আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
১৪ পর্ব
.
পিয়াস তার পোষা শালিকটির জন্য হাওরে যাবে ঘাস ফড়িং ধরতে। বন্য ঘাস এবং পানায় শালিকের প্রধান খাদ্য ফড়িং পাওয়া যায়। ফড়িং ধরে ধরে একটি বোতলে ভরে সে। অসংখ্য ছোট ছোট ফুটো করা সেই বোতল। শালিকের সামনে বোতল ধরলেই ‘হা’ করে ডাকতে ডাকতে অস্থির হয়ে যায়। হস্ত তৈরী একটা বাঁশের খাঁচা আছে তার জন্য। এলাকায় কনাই চাচা খাঁচা তৈরীতে ওস্তাদ। কেবল এক প্যাকেট নাসির বিড়ির টাকা হাতে দিলেই হয়ে গেল।
জিসানের জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে এসে শালিকের গল্পই করছে পিয়াস। কথা একটু বেশি বলে তা বুঝাই যাচ্ছে।
জিসান চায়ের কাপে টোস্ট বিস্কুট ভিজিয়ে মুখে দিল। এতদিনে তার ধারণা হয়ে গেছে গ্রামে চায়ের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয় টোস্ট বিস্কুট।
চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
— ‘শালিক ধরলে কীভাবে।’
পিয়াস দরজা খুলে বাইরে এসে বলল দেখে যান কীভাবে ধরি৷ কৌতূহলী হয়ে বেরুল সে। পিয়াস তর্জনী দিয়ে একটা লম্বা সুপারি গাছ দেখলো। গাছের মাথায় একটা মাটির হাড়ি বাঁধা।
— ‘ওই হাড়িতে শালিক বাসা বেঁধে বাচ্চা ফুটাইছিল।’
— ‘দারুণ তো। আমি আজ তোমার সঙ্গে ফড়িং ধরায় যেতে চাই। সমস্যা নাই তো?’
— ‘যেতে পারবেন। তবে লুঙ্গি পরে যেতে হবে। কাদাপানি আছে।’
— ‘সমস্যা নেই লুঙ্গি আছে।’
পিয়াস গরু নিয়ে বেরুল। প্রতিদিনই গরু মাঠে দিয়ে ফড়িং ধরতে যায়। জিসানের কাদা পানিতে হাঁটতে খারাপ লাগছে না। সবকিছু বেশ ভালোই লাগছে।
— ‘স্যার কি আজ মাদ্রাসায় যাবেন না?’
— ‘না। আজ তোমার সঙ্গে ঘুরবো।’
— ‘ও।’
জিসান চাচ্ছে কোনো কৌশলে চেয়ারম্যানের বাড়ির রাস্তা চিনতে।
পিয়াস প্রথমে গরু দিল। তারপর হাটঁতে লাগল ফড়িংয়ের খুঁজে৷
জিসান ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো,
— ‘আচ্ছা চেয়ারম্যানের বাড়ি কোনদিকে এখান থেকে?’
পিয়াস আঙুল দিয়ে অনেক দূরের কিছু গাছগাছালি দেখিয়ে বললো,
— ‘এইটা চেয়ারম্যানের বাড়ি। আমি প্রতিদিন ওখানকার একটা বিলের পাড়েই ফড়িং ধরি। আজকে আপনি সাথে তাই ওদিকে যাব না।’
জিসান অবাক হয়ে বলল,
— ‘আমি সাথে থাকলে যাবে না কেন?’
পিয়াস মুচকি হেঁসে বলল,
— ‘গ্রামের মানুষ বাতাসে সব খবর পায় স্যার। চেয়ারম্যানের বাড়ি থাইকা আপমার লজিং কেন গেল সেটা সবাই জানে। তবুও সমস্যা নাই কারণ এলাকার মানুষ চেয়ারম্যানকে পছন্দ করে না।’
কি বলবে খানিক্ষণ ভেবে পেল না জিসান। দু’জন হাঁটতে হাঁটতে একটি ডোবার সামনে এসে পড়েছে। চারপাশে ঘাস আর পানা৷ পিয়াস লুঙ্গি কাছা মেরে নেমে পড়েছে। জাপ্টে জাপ্টে ফড়িং ধরায় ব্যস্ত হয়ে গেল। জিসানের হঠাৎ মনে হল সমস্যার মুখোমুখি তো তাকে দাঁড়াতেই হবে। তাছাড়া পিয়াস বিষয়টি জানে।
আমতা আমতা করে বলল,
— ‘পিয়াস তুমি কি চেয়ারম্যানের ভাতিজি অন্তরাকে চেনো?’
বোতলে একটা ফড়িং ঢুকিয়ে বলল,
— ‘দেখিনি কখনও। গ্রামগঞ্জে এক বাড়ির মানুষ আরেক বাড়ি কি দিয়ে কোন বেলা ভাত খায় সেটাও জানে। কার বাড়ি মেহমান এসেছে কোনদিন গেল সবকিছু জানে। কিন্তু শালার চেয়ারম্যানের বাড়ি আলাদা। শহরের মতো বিচ্ছিন্ন পরিবার যেন। তাদের খাস লোক ছাড়া কেউ কিচ্ছু দেখে না, জানে না।’
— ‘তাই না-কি?’
— ‘হ।’
— ‘আচ্ছা এলাকায় চেয়ারম্যানের এতো প্রভাব কেন?’
— ‘আগে থেকেই প্রভাব। বড় গোষ্ঠী ছিল, জায়গা সম্পত্তি আছে। এখন আবার প্রশাসনিক পাওয়ার। পুলিশ আর এমপি মন্ত্রীদের লগে শুনছি ভালো খাতির।’
— ‘ও আচ্ছা।’
জিসান কথাটি গুছিয়ে আনতে পারছে না। কীভাবে বলবে, পিয়াসও কথাটি কীভাবে নেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
শেষপর্যন্ত আমতা আমতা করে বলল,
— ‘আমার মনে হয় অন্তরার সঙ্গে দেখা করা দরকার। চেয়ারম্যান বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর ওর প্রতিক্রিয়া কি জানতে চাই। সে চাইলে তো আমরা পালিয়েও বিয়ে করতে পারবো। তাছাড়া ক’দিন হয়ে গেল তাকে দেখি না৷ অসুস্থও শুনলাম। এখন কেমন আছে। ওরা তার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করছে কি-না জানতে ইচ্ছে করছে।’
পিয়াস বোতলের ছিপি লাগিয়ে জিসানের পাশে এসে আইলে বসলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খানিক্ষণ ভেবে বলল,
— ‘বিষয়টা জটিল করেছেন আপনি নিজে। অন্তরাকে আগে প্রস্তাব দিয়ে রাজি হইলে পালানোই উত্তম ছিল। আমি সিক্তার পরিবারের কাছে কোনো প্রস্তাব মারাতে যাইনি। কারণ জানি বিয়ে দিবে না। আল্লাহ যা করে বলে, সোজা পালিয়ে নিয়ে আসলাম। ব্যস খেলা খতম।’
— ‘আমি তো ভেবেছিলাম বিয়ের প্রস্তাব দিলে চেয়ারম্যান রাজি হবে।’
— ‘তাও ঠিক বলছেন। কিন্তু এখন দেখা করা এতো সহজ না। এই মেয়ে বাইরে কোথাও যায় না। বাড়ির ভেতরেও যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু দেখা করে রাজি হইলে কাম সোজা। রাতে কোনোভাবে অন্তরা বের হইলেই নিয়া পালাইবেন। বাঙালী প্রেমিক-প্রেমিকাদের মিলন খুব কম হইছে, যা হইছে তার বেশিরভাগ পালিয়ে। হা-হা-হা।’
— ‘দেখা করার রাস্তা একটা আছে পিয়াস। অন্তরা বাড়ির বাইরে চুলোয় রান্নাবান্না করে। সন্ধ্যায় বাড়ির পেছনের বিল পাড়ি দিতে পারলেই দেখা করা সম্ভব। চেয়ারম্যানও সব সময় বাড়িতে থাকে না। কবরস্থানে খানিকক্ষণ ঘাপটি মেরে বসে পরিবেশ বুঝে নিয়ে তারপর সামনে যাব।’
পিয়াস অদ্ভুত এক নয়নে তাকালো। তার কাছে মনে হলো এই মানুষটি গভীর জলে পড়ে গেছে।
— ‘আপনি কি সন্ধ্যায় বিল পাড়ি দিয়ে কবরস্থানে যেতে পারবেন?’
— ‘হ্যাঁ পারবো।’
— ‘ওখানকার কবরস্থান নিয়ে অনেক জ্বিন ভূতের গল্প কিন্তু শুনেছি।’
— ‘আমি ওসব বিশ্বাস করি না পিয়াস। তুমি কেবল সন্ধ্যায় বিলের পাড়ে নিয়ে দিতে পারবে কি-না সেটা বলো।’
— ‘আপনি তো দেখছি প্রেমে পড়ে হুলস্থুল কাণ্ড। আপনারে সহযোগিতা না করলে নিজেরেই অপরাধী মনে হইব। কোনদিন দেখা করতে চান?’
— ‘আজ সন্ধ্যায়।’
বিলের পাড়ের একটা টিলার ওপর বসে আছে পিয়াস। ঘন অন্ধকার। নিজের হাতও দেখা যাচ্ছে না। আশপাশে ব্যাঙ ডাকছে। দূরে কোথাও শিয়ালের কান্না। তার ঘন ঘন হাই উঠছে। ঘুমে খানিক পর পর ঝিমাচ্ছে। নিজেকে চাঙ্গা রাখার জন্য একটা সিগারেট ধরালো।
জিসান বিল সাঁতরে এখন কিনারায় এসেছে। কিন্তু অন্ধকারে কোথায় এলো ঠিক বুঝতে পারছে না। হাতের মুঠোয় অবশ্য পলিথিন দিয়ে পেঁচানো স্লাইড লাইট ছিল। সাঁতরাতে গিয়ে নিজের অজান্তেই পানিতে পড়ে গেছে। তার টার্গেট ছিল কবরস্থান। কিন্তু এই জায়গাটা মনে হচ্ছে ঝোপঝাড়। অন্ধকারে সাঁতরাতে সাঁতরাতে হয়তো অন্যদিকেই চলে এসেছে। হঠাৎ মাথায় এলো পিয়াসের অবস্থান আন্দাজ করে সনাক্ত করতে পারলেই কবরস্থান কোনদিকে ধরতে পারবে। অন্ধকারে ওপারের চারদিকে তাকাল। হঠাৎ চোখে পড়লো বিন্দুর মতো লাল আলো বাড়ছে কমছে। অন্ধকারে বসে কেউ সিগারেট টানছে। মানুষটি পিয়াসই হবে। বোধহয় উত্তরদিকে অনেক বেশিই চলে এসেছে। লাল বিন্দুকে লক্ষ্য করে কিনারা ধরে হাঁটতে লাগলো৷ হঠাৎ যন্ত্রণায় অস্ফুটে ‘উফ’ করে উঠলো সে। বাম পা বোধহয় কাঁচের কোনো ভাঙা বোতলে পড়ে গেল। অন্ধকারে পায়ে হাত দিতে গিয়ে আঙুলও কেটে গেছে। বসে পড়লো মাটিতে। আন্দাজে টান দিয়ে বের করে দূরে ছুড়ে ফেলল টুকরোটা। মাথা তুলে আবার তাকাল বিলের ওপারে। লাল বিন্দু আর দেখা যাচ্ছে না। তবুও দক্ষিণদিকে হাঁটতে লাগলো পা টেনে টেনে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। বিল সাঁতরেই হাঁপিয়ে গিয়েছিল। এখন আবার পা-হাত কেটে গেছে। ইচ্ছে করছে এখানেই শুয়ে পড়তে। খানিক্ষণ হেঁটে এসে একটা দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেল। হ্যাঁ কবরস্থান। দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে গেল। এপাশ থেকে ওপাশের দেয়ালে চলে গেলে গিয়ে উঁকি দিলেই দেখা যাবে অন্তরার রান্নাঘর। পা টেনে টেনে এগুচ্ছে। হঠাৎ নিচের দিকে চলে গেল কোমর অবধি। হাঁটুতে প্রচন্ড আঘাত পেল। পুরাতন কোনো কবরের বাঁশ ভেঙে বোধহয় নিচে পড়ে গেছে।
–চলবে..
লেখা: জবরুল ইসলাম