আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন পর্ব ১৬

0
275

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
১৬ পর্ব
.
গাছটির নীচেই গুটিশুটি খেয়ে শুয়ে রইল জিসান। সজ্ঞানে আছে। সবকিছু তীক্ষ্ণভাবে খেয়ালও করছে। খুব যে ভয় পাচ্ছে তাও না। কেবল শরীরটা দূর্বল লাগছে৷ কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়ার সময় লাঠিয়ালদের বলেছিল লজিং থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এনে দিতে। তারা সবকিছু একটি ব্যাগে ভরে এনে দিয়েছে। চোখবুঁজে শুয়ে শুয়ে ভাবছে এখন কি করবে। ব্যাগ নিয়ে হাঁটার শক্তি আছে বলে তার মনে হচ্ছে না। শীত শীতও লাগছে ভীষণ। হঠাৎ আলো চোখে লাগায় তাকাল। মেঘাচ্ছন্ন আলো।
— ‘এই মিয়া কে আপনি? কাইপা উঠছি মিয়া। আন্ধারে এভাবে শুইয়া আছেন কেন?’

জিসান মুচকি হেঁসে গাছে হেলান দিয়ে বলল,
–‘বসুন ভাই।’

— ‘বসমু মানে। কে আপনি? নোংরা কাপড়। সাথে গাট্টি একটা। দেইখা তো আবার ভদ্রলোকই মনে হয়, এখানে কি?’

— ‘সেগুলোই বলবো বসুন। ভয় নাই আমি মানুষই।’

লোকটি পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে খানিক দূরে বসলো।

— ‘আশেপাশে কি থাকা-খাওয়ার মতো কোনো বাজার আছে ভাই?’

— ‘না, এইযে বাতি দেখতাছেন এইটা করিমগঞ্জ বাজার। কিন্তু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নাই। আপনি কে? এখানে কি করে আইলেন?’

— ‘বলছি একটা সিগারেট থাকলে দেন।’

— ‘সিগারেট নাই, নাসির বিড়ি আছে চলবো?

— ‘দেন একটা।’

লোকটি বিড়ি দিয়ে বলল,
–‘কন এইবার।’

জিসান বিড়ি ধরিয়ে একটা টান দিয়ে বলল,
— ‘আমি ইলাশগঞ্জ মাদ্রাসার ইংলিশ টিচার। বাড়ি ঢাকা।’

— ‘তাইলে আপনার এই অবস্থা কেন?’

— ‘আমার পায়ের দিকে একটু লাইট দিয়ে দেখান তো।’ লোকটি লাইট মেরে দেখে পায়ের তলা ‘হা’ হয়ে আছে।
— ‘কি মিয়া পায়ের এই অবস্থা কেন?’

— ‘প্রেমিকার সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি, পরিবার রাজি হয়নি। ভাবলাম মেয়ে রাজি হয় কি-না জিজ্ঞেস করে দেখি। রাজি হাইলে পালাবো। কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম। এলাকাবাসী গ্রাম থেকে বের করে দিল, এই আরকি।’

— ‘ও, এই কিচ্ছা। এখন কি করবেন?’

— ‘এখন তো ঢাকায় যাওয়া সম্ভব না। আমি যেতেও চাই না। একটা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হলেই হবে। টাকা-পয়সা যা লাগে দেব। আপাতত নাই৷ কাল ব্যাংকে যেতে পারলেই হবে।’

— ‘আপনি জাতে তো মুসলমান। আমি হিন্দু, তাই বাড়িতে নিয়া খাওন দিতে পারমু না। আমি নাপিত মানুষ। সেলুনের উপরে একটা ছোট্ট ঘর আছে। আমরা তাস-টাস খেলি। আজকে রাত সেইখানে থাকতে পারবেন। ১৫০ টাকা দেওন লাগবো।’

— ‘আপনি আমাকে খাওয়া আর গোসলেরও ব্যবস্থা করে দেন ৫০০ টাকা দেব। সব চাইতে ভালো হয় সপ্তাহ দুয়েক থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলে৷ আপনাকে কালই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অগ্রীম দিয়ে দেব।’

লোকটি মাথা চুলকে বলল,
— ‘কোনো বিপদ-আপদে ফেলবেন না তো আবার?’

— ‘না।’

— ‘তাইলে চলেন। দোকানের উপরে ফ্লোরে থাকতে হইব। আমি বাড়িতে গিয়া খাবার আর বালিশ বিছানা নিয়া আসবো।’

লোকটির পেছনে পা টেনে হাটঁতে হাঁটতে বাজারে এলো জিসান। সেলুনের উপরেই তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল।


কম বয়সের কারণে কি-না কে জানে, জিসানের প্রতি সায়মার ভালো লাগা এখন আর নেই। বেলুনের বাতাসের মতো ভালো লাগা ভালোবাসা ‘ফুস’ করে উড়ে গেছে। গতকাল রাতে তো তার নিজের প্রতিই ঘেন্না হচ্ছিল। এইরকম একটা পাগলের প্রেমে পড়েছিল সে? জানালা দিয়ে বারংবার উঠোনে তাকাচ্ছিল। দাড়ি-গোঁফ লম্বা। বিল সাঁতরে চোরের মতোন দেখা করতে এসেছে। মাটিতে বসে আছে মাথা নীচু করে। কি নগন্য লাগছে দেখতে। ছিঃ ছিঃ তার বুঝি এই লোকটিকে ভালো লেগেছিল৷ সে চুপচাপ উঠে বৈঠকখানায় কান পাতে। ফুফিয়ে ফুফিয়ে কান্না শোনা যাচ্ছে। মুখ ভেঙচিয়ে ‘আহারে মজনুর জন্য লাইলি কাঁদতেছে’ বলে চলে গেল।

গতকাল সারারাতই বৈঠকখানার মেঝেতে পড়ে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেঁদেছে অন্তরা। এই লোকটা তার জন্য এতো কষ্ট করে আসবে কেন? কেন বিপদে পড়লো এসে? দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তো সে বলেছিল চলে যেতে। নিশ্চিত বুঝতে পেরেছিল লোকটি বিপদে পড়বে। এর আগে অন্তরা কখনও ভাবেনি জিসান এতোটাই ভালোবাসে ফেলেছে তাকে। বিয়ের সম্মন্ধ দেবে সেটাও বুঝে উঠতে পারেনি৷ তারপর যখন চাচা জিসানকে প্রত্যাখ্যান করলেন তখন ভেবেছিল জিসান হয়তো ভুলে যাবে তার কথা। ব্যস্ত হয়ে পড়বে অন্যকিছু নিয়ে৷ কিন্তু আজ সে ভিন্ন এক জিসানকে আবিষ্কার করলো। যার ভালোবাসাকে তাচ্ছিল্য করা যায় না। যাকে সে ফিরিয়ে দিতে পারে না। কাঁদতে কাঁদতে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মতোই রান্নাঘরে চলে গেল। মনের সেই তুমুল পরিবর্তন বাইরে প্রকাশ পেল না। বুকের ভেতর আরেকটি মানুষের বসবাস কেউ দেখলো না। সারাক্ষণ চোখের সামনে একটি চেহারাই ভেসেছে। মানুষটার জন্য দুশ্চিন্তা হয়েছে। এখন কোথায় সে? কেমন আছে? আশা ছেড়ে আবার তাকে না নিয়েই ঢাকায় ফিরে যাবে না তো? মনে মনে অপেক্ষা করছিল বক্কর আলীর জন্য। কৌশলে জিজ্ঞেস করে সব জেনে নিতে হবে। কিন্তু বক্কর আলী কাল রাত থেকেই বাড়িতে নাই। খানিক বাদেই তাকে দেখা গেল, ‘তাড়াতাড়ি চা দাও তো বইন গরু নিয়া যেতে হবে।’
তারপর চারদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— ‘কিতা শুনলাম চা’র হোস্টেলে। মাস্টার সাব না-কি রাতে আইসা ধরা পড়ছে। গ্রাম থাইকা না-কি বাইর কইরা করিমগঞ্জ ফেইলা আসছে।’

ধরা পড়ার পর কি হয়েছে অন্তরা সেসবের কিছুই জানে না। গ্রাম থেকে এভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে তাও জানে না৷ ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো কথাটি শুনে। তারপর আস্তে করে বলল,
— ‘জানি না বক্কর ভাই।’

— ‘চা’র হোস্টেলে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এলাকায় কয়েকটা দল হয়ে গেছে। কেউ বলছে তোমার সঙ্গে মাস্টারের কোনো সম্পর্ক ছিল তাই দেখা করতে আইছে৷ মেম্বার আর ময়নুল মাস্টার না-কি বিচার মানতেছে না। তাদের কথা হলো মাদ্রাসার চাকরি গেছে ভালো কথা। রাতে গ্রাম থেকে বাইরে নিয়ে ফেলে আসবে কেন? গ্রাম কি কারও বাপের সম্পত্তি? এই গ্রাম কি বাংলাদেশের বাইরে? এখানে যে-কেউ আসতে পারে। এলাকার কিছু লোক বিগড়ে গেছে। তারা আবার মাস্টারকে খুঁজে ফিরিয়ে আনতে চাইছে। ময়নুল মাস্টারের বাড়ি না-কি সে মেহমান হিসাবে থাকবে। যখন ইচ্ছে হবে তখন চলে যাবে। মানে ক্ষমতার লড়াই আরকি শুরু হইছে বুচ্ছো নি? বর্তমান মেম্বার আর ময়নুল মাস্টার একপক্ষ। তাদের পেছনে আরও লোক আছে। আখলাছুর মিয়া পিয়াসরে ধরে আনার কারণে ময়নুল মাস্টার আরও ক্ষ্যাপছে। তার ছেলেকে হাওর থেকে কেন দৌড়িয়ে ধরে আনা হবে? সে তো কারও বাড়িতে যায়নি? হা হা হা খেলা জমছে বুচ্ছোনি অন্তরা। মাঝখানে মাস্টার সাব ফুটবল।’

এসব শুনে অন্তরার যেন হাত-পা কাঁপছে। এতো বড় ঝামেলার সঙ্গে সেও যে জড়িত বিশ্বাস হচ্ছে না। অস্ফুটে বলল,

— ‘মাস্টারকে কি খোঁজে পাইছে?’

— ‘সকালে পিয়াস গিয়ে খুইজা আইছে, কিন্তু পায়নি। তয় তারা খোঁজাখুঁজির ভেতরেই আছে।’

অন্তরার বুঝতে আর বাকি রইল না৷ লোকটি আশা ছেড়ে ঢাকা চলে গেছে। ভেতরে ভেতরে সে পুরোপুরি ভেঙে গেল। কোনো কাজেই মন বসছিল না। জগত-সংসারের সমস্ত কিছু যেন মিথ্যে। গোসল করা, কাপড় পরা, খাওয়া-ধাওয়া কিছুই ভালো লাগছে না। সবকিছুতেই মনে হচ্ছে লোকটি তো নেই।
কিন্তু বিকেলের দিকে সায়মার ছোট খালারা বেড়াতে এলেন। অন্তরার ব্যস্ততা বেড়ে গেল। তুমুল ব্যস্ততা। তাদের সঙ্গে ছোট্ট একটি মেয়ে৷ পিছু নিয়েছে অন্তরার। সারাক্ষণ লেপ্টে থাকছে৷ তাতে সে মোটেও বিরক্ত না৷ বরং আগ্রহ নিয়েই সঙ্গ দিচ্ছে। রাতে এলো অন্তরার সাথে শুইতে। বাধ্য হয়ে সায়মা যেতে হল অন্যখানে৷ ছোট্ট মেয়েটি অন্তরাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
–‘আফা এখটা গল্ফ খও। আমার দাদুমণি গল্ফ খইয়া ঘুম ফাতাইন।’

অন্তরা বাধ্য হয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে গল্প বলা শুরু করল।

— ‘একজন পুরুষকে স্রষ্টা দুনিয়ায় পাঠানোর আগে বললেন নিজের জীবনের পান্ডুলিপি দেখে যাও। পুরুষটি পুরো জীবনের পান্ডুলিপি দেখতে গিয়ে বিবাহিত জীবনও দেখল। কিন্তু বউয়ের জীবন বৃত্তান্ত দেখে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ বউ তার অলক্ষি-অপেয়া। সে স্রষ্টাকে বলল আমার বউ পাল্টে দেন।
স্রষ্টা রেগে বললেন জীবনের পান্ডুলিপি পরিবর্তন করার নিয়ম নাই। এই জীবন চাইলে দুনিয়ায় যাবে না হলে নাই। পুরুষটির অভিমান ছিল বড্ড বেশি। অভিমান করে বলল আমি যাব না দুনিয়ায়। সে ওপারেই রয়ে গেল৷ দুনিয়ায় আসেনি৷ তাই তার সঙ্গিনী আজও একা। ভীষণ একা। পুরো জীবনই একা কাটিয়ে যেতে হবে। কারণ অপেয়া মেয়েটির ব্যক্তিগত পুরুষকে স্রষ্টা আঁটকে রেখেছেন।’

গল্পটি বলতে বলতে অন্তরার চোখ জলে ভরে গেল৷ পাশের শিশুটি ইতোমধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।

— চলবে..
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here