আরশিযুগল প্রেম পর্ব — ৩৬

আরশিযুগল প্রেম পর্ব — ৩৬
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা

ঘড়িতে নয়টা বাজে। কিছুক্ষণ আগেই বাসায় ফিরেছে শুভ্রতা। রাইসুর সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। চোখে-মুখে স্পষ্ট অস্বস্তি। ভাগ্নীর এমন বেপরোয়া চলাফেরা কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না তার। সকালের ব্যাপারটাতেও ভীষণ রকম বিরক্ত তিনি। শুভ্রতাকে কড়া কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছে তার। মাঝে মাঝে ঠাডিয়ে চড় বসাতেও ইচ্ছে করছে। এতবড় মেয়ের গালে চড় বসানো যায় না। তাছাড়া, দু’দিনের জন্য বেড়াতে আসা ভাগ্নীকে কড়া কথা বলাটাও ভালো দেখায় না। কথায় আছে, ‘মামার বাড়ি রসের হাঁড়ি’। শুধুমাত্র শুভ্রতার বেপরোয়া চলাফেরার জন্য এই প্রবাদ বাক্যটাকে মিথ্যে করে দেওয়া চলে না। রাইসুর রহমান অসন্তুষ্ট চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হালকা কাশলেন। ভারী গলায় বললেন,

—-” সন্ধ্যার পর মেয়েদের বাইরে থাকা মানায় না শুভি মা। তাছাড়া, শহরটা তোমার অচেনা। সেই সকালে বেরিয়ে এতক্ষণে ফিরলে অথচ কোথায় গিয়েছ সেটাও বলে যাও নি। কাজটা কি খুব ভালো হয়েছে?”

শুভ্রতা মামুর সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। অপরাধী দৃষ্টিতে একবার মামুর দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। ড্রয়িংরুমের এক কোণায় রাখা জলচৌকিতে বসে পুতুল খেলছে রুম্পি। সাধারণ বাচ্চারা এই সময়ে পুতুল খেলে না, বইয়ে মুখ গুঁজে পড়া মুখস্থ করে। কিন্তু রুম্পি খেলছে। প্রায় প্রতিদিনই খেলে। রাইসুর সাহেব কিছু বলেন না। হালকা ধমকও দেন না। তার ব্যবহার দেখে মনে হয়, রুম্পি যে দয়া করে এ পর্যন্ত বেঁচে আছে তাতেই তিনি কৃতজ্ঞ। পড়ালেখা করা খুব একটা জরুরি কোন ব্যাপার নয়, ওটা অপশনাল। শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিনমিন করে বলল,

—-” সরি মামু। এত দেরি হয়ে যাবে বুঝতে পারি নি। আসলে, ফ্রেন্ডের বাসায় গিয়েছিলাম। তারপর…”

শুভ্রতার কথার মাঝেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন রাইসুর সাহেব,

—-” তোমার ফ্রেন্ডের বাসা কোথায়, শুভি মা?”

শুভ্রতা হঠাৎ করেই কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে মৃদু গলায় বলল,

—” জিইসি মোড়। জিইসি মোড়ের ওখানেই ওদের বাসা।”

রাইসুর সাহেব থমথমে গলায় বললেন,

—-” এখান থেকে জিইসি মোড় যেতে আসতে রাত নেমে এলো? অদ্ভুত!”

শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে বলল,

—-” বিষয়টা তেমন নয়। আসলে, জিইসি মোড় যাওয়ার পর হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলাম বাটালি হিল যাব। ওটা যে চট্টগ্রামের একটা দূর্দান্ত জায়গা তা তো আপনি জানেনই মামু। এই বর্ষায় বাটালি হিল থেকে পুরো চট্টগ্রামটাকে দেখার লোভটা সামলাতে পারি নি। এদিকে আন্টিও ছাড়ছিলেন না। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বাটালি হিলের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে দিতে দু’টো বেজে গেল। সব মিলিয়ে এত রাত।”

রাইসুর সাহেব কিছুক্ষণ গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। কোন কথা বললেন না। শুভ্রতা ভেতরে ভেতরে হাঁসফাঁস করছে। অকপটে এত এত মিথ্যে কথা এর আগে খুব কমই বলেছে সে। মূলত সাদাফের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই মিথ্যে নামক বাতিক হয়েছে তার। রাইসুর সাহেবের তীক্ষ্ণ চাহনিতে চুরের মত গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শুভ্রতা। মনে মনে একশো একবার আয়তুল কুরসি পড়ছে সে। রাইসুর সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন,

—-” রাতের বেলা মেয়েদের বাইরে ঘুরাঘুরি একদমই পছন্দ নয় আমার। তাছাড়া, তুমি যে ফ্যামিলি থেকে বিলং কর সেখানে এমন বেপরোয়া চলাফেরা কখনোই মেনে নেওয়ার কথা নয়। বেড়াতে এসেছ, বেড়াবে। সমস্যা নেই। কিন্তু এভাবে একা ঘুরে বেড়ানোটা সেইভ নয়। কাল থেকে ফারদিনকে সাথে নিবে। সে নাহয় গাইড করবে তোমায়। এখন রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।”

শুভ্রতা ফারদিনের নামটা শুনেই ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কিন্তু মামুকে কিছু বলার সাহস পেল না। এমনিতেই এতো রাত করে বাড়ি ফিরেছে বিষয়টা মায়ের কানে পৌঁছালে কেলেংকারী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। শুভ্রতা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। নিজের রুমে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে দিতেই সাদাফের ফোন এলো।

—-” বাসায় ঝামেলা হয়েছে?”

শুভ্রতা ক্লান্ত গলায় বলল,

—-” একটু৷ আমি ম্যানেজ করে নিয়েছি।”

—-” সরি শুভ্রা। তোমাকে আরো আগে পৌঁছে দেওয়া উচিত ছিল আমার।”

—-” বাদ দাও তো। আচ্ছা? ঢাকা কবে ফিরছ?”

—-” পরশু রাতের ট্রেনে। তুমি কি আমার সাথেই ফিরবে? নাকি থাকবে?”

শুভ্রতা মৃদু গলায় বলল,

—-” তুমি না থাকলে আমি এখানে থেকে কি করব? আমি পারলে তো কালই চলে যাই। এই ফারদিন নামক আপদটা একদম ভালো লাগছে না আমার।”

সাদাফ ভ্রু কুঁচকে বলল,

—-” ফারদিন কে?”

—-” মামুর বন্ধুর ছেলে। মামু তাকে আমার গাইড নিযুক্ত করতে চাইছেন কাল। ওমন হলে তোমার সাথে দেখা করা সম্ভব হবে না। আমরা কাল রাতে ফিরে গেলেই বেশি ভালো হত।”

—-” তবে, কাল তুমি বেরুচ্ছ না? আমি আরো ভাবলাম কাল তোমায় নিয়ে সারা শহর ঘুরব আর চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাবার খাওয়াব।”

—-” বলে বলে লোভ দেখাবে না একদম। পরে আফসোস হবে আমার।”

সাদাফ হেসে বলল,

—-” আফসোস হওয়াটাই স্বাভাবিক। শুঁটকি , মধুভাত, বেলা বিস্কুট, বাকরখানি, লক্ষিশাক,গরুর গোস্ত ভুনা, পেলন ডাল, কালাভুনা, বিরিয়ানি, মেজবানি মাংস, আফলাতুন হালুয়া, তাল পিঠা, নোনা ইলিশ সবকিছুই দারুণ টেস্ট।”

শুভ্রতা মুখ ফুলিয়ে বলল,

—-” তুমি বেশি বেশি বলছ।”

সাদাফ নিঃশব্দে হাসল। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ থাকার পর বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুভ্রতা। হালকা গলায় বলল,

—-” তোমার বাসায় আমায় নিয়ে কোনো আলোচনা হয় নি?”

সাদাফ বিরস মুখে বলল,

—-” কি আলোচনা হবে?”

—-” কার কেমন লাগল এসব?”

—-” না তেমন কিছু তো কেউ বলে নি। এটলিস্ট আমার সামনে বলে নি। মা শুধু বললেন, মেয়েটা ভীষণ নরম মনের। আর পৃথা তো তুমি বলতে অজ্ঞান। বড় ভাবি, মেজো ভাইয়া, বড় ভাইয়া, বাবা কারো সাথে তো তোমার তেমন দেখা সাক্ষাৎই হয় নি। তোমাকে আজ বাসায় আনাটা ঠিক হয় নি। আরও কিছুদিন পর আনলে ভালো হত। তাহলে আত্মীয় স্বজনের চাপটা থাকত না। সবার সাথে ফ্রীলি দেখা-সাক্ষাৎ হত।”

শুভ্রতা বিরক্ত মুখে ফোনটা একবার চোখের সামনে ধরল। তারপর বিরস মুখে বলল,

—-” অর্পন কল দিয়ে জ্বালাচ্ছে। তোমায় পরে কল করছি।”

সাদাফ ছোট্ট করে উত্তর দিল,

—-” আচ্ছা।”

সাদাফের ফোন কেটে অর্পনের ফোন রিসিভ করতেই একে একে কথা বলে উঠল চারজন। শুভ্রতা বিস্ময় নিয়ে বলল,

—-” তোরা সব!”

অর্পন দাঁত কেলিয়ে বলল,

—-” কনফারেন্সে আছি সবাই। এবার বল, ভাইয়ার সাথে হানিমুন কেমন চলে?”

শুভ্রতা ধমকে উঠে বলল,

—-” কিসের হানিমুন? উল্টাপাল্টা কথা বলবি না একদম। আমি মামুর বাসায় আছি।”

—-“বুঝি বুঝি সবই বুঝি। নেক্সট মান্থে যে খালামনি হয়ে যাচ্ছি সেটাও বেশ বুঝতে পারছি।”

শুভ্রতা জ্বলে উঠে বলল,

—-” তোরে সামনে পাইলে খুন করতাম গপ্পন। যতসব থার্ডক্লাস আলাপ।”

পুষ্পি সমঝোতার ভাব করে বলল,

—-” আচ্ছা, ওসব বাদ দে। তুই বরং এটা বল….কেমন কাটল সব? ট্রেন টু শ্বশুর বাড়ি? আমাদের সাথে একটু শেয়ার করতেই পারিস। আমাদের তো একটু অভিজ্ঞতা দরকার নাকি? ট্রেনের কেভিনে কত টাইপের প্রেম হতে পারে সে সম্পর্কে ছোটো-খাটো ধারণা কিন্তু তুই দিতেই পারিস।”

ট্রেনের কেভিনের কথা বলতেই লালটে লাজুকলতা ছুঁয়ে গেল শুভ্রতার সারা অঙ্গ জুড়ে। অর্পন-পুষ্পিদের এটা ওটা বলে ফোন কেটে বালিশে মুখ ঢেকে পড়ে রইল সে। হাত বাড়িয়ে রুমের লাইটটা নিভিয়ে দিতেই রোমাঞ্চিত অতীতগুলো ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে সামনে আসতে লাগল একের পর এক।

সেদিন রাতে অযথাই লজ্জায় কুঁকড়ে উঠছিল শুভ্রতা। সাদাফের স্বাভাবিক কথাবার্তাগুলোতেই কেন যেন কেঁপে উঠছিল সে। সাদাফ স্বাভাবিক আলোচনার মাঝপথেই দ্বিধাময় গলায় বলল,

—-” কোনোভাবে তুমি কি আমায় ভয় পাচ্ছো শুভ্রা? মানে, আমার সাথে সেইভ ফিল করছ না এমন কিছু?”

সাদাফের কথায় একপলকের জন্য চোখ তুলে তাকিয়েছিল শুভ্রতা। সাদাফের গাঢ় দৃষ্টির সামনে চোখ রাখতে না পেরে মুহূর্তেই জানালার বাইরে তাকিয়ে ঘাড় নাড়িয়েছিল। যার অর্থ, সে ভয় পাচ্ছে না।

—-” তারমানে শুভ্রাণী লজ্জার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তুমি যতটা লজ্জা পাচ্ছো, মেয়েরা নতুন নতুন বিয়ের পর ততটা লজ্জা পায় কিনা সন্দেহ শুভ্রা। নির্ঘাত মনে মনে আমায় নিয়ে গভীর কিছু ভাবছ তুমি।”

সাদাফের এমন কথায় ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শুভ্রতা। সাদাফের ঠোঁটের কোণায় হাসি দেখেই অস্থির চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল সে। চোখে-মুখে রাগ আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হল তাকে। মনে মনে রাগ লাগলেও রাগটা প্রকাশ করতে পারছে না সে। শুভ্রতা নিজের প্রতিই বিরক্ত বোধ করল। মুখ ফুলিয়ে বলল,

—-” আমি তোমার মত অসভ্য নই। এমন কিছুই ভাবছিলাম না আমি।”

সাদাফ হেসে শুভ্রতার পাশে গিয়ে বসতেই চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এল শুভ্রতার। এই ছোট্ট কেবিনে সাদাফ আর সে ভাবতেই ভেতরটা অদ্ভুত উত্তেজনায় কেঁপে উঠল। সাদাফ ঠোঁট টিপে হেসে বলল,

—-” আমার পাশে আজ প্রথম বসছ তা তো নয়। এর আগেও অসংখ্যবার বসেছ। ইভেন বেশ কয়েকবার কোলেও উঠেছ। তাহলে আজ এত কাঁপা-কাঁপি কেন? বিষয়টা কি সন্দেহের নয়?”

শুভ্রতা শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা গলায় বলল,

—-” সরে বসো প্লিজ।”

সাদাফ হেসে ফেলল। হুট করেই শুভ্রতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল সে। শুভ্রতা চমকে সাদাফের মুখের দিকে তাকাল। সাদাফ মিষ্টি হেসে দু’হাতে শুভ্রতার কোমর জড়িয়ে ধরল। শুভ্রতার আঁচল সরে বেরিয়ে থাকা ফর্সা উদরে ওষ্ঠজোড়া চেপে ধরেই মৃদু গলায় বলে উঠল সাদাফ,

—-” অফিস থেকে সোজা এখানে এসেছি। প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। একটু স্বামী সেবা করো শুভ্রাণী।”

সাদাফের স্পর্শে থরথর করে কাঁপছে শুভ্রতা। পা’দুটো ঝিমঝিম করছে তার। হাত-পায়ের অবশিষ্ট বলটুকুও নিঃশেষ হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। শুভ্রতা দুর্বল হাতেই সাদাফের চুল খামচে ওকে সরানোর চেষ্টা করে বলল,

—-” প্লিজ সরো।”

—-” উহু। কেন?”

—-” আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। মরে যাচ্ছি আমি।”

সাদাফ মৃদু গলায় বলল,

—-” মরে গেলে আবারও জাগিয়ে তুলব। কিন্তু, ছাড়তে পারব না।”

সাদাফের কথার ভাজে ভাজে তার ওষ্ঠদ্বয়ের আন্দোলনে শুভ্রতার কম্পন যেন বাড়তে লাগল। উন্মুক্ত উদরে কোনো পুরুষের প্রথম স্পর্শে পৃথিবীটা যেন দুলতে লাগল৷ শ্বাসটাও কেমন আটকে আসতে লাগল৷ অদ্ভুত এক শিহরণে সাদাফের এক গোছা চুল খামচে ধরে সিটে গা এলিয়ে দিল সে। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। ছোট ছোট বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আরও একদফা অনুভূতি মিশ্রিত করছে চারপাশ।

—-” শুভিদি? শুভিদি?”

রুম্পির ডাকে ভাবনার জগৎ ছিঁড়ে সটান ওঠে বসল শুভ্রতা। হঠাৎ করেই খেয়াল করল শরীরটা হালকা মৃদু কাঁপছে তার। সেইদিনের সেই অনুভূতিগুলোই ঘিরে রেখেছে চারপাশ….

#চলবে….

[ আমি যেদিন ভাবি গল্প দিব। সেদিনই পৃথিবীর সব ঝামেলা এসে প্রেজেন্ট দিয়ে যায়। ঝামেলারা বেধহয় আমায় ভীষণ পছন্দ করে😑]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here