আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
( ২য় পর্ব )
.
বৃষ্টি থেমে গেছে। কাদায় মাখামাখি রাস্তা।
লঞ্চ থেকে নেমে যাত্রীরা জুতো খুলে প্যান্ট গুটাচ্ছে। এখান থেকে মাইল দুয়েক উত্তরে ইলাশপুর গ্রাম।
বক্কর আলী বলল,
–‘মাস্টার সাব রাস্তায় কাদা আছে প্যান্ট ভাঁজ করে জুতা হাতে লউক্কা।’
জিসান আমতা-আমতা করে জুতো হাতে নেয়। সাবধানে বক্কর আলীর পেছনে হাঁটতে থাকে। পা বারংবার পিছলে যাচ্ছে তার। অথচ ব্যবসায়ীরা কাঁধে মাল নিয়ে রীতিমতো দৌড়াচ্ছে। মহিলারা কোলে বাচ্চা নিয়ে পা টিপে টিপে হাঁটছে। সামনে একটা বাচ্চা পা পিছলে পড়ায় কান্নাকাটি করে হুলস্থুল কারবার। বাবা এক হাতে বাজার-সাদাই আর অন্য হাতে ছেলেকে টেনে কোলে তুলে নিলেন।
সবকিছু দেখে জিসান জিজ্ঞেস করল,
— ‘বক্কর সাহেব, আমি ভেবে পাচ্ছি না এই অঞ্চলের প্রেগন্যান্ট মহিলা কিংবা হঠাৎ অসুস্থ হওয়া রুগীদের নিয়ে ডাক্তারের কাছে কীভাবে যায়? এলাকায় কি সেরকম কোনো ডাক্তার-ফাক্তার আছে?’
– ‘হা-হা-হা কিতা কইন মাস্টার সাব। আমরার পীর সাবের ছেলে আছইন না। অবশ্য আগের পীর ছিলা বেশি গরম। ফুঁ দিলে সব রোগ শেফা। আর পোয়াতি মহিলাদের লাগি ধইন্যা বেটি আছে তারা কাম খালাস করিলায়।’
– ‘বলেন কি? ডাক্তারি ছাড়া সবকিছু পীর সাহেব দ্বারা হয়ে যায়?’
– ‘আমরা ছোট থাকতে দেখতাম কেউ ডাক্তারে যায় না। ডাক্তার বিশ্বাসই করতো না। তখন কেউ কেউ পীর মানে না তারা পালকী কইরা লঞ্চ ঘাটে রোগী নিয়া সিলেটে বড় ডাক্তার দেখায়।’
জিসান ভেতরে ভেতরে বিস্মিত হয়ে বলল,
–‘মানে পীর সাহেবের কাছে গেলেই রোগ ভালো হয়ে যায়?’
– ‘একজন পীরের গেছে ভালা না অইলে আরেকজনের গেছে যাইন। চাইরোবায়দি সব গ্রামেই আছইন পীর। আল্লাহ পাক চাইলে ভালা অয় না অইলে হাজার পীরের কাছে গেলেও ভালা অয় না।’
– ‘ধরেন কোনো একজন রুগী পীর সাহেবদের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে করতেই মারা গেল তখন পীরকে কিছু বলে না?’
– ‘কেন বলতো? ডাক্তারে নিলে কিতা সব রুগী ভালা অইযায়নি?’
জিসানের আর কথা চালাতে ভালো লাগছে না৷ খুবই সতর্কভাবে পা ফেলতে হচ্ছে। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। পথ যেন শেষই হচ্ছে না। সে কি অনন্তকাল ধরে এই পথ ধরে হাঁটছে?
—-
চেয়ারম্যান ইমরাজ উল্লাহ উঠোনের মাথায় খাটে বসে আছেন। একজন চুল-দাঁড়ি কেটে দিচ্ছে। তিনি ডাকলেন
– ‘অন্তরা কই?’
পর্দার আড়াল থেকে মিষ্টি কন্ঠে অন্তরা বলল,
-‘জ্বী চাচাজি কওক্কা।’
– ‘বক্কর আলী গেছে মাস্টার সাবরে আনতে। দোতলার ঘর ঝাড়ু-টারু দিয়া পরিষ্কার কইরা বিছনা করো।’
– ‘আইচ্ছা চাচাজি।’
অন্তরা তাড়াতাড়ি দোতলার রুমটি বসবাস যোগ্য করতে চলে গেল। বছর দুয়েক আগে ছাদে কেবল একটি লাকড়ি ঘর বানানো হয়েছিল। বাকি পুরোটা ছাদ ছিল খালি। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেবের ইদানীং মনে হচ্ছে মাদ্রাসার একজন শিক্ষক লজিং না দিলে ইজ্জত থাকছে না। তাই বক্করকে দিয়ে লাকড়ি বের করে ঘরটি ঠিকঠাক করা হয়েছে।
ইলাশপুরে একটি প্রাইমারি স্কুল আছে। হাইস্কুল নেই। তিন ঘন্টা হেঁটে করিমগঞ্জে গেলে অবশ্য একটা হাইস্কুল আছে। চেয়ারম্যান সাহেবের একমাত্র মেয়ে সায়মা পড়ে সেই স্কুলের ক্লাস নাইনে। ইংলিশ স্যার লজিং দেওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে সায়মার পড়াশোনার কাজে আসবে।
সায়মা রুম থেকে বের হয়ে খাওয়ার টেবিলে গিয়ে দেখল ভাত দেয়া হয়নি। মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল৷
-‘অন্তরা, এই অন্তরা।’
কোনো জবাব না পেয়ে ছাদে গিয়ে দেখতে পেল অন্তরা মাথা নুইয়ে ঘরদোর ঝাড়ু দিচ্ছে। টানটান মাঝপিঠে দুম করে একটা কিল মেরে বলল,
–‘খানকির ঘরের খানকি তরে কোন সময় কইছি ভাত দিতে?’
অন্তরা কোনো কথা বলতে পারলো না। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। উল্টো হাতে পিঠ চেপে কিছুক্ষণ মেঝেতে পড়ে রইল।
– ‘অইছে আর ভঙ্গি ধরা লাগতো নায় ভাত দিবায় হাঁটো। তুমি তো জানো আমি পেটবুক সহ্য করতাম পারিনা।’
অন্তরা চুপচাপ উঠে রান্নাঘরে গেল। সায়মার থেকে সে বছর চারেক বড় হবে। তবুও এমন আচরণে কোনোদিন প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি।
সন্ধ্যার পর সায়মা রুমে ঢুকে দেখল অন্তরা কাপড় সেলাই করছে। হাত বাড়িয়ে কাপড় সরিয়ে বলল,
–‘মাথাত বেদনা করের আপা, টিইপা দেও।’
তারপর ফিক করে হেঁসে বলল,
–‘আজকে ইস্কুলো কিতা অইছে জানোনি অন্তরা আপা। একটা ছেলের কথা কইচলাম মনে আছে?’
তখনই বাইরে থেকে বক্কর আলীর ডাক শোনা গেল,
– ‘চেয়ারম্যান চাচা, ও চেয়ারম্যান চাচা।’
গৃহবন্দী অন্তরার বাইরের সবকিছুর প্রতি সীমাহীন আগ্রহ। সে চট করে কোল থেকে সায়মার মাথা সরিয়ে জানালা দিয়ে উঠোনে তাকাল। সৌর বিদ্যুতের বাতির আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল এক সুদর্শন যুবককে।
প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত তোলা। সাদা ধবধবে পায়ে পাতলা কালো লোম। বক্কর আলী বালতি থেকে পানি ঢেলে দিচ্ছে৷
আচমকা জানালার গ্রিলের সঙ্গে কপাল লাগায় ‘উফ’ করে পেছন ফিরে তাকাল অন্তরা। অগ্নিমূর্তি হয়ে তাকিয়ে আছে সায়মা৷
– ‘ছিলানের ঘরের ছিলান বাইরে কিতা তর জামাই আইছেনি? হর ইকান থাকি৷’
অন্তরা প্রথমে বুঝতে পারেনি৷ এখন মনে হচ্ছে কপাল যেন ফেটে গেছে।
সায়মা বাইরে তাকিয়ে মাস্টারকে দেখে বলল,
-‘ওমাগো মাস্টার তো পুরাই নায়ক গো আপা।”
তারপর নিজেই অন্তরাকে টেনে বলল,
– ‘দেখো আফা দেখো উফ কি সুন্দর।’
অন্তরা কপাল চেপে ধরেছে। তর্জনীর আগা রক্তে ভেজা। ব্যথা নিয়েই সে তাকাল। ছেলেটি এবার মুখ ধুচ্ছে। ফরসা গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। সামনের আধো ভেজা সিল্কি কালো চুল কপালে এসে পড়ছে৷ অন্তরার কেমন যেন লাগল। খুব অচেনা এক অনূভুতি।
পেছন থেকে সায়মা টানছে। অন্তরার যেন চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না। চোখের বড় তৃষ্ণা। তাকিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করছে। বক্কর আলী মাস্টারকে নিয়ে উপরে গেল। ঠিক তখনই মনে হলো প্রচন্ড জলের পিপাসা পেয়েছে। অন্তরা জানালার কাছ থেকে সরে ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে জল খেতে গেল। কপালে ভীষণ ব্যথা। আয়নার সামনে গিয়ে দেখতে হবে কতটুকু ফেটেছে।
এদিকে টানাটানি করে জানালা থেকে সরাতে না পারায় রাগে সায়মার চোখ থেকে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরোচ্ছে। ধেয়ে গেল অন্তরাকে মারতে।
–চলবে—
লেখা: জবরুল ইসলাম