আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন পর্ব ২৩

0
430

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
২৩ পর্ব
.
ভেজানো দরজা ‘খ্যাক’ করে খোলার শব্দ হলো। তাড়াতাড়ি সরে গেল অন্তরা। মুখ ঢেকে বসে গেল পাটিতে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। জিসান বিব্রত ভঙ্গিতে সৌজন্যের হাসি দিয়ে তাকালো সুমিতের দিকে। সেও বিব্রত। তার হাতে কালো পলিথিনের ব্যাগ। তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘কেউ দেখলে আমারে বিপদে ফেলাইবেন ভাই। লোকে কইব আমি এইগুলার জন্য ঘর ভাড়া দিছি, বুঝতে পারছেন তো? তাড়াতাড়ি নাস্তা করে নিন রিকশা ডেকে দিচ্ছি।’

— ‘আচ্ছা ঠিকাছে যান।’

জিসান কালো পলিথিন খুলে দেখলো সিঙ্গারা। তার চোখের বিষ। একদম পছন্দ না। অন্তরার মাথায় হাত রেখে বলল, ‘মুখ ঢেকে আছো কেন? এতো লজ্জা পেও না তো। এই নাও, এখন সিঙ্গারা খাও। রাস্তায় কোথাও নেমে আমরা ভালো কিছু খেয়ে নেব।’

অন্তরা পেটের ক্ষুধায় পর পর তিনটা সিঙ্গারা খেয়ে ফেলল। জিসান পানির বোতলের ছিপি খুলে বাড়িয়ে দিল ওর দিকে। এতোক্ষণ সে একটা সিঙ্গারাই নাড়াচাড়া করেছে। অন্তরাকে কিছু বুঝতে দেয়নি।

বক্কর আলী পান চিবোতে চিবোতে এসে বলল, ‘মাস্টার সাব, আসেন রিকশা পাইছি।’

তখনই অন্তরা বোতল দিয়ে পানি খেতে গিয়ে বিষম খেল, কাশি-টাশি দিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড। বোতলের সব পানি অন্তরার কামিজে। গলা থেকে বুক দিয়ে একেবারে পাটি অবধি ভিজেছে।
— ‘আমরা আসছি, তুমি একটু বাইরে যাও বক্কর ভাই।’

বক্কর আলী বিরক্ত হয়ে বাইরে গেল। জিসান তাড়াতাড়ি তার ব্যাগ থেকে শুকনো লুঙ্গি বের করে দরজা লাগিয়ে দিল। বাইরে থেকে সুমিত দাঁত কটমট করছে। অন্তরা এখনও গলা পরিষ্কার করতে পারছে না। এদিকে কাপড় ভিজে যাওয়ায় বিব্রতবোধ করছে। জিসান এসে হাত ধরে দাঁড় করাল। পিঠের দিকে এক হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে কাছে টেনে গালে এক হাত রেখে বলল, ‘তোমার গাল বেবিদের মতো এতো তুলতুলে কেন বলো তো? ঘুমাও মনে হয় বেশি?’

অন্তরার লজ্জা লজ্জা লাগছে। সে দাঁড়িয়ে রইল। জিসান আস্তে করে ওড়নাটা টেনে খুলে নিল। অন্তরা আঁতকে উঠে প্রথমে চোখ তুলে তাকাল জিসানের দিকে, তারপর নিজের ভিজে যাওয়া বুকের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
জিসান মুচকি হেঁসে বলল, ‘তুমি এতো লজ্জা পাও কেন বলো তো।’
তারপর ওড়নাটা ভালো করে চিপে ঝেড়েঝুড়ে একপাশে রেখে ব্যাগ থেকে শুকনো লুঙ্গি নিল। অন্তরাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো এসে। শুকনো লুঙ্গি দিয়ে না দেখেই গলা থেকে মুছে দিতে লাগলো। কেঁপে কেঁপে উঠলো অন্তরা। কি হচ্ছে এসব? সে পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ জিসান কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘চোখবন্ধ করে মুছে দেই সব?’
গরম শ্বাস এসে পড়লো কানে৷ মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছে না অন্তরার। তবুও অঘটনের আগেই টান দিয়ে নিজের হাতে লুঙ্গি নিল।
মুচকি হেঁসে সরে দাঁড়াল জিসান। অন্তরা ভালোভাবে মুছে নিল সব। লুঙ্গি পেছন দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, আমার ওড়নাটা দিন।’
জিসান ওড়না ছুড়ে দিয়ে মিছামিছি রাগ দেখালো। অন্তরা ভ্রুক্ষেপ না করে ঠিকঠাক হয়ে বলল, ‘চলুন, তারা অপেক্ষা করছে।’

— ‘আমি যাবো না, এখানেই থাকবো।’

— ‘থাকেন আপনার বাচ্চামু নিয়ে আমি যাচ্ছি।’

অন্তরা দরজার ছিটকিনি খুলতে যাচ্ছিল। জিসান তাড়াতাড়ি এসে পথ আগলে দাঁড়াল।
— ‘পথ ছাড়েন।’

— ‘এমন করছো কেন?’

— ‘আমার লজ্জা করছে তো। বাইরে ওরা অপেক্ষা করছে।’

জিসান নাছোড়বান্দা হয়ে হাত বাড়িয়ে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তার ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। অন্তরা মোচড়া-মুচড়ি করছে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য। জিসান একটু আলগা করে মুখ ধরে কপালে একটা চুমু খেয়ে আবার বুকে টেনে অস্ফুটে বলল, ‘আমার বউটা।’
অন্তরা লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। তবুও ফিক করে হেঁসে ফেলল। লোকটা যে এতো নির্লজ্জ হবে আগে দেখে তার একটুও মনে হয়নি।
জিসান অনিচ্ছাসত্ত্বেও দরজা খুলে বাইরে এসে বলল, ‘আসো।’
অন্তরা চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে৷ কেন যেন বুকটা শিরশির করে উঠলো। বাইরে এসে আদুরে গলায় বলল, ‘মন খারাপ করে আছো কেন জিসান? রাগ করলে না-কি?’
কথাটি বলে অন্তরা জিভ কামড়ে ধরলো। এই প্রথম সে সরাসরি তুমি করে বলে ফেলছে৷ জিসান সরাসরি চোখ তুলে তাকাল। এর আগে নিজের নাম অন্তরার মুখে শুনেছে বলে মনে হয় না। তার কাছে এই মুহূর্তে মনে হলো ‘জিসান’ এই জগতের সব চাইতে সুন্দর নাম। এদিকে দরজা বন্ধ করায় মেজাজ গরম হয়ে আছে সুমিতের। বক্কর আলী একটু পাশে এসে বলল, ‘মাস্টার সাব, রিকশায় যাওয়ার সময় এতো জড়াজড়ি করবেন না। লোকে মন্দ কইব।’

— ‘আচ্ছা ঠিকাছে।’ বলে ঠিকই আবার হাত ধরে রিকশায় তুলে বসাল অন্তরাকে।

বক্কর আলী এবং সুমিত মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। অন্তরার ইচ্ছে ছিল বক্কর ভাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রিকশায় উঠবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে কারও দিকে তাকাতে পারবে না৷ ভীষণ লজ্জা করছে। চারদিকে অন্ধকার হলে ভালো হতো। লোকটির পাল্লায় পড়ে এই মুখ এখন মানুষকে দেখাতেই লজ্জা লাগছে৷
জিসান এগিয়ে গেল সুমিত আর বক্কর আলীর দিকে৷
— ‘কাগজ কলম থাকলে দাও তো সুমিত।’

— ‘দোকানের ভেতরে আসেন।’

দু’টা কাগজে মোবাইল নাম্বার, ঠিকানা লিখে তাদেরকে দিল।
— ‘ঢাকা কখনও গেলে যোগাযোগ করবে সুমিত ভাই।’

— ‘আইচ্ছা ঠিকাছে। আর এখন যান দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

বক্কর আলীকে নিয়ে বাইরে এলো জিসান।
— ‘বক্কর ভাই, তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। ঠিকানা রাখো। যেকোনো প্রয়োজনে যোগাযোগ করবে। একদিন অবশ্যই বেড়াতে যাবে। অন্তরার তো কেউ নেই। চাচাও আর দেখতে যাবে না তাকে। তুমি ওর ভাই হিসেবে মাঝে মাঝে যাবে।’

বক্কর আলী বিদায় জানালো। জিসান গিয়ে রিকশায় উঠার সঙ্গে সঙ্গে চালক প্যাডেল দিল। অন্তরার বুকটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে। এতো বছরের পরিচিত জগত ছেড়ে অচেনা একজন মানুষের সঙ্গে বাকী জীবন কাটাতে চলে যাচ্ছে সে৷ আর কখনও হয়তো চাচার সঙ্গে দেখা হবে না। সায়মার সঙ্গে দেখা হবে না। মানুষ তারা যেমনই হোক৷ এতোটা বছর এদেরকেই তো আপন ভেবে এসেছে। আশ্রয়ে থেকেছে। আজ একেবারে সেই বন্ধন ছিঁড়ে চলে যাচ্ছে সে। জলে ভরা চোখে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল বক্কর আলীর দিকে।
— ‘ভাই যাচ্ছি।’

— ‘যাও বইন।’
বক্কর আলীর গলা ধরে এসেছে। চোখ ঝাপসা লাগছে। সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে এক গলির দিকে হাঁটা দিল। আড়ালে যেতেই হু হু করে কেঁদে উঠলো৷ দূর থেকে কেউ তার এই ভানহীন শুদ্ধতম কান্না দেখলে ভাববে হাসছে৷ বক্কর আলী নিজেও এই কান্নার সুনির্দিষ্ট কারণ জানে না৷ রহস্যময় মানব মনের অনেক অলিগলি। সব গলির খবর আমরা নিজেও রাখতে পারে না।

জিসান ভাসছে সুখের সমুদ্রে। রিকশায় উঠেই পিঠের দিকে হাত নিয়ে সাপের মতন জড়িয়ে ধরলো অন্তরাকে। অন্তরার মন খারাপ লাগছে। মাথা নীচু করে বসে আছে সে। জিসান গালে ধরে অন্তরার মাথাটা তার দিকে চেপে অযুহাত দেখিয়ে বলল, ‘কাঁচা রাস্তা তো৷ ঝাঁকুনি অনেক। আমার আরও কাছে এসে বসো।’

অন্তরা মাথা তুলে জিসানের দিকে তাকাল।
— ‘এভাবে কি দেখছো?’

— ‘আমার ভয় হচ্ছে জিসান।’

— ‘কেন?’

— ‘আজ থেকে তুমি ছাড়া আমার আর কেউ রইল না।’

জিসান খানিক বিরক্ত হলো,
— ‘এই মুহূর্তে এসব ভাবার সময়? আমার কত আনন্দ হচ্ছে আর তুমি ভয়ে আছো?’

অন্তরা কিছু বলল না। জিসান আরেকটু কাছে টেনে বলল, ‘ভয় পেলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসো।’

তারা শেরপুর যেতে পৌঁছে গেলে জিসান রিকশা থেকে নেমে বলল, ‘চলো ভাত-টাত কিছু খাই।’

অন্তরার কিছুই ভালো লাগছে না। মাথা নেড়ে বলল, ‘না কিছু খাব না। তুমি খেতে হলে খাও।’

— ‘চলো তো৷ খাবে না মানে কি। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি৷ খেয়ে-দেয়ে বাসে উঠবো।’

একটা রেস্টুরেন্টে গেল তারা। কেবিনের পর্দা টেনে খাবার অর্ডার দিল। ওয়েটার খাবার দেওয়ার পর বলল ঠিকাছে আপনি যান ডাকলে আসবেন।
তারপর অন্তরাকে বলল, ‘তোমার যখন খেতে ভালো লাগছে না, আমি খাইয়ে দেই?’

অন্তরা জবাব না দিয়ে মলিন মুখে চুপচাপ বসে রইল। জিসান চলে গেল হাত ধুতে। অন্তরা বামের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। একটি টলটলে দীঘি দেখা যাচ্ছে। পশ্চিম পাড়ে কয়েকটি হাঁস বসা। তারা বুঝি রোদ পোহাচ্ছে? না-কি সাঁতার কেটে ভীষণ ক্লান্ত তাই খানিক জিরিয়ে নিচ্ছে? সাদা হাঁসটি নেমে গেল পানিতে। আরেকটি হাঁস পিছু নিল ওর। দীঘির টলটলে জল এখন মৃদু মৃদু কাঁপছে। সাদা হাঁস “প্যাকপ্যাক” করে পালাচ্ছে। মাঝখানের বাঁশটাতে আহারের অপেক্ষায় থাকা মাছরাঙাটি বোধহয় বিরক্ত, সে আচমকা উড়াল দিল।
জিসান ফিরে এসে আবার বলল, ‘তুমি তো হাত ধুতেও গেলে না, তুলে খাওয়াবো না-কি কিছু তো বলো?’

অন্তরা চোখ তুলে তাকাল জিসানের মুখে। এখন নিজের কাছেই খারাপ লাগছে৷ জিসানের আনন্দের মুহূর্তগুলো বোধহয় সে অযথা নষ্ট করে দিচ্ছে। মানুষটার আনন্দে সারাক্ষণ চোখমুখ ঝলমল করছে। তাকে খেয়ে ফেলতে পারলেই যেন বাঁচে৷ অন্তরা মুচকি হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘আচ্ছা।’
— চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here