আরশিযুগল প্রেম পর্ব — ৪২

আরশিযুগল প্রেম পর্ব — ৪২
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা

আনিমুল সাহেব খুশি খুশি চোখে তাকিয়ে আছেন। শুভ্রতা মিষ্টি গলায় হাদিসের বই পড়ে শুনাচ্ছে। শুভ্রতার মনোযোগী কন্ঠস্বরের মাঝেই উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠলেন আনিমুল হক,

—-” তোমার দাদীকে যখন বিয়ে করে এনেছিলাম তখন তার বয়স ছিল আঠারো। ছোট-খাটো গোলগাল মুখটা ছিল রূপকথার পরীদের মতো। তোমার মুখটাও অবিকল তোমার দাদীর মতো। সে যদি বেঁচে থাকত তাহলে নিশ্চয় অবাক হত। তোমাকে দেখেই বিস্ময়ে বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকত। সেই চোখদুটো যে কত মায়াময় ছিল দিদিভাই!”

এটুকু বলেই থামলেন আনিমুল হক। ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে উদাসী হয়ে বসে রইলেন। শুভ্রতা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে চুপচাপ বসে রইলো। দাদুকে এসব বিষয় নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে কখনই দেখে নি শুভ্রতা। তারওপর দাদুর এই প্রশস্ত হাসি! শুভ্রতা চোখ পিটপিট করে তাকাল। দুষ্টামি ভরা গলায় বলল,

—-” আজ তোমাকে ভীষণ খুশি খুশি লাগছে দাদু। দাদীর কথা খুব মনে পড়ছে বুঝি?”

আনিমুল সাহেব হেসে বললেন,

—-” প্রতিদিনই মনে পড়ে। তবে আজকে শম্পার বেফাঁস কথাবার্তাগুলোই মাথায় আসছে বার বার। তোমার দাদী একটু বোকা ধরনের ছিল বুঝলে? কথায় কথায় রাগ করত। কিছুক্ষণ মুখ ফুলিয়ে বসে থাকার পর যদি জিগ্যেস করা হত, ‘শম্পা? রেগে আছ কেন?’ তাহলেই সবকিছু গুলিয়ে ফেলে উলোটপালোট উদ্ভট কথা বলত। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে আশ্চর্য নারী ছিল সে। ভালোবাসাময় নারী।”

আনিমুল সাহেবের এই সহজ স্বীকারোক্তিতে অবাক হলেও বেশ মজা পেল শুভ্রতা। আনিমুল সাহেব খুশি খুশি গলায় বললেন,

—-” তুমিও অনেকটা তোমার দাদীর মতোই হয়েছ দিদিভাই। তোমাকে পাওয়ার পর নাতজামাইয়ের মধ্যে আমার মতই উচ্ছ্বাস আসে কিনা তাই দেখতে চাই আমি। নিজের যৌবনের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাওয়াটাও কিন্তু বিশাল বিষয় দিদিভাই।”

শুভ্রতা হাসল। আনিমুল হক থেমে দম নিলেন। আশা ভরা দৃষ্টিতে তাকালেন,

—-” এবার বিয়ে করবে তো দিদিভাই? বিশাল আয়োজন করে রাজপুত্রের হাতে তুলে দেব তোমায়। তোমার দাদীরও ঝাঁকঝমক বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল। তখন সদ্য স্কুলের চাকরীতে ঢুকেছি। প্রতিমাসে ষাটটাকা স্কেলে বেতন জুটে। ওই অল্পতে কি আর ধুমধাম বিয়ে চলে? আল্লাহর রহমতে এখন আর সে ঝামেলা নেই। এবার মনের খোরাক মিটিয়ে আয়োজন করব, দেখো।”

শুভ্রতা দুরুদুরু বুক নিয়ে প্রশ্ন করল,

—-” দাদু? আমি যদি তোমার কাছে অন্যায় কিছু চাই তুমি দেবে? আমার জীবনের শেষ চাওয়া হিসেবে যদি চাই? দেবে?”

আনিমুল সাহেব কপাল কুঁচকে তাকালেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন,

—-” তোমার কি চাই দিদিভাই?”

শুভ্রতার গলা শুকিয়ে এলো। সাদাফের কথাটা বলার সাহস যোগাতে লাগল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিনমিন করে বলল,

—-” আমি আমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে চাই দাদু।”

কথাটা বলে চোখ তুলে আনিমুল সাহেবের মুখের দিকে তাকানোর সাহস যোগাতে পারল না শুভ্রতা। আনিমুল সাহেব থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসতে লাগল তার। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর চোখ তুলে তাকাল শুভ্রতা। আনিমুল সাহেবের কুঁচকানো কপাল দেখে ঢোক গিলল। ধীর গলায় ডাকল,

—-” দাদু?”

আনিমুল সাহেব শান্ত গলায় বললেন,

—-” তুমি কাউকে পছন্দ করো?”

শুভ্রতা মাথা নাড়ল। আনিমুল সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন,

—-” এই কথা আগে কোনো বলো নি দিদিভাই? তোমার মাকে বলতে পারতে।”

শুভ্রতা অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল।

—-” মা যখন জিগ্যেস করেছিল তখন ছিল না। তারপর….. প্লিজ দাদু। আমি জানি এটা অন্যায় আবদার কিন্তু এই আবদারটা পূরণ না হলে আমি কখনই সুখী হতে পারব না। আর আমি সুখী হতে চাই। তুমিও কি আমায় বুঝবে না দাদু?”

আনিমুল সাহেব প্রথমেই কোনো উত্তর দিলেন না। দীর্ঘক্ষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে রইলেন। শুভ্রতার কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলেন। ডানহাতটা এগিয়ে শুভ্রতার মাথায় হাত বুলালেন। হাসার চেষ্টা করে বললেন,

—-” আমি ভাবব এই বিষয়ে।”

দাদুর এটুকু কথাতেই খুশি হয়ে গেল শুভ্রতা। আনিমুল সাহেব দুর্বল গলায় বললেন,

—-” তুমি ঘুমাও গিয়ে দিদিভাই। মনটা বড্ড অস্থির লাগছে। কিছুক্ষণ আল্লাহকে ডাকব। যাও… ঘুমাতে যাও।”

শুভ্রতা খুশি মনে উঠে যেতেই পেছন থেকে ডেকে উঠলেন আনিমুল হক,

—-” দিদিভাই?”

শুভ্রতা ফিরে তাকাল,

—-“জ্বি?”

—-” তুমি পায়েস রাঁধতে পারো? তোমার দাদী ভীষণ ভালো করত পায়েস।”

শুভ্রতা মাথা হেলিয়ে বলল,

—-” পারি দাদু।”

—-” কাল বানিও। হঠাৎ পায়েস খেতে ইচ্ছে করছে। যাও ঘুমাতে যাও।”

শুভ্রতা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। ধীর পায়ে দাদুর রুম থেকে বেরিয়ে এসেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ল সে। দাদু রাজি হয়ে গিয়েছে ভাবতেই সারা শরীরময় শিহরিণ বয়ে গেল। সবকিছু এতো সহজে হয়ে যাবে কল্পনায় করতে পারে নি শুভ্রতা। শুভ্রতা নিজের খুশিটা চেপে রাখতে না পেরে সাদাফকে কল লাগাল। দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় ফোনটা রিসিভ হতেই উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে গেয়ে উঠল শুভ্রতা,

—-” কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে,
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দু’টি চোখে।।
আমি যে মাতাল হাওয়ারই মত হয়ে
যেতে যতে পায়ে পায়ে গেছি জড়িয়ে।।
কি করি, ভেবে যে মরি, বলবে কি লোকে?
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দু’টি চোখে
কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দু’টি চোখে।

এই মুহুর্তে প্রচন্ড খুশি লাগছে আমার। ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে গিয়ে তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি।”

—-” তাই নাকি? খুবই ভালো কথা। কিন্তু শুধু ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলেই চলবে? আমাকেও তো একটু আধটু ধরতে পারো নাকি?”

শুভ্রতা চমকে উঠল। বিস্ময়ে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল তার। লজ্জায় চোখ দুটোকে কুঁচকে বন্ধ করে ফেলল সে। ফর্সা মুখটাতে রক্তিম আভা ফুটিয়ে তুলে হেসে ফেলল সে। আদুরে গলায় শাসিয়ে উঠল,

—-” এই পিচ্চি মেয়ে? এতো শয়তান হয়েছ কেন তুমি? খুব পেকেছ না? তোমার ভাইয়াকে বলছি দাঁড়াও, এই মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে শান্তি নেই।”

পৃথা অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-” বাহ রে! আমি শয়তানীর কি করলাম? আমি তো জাস্ট আদর চাইলাম। ভাইয়াকে জড়িয়ে, ঝাপটে ধরে আদর করছ। আর ছোট্ট আমি আদর চাইলেই দোষ?”

শুভ্রতা লজ্জায় ডানহাতে মুখ চেপে ধরল। পৃথা মেয়েটা যে কি ভীষণ লাঘাম ছাড়া! ভাই-বোন দুটো একদম একরকম, লাগামহীন কথাবার্তায় দু’জনেরই জুড়ি মেলা ভার। শুভ্রতা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে, নিজের লজ্জা নিয়ন্ত্রণ করে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। মৃদু গলায় বলল,

—-” হয়েছে, বুঝতে পেরেছি। খুব জলদিই তোমায় আদর দেওয়ার মানুষ খুঁজে বের করছি দাঁড়াও। এখন বল, তোমার ভাইয়া কোথায়?”

—-” সত্যিই? আমি পারলে দশপায়ে দাঁড়িয়ে থাকি ভাবি কিন্তু তা যেহেতু সম্ভব নয় তাই দুই পায়েই দাঁড়িয়ে রইলাম। জলদি খুঁজো তো। চারপাশে সবার এতো আদর আদর ভাব দেখে আমার আর মরা কাঠের মতো বসে থাকা চলছে না। প্রচুর ফাস্ট হতে হবে, বুঝলে?”

—-” ইশ! এই মেয়েটা এতো নির্লজ্জ কেন?”

—-” আপনি এতো লজ্জাশীল তাই।”

সাদাফের কন্ঠে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটলো শুভ্রতার। কিছু বলার আগেই পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠল পৃথা,

—-” ছোট ভাবি? হেব্বি হ্যান্ডসাম খুঁজবে কিন্তু নয়ত জমবে না…..”

পৃথার কথায় হেসে ফেলল শুভ্রতা। সাদাফ ধমকে উঠে বলল,

—-” এই বেয়াদব! এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছিস তুই? যা বলছি। দিন দিন শেইমলেস হচ্ছিস।”

—-” আর তুমি দিন দিন প্রেমিক পুরুষ হচ্ছ….আহা প্রেম!”

—-” এই ফাজিল! দাঁড়া তুই।”

ভাই-বোনের খুনশুটিতে খিলখিল করে হেসে উঠল শুভ্রতা। সাদাফ গম্ভীর গলায় বলল,

—-” একদম হাসবে না। ও যে মারাত্মক বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে খেয়াল করেছ? আমি যে ওর বড় ভাই তা যেন তার খেয়ালই থাকে না আজকাল।”

—-” বড় ভাইয়ের সাথে একটু আধটু ফাজলামো চলে। আমার আর ভাইয়ার তো লেগেই থাকে।”

—-” তোমার সাথে ওর তুলনা? তোমাদের বয়সের ডিফারেন্স মাত্র ৪ বছর। আর ও আমার থেকে ১১/১২ বছরের ছোট।”

—-” আচ্ছা বাদ দাও। একটা দারুণ খবর আছে।”

—-” কি খবর?”

শুভ্রতা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,

—-” আমি দাদুকে তোমার কথা বলেছি এবং দাদু অলমোস্ট রাজি হয়ে গিয়েছে। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। আমাদের বাসায় দাদুর কথার বাইরে কিচ্ছু হয় না। দাদু রাজি মানে সব রাজি….”

সাদাফ-শুভ্রতার প্রেমময় আলাপে কখন যে রাতটা কেটে গিয়ে ফজরের আযান পড়ল সেদিকে খেয়ালই হল না তাদের। আযানের শব্দে ফোন রেখে ঘুমোতে গেল দু’জনেই। ঘুমের মাঝেও অদ্ভুত সুন্দর কিছু স্বপ্ন দেখল শুভ্রতা। অনেকদিন পর দীর্ঘ চমৎকার একটি ঘুম হলো তার। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে প্রায় নয়টা বাজল। ঘুম ভাঙতেই দাদুর বলা পায়েসের কথা মনে পড়ল শুভ্রতার। কোনোরকম মুখ-হাত ধুয়ে রান্নাঘরে দৌঁড় লাগাল শুভ্রতা। রাদিবা তখন টেবিল গুছাচ্ছেন। মেয়েকে এভাবে দৌঁড়াতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। সন্দেহী গলায় বললেন,

—-” পাগলের মত দৌঁড়ঝাপ পাড়ছিস কেন?”

শুভ্রতা খোলা চুলগুলোকে হাত খোঁপা করতে করতে বলল,

—-” দাদু রাতে পায়েস রাঁধতে বলেছিল। আর আমি মরার মত ঘুমুচ্ছিলাম। দাদু কোথায় মা? সকালের নাস্তা করে নিয়েছেন?”

রাদিবা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মন দিলেন। টেবিল মুছতে মুছতে বললেন,

—-” বাবা ঘুমাচ্ছেন। কাল অতো জার্নি করে এলেন তাই আর ডাকি নি। দুধটা চুলোয় দিয়ে দাদুকে ডেকে তোল যা।”

শুভ্রতা দুধ চুলোয় দিতে দিতে বিস্মিত গলায় বলল,

—-” এখনও ওঠে নি? অদ্ভুত।”

এটুকু বলে কপাল কুঁচকাল শুভ্রতা। মুহূর্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,

—-” স্বপ্নে দাদির সাথে যৌবনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হয়ত,তাই আর ঘুম ভেঙে উঠতে ইচ্ছে করছে না।”

রাদিবা গরম চোখে তাকালেন। শক্ত গলায় বললেন,

—-” দাদুকে নিয়ে এসব কেমন মজা?”

—-” দাদুকে নিয়ে এসব দাদুটাইপ মজা। তুমি ওসব বুঝবে না মা। ওটা আমার আর দাদুর সিক্রেট চেম্বার।”

রাদিবা সরু চোখে তাকালেন। বললেন,

—-” সিক্রেট আলাপ শেষ হলে এবার দাদুকে ডেকে তোল যা। অনেক বেলা হয়েছে…।”

শুভ্রতা খুশি মনে আনিমুল হকের ঘরের দিকে পা বাড়াল। আনিমুল সাহেব নিশ্চিন্ত চিত্তে ঘুমাচ্ছেন। পশ্চিমের জানালা দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়ছে তাঁর মুখে। সাদা দাঁড়ি-চুলে আনিমুল সাহেবকে ভীষণ নিষ্পাপ লাগছে। ঘুমন্ত চোখে-মুখে উদ্বেগহীন চাপা খুশি। শুভ্রতা নরম গলায় ডাকল,

—-” দাদু?দাদু? নয়টা বেজে গেছে, নাস্তা করবে না?”

আনিমুল সাহেব সাড়া দিলেন না। শুভ্রতা বার কয়েক ডেকে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শফিক আর শাহিনুজ্জামান সাহেব নাস্তা করছিলেন। শুভ্রতাকে বের হতে দেখেই বললেন,

—-” শুভি? বাবা ওঠেছে?”

শুভ্রতা খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে বলল,

—-” না।”

রাদিবার চিল্লাপাল্লায় মাত্রই রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে শুভ্রব। চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। শাহিনুজ্জামান ছেলের এহেন দশা দেখে কপাল কুঁচকে তাকালেন। অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,

—-” কি ব্যাপার? চেহারার এমন বেহাল দশা বানিয়েছ কেন? নেশা-টেশা করো নাকি আজকাল? চোখ লাল কেন?”

শুভ্রব চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,

—-” চোখ লাল থাকলেই যে নেশা করি এটা কোন ভালো যুক্তি হতে পারে না, বাবা। রাত জেগেছি বলে চোখ লাল। বিশেষ কিছু নয়।”

শাহিনুজ্জামান ছেলের উত্তরে খুশি হতে পারলেন না। বিরক্ত গলায় কিছু বলবেন তার আগেই কথা বলে উঠলেন শফিক,

—-” সেকি? বাবা এখনও ওঠে নি? জ্বর টর উঠল না তো আবার?”

শুভ্রতা ফলের ঝুড়ি থেকে একটা কলা ছিঁড়ে নিয়ে শফিকের দিকে তাকাল। অসম্মতি জানিয়ে বলল,

—-” না। জ্বর তো আসে নি দেখলাম। শরীর ঠান্ডা। ঠান্ডা লাগছে ভেবে, গায়ে চাঁদর টেনে দিয়ে এসেছি।”

শাহিনুজ্জামান হঠাৎই থমকে গেলেন। মেয়ের দিকে দু’দন্ড তাকিয়ে থেকে কিছু একটা ভাবলেন। কয়েক সেকেন্ড পর, খাবারের থালটা ঠেলে দিয়ে বাবার রুমের দিকে ছুটলেন। শাহিনুজ্জামানের এহেন কাজে প্রথম দফায় সবাই অবাক হলেও ব্যাপারটা ধাতস্থ হতেই চমকে উঠল।

সবাই আনিমুল সাহেবের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে উদ্বেগ। শাহিনুজ্জামান সাহেব বাবার মাথার কাছে বসে আছেন। শফিক তাঁর নাড়ি পরীক্ষা করছেন। নাড়ি পরীক্ষা শেষ করে মুখ তুলে তাকালেন শফিক। থমথমে গলায় বললেন,

—-” শুভ্রব? নিচের তলার ডাক্তারকে কল করেছিস? আসছেন?”

শুভ্রব উত্তর দেওয়ার আগেই ডাক্তারের আগমন ঘটল। মাথায় বিশাল টাকের অধিকারী মধ্যবয়স্ক একটি লোক। মুখটা সবসময়ই হাসি হাসি। ঘন্টায় অন্তত দশ-বারোবার মিশ্রণ টাকে হাত বুলানো তার অভ্যাস। তার চোখ- মুখ দেখে মনে হয় মাথার টাক নিয়ে তিনি ভীষণ সন্তুষ্ট। লোকটি নিচ তলার ফ্ল্যাটে মাস দুয়েক আগেই উঠেছে। শুভ্রতাকে মামুনি বলে ডাকে। ডাক্তার সাহেব আনিমুল হকের নাড়ি দেখে খুশি হতে পারলেন না। সবসময় লেগে থাকা হাসিটা হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে গেল। মলিন মুখে বললেন,

—-” উনি বেঁচে নেই।”

ডাক্তার সাহেবের এই ছোট্ট কথাটা বজ্রপাতের মত শুনাল। কারো মুখে কোনো কথা ফুটলো না। শুভ্রতা অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ডাক্তার সাহেবের কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে। শুভ্রতা এর আগে কখনও মৃত্যু দেখে নি। মৃত্যুর রূপ তার অচেনা। আচ্ছা? মৃত্যু কি এতটাই সহজ? এতটাই শীতল? এতটা আকস্মিক আর নির্বাক? কাল রাতেও যে মানুষটা হেসে কথা বলছিল সে মানুষটা একটা রাতের ব্যবধানেই নেই? এটা আদৌ সম্ভব? শুভ্রতার মাথা ভন ভন করছে। চারপাশের সবকিছু মিথ্যে, বানোয়াট মনে হচ্ছে। সবটা নিতান্তই একটা দুঃস্বপ্ন বলে বোধ হচ্ছে। এই থমথমে, শীতল পরিবেশে ছেদ ঘটিয়ে আবারও কথা বললেন ডাক্তার সাহেব,

—-” আমার যতটুকু মনে হচ্ছে, উনি আরো আট/নয় ঘন্টা আগেই মারা গিয়েছেন।”

ডাক্তার সাহেবের কথা শেষ হতেই আবারও বিষাক্ত নীরবতায় ডুবে গেল পুরো ঘর। শুভ্রতা হঠাৎ করেই খেয়াল করল তার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বুকে কিছু একটা কামড়ে কামড়ে ধরছে। দাদুকে ছাড়া এতোটা কষ্ট হতে পারে কখনও ভাবেই নি শুভ্রতা। মূলত, দাদুর মৃত্যুর কথাটা কল্পনাও করে নি সে। আমাদের আশেপাশে এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের মৃত্যুর কথা কখনোই মাথায় আসে না। ভাবতে বসি না। মনে হয়, তারা ছিল, আছে, থাকবে। সবকিছু এভাবেই চলবে। কিন্তু চলে না। নিয়মিত ভাবনায় হঠাৎই ছন্দ পতন হয়। চিরপরিচিত মানুষগুলো হঠাৎ করেই হারিয়ে যায়। আনিমুল সাহেবও হারিয়ে গেলেন। ছেলেদেরকে বটছায়া থেকে উত্তপ্ত রৌদ্রে আশ্রয় দিয়ে হুট করেই অবসরের খাতা টানলেন। ‘দাদু নেই’ কথাটা মনে হতেই বুকের ভেতর কামড়ে ধরল শুভ্রতার। সকল নিস্তব্ধতা কাটিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে। ঘরের বাকি সদস্যরা চোখ ঘুরিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকাল। সবার চোখেই অবিশ্বাস মাখা ঘোর। শুভ্রতা মুখ চেপে ধরে ফ্লোরে বসে পড়ল। তার আর্তনাদ দেয়ালে দেয়ালে আঘাত হেনে মর্মান্তিক থেকেও মর্মান্তিক রূপে বেজে উঠল। জানালার পাশে দু’তিনটা কাকও তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল। ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল পুড়ে যাওয়া পায়েসের গন্ধ। কিছুক্ষণ আগেই চুলোয় পায়েস বসিয়েছিলেন রাদিবা৷ পায়েসটা বোধহয় ধরে এসেছে। শুভ্রতার আর্তচিৎকার আর কাকদের আহাজারি বিনা ঘরে আর কোনো শব্দ পতন ঘটল না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দিন বাঁধা বুয়াটা দৌঁড়ে গেল রান্না ঘরে। ঘরময় পায়েসের পুড়া গন্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। শুভ্রতার কান্নার শব্দটা হয়ে উঠল ততটাই বেদনাদায়ক, তীব্র!

#চলবে…..

[ এডমিশনের প্রিপারেশন চলছে তবুও সময় করে গল্প দিচ্ছি অথচ পাঠকদের সাড়া কমছে। তারা কি উৎসাহ হারাচ্ছে? পাঠকদের উৎসাহ হারানোর পাশাপাশি আমার লেখার উৎসাহটাও কমছে। তাই পাঠকদের বলব, আপনাদের মনোরঞ্জনের জন্য লিখছি একটা রিয়েক্ট দিয়ে উৎসাহটাতো বাড়াতে পারেন এটলিস্ট! আমি হতাশ!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here