আরশিযুগল প্রেম❤ পর্ব- ২২

আরশিযুগল প্রেম❤ পর্ব- ২২
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা ❤

আকাশের কোণে মস্ত চাঁদ। চাঁদটা আজ বড্ড চঞ্চল। পেঁজা তুলোর মতো আদুরে মেঘগুলোর সাথে তার কতো লুকোচুরি খেলা! আশেপাশের কোনো এক এপার্টমেন্ট থেকে ভেসে আসছে ক্ষীণ বেহালার সুর। করুন সুর। এর আগে কখনও সুরটা কানে আসে নি শুভ্রতার। তবে কি বিল্ডিংয়ে নতুন কেউ এসেছে? হয়তো এসেছে নয়তো নয়। শুভ্রতা বারান্দার রেলিংটাতে মাথা ঠেকিয়ে উদাস চোখে তাকালো। স্নিগ্ধ চোখজোড়া মেলে মস্ত চাঁদটির দিকে তাকাতেই পূর্ণিমার কথা মনে পড়লো শুভ্রতার। চারদিকে কি ধবধবে জ্যোস্না। আচ্ছা? আজ কি তবে পূর্ণিমা? শুভ্রতা অনেক ভেবেও পূর্ণিমার তারিখটা মনে করতে পারলো না। প্রথম কৈশোরে হুমায়ুন আহমেদের জ্যোস্না বিলাসের প্রেমে পড়েই পূর্ণিমা গণনাটা শিখেছিলো সে। তারপর সেই অনেক বছর কেটে গেলো। পূর্ণিমার দিন গণনা করা হয় না। কিন্তু, আজ হঠাৎ এই গণনাটাকেই ভীষণ প্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছে তার। শুভ্রতা তার তুলতুলে গোলাপি আঙ্গুলগুলো বারান্দার গ্রিলের ফাঁকে ঢুকিয়ে, পেছন দিকে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ালো। সাথে সাথেই বেনুনি পিছলে বেরিয়ে আসা চুলগুলো ঝুঁকে পড়লো পেছন দিকে। ক্লান্ত চোখজোড়া বন্ধ করে তীক্ষ্ণ শ্বাস টেনে নিলো শুভ্রতা। মনটা ভীষণ জ্বলছে তার। একদমই উঠতি কিশোরীদের মতো ছটফটানোতে ফেটে যাচ্ছে বুক। এইতো সেদিনও, হাজারো অযৌক্তিক বানোয়াট যুক্তিতে মাকে পরাস্ত করে তৃপ্তির হাসি হাসতো শুভ্রতা। কিন্তু, আজ হঠাৎ করেই থমকে গেলো সব। বেহায়া মনটা মায়ের দৃঢ় যুক্তির পেছনে না ছুটে ঘাপটি মেরে বসে রইলো। সাড়া দিলো না। একটুও না। শুধু এক আষাঢ় বৃষ্টি হানা দিলো তার চোখে। শেফাদের বাসা থেকে ফিরেও আনন্দে উছ্বাসিত ছিলো প্রতিটি মুখ। গন্তব্য এখন হাতের নাগালে এই ভাবনাটাও ছিলো প্রবল। পাঁচ বান্ধবীর অদ্ভুত সব পরিকল্পনার কথা ভেবে অল্প একটু হাসলো শুভ্রতা। ভাবতে লাগলো বিকেলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো, একের পর এক!

অদ্ভুত উত্তেজনায় কাটা হয়ে উত্তরা থেকে সরাসরি ধানমন্ডিতে, শুভ্রতার বাসায় এসে হানা দিলো পাঁচজন। একজনও বাড়ি ফেরার নাম মুখে নিলো না। মনের ভুলেও না। দীর্ঘ জ্যাম পেরিয়ে, এতোটা পথ আসতে কেউ একটু ক্লান্তও হলো না। সারা শরীরে বয়ে যেতে লাগলো উত্তেজনা। তীব্র উত্তেজনা। তারপর কি হবে? কি হবে তারপর? সূর্যের তেজটা তখন কমে এসেছে। চারদিকের নরম আলো আলোড়িত হচ্ছে আছরের তীক্ষ্ণ মধুর আজানের সুরে। এই অসময়ে, ঘেমে নেয়ে একঝাঁক বান্ধবী নিয়ে বাসায় ফেরায় ভ্রু কুঁচকালেন রাদিবা আহমেদ। মেয়ের মতিগতি দিন দিন ভয়ানক থেকে ভয়ানক বলে মনে হচ্ছে তার। রাদিবা আহমেদ দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াতেই সব কটা একরকম দৌঁড়ে গিয়ে ঢুকলো শুভ্রতার রুমে। তাদের এই স্বভাবটাও রাদিবার ঠিক ভালো লাগলো না। কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বিরবির করতে করতে নিজের শোবার ঘরে ঢুকে গেলেন তিনি। আসরের আজান পড়েছে। নামাযের ব্যাপারটা না থাকলে মেয়ের দরজায় নিশ্চয় কান পাততো সে। কি এতো ছাইপাস গল্প তাদের? কোনোরকম চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে বিছানায় গোল হয়ে বসলো তারা। সবার বুক চিঁড়েই বেরিয়ে এলো এক খন্ড ক্লান্তির নিঃশ্বাস। অর্পন ধৈর্য রাখতে না পেরে বললো,

—” ধুর! এভাবে রোবট হয়ে বসে আছিস কেন সব? ফোনটা লাগা।”

সবাই দ্বিধাভরা দৃষ্টি বিনিময় করলো। অর্পন অধৈর্য হয়ে বললো,

—” নয়তো আমায় দে। আমি ফোন দিই। ফোনটা ধরেই বলবো, ‘জানু? কেমন আছো সোনা?”

অর্পনের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো শুভ্রতা। তনয়া ফিক করে হেসে ফেললো। পুষ্পি আর প্রেমাও মুখ টিপে হাসলো। শুভ্রতার রাগী মুখ দেখে ‘এবারের মতো ক্ষমা করে দিলাম’ এমন একটা ভাব নিয়ে বলে উঠলো অর্পন,

—” আচ্ছা যা। জানু বাদ। দুলাভাই ডাকবো। ফোনটা ধরেই বলবো, দুলাভাইইইইইই কেমন আছো গো? নটি বয়!”

অর্পনের মুখভঙ্গি আর কথায় এবার আর হাসি আটকানো সম্ভব হলো না। তিনজনই খিলখিল করে হেসে উঠলো। তনয়া হাসতে হাসতে শুয়েই পড়লো। ডানচোখের কোণে মুহূর্তেই এক বিন্দু জল চিকচিক করে উঠলো। প্রেমা হাসি চেপে বললো,

—” এই অর্পন? তার থেকে বরং এই গানটা গাস, ‘ভাইসাব আমার জানের জান। ভাইসাব আমার প্রাণের প্রাণ। ভাইসাবেরে না দেখেলে বাঁচে না পরাণ।’

শুভ্রতা ফুঁসে ওঠে বললো,

—” তার থেকে বরং তুই এই গানটা গা প্রেমা, ‘কালাচান আমার জানের জান, কালাচান আমার প্রাণের প্রাণ, কালাচানেরে না দেখিলে বাঁচে না পরাণ।’ এটা তোর জন্য বেশি এফেক্টিভ।”

—“আশ্চর্য! তুই এর মধ্যে উনাকে টানছিস কেন?”

সাথে সাথে সবাই সুর তুলে বলে উঠলো,

—” ওহহো…উনননননাকককে!!!!”

প্রেমা কিছু বলতে গিয়েও কথাটা গিলে নিয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। পুষ্পি এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

—” এখন মজা টজা বাদ দে। উত্তেজনায় আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ফোনটা লাগা তো শুভি।”

শুভ্রতা জিহ্বা দিয়ে নিচের ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে বললো,

—” কিন্তু ফোনটা রিসিভ করে কি বলবো?আমার খুব নার্ভাস লাগছে।”

অর্পন বিরক্তিতে হাত উল্টে বললো,

—” কি বলবি মানে? তোর এটাতেও কনফিউশান? ডিরেক্ট ফোন লাগাবি। ফোনটা তুলতেই বলবি, হেই সাদাফ? আমি শুভ্রতা। তোমাকে আমার অনেক ভালো লাগে। চলো ডেটিং এ যাই।”

অর্পনের কথায় সবাই বিস্ফারিত চোখে তাকালো। অর্পন চোখ ঘুরিয়ে ডানহাতে ভ্রু চুলকিয়ে বললো,

—” কোনো সমস্যা?”

সবাই কয়েক সেকেন্ড নীরবতা পালন করে, একসাথে চেঁচিয়ে ওঠে বললো,

—” ডেটিংএ? ”

অর্পন থতমত খেয়ে বললো,

—” তাহলে কাজি অফিস?”

পুষ্পি মুখ ঝামটি দিয়ে বললো,

—” তোর মাথা। শুভ্রতার বর্ননা শুনে বুঝতে পারছিস না যে সাদাফ ভাইয়া একজন জেন্টেলম্যানস। সো উনার সাথে উনার ওয়েতে কথা বলতে হবে। ভদ্র ভাবে।”

কিছুক্ষণ সবাই গম্ভীর চিন্তা-ভাবনায় মত্ত থাকার পর হুট করেই বলে উঠলো তনয়া,

—” শুভি? তুই একটা কাজ কর, ফোনটা লাগা। ফোনটা ধরার পর সালাম দিয়ে বলবি, শ্রদ্ধেয় সাদাফ মহোদয়, আমি অতি ক্ষুদ্র বালিকা শুভ্রতা। আপনার সাথে সাক্ষাৎ এর পর থেকে আমার হৃদয়ের মনিকোঠায় অদ্ভুত কিছু বাসনার উদ্ভব ঘটিতেছে। মূলত আমি আপনার সহিত প্রণয়….”

এটুকু বলতেই বাকি চারজন চেঁচিয়ে ওঠে বললো,

—” প্লিজ থাম!”

তনয়া চমকে ওঠে অদ্ভুত চোখে তাকালো। অর্পন তনয়ার কাঁধে হাত রেখে দুঃখী দুঃখী গলায় বললো,

—” দোস্ত? বিশ্বাস কর…আমার আইডিয়াটাতে পোলাটা যায় একটু ঝুলে থাকবে। তোর এই আইডিয়াটা ফলো করলে ইন্সটেন্ড আট্যাক ফ্যাটাক করে মরে যাবে। বাঁচার কোনো চান্সই নাই। এক্কেবারেই নাই।”

তনয়া অবাক হয়ে বললো,

—” কেন? শুভ্রতায় তো বললো সাদাফ ভাইয়া নাকি গম্ভীর টাইপ মানুষ। তাই আমি ভাবলাম গম্ভীরভাবে….”

পুষ্পি নাক ফুলিয়ে হাত জোড় করে বললো,

—” প্লিজ বইন। কিছুক্ষণের জন্য হলেও তোর এই ‘ভাবনা’ নামক সফটওয়্যারটা বন্ধ রাখ। তোর এই সফটওয়্যারটা যে কতোটা ডেঞ্জারাস সে সম্পর্কে তোর কোনো ধারণায় নাই। মানুষ খুন করতে তোর এই বিখ্যাত ভাবনাগুলোই যথেষ্ট। ডাফার!”

তনয়া বাধ্য মেয়ের মতো ভাবনা নামক অপচেষ্টাটা বাদ দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। আবারও নীরব হয়ে গেলো সবাই। শুভ্রতা ফোনটা ডানহাতের তালুতে আঘাত করতে করতে রুমময় পায়চারী করতে লাগলো। পুষ্পি তুমুল গতিতে নখ কামড়াতে লাগলো। অর্পন ঠোঁট উল্টে গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। প্রেমা দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে পায়ের নখ খুঁটতে লাগলো। তনয়া উদাসীন হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। কিন্তু কারো মাথাতেই চমৎকার কোনো কথা এসে ধাক্কা দিলো না। অনবরত কথা ফুটানো মেয়েগুলোর কথার ঝুড়িটা যেন হুট করেই ফাঁকা হয়ে গেল। সহজ ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিলে হয়তো বিষয়গুলো এতোটা ভয়াবহ ভাবনার হয়ে উঠতো না। এতোটা ভাবতেও হতো না। কিন্তু সহজ জিনিসটাকে অযথায় টেনে-হিঁচড়ে কঠিন করায় তা যেন ক্রমেই ভাবনার বাইরে গিয়ে ঠেকলো। বিশ্বাস করতে বাধ্য করতে লাগলো যে, ব্যাপারটা ভয়ানক কঠিন। খুব বেশিই কঠিন। প্রায় আধাঘন্টার মতো চুপচাপ বসে থাকার পর চারদিকে সূর্যের আলো মিঁইয়ে এলো। মাগরিবের আযানটা কানে আসতেই প্রত্যেকে অস্থিরতায় নড়েচড়ে উঠলো। মাগরিবের আজানটা মধ্যবিত্ত মেয়েদের বাড়ি ফেরার এক অলিখিত সতর্ক বার্তা। এই সময়টাতে মধ্যবিত্ত মেয়েদের বাড়ি ফিরতে হয় এটাই নিয়ম। এই নিয়মের বাইরে গেলেই মেয়েদের মন আঁৎকে ওঠে। অচেনা ভয় আর অনিশ্চয়তায় বুকটা কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে। সেই সাথে মনটাকে আচ্ছাদিত করে গাঢ় মন খারাপ। সেই মন খারাপের রেশ ধরেই তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো পুষ্পি। তার দীর্ঘশ্বাসটা যেন নিস্তব্ধ রুমের চারটি দেয়ালে বিরহীনির মতো ঘুরেফিরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। মৃদু গলায় বললো,

—” তুই ফোনটা কর শুভি। সালাম দিয়ে নিজের পরিচয়টা দিবি। তারপর কফির জন্য জিগ্যেস করতে পারিস।”

—” যদি মানা করে দেয়?”

—” দিলে দিলো। কি আর করা?”

অর্পন জ্বলে ওঠে বললো,

—” মানা করবে মানে? মানা করলে ব্যাটাকে বনানী থেকে তুলে আনবো।”

তনয়া বললো,

—” ওমন এক ব্যাটাছেলেকে তুই তুলে আনতে পারবি?”

—” আরে ধুর! আমি কেন আনবো? গুন্ডা ভাড়া করবো। সবাই পাঁচশো করে চাঁদা দিবি বুঝলি?”

তনয়া কপট বিস্ময় নিয়ে বললো,

—” পাঁচশো টাকার চাঁদা দিয়ে গুন্ডা পাওয়া যাবে? তাও আবার আস্ত মানুষ তুলে আনার গুন্ডা?”

প্রেমা বিরক্ত হয়ে বললো,

—” তোরা বড্ড বকিস। এক কথার মধ্যে ফাউ ফাউ হাজার কথা। এই শুভ্রতা? তুই ফোনটা লাগা তো। দরকার হলে কি কি বলবি তা কাগজে লিখে দিই। দিবো?”

শুভ্রতা ঢোক গিলে আবার জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। অনেক সাহস নিয়ে সাদাফের নাম্বারটা ডায়াল করে কানে ধরলো। ফোনটা কানে ধরার সাথে সাথেই বুঝতে পারলো হাতটা কেমন থরথর করে কাঁপছে তার। এটাই কি তবে প্রথম প্রেমের অনুভূতি? বহু যুগ আগে নব্য প্রমে মত্ত তরুনীরা কি প্রথম প্রেমপত্র হাতে তুলে এভাবেই কেঁপে উঠতো? ঠিক শুভ্রতার মতো? হয়তো! আবার হয়তো না। শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফোনের ওপাশের আওয়াজটা সেই দীর্ঘশ্বাসটাকে নেড়ে চেড়ে হাজারও খন্ড করে বাতাসে উড়ালো। নির্দ্বিধায় বলে চললো শুধুমাত্র একটি কথা,

—” আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ…..”

শুভ্রতা যেন আর কিছুই শুনতে পেল না। ফোনটা কেটে আবার ডায়াল করলো। তারপর আবার….একবার, দুবার, অনেকবার!!! ধীরে ধীরে তার স্বচ্ছ চোখদুটোতে জমা হতে লাগলো বিন্দু বিন্দু জল। পুষ্পি শুভ্রতার কাঁধে হাত রাখতেই জলভরা স্নিগ্ধ চোখ তুলে তাকালো শুভ্রতা। ধরা গলায় বললো,

—” ফোনটা বন্ধ দেখাচ্ছে পুষি।”

এতোকিছুর পর এই কথাটা শোনার জন্য কেউই যেন প্রস্তুত ছিলো না। সবার চোখেই দেখা দিলো একঝাঁক হতাশা। এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন রাদিবা আহমেদ। নামাযের হিজাবটা এখনও তার মাথায় জড়ানো। চোখ-মুখ স্নিগ্ধ শীতল। ডানহাতে নীলরঙা তাতের শাড়ি। মেয়েদের বিমর্ষ মুখ দেখে প্রথম দফায় খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন রাদিবা। টেনশনটা সবসময়ই একটু বেশিই তার। ছেলে-মেয়ের বিমর্ষ চেহারা দেখলেই কেন যেন আত্মাটা ছাৎ করে ওঠে তার। মনে হয়, এই বুঝি কিছু ঘটে গেলো। খারাপ কিছু। ভয়ানক খারাপ কিছু। নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে মৃদু হেসে মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন রাদিবা। মাকে দেখে শুভ্রতা অনুভূতিহীন চোখে একবার তাকাল। রাদিবা আহমেদ হাতের শাড়িটা শুভ্রতার দিকে ধরিয়ে দিতেই শুভ্রতা প্রশ্নমাখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মার চোখে,

—” শাড়ি কেন দিচ্ছো মা? এটা তো তোমার।”

রাদিবা আহমেদ মৃদু হেসে বললো,

—” শাড়ি কেন দেয়, বোকা মেয়ে?”

পাশ থেকে অর্পন ফট করেই বলে উঠলো,

—” আন্টি হয়তো শাড়িটা যত্ন করে রাখার জন্য দিয়েছে। যা যা জলদি শাড়িটা আলমারিতে রেখে আয় যা।”

অর্পনের কথায় বিরক্ত হলেন রাদিবা। থমথমে গলায় বললেন,

—” শাড়িটা রেখে দিতে নয়। পড়ার জন্য দিয়েছি।”

—” এই গরমে শাড়ি কেন পড়বো মা? তাও আবার এই সন্ধ্যায়!”

—” এখন পড়ার জন্য দিচ্ছি না। দিচ্ছি তো কালকের জন্য। কাল তোর ভার্সিটি যেতে হবে না। তোর দাদু আসছে। এগারোটা নাগাদ চলে আসবে। ট্রেনে আছেন।”

শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকালো। বিস্ময় নিয়ে বললো,

—” দাদু আসার সাথে শাড়ির কি সম্পর্ক মা? এমন তো নয় দাদু আজ প্রথমবার আসছে। তাহলে হঠাৎ ভার্সিটি মিস দিতে যাবো কেন?”

রাদিবা কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে বললো,

—” কাল তোকে দেখতে আসবে শুভি।”

রাদিবার কথাটা যেন বজ্রপাতের মতো শুনালো। শুভ্রতার পাশ থেকে চার বান্ধবীই একরকম চেঁচিয়ে ওঠে বললো,

—” কিহ??”

রাদিবা কপাল কুঁচকে বললো,

—” কোনো সমস্যা?”

কারো মুখে কথা ফুটলো না। শুভ্রতা বিস্মিত স্বরে বললো,

—“কাল?কি বলছো এসব? তুমি আবারও বাবাকে না বলে…”

শুভ্রতাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন রাদিবা,

—” তোমার বাবা জানে শুভ্রতা। এবং তোমার দাদু এবং ছোট চাচ্চুও জানে। তাই অযথা ঝামেলা করো না। ছেলে দেখতে শুনতে ভালো। তোমারও কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।”

শুভ্রতা শক্ত গলায় বললো,

—” ছেলেটা কে? ওই প্রফেসর?ফারদিন হাসান?”

—” হ্যাঁ।” রাদিবার স্পষ্ট জবাব।

তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। মেয়েরা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দ বার্তা বিনিময় করে একজায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। ব্যাপারটা কোন দিকে গড়াচ্ছে কিছুই যেন বুঝতে পারছে না তারা। এই নীরবতার বহর কাটিয়ে আবারও কথা বললো রাদিবা।

—” অর্পি?”

রাদিবার মুখে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলো অর্পন। থতমত খেয়ে বললো,

—” জ্বি, আন্টি?”

রাদিবা হেসে বললো,

—” তুমি তো খুব ভালো মেকাপ করতে পারো। কাল শুভ্রতাকে সাজানোর ভারটা কিন্তু তোমার। চোখ ধাঁধানো সুন্দর করে সাজাবে কেমন?”

অর্পন মাথাটা হালকা কাত করে সম্মতি জানালো। রাদিবা শুভ্রতার মাথায় হালকা চুমু দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। শুভ্রতা রুদ্ধশ্বাসে বসে রইলো চুপচাপ। অর্পন শুভ্রতার কাঁধে হাত রাখতেই হঠাৎ করেই ফুঁপিয়ে উঠলো শুভ্রতা। বান্ধবীর বুকে মাথা রেখে অবুঝ কিশোরীর মতো ফুঁপিয়ে উঠলো সে। সবাই একে একে শুভ্রতার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। পুষ্পি সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বললো,

—” কাঁদিস না প্লিজ। দেখতে আসলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক হবে।”

শুভ্রতা নাক টেনে টেনে অস্পষ্ট গলায় বললো,

—” তোরা বুঝতে পারছিস না। ফারদিন সাহেবকে মামুর আগে থেকেই পছন্দ। মা তো মামুর কথাতেই নাচে। সেটাও নাহয় ঠিক ছিলো কিন্তু এবার বাবাও রাজি। গ্রাম থেকে দাদু আর ছোট চাচ্চু আসছে মানে ব্যাপারটা সিরিয়াস। ওরা… ওরা যদি কালই কাবিন করতে চায়? আমি কিন্তু একদম মরে যাবো। শেষ করে দিবো নিজেকে। তোরা জাস্ট আমাকে ঘুমের ট্যাবলেট এনে দিস প্লিজ।”

পুষ্পি ধমকে উঠে বললো,

—” কি সব বাজে বকছিস। সব ঠিক হয়ে যাবে। এতো চিন্তা কেন করছিস বল তো? আমরা তো আছি।”

অর্পনও তার মায়াবী চোখজোড়ায় একঝাঁক মায়া ঢেলে বললো,

—“এভাবে কাঁদিস না প্লিজ। দে তো…ফোনটা দে আমি ট্রাই করছি। যদি লেগে যায়।”

—” দু’বার তো পালিয়েছিলি। দরকার হলে এবারও পালাবি। সমস্যা কই? তাই বলে মরার কথা ভাববি?” প্রেমার প্রশ্ন।

শুভ্রতা হেঁচকি তুলে নিয়ে বললো,

—” তখন তো মামুর বাসা থেকে রাগ করে বেরিয়ে এসেছিলাম। সেটাকে কি পালানো বলে? তাছাড়া এবার দাদু আসছে। দাদু আমায় বড্ড ভালোবাসে। দাদু খুবই কনজারভেটিভ রে, আমি উনার উপস্থিতিতে এমনটা করলে একদম সহ্য করতে পারবে না। ”

সবাই নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। কারো মুখে কোনো সান্ত্বনামূলক কথাও আসছে না। কি বলবে, ভেবেই পাচ্ছে না। অর্পন একের পর এক ফোন লাগাচ্ছে সাদাফকে কিন্তু প্রতিবারই ভেসে আসছে নারী কন্ঠি ওই একই ছড়া। ধীরে ধীরে রাত বাড়ে। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে আটটার দিকে বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় সবাই। কান্নারত শুভ্রতাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে না করলেও বা কি করতে পারে তারা? এমনিতেও এতোটা রাত করে ফেরায় যথেষ্ট ঝড়ঝাপটা পোহাতে হবে আজ। ওরা বেরিয়ে যেতেই দরজায় ছিটকানি দিয়ে আবারও বিছানায় উপুর হয়ে শোয় শুভ্রতা। ঘন্টার পর ঘন্টা বিরতিহীন কান্নায় মেতে থাকে সে। সেই সাথে বাড়তে থাকে কললিস্টে ডায়ালের সংখ্যা। কেনো যেন মনে হতে থাকে, সাদাফ ফোনটা ধরলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সব! দুই দিন আগেও যে ছেলের প্রতি বিন্দুমাত্র অনুভূতি ছিলো না তার। আজ হঠাৎ তাকে পাওয়া হবে না ভাবতেই আৎকে উঠেছে শুভ্রতা। কান্নায় বুকটা ভেঙে আসছে। অন্যকারো হতে হবে কথাটা ভাবতেই নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসছে তার। এভাবে কি বাঁচা যায়?

নিচ থেকে সিএনজির বিকট হর্ণে ভাবনা কাটিয়ে নিচের দিকে তাকালো শুভ্রতা। দাদু এসে গেছেন। গায়ে সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামা, সাদা লম্বা দাঁড়ি আর টুপি মাথায় গম্ভীর একজন বৃদ্ধ। চোখ-মুখে সম্ভ্রান্তভাবটা স্পষ্ট। বয়সটা আশির কোঠা পেরুলেও শক্ত-পোক্ত রসালো শরীরটা এখনও বেশ আকর্ষনীয়। গ্রামের হাইস্কুলের এককালীন হ্যাড মাস্টার ছিলেন তিনি। স্কুল থেকে রিটায়ার নিয়ে টানা দশ বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার গুরুগম্ভীর চালচলন, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং হাজী পদবির জন্য গ্রামের সবাই বেশ সমীহ করে চলে তাকে। তিনছেলেও তার বাধ্যগত সন্তান। সবার প্রতি শক্ত হলেও শুভ্রতার প্রতি বড় দুর্বল তিনি। ছোট ছেলেটা হওয়ার সময়ই তার স্ত্রী সম্পা পৃথিবী ছাড়ে। সেই মৃত স্ত্রীকে এখনও সময় করে ভাবে আনিমুল হক। শুভ্রতার মুখটাতে মাঝে মাঝেই অল্প বয়সা স্ত্রীর ছায়া খুঁজে পান আনিমুল হক। তাই হয়তো দুর্বল হয়ে পড়েন বার বার!

#চলবে…..

( কারেন্ট নেই কাল থেকে। লেখা থাকা সত্ত্বেও ফোনের চার্জ আর ওয়াইফাই জনিত সমস্যার কারণে পোষ্ট করা সম্ভব হয় নি।

দয়া করে কেউ স্টিকার কমেন্ট করবেন না। ব্যাপারটা বিরক্তিকর। আর আপনার ‘next’ ওয়ার্ডটা না লিখলেও আমি নেক্সট পার্ট অবশ্যই দিবো। তাই প্লিজ, এই ওয়ার্ডটাও এড়িয়ে চলুন। ধন্যবাদ সকলকে। ভালোবাসা অবিরাম❤❤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here