চারজনকেই নীরবতা ছেয়ে ধরলো। সবার চোখে-মুখেই অস্বস্তির ছাপ। এই অস্বস্তির পরদ উঠিয়ে জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে বলে উঠলো সাদাফ,

—” তোরা কথা বল আরাফ। আমি বাইরে দিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি। কিছু কেনার ছিলো।”

এটুকু বলেই উঠে দাঁড়ালো সাদাফ। শুভ্রতাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে হালকা কেশে বলে উঠলো সাদাফ,

—” শুভ্রতা? আব..আপনি কি আমায় হেল্প করবেন? আই মিন, কেনাকাটায় হেল্প করবেন?”

সাদাফের মুখে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলো শুভ্রতা। তটস্থ হয়ে সাদাফের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো দারুন বোকামো করেছে সে। সাদাফ যে আরাফদের স্পেস দেওয়ার জন্যই বেরিয়ে যাচ্ছে তা বুঝে নিজেরও কিছু একটা বাহানা দেওয়া উচিত ছিলো। মনে মনে নিজেকে হাজারটা বকা দিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো শুভ্রতা। শেফার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,

—” তোমরা গল্প করো আপু। রাতের রাস্তাটা বেশ লাগে আমার। আমি বরং উনার সাথে হেঁটে আসি। কেমন?”

__________________

ক্যাফে থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটছে সাদাফ-শুভ্রতা। দু’জনের মাঝেই বিষাক্ত নীরবতা। সাদাফ পকেটে হাত ঢুকিয়ে চুপচাপ হেঁটে চলেছে। দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির হলেও বেহায়া মনটা শুভ্রতার দিকেই ছুটে চলেছে ক্রমাগত। শুভ্রতার ফর্সা গায়ে কালো জামা, খোলা চুল, গাঢ় কাজলে ঢাকা চোখ সবই যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তার মন। শুভ্রতার মনে হাজারো অস্বস্তি। সাদাফের জায়গায় অন্য কেউ হলে সহজেই কথা বলতে পারতো সে। নিঃসংকোচে হাঁটতে পারতো কিন্তু কি আশ্চর্য, যার সাথে সংকোচহীন সম্পর্কে বেঁধে আছে তার কাছেই নিঃসংকোচ হতে পারছে না সে। পাঁচ/দশ মিনিট নিঃশব্দ থেকে কিছুটা ফাঁকা রাস্তায় এসে কথা বললো সাদাফ,

—” কেমন আছেন, শুভ্রতা?”

নীরবতা ভেঙে সাদাফের এই প্রশ্নে চমকে উঠলো শুভ্রতা। বামপাশের চুলগুলো কানে গুঁজে নিয়ে মৃদুস্বরে বললো,

—” ভালো আছি, আপনি?”

—” আমি সবসময় ভালোই থাকি। আপনি কি খুব বেশি অস্বস্তি ফিল করছেন?এ..”

সাদাফের কথা শেষ না হতেই একটা গাড়ি শুভ্রতার পাশ কেটে খুব স্পিডে বেরিয়ে গেলো। সাদাফ খুব সাবধানে শুভ্রতার অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। শুভ্রতাকে ফুটপাতের ভেতরদিকে হাঁটতে দিয়ে নিজে রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটতে লাগলো। সাদাফের এই ছোট্ট যত্নটাও যেন শুভ্রতার মনে হাজারো ভালোলাগার পরশ দিয়ে গেলো। আড়চোখে ল্যাম্পপোষ্টের হলদে আলোয় সাদাফকে দেখতে চেষ্টা করলো শুভ্রতা। তবে, দু’জন পাশাপাশি হাঁটতে থাকায় সাদাফের সবটা দেখতে পেলো না শুভ্রতা। চোখে শুধু ধরা পড়লো সাদাফের ফর্সা গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, কালচে লাল ঠোঁট আর কনুই পর্যন্ত ভাজ করে রাখা খয়েরী শার্টের হাতা আর হ্যা, ফর্সা হাতের কব্জির খানিকটা উপরে কুচকুচে কালো তিল। সেই তিলটার দিকেই সম্মোহনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শুভ্রতা। ঘড়ির সাদা বেল্টের খানিক উপরে তিলটাকে এমন নিঃসংকোচে নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে দেখে খানিকটা হিংসে লাগলো শুভ্রতার। সাদাফ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে আবারও কথা পাড়লো,

—” আপনি যে অস্বস্তি ফিল করছেন তা বুঝতে পারছি আমি। আপনার অস্বস্তি দেখে আমারও অস্বস্তি লাগছে। আপনার কাজিনের সাথে আরাফের বিয়েটা হয়ে গেলে হয়তো মাঝে মাঝেই মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। তাই বলছিলাম, প্লিজ! ইজি হওয়ার চেষ্টা করুন। আমাদের সাথে যা ঘটে গেছে তা একটা এক্সিডেন্ট। আপনি অন্যকারো সাথে জড়িয়ে থাকতে পারেন। আর থাকাটাও স্বাভাবিক। আমি এই বিষয়ে কোনো রকম প্রশ্ন করবো না আপনাকে। না কোনো রকম জবাবদিহি চাইবো। আপনার উপর অধিকারও খাটাবো না। আপনি আপনার মতোই চলুন। এতো ভয় বা অস্বস্তির কিছু নেই। নয়তো, ব্যাপারটা ধীরে ধীরে আরো বেশি ক্রিটিক্যাল হয়ে যাবে। আই থিংক, আপনি বুঝতে পারছেন।”

শুভ্রতা মাথা নাড়লো। সাদাফ হেসে বললো,

—” এখনও অস্বস্তি ফিল করছেন?”

শুভ্রতা আড়চোখে তাকালো। হালকা হেসে বললো,

—” হালকা। তবে,ধীরে ধীরে কেটে যাবে।”

সাদাফ ঠোঁট টিপে হাসলো। শুভ্রতার বলতে ইচ্ছে হলো, “আরেকবার হাসুন না প্লিজ!” আচ্ছা? এই লোকটা এতো সুন্দর করে হাসে কেন?কেন? কিছুটা সামনে এগুতেই ফুসকার স্টল চোখে পড়লো। সাদাফ আড়চোখে শুভ্রতাকে দেখে নিয়ে বললো,

—” ফুসকা খাবেন?”

শুভ্রতা মুখে হাসি ফুটিয়ে চট করে বলে উঠলো,

—” অবশ্যই।”

কথাটা বলে ফেলেই জিব কাটলো শুভ্রতা। সাদাফের কথাটা একদমই মনে ছিলো না তার। জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো,

—” না মানে…আসলে….!”

সাদাফ হেসে ফেললো। ঠোঁট টিপে হেসে বললো,

—” চলুন,ম্যাডাম।”

নিজেকে হাজারখানেক বকা দিয়ে সাদাফের পেছন পেছন ফুসকার স্টলের সামনে দাঁড়ালো শুভ্রতা। সাদাফ এক প্লেট ফুসকার অর্ডার করতেই ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো শুভ্রতা,

—“এক প্লেট কেন?”

—“আমি ফুসকা খাই না।”

—” তাই বলে আমি একা একা খাবো? চলুন, আমিও খাবো না।”

সাদাফ তাড়াহুড়ো করে বললো,

—” তা কেনো হবে? অর্ডার তো দেওয়া হয়ে গেছে শুভ্রতা। তাছাড়া আমি ঝাল তেমন খেতে পারি না। আপনি খান, সমস্যা নেই।”

শুভ্রতা স্পষ্ট গলায় বললো,

—” বললাম তো খাবো না। চলুন।”

সাদাফ শুভ্রতার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

—” আচ্ছা,বেশ। চলুন আমিও খাচ্ছি। ”

শুভ্রতা সামনের দিকে হাঁটা দিয়ে বললো,

—” বললাম তো খাবো না।”

সাদাফ ফুসকা ওয়ালাকে অযথা এক প্লেটের দাম দিয়ে শুভ্রতার পেছনে ছুটলো। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো,

—” আপনি খুব জেদি শুভ্রতা।”

শুভ্রতা হেসে বললো,

—” জানি। শেফা আপু বলে আমার বরের কপালে দুঃখ আছে। জেদী বউয়ের বররা বেচারা টাইপের হয়।”

সাদাফ হুট করেই বলে ফেললো,

—” তবে কি আমাকে বেচারা টাইপ মনে হয়?”

সাদাফের এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো শুভ্রতা। সাদাফও নিজের অস্বস্তিকর প্রশ্নটা বুঝতে পেরে অন্যদিকে চোখ ঘুরালো। শিট! কি সব বলছে সে। এরপর দু’জনেই চুপ। তাদের এই নিশ্চুপতা কাটিয়ে ফোন বেজে উঠলো তুমুল শব্দে। সাদাফ নিজের ফোনটা চেক করে নিয়ে বললো,

—” আমারটা তো নয়। হয়তো আপনার ফোন বাজছে, শুভ্রতা।”

শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ফিসফিস করে উঠলো শেফা,

—” এই কই তুই? সাদাফ ভাইয়ের সাথে প্রেম করতে লেগে গেছিস নাকি? তাড়াতাড়ি আয় না, প্লিজ। আমার প্রচুর লজ্জা লজ্জা লাগছে।”

শুভ্রতা ছোট্ট করে বললো,

—“হু।”

#চলবে…

(কপি সম্পূর্ণ নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here