আরশিযুগল প্রেম❤সূচনা পর্ব
#লেখিকা-নৌশিন আহমেদ রোদেলা
এক.
বর্ষার মাঝামাঝি সময়। দিন-রাত আঁধার করে আনা বৃষ্টি। রেলস্টেশনের সামনের কিছুটা জায়গাও কর্দমাক্ত। শুভ্রতা একহাতে স্কার্ট সামলে অন্যহাতে ভারি স্যুটকেস নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মনটা ধুকপুক করছে তার। মনে হচ্ছে, এই বুঝি লাগেজ হাতে পা পিছলে পড়বে সে। খুব সাবধানে কাঁদামাখা জায়গাটুকু পাড় হয়ে রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালো। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে গায়ের টপসটাও অনেকটা ভিজে এসেছে তার। স্কার্টটা দু’হাতে ঝেড়ে নিয়ে বামহাতে পড়া ঘড়ির দিকে তাকালো সে —- ৯ঃ৩০। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী “মহানগর এক্সপ্রেস” স্টেশন ছাড়ার কথা সাড়ে নয়টায়। অথচ এখনও ট্রেন আসার নামগন্ধ নেই। শুভ্রতা বিরক্ত ভঙ্গিতে পিলারে ঠেস দিয়ে বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকালো। কিছুক্ষণের মাঝেই যে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হবে তারই পূর্বাবাস দিচ্ছে প্রকৃতি। ইংরেজিতে এই বৃষ্টিকে বলে “কেটস এন্ড ডগস্”। মুষলধারার বৃষ্টির সাথে কুকুর বিড়ালের কি সম্পর্ক জানা নেই শুভ্রতার। শুভ্রতা কপাল কুঁচকে আকাশের দিকে তাকায়। রাতের অন্ধকার আকাশকে চিরে দিয়ে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সাথে সাথেই চারপাশটা সাদা সাদা আলোয় ভরে উঠছে। এমন একটা ভয়ঙ্কর রাতে একা ঢাকার পথে রওনা দিয়েছে বলে নিজের উপরই রাগ লাগছে তার। শুভ্রতার পুরো নাম — রৌশিন আহমেদ শুভ্রতা। ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসার শাহিনুজ্জামান সাহেবের মেয়ে সে। চট্টগ্রামে মামুর বাসায় বেড়াতে এসেছিলো শুভ্রতা। মামুর সাথে রাগ করেই হুট করে বর্ষার রাতে বেরিয়ে এসেছে বাড়ি ফিরবে বলে। কিছুক্ষনের মাঝেই ট্রেন এলো। শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও ঘড়ির দিকে তাকালো —- ৯ঃ৪০। স্যুটকেস হাতে ঝটপট ট্রেনে উঠে গেলো শুভ্রতা। বাবা-মা ছাড়া এর আগে কখনো ট্রেনে উঠে নি শুভ্রতা। ছোট থেকেই ট্রেন নিয়ে বেশ ভীতি আছে তার মনে। তার ধারনা ট্রেনে উঠতে গেলেই অসংখ্য মানুষের পিড়াপিড়িতে হাত ছুটে গিয়ে অচেনা মানুষের ভীরে হারিয়ে যাবে সে। শুভ্রতা টিকেট দেখে নিজের সিটটা খুঁজে নিয়ে স্যুটকেসটা তাকে রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ব্যাগ থেকে একটা শাল বের করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বৃষ্টি দেখতে মগ্ন হলো। রাতের বৃষ্টিগুলোর সৌন্দর্য একদমই অন্যরকম। মনে হয় কালো পর্দায় সাদা সাদা মুক্তো ঢেলে দিচ্ছে কেউ। শুভ্রতা ট্রেনের গায়ে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। ঠান্ডায় কেমন একটা তন্দ্রা ভাব হচ্ছে তার।
— এক্সকিউজ মি? এক্সকিউজ মি, আপু?
শুভ্রতা চোখ মেললো। বৃষ্টি দেখতে দেখতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিলো বুঝতেই পারে নি সে। চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে ডানপাশে তাকালো শুভ্রতা। সাদা টি-শার্টের উপর কালো জ্যাকেট পড়া একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। একহাতে কালো চামড়ার ব্যাগ। অন্যহাতে ভেজা চুলগুলো ঠিক করতে করতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে। শুভ্রতা তাকাতেই নম্রভাবে বলে উঠলো ছেলেটি,
— আমার ভুল না হলে আপনি যেখানে বসেছেন সেটা আমার সিট। আমি কি আপনার সিটে বসতে পারি?
শুভ্রতা দ্রুত সিট নাম্বারটা খেয়াল করলো। সিট নাম্বারটা দেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াতে গিয়েই আঘাত পেলো মাথায়। ঠোঁট উল্টে এক হাতে মাথার বামপাশটাই চেপে ধরে ডানহাতে লাগেজ নিতে গিয়ে গায়ের চাদরটাও লুটিয়ে পড়লো। শুভ্রতা অস্বস্তিতে খিটমিট করে দ্রুত কাজ করতে গিয়ে আবারও সবটা গুলিয়ে ফেললো। ছেলেটি ব্যস্ত হয়ে বললো,
— আপনি অযথা ব্যস্ত হচ্ছেন, আপু। আপনি ধীরে করুন আমার কোনো তাড়া নেই।
ছেলেটার নিতান্ত ভদ্র কন্ঠে শুভ্রতার খুশিতে গদগদ হয়ে পড়ার কথা থাকলেও তার চোখে-মুখে বিরক্তি। ঘুম ভেঙেই এমন অযাচিত পরিস্থিতিতে পড়ায় ছেলেটার প্রতি অসম্ভব ক্ষেপে আছে সে। অনেক কষ্টে লাগেজটা সরিয়ে নিজের তাকে রেখে সিটে বসতে নিয়েও বাঁধালো এক গন্ডগোল। সিটের এককোনায় রাখা পানির বোতলটা উল্টে দিয়ে সিটের খানিকটা ভিজিয়ে দিলো সে। ছেলেটা নীরবে সবটা সহ্য করলেও চোখে-মুখে বিরক্তি স্পষ্ট। ভ্রু- দুটো খানিকটা কুঁচকে আছে। মুখটাও গম্ভীর। শুভ্রতা বোতলটা ঝটপট তোলে নিয়ে ওড়নার কোণে পানিটা মুছে দিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো,
— সরি!
ছেলেটি গম্ভীর স্বরে বললো,
— ইট’স ওকে।
ট্রেন ছাড়তে ছাড়তে প্রায় পনে দশটা বেজে গেলো। ট্রেনের জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। শুভ্রতার কাছে ব্যাপারটা ভালো লাগলেও সামনে বসা ছেলেটা ব্যাপারটায় চরম বিরক্ত। ভ্রু কুঁচকে জানালাটির দিকে তাকিয়ে থেকে খানিকবাদে জানালাটা বন্ধই করে দিলো সে। শুভ্রতার ইচ্ছে হচ্ছিলো ছেলেটাকে ধরে টুকরো টুকরো করে রেললাইনে ফেলে দিতে। কিন্তু তা সম্ভব নয় বলে চুপচাপ বসে রইলো। কিছুক্ষণ আগে করা নিজের বোকামীতে নিজেই বিরক্ত হচ্ছে সে। সময়টাকে পিছিয়ে নেওয়ার অপশন থাকলে কিছুক্ষণ আগের সময়টুকু ক্রপ করে পৃথিবী থেকে নাই করে দিতে এক মুহূর্তও ভাবতো না শুভ্রতা। ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজতেই হঠাৎই অজানা ভয় হানা দিতে লাগলো তার মনে। রাতের ট্রেনে কেভিন নেওয়ার মতো বোকামির জন্য আবারও নিজেকে বকতে লাগলো সে। ভেবেছিলো বৃষ্টির রাতে কেভিনে চাঁদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই পৌঁছে যাবে ঢাকা। কিন্তু কেভিনের অংশীদার যে একটা ছেলেও হতে পারে মাথাতেই আসে নি তার। এই রাত-বিরাত ফাঁকা কেবিনে ছেলেটি যদি তার উপর হামলে পড়ে, তখন কি হবে? শুভ্রতা ভয়ে ভয়ে ছেলেটির দিকে তাকালো। ছেলেটি কানে হ্যাডফোন লাগিয়ে ভ্রু কুঁচকে ল্যাপটপ দেখায় মগ্ন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে খুবই জরুরী কাজে ব্যস্ত সে। শুভ্রতা বেশ কয়েকবার দোয়া-দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে সিটের এককোনায় জড়োসড়ো হয়ে বসে সন্দেহী দৃষ্টিতে বারবার তাকাতে লাগলো। শুভ্রতাকে সম্পূর্ণ এবোয়েড করাটাকেও কেমন রহস্যজনক মনে হচ্ছে তার। আচ্ছা? ছেলেটা শুভ্রতার ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা করছে না তো? দীর্ঘ দেড়ঘন্টা পর মুখ তুলে তাকালো ছেলেটি। অত্যন্ত নম্র কন্ঠে বললো,
— আমার একটা কনফারেন্স আছে। আমি কনফারেন্সটা এটেন্ড করলে আমার সাউন্ডে কি সমস্যা হবে আপনার?
শুভ্রতা অদ্ভুত চোখে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়লো। যার অর্থ — তার কোনো সমস্যা হবে না। শুভ্রতার উত্তর পেয়ে আবারও ল্যাপটপে মুখ গুজলো ছেলেটি। খানিকবাদেই ইংরেজিতে বকবক করতে লাগলো সে। শুভ্রতা মুখের সামনে একটি বই ধরে বইয়ের উপর দিয়ে আড়চোখে বারবার ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটির অতি ভদ্র ব্যবহার ঠিক নিতে পারছে না শুভ্রতা। কথায় আছে “অতি” জিনিসটাই খারাপ। এই ছেলেটার ক্ষেত্রে প্রবাদটা কতটুকু প্রযোজ্য তাই ভাবছে সে।
#চলবে…