আরশিযুগল প্রেম পর্ব — ৪৪

আরশিযুগল প্রেম পর্ব — ৪৪
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা

শুভ্রতার কথায় শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন রাদিবা আহমেদ। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে মেয়েকে নিরক্ষণ করে নিয়ে বললেন,

—-” কি বললি?”

শুভ্রতা ঢোক গিলল। মায়ের চোখের দিকে তাকানোর সাহস জোগাতে পারল না। শক্ত হাতে চেয়ার খামচে ধরে বিরবির করে বলল,

—-” আমার নিজের পছন্দ আছে মা। আমি একজনকে পছন্দ করি।”

রাদিবা হঠাৎ করেই কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সন্দেহী গলায় বললেন,

—-” তুই কি বিয়েটা আটকানোর জন্য এসব লেইম এক্সকিউজ দিচ্ছিস? তাহলে তোর জানা উচিত যে এসব লেইম এক্সকিউজে বিয়েটা আটকে যাবে না।”

শুভ্রতা এবার মুখ তুলে তাকাল। প্রতিবাদ করে বলল,

—-” লেইম এক্সকিউজ নয় মা। আমি সত্যিই একজনকে পছন্দ করি। খুব বেশি পছন্দ করি। নয়ত এমন একটা পরিস্থিতিতে এসব কথা কখনোই বলতাম না আমি। বিশ্বাস করো।”

রাদিবা আহমেদের কপাল কুঁচকে এলো। হাতে থাকা তরকারির বাটিটা টেবিলে নামিয়ে রেখে চোয়াল শক্ত করে তাকালেন। শক্ত গলায় বললেন,

—-” এসব তো তোমার নতুন নয় শুভি। বাসায় বিয়ের কথা উঠলেই একের পর এক বাহানা জুড়ে দাও তুমি। কিন্তু এবারের পরিস্থিতিটা যে প্রতিবারের মত স্বাভাবিক নয় তা বুঝতে পারছ?”

শুভ্রতা অসহায় গলায় বলল,

—-” আমি কোনো অজুহাত দিচ্ছি না মা। আমার বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই। তোমরা যদি চাও তাহলে এই মুহুর্তে বিয়ে করতে রাজি আমি কিন্তু বর হিসেবে আমি আমার পছন্দের ছেলেটিকেই চাই। প্লিজ মা।”

রাদিবা আহমেদ উত্তর দিলেন না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শুভ্রতা মায়ের তীক্ষ্ণ চোখে চোখ রাখতে না পেরে চোখ নামিয়ে নিল। বেশ কিছুক্ষণ শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর কথা বললেন রাদিবা,

—-” ছেলেটা কে? কি করে? বেকার? নাকি ক্লাসমেট?”

রাদিবার এমন প্রশ্নে খানিকটা ভরসা পেল শুভ্রতা। মায়ের দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিল,

—-” ক্লাসমেট বা বেকার কোনটাই নয়। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করে। তুমি তাকে চেনো।”

রাদিবা অবাক হয়ে বলল,

—-” আমি চিনি?”

শুভ্রতা মাথা নাড়ল। মাথা তুলে রাদিবার মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,

—-” আরাফ ভাইয়ার বন্ধু।”

রাদিবার ভ্রু কুঁচকে এলো। চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন,

—-” আরাফের বন্ধু?”

রাদিবা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ‘আরাফের বন্ধু’ নামক মানুষটিকে মনে করার চেষ্টা করলেন। মেয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

—-” ওই লম্বা, সুন্দর করে ছেলেটা?”

শুভ্রতা মাথা নাড়ল। রাদিবা সতর্ক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন,

—-” কতদিনের সম্পর্ক?”

সাদাফের ব্যাপারে রাদিবার খবরদারিতে শুভ্রতার মনে ক্ষুদ্র আশা জাগল। চোখ তুলে তাকিয়ে, উজ্জ্বল মুখে বলল,

—-” প্রায় এক বছর।”

রাদিবা আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তরকারির বাটিটা হাতে তুলে নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন। রাদিবার কাছ থেকে কোনরকম সদুত্তর না পেয়ে কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল শুভ্রতা। রাদিবাকে উল্টো প্রশ্ন করার সাহস খুঁজে পেল না। রাদিবা আহমেদ তরকারির বাটি রেখে এসে টেবিল মুছতে লাগলেন। শুভ্রতা ধুরুধুরু বুক নিয়ে ডাকল,

—-” মা?”

রাদিবা আহমেদ উত্তর দিলেন না। শুভ্রতা কাতর গলায় বলল,

—-” কিছু বললে না, মা?”

—-” শুক্রবারে ফারদিনের সাথে তোমার বিয়ে। এই কথাটা মনে রেখে বাকিসব ভুলে যাও।”

রাদিবার স্বাভাবিক কন্ঠে বলা অতি স্বাভাবিক কথাগুলো শুভ্রতার কাছে বোধগম্য মনে হল না। মায়ের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

—-” মা!”

—-” এখানে মা, মা করার মতো কিছু দেখছি না। ফারদিন ভালো চাকরি করে। দেখতেও আরাফের বন্ধুর থেকে খুব একটা খারাপ নয়। মানিয়ে নিতে খুব একটা কষ্ট তোমার হবে না। বিয়ে হয়ে গেলে এইসব ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে ততটা ঝামেলাও হবে না। দু’দিন একটু কষ্ট হবে তারপর সব ঠিক।”

শুভ্রতার গাল বেয়ে দু’ফোটা স্বচ্ছ জল গড়িয়ে পড়ল। মায়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে হাজার খানেক কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও সবই যেন গলার কাছে আটকে গেল। রাদিবা আহমেদ মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে আরো কিছু বলবেন তার আগেই পেছন থেকে তেজি গলায় কথা বলে উঠল শুভ্রব,

—-” এটা কোনো সদুত্তর হল না মা। এমন অবান্তর যুক্তি দিয়ে বুলিয়ে দেওয়ার মত বাচ্চা এখন আর শুভি নেই।”

রাদিবা আহমেদ ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকালেন। শুভ্রব কয়েক পা এগিয়ে এসে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াল। চোখ দুটো আজও ভীষণ লাল দেখাচ্ছে তার। রাদিবা আহমেদ হঠাৎ করেই খেয়াল করলেন ছেলের চোখে চোখ রেখে কিছু বলতে গিয়েও থমকে যাচ্ছেন তিনি। কোনো একটা অচেনা ভয় প্রাণপণে বাধা দিয়ে চলেছে তাকে। তবে কি, সত্যিই বড় হয়ে গেল ছেলেটা? শুভ্রব মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,

—-” বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা নয় মা। ‘এডজাস্টমেন্ট’ খুবই সিম্পল একটা শব্দ। কত সহজেই বুঝিয়ে দিলে বিয়ের পর এডজাস্ট করে নিবে। এডজাস্ট করাটা কোনো আহামরি কিছু নয়। কিন্তু এই এডজাস্টমেন্টটা করতে গেলে যে কতটা পুড়তে হয়, কতবার মরতে হয় তা কেবল যে করে সেই বুঝে। তোমরা নিজেদের খুশির কথা ভেবে ওর সুখ নষ্ট করতে পারো না। জন্ম দিয়েছ বলেই যে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়ার অধিকার তোমাদের আছে তা কিন্তু নয়। তাকে যত কষ্ট করেই এই পৃথিবীতে আনো না কেন? যতই আদর-যত্নে লালন পালন করো না কেন। ওর জীবনটা শুধুই ওর। আর ওর জীবনের ডিসিশন ও নিজে নেবে, তোমরা কেউ নও। কেউ না।”

রাদিবা আহমেদ কিছুক্ষণ ছেলের দিকে ভাষাহীন চোখে তাকিয়ে থেকে নড়েচড়ে উঠলেন। রূঢ় গলায় বললেন,

—-” আমরা নিজের খুশির জন্য কখনই তোমাদের সুখ বিসর্জন দিই না শুভ্রব। সারাটা জীবন তোমাদের ভালো রাখার প্রচেষ্টা করতে করতেই কাটিয়ে দিয়েছি। মায়ের সাথে কথা বলার আগে ভেবে কথা বলো। আর ফারদিন কোন যেনতেন টাইপ ছেলে নয়। আমরা শুভ্রতাকে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছি এমনটাও নয়। ওর ভালোর জন্যই….”

—-” ও যাকে পছন্দ করে তার সাথে সে ভালো থাকবে না এটা তোমাদের কে বলল মা? একটাবার আপাতত ওর নিজের ভালোটা ওকে বুঝতে দাও মা। নিজেদের ভাবনাটা ওর ওপর চাপিয়ে দিয়ে ওকে জীবন্ত লাশ হয়ে যেতে বাধ্য করো না। বিয়েটা ওর পছন্দতে হলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে মা?”

—-” তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন এমনটা শুধুমাত্র তোমার বোনের সাথেই হচ্ছে। চারপাশে অহরহ মেয়েরা পরিবারের পছন্দে বিয়ে করছে, মানিয়ে নিচ্ছে এবং ভালো থাকছে। তাছাড়া, এটা তোমার দাদুর শেষ ইচ্ছে ছিল। মৃত্যুর আগে ওয়াদা করে গিয়েছেন তিনি।”

শুভ্রবের চোখে-মুখে স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠল। হাতের কাছে থাকা কাচের গ্লাসটা ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলল। শুভ্রতা ভাইয়ের অগ্নিমূর্তি দেখে আৎকে উঠল। ডানহাতের পিঠে চোখ মুছে ভয়মাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শুভ্রব উঁচু গলায় বলল,

—-” চারপাশের অহরহ মেয়ে আজ ধর্ষিতা হচ্ছে মা। তাহলে কি তুমি তোমার মেয়েকেও ধর্ষকদের হাতে তুলে দেবে? অনেক মেয়েই তো হচ্ছে তাহলে তোমার মেয়ে হলে ক্ষতি কি?”

রাদিবা আহমেদ ধমকে উঠে বললেন,

—-” শুভ্রব! তুমি হয়ত ভুলে যাচ্ছ যে তুমি তোমার মায়ের সাথে কথা বলছ।”

নিজের ভালোবাসা হারিয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য শুভ্রব হুট করেই মায়ের ডানহাতটা নিজের হাতে নিল। করুণ গলায় বলল,

—-” তুমিই তো বলতে, মায়েরা সন্তানদের সবচেয়ে বেশি বুঝে। তুমিও তো আমাদের মা। শুভিকে তো আমার থেকেও বেশি বুঝো তুমি। তোমার মেয়েটা যে কতটা দুর্বল মনের তা তোমার থেকে আর কে ভালো জানে বলো? বাবা-মার ঋণ শোধ করার মত কঠিন শব্দগুলো ওর ছোট্ট কাঁধে চাপিয়ে দিও না। ও তোমার আমার মতো শক্ত নয়। ও সহ্য করতে পারবে না। আমার একটাই বোন মা।”

রাদিবা ছেলের দিকে নীরব দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

—-” তোমার দাদুর ওয়াদার কথা ভুলে যেও না শুভ্রব। উনার শেষ ইচ্ছে…. ”

রাদিবা আহমেদকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ছিটকে সরে গেল শুভ্রব। ভয়ানক রাগী গলায় বলল,

—-” ইচ্ছে! ইচ্ছে! ইচ্ছে! একজন মরা মানুষকে নিয়ে এতো আদিখ্যেতা কেন দেখাচ্ছ মা? যে মানুষটা অলরেডি মৃত তার জন্য আরো দুটো মানুষকে মৃত্যুর মুখে কিভাবে ঠেলে দিতে পারো তোমরা? মৃত মানুষের প্রতি এত দরদ… ”

শুভ্রবের কথা শেষ না হতেই গালের ওপর দানবীয় আঘাতে খানিকটা পিছিয়ে গেল শুভ্রব। শুভ্রব মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকাতেই শাহিনুজ্জামান সাহেবের অগ্নিরূপ চোখে পড়ল। শাহিনুজ্জামান সাহেবের শরীর রাগে অল্প বিস্তর কাঁপছে। শুভ্রবের বলা ‘মরা মানুষ’ কথাটা শুনেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন তিনি। নিজের বাবা সম্পর্কে নিজের ছেলের মুখেই এমন কিছু শুনতে হবে কল্পনায় করতে পারেন নি উনি। শাহিনুজ্জামান সাহেব রাগ ধরে রাখতে না পেরে আরো একটা চড় বসালেন শুভ্রবের গালে। শুভ্রতা দু’হাতে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। ততক্ষণে বাসার বাকি সদস্যগুলোও ধীর পায়ে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। শুভ্রতার নিজেকে ভয়ানক দোষী বলে মনে হচ্ছে। শুধুমাত্র ওর জন্যই প্রথমবারের মত শুভ্রবের গায়ে হাত তুললেন শাহিনুজ্জামান সাহেব। শুধুমাত্র তার জন্যই। শাহিনুজ্জামান সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

—-” তোমার সাহস কিভাবে হয় আমার বাবাকে নিয়ে এমন কথা বলার? সে যে তোমার দাদু তা কি ভুলে গিয়েছ তুমি? এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোমায়? চারদিন হলো দাদু মারা গেছে এখনই তাকে ‘মরা মানুষ’ ‘আদিখ্যেতা’ এসব মনে হচ্ছে? কাল আমি মরে গেলে তো কবরটাও ঠিকঠাক দেবে না। রাস্তার পাশে ফেলে এসে বলবে ‘এই মরাকে নিয়ে এতো আদিখ্যেতার কি আছে?’ তাই না?”

শুভ্রব মাথা নিচু করে বলল,

—-” বাবা তুমি… ”

শাহিনুজ্জামান গর্জে উঠে বললেন,

—-” একদম চুপ, বেয়াদব ছেলে। আমার মুখের ওপর কথা বলার সাহস কি করে হয় তোমার? খুব বেশি বড় হয়ে গিয়েছ? খাইয়ে দাইয়ে আস্ত কুলাঙ্গার তৈরি করেছি আমি। ছি!”

শুভ্রব ধীরে কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল,

—-” বাবা তুমি সবটা না শুনেই রিয়েক্ট করছ। শুভি একজনকে পছন্দ করে আর তোমরা…”

শাহিনুজ্জামান সাহেব আবারও তেড়ে গেলেন। রাদিবা উনার হাত টেনে ধরে উনাকে আটকানোর চেষ্টা করলেন। অনুরোধের সুরে বললেন,

—-” দয়া করে শান্ত হও তুমি। বেশি উত্তেজিত হলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তুমি। তোমার শরীর কাঁপছে। একটু বসো।”

শাহিনুজ্জামান সাহেব রাগী গলায় বলল,

—-” আমার মুখে… আমার মুখের ওপর কথা বলতে শিখে গিয়েছে তোমার ছেলে। এই কুলাঙ্গারটাকে এই মুহুর্তে আমার সামনে থেকে যেতে বলো। বের হয়ে যেতে বলো আমার বাসা থেকে।”

শুভ্রব এবারও মাথা তুলে তাকাল না। তবে স্পষ্ট গলায় বলল,

—-” শুভির মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাদের কোনো সিদ্ধান্তই মেনে নেব না আমি। তোমাদের সিদ্ধান্তের কারণে আমার বোনের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হলে আমি তার শেষ দেখে ছাড়ব।”

কথাটা শেষ করে এক মুহূর্ত দাঁড়াল না শুভ্রব। দরজায় তুমুল শব্দ তুলে বাসা থেকেই বেরিয়ে গেল। ঘরের সবাই বিস্ময় নিয়ে শুভ্রবের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। পরিবারের সবচেয়ে ভদ্র ছেলেটার এমন রূঢ় ব্যবহারে সবাই যেন নির্বাক।

#চলবে….

[ রি-চেইক করা হয় নি। গল্পে ভালো রেসপন্স পেলে কাল প্রেমকথন দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here