আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
১৮ পর্ব
.
পিয়াস সকাল দশটার দিকেই কালো লুজ প্যান্টের সঙ্গে সাদা শার্ট পরে চলে এলো ইজাজ মেম্বারের বাড়িতে।
ইজাজ মেম্বার ছাদের ওপরে একটা চেয়ারে বসে আছেন। তার সামনে পা চাটা কুকুরের মতো বসে আছে ফিরোজ মিয়া। একপাশে পিয়াস দাঁড়িয়ে আছে। ইজাজ মেম্বার উকিলের মোবাইল নাম্বার আর ঠিকানা লেখা কাগজের টুকরো পিয়াসকে দিয়ে বললেন, ‘উকিল আমার খাস লোক, গিয়ে নাম কইলেই আলাদা কদর পাবে। যাও চলে যাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
পিয়াস কাগজটা হাতে নিয়ে সালাম করে হাঁটা শুরু করল। ক’দিন থেকে পেটে চিনচিনে ব্যথা করছে। আস্তে আস্তে চাপড় দিলে খানিকটা আরাম লাগে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পেটে আলগোছে ঘুসি দিতে দিতে নেমে গেল৷
পিয়াস ছাদ ত্যাগ করার পরই ইজাজ মেম্বার হাসলেন। তর্জনী থেকে জিভে খানিক চুন নিয়ে বললেন, ‘খেলা জমে গেছে বুইছোনি ফিরোজ।’
— ‘হ মেম্বার সাব।’
— ‘শত্রুদের যুদ্ধ চলছে৷ মাঝখানে আমার রাস্তা ক্লিয়ার। হা-হা-হা।’
— ‘ময়নুল সাব না আপনার পক্ষের লোক?’
ছাদেই ‘ফুরুত’ করে পানের পিক ফেলে বললেন, ‘বালের কথা কইলা ফিরোজ মিয়া। শালার পুত ময়নুলও মেম্বারিতে দাঁড়াতে চাইছিল। এদিকে চেয়ারম্যান সমর্থন দিয়ে আখলাছুরকে দাঁড় করাচ্ছে। এখানে কেউ-ই আমার বন্ধু না। বুঝতে পারছো? পক্ষের ছিল নরায়ণ মাস্টার৷ তারে চেয়ারম্যানিতে দাঁড় করাতে পারলেই খেলা জমে যাইত।’
— ‘হ।’
— ‘যাইহোক ফিরোজ মিয়া। এখন ময়নুল আর চেয়ারম্যান যেহেতু খেলাটা শুরু করছে আমরা একটু নাড়া দিলে কেমন হয়?’
— ‘কীভাবে মেম্বার সাব?’
— ‘এলাকার সব মানুষ জানে জিসান মাস্টারের সঙ্গে চেয়ারম্যান আর আখলাছুরের বিরোধ আছে৷ তারা বিচারের মাধ্যমে এলাকা ছাড়াও করেছিল। এখন যদি জিসানের কিছু হয় দোষটা কোনদিকে যায় বুঝতে পারছো তো।’
— ‘আপনার ম্যালা বুদ্ধি মেম্বার সাব। তাইলে তো খেলা জমে যাবে।’
— ‘হ ফিরোজ মিয়া। এখন কাছে আসো। পোলাপান নিয়ে শুধু কি করতে হবে বলে দেই।’
ফিরোজ মিয়া কাছে গেল। ইজাজ মেম্বার জিসানকে মারার নকশা বুঝিয়ে দিলেন।
দাড়ি-গোঁফ লম্বা হয়ে গেছে। এলেমেলো চুল। অনিদ্রার অভিশাপে চোখের নিচে কালিও পড়েছে। ময়নুল মিয়া হাজতে। পিয়াস থাকে কোর্ট-কাঁসারিতে। জিসান নিজেই সেতারা বেগমকে মাঠে গরু নিতে আনতে সহযোগিতা করে। বাজার-সদাই করে দেয়। মাঝে মাঝে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। কি করবে ভেবে পায় না। মাঝে মাঝে মনে হয় তার জন্যই কি এই সুন্দর সুখী পরিবাটায় কাল বৈশাখী ঝড় এলো? ক’দিন আগে ভেবেছিল ঢাকায় চলে যাবে৷ পরক্ষণেই মনে হলো এই দুঃসময়ে কি তার চলে যাওয়া ঠিক হবে? এই যে বাজার করে দিচ্ছে৷ গরু নেওয়া আনায় সহযোগিতা করছে এরকম ছোটখাটো ব্যাপারে না হয় একটু সহযোগিতা করবে সে। প্রথম কয়েকদিন সেতারা বেগমের সঙ্গে সে গরু নিয়ে যেতো। দু’দিন থেকে সে একাই সবকিছু পারছে। এখন যাচ্ছে গরুকে পানি খাওয়াতে। দুপুরের ঝকঝকে রোদ। আকাশের দিকে তাকালে চোখ পিছলে মাথা নীচু হয়ে যাচ্ছে। রোদের কারণ কি-না কে জানে, তার দাড়িতে এখন খুব চুলকাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে গরুর কাছে এসে একটাকে ডোবায় নিয়ে গেল পানি খাওয়াতে৷ এভাবে সব কয়টাকে পানি খাওয়ানোর পর একটা টিলার উপর থেকে ডাক ভেসে এলো। এতোক্ষণ সে খেয়াল করেনি। তাকিয়ে দেখল টিলার উপরে একজন গাঁজা খাচ্ছে। বাকি দু’জন তাস খেলায় ব্যস্ত। আর কালো করে একজন তাকে ডাকছে। জিসান খানিক এগিয়ে টিলার দিকে মাথা তুলে বলল, ‘কি ভাই?’
— ‘তুমি না মাস্টার। এখন দেখি গরু রাখতেছো কাহিনী কি মিয়া?’ বাকি সবাই হাহাহা করে হেঁসে দিল।
জিসান কোনো কথা না বলে চলে আসছিল। আবার ডাক এলো, ‘অই মিয়া কই যাও।’
জিসান আবার দাঁড়াল। সূর্যের জন্য মাথা তুলে ঢিলার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ওরা গাছের ছায়ায় বসে তাস খেলছে।
— ‘ভাই কিছু বলবেন না-কি?’
— ‘আসো মিয়া তাস খেলি।’
জিসান সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘তাস পারি না ভাই।’
— ‘আরে মিয়া আমরা আছি না। শিখিয়ে দিমুনে আসেন।’
— ‘না ভাই খেলবো না।’ কথাটি বলেই জিসান বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। অন্যদিন সে গরু দিয়ে হাওরে একটু হাঁটাহাঁটি করে। চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে তাকায়। একদিন বিলের পাড়েও চলে গিয়েছিল। গাছগাছালির ফাঁক গলে চোখ গেল চেয়ারম্যানের ছাদে। সেখানে একটি দড়িতে শুকোতে দেওয়া ফিরোজা কালারের ভেজা সেলোয়ার-কামিজ। খুব চেনে সে এই ড্রেস। অন্তরা রোজই পড়তে আসতো ড্রেসটি পরে। বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে রইল ছাদের দিকে। যেন ওই ড্রেসটাই জগতের সব চাইতে সুন্দর দৃশ্য৷ আচ্ছা, অন্তরা কি গোসল করে ফেলেছে? করেছে হয়তো। না হলে তো কাপড় শুকোতে দিতো না।
গরুকে পানি খাওয়ানোর পর ইচ্ছে ছিল বিলের পাড়ে যাওয়ার। কিন্তু গাঁজাখোরদের জন্য আজ আর গেল না। এখন গিয়ে গোসল করবে। ক’দিন হল গোসল করছে না। আসলে কিছুই ভালো লাগে না৷ চুল-দাড়ি কাটা, গোসল, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম এসব আর টানে না। কোনোভাবে কি সুস্থ জীবন-যাপনের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়েছে? মাঝেমধ্যে বাবা-মা ফোন দেন। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে রেখে দেয়। তারা ভাবেন চাকরি-বাকরি করছে, করুক। ব্যস্ত থাকা ভালো। আজ তার বোহেমিয়ান কবি বন্ধুকে ফোন দেবে ভাবছে। সবকিছু বলে পরামর্শ চাইবে। এসব আউলা মানুষ নিজের জন্য নিজে কোনো কাজে না আসলেও অন্যের কাজে দেয়।
সিক্তা জিসানের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। কিন্তু এরপরেই পরিবারের উপর দিয়ে যে ঝড় এসেছে তাতে আর এসব তুচ্ছ বিষয়ে মনযোগ দেয়া যায় না। কিন্তু একটু আগে সেতারা বেগম এসে বললেন, ‘মাস্টার কি কথা কইতে চান আমাদের লগে। তোমার ঘরেই আইতাছেন।’
একটু পরেই জিসান ঘরে ঢুকে। বিস্মিত হয়ে তাকায় সিক্তার দিকে। অনেক মিষ্টি দেখতে। সে চেয়ারে বসে সেতারা বেগমকে বলল, ‘এদিকে বসুন চাচি। পিয়াস থাকলেও ভালো হতো।’
সেতারা বেগম বসলেন। সিক্তাও আগ্রহী হয়ে চেয়ে আছে। দরকারি কথা বোঝা যাচ্ছে। বিপদের সময় লাজ-লজ্জাকে কেউ পাত্তা দেয় না। এসব বিষয় তুচ্ছ হয়ে যায় তখন। সেতারা বেগম বললেন, ‘কও বাজান কি কইতে চাও।’
জিসান চারদিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা চাচি, আপনাদের কি মনে হয় না ময়নুল স্যারকে ফাঁসানোর জন্য এখানে চেয়ারম্যানের হাত আছে।’
— ‘হ বাবা, এই শয়তান আর আখলাছুর মিইল্লাই এগুলা করতাছে।’
— ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে চাচি। আজ আমার এক বন্ধুর সঙ্গে এসব নিয়ে ফোনে কথা বলেছিলাম। তাকে সবকিছু বললাম। শুরু থেকে সব। তার শতভাগ ধারণা অন্তরা মেয়েটি আমার কাছে বিয়ে বসতে রাজি। শুধু তার কাছে পৌঁছানো এবং তার ভেতরে বিশ্বাস আর সাহসই ঢোকানো দরকার। ওর কাছ থেকে আমরা চেয়ারম্যানের বাড়ির ভেতরের খবর জানতে পারবো। শুধু অন্তরাকে বুদ্ধি, সাহস, আর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে তুলতে হবে। আমি যতদূর জানি চেয়ারম্যান আখলাছুরদের নিয়ে পেছনের একটি ঘরে বৈঠক করে। আপনাদের এলাকায় ২০১২ সালে এসেও মানুষ মোবাইলের রেকর্ডিং বিষয়টা সেভাবে জানে না। আমরা যদি অন্তরার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। আর তাকে মোবাইল দিয়ে ফাংশন বুঝিয়ে দেই। তাহলে মনে হয় চেয়ারম্যানের গোপন বৈঠকের কথাবার্তা রেকর্ড করতে পারবে। এখন সমস্যা হলো অন্তরার সঙ্গে দেখা করে এগুলো বুঝিয়ে বলাই মুশকিল।’
— ‘এইটা কি কইরা হয় বাবা৷ চেয়ারম্যানের বাড়ি যাইব কে? কি কইরাই বা যাইব? তাছাড়া অন্তরা মেয়েটি চাচার কাছে সব বইলা দেবে না তার গ্যারান্টি কি?’
— ‘চাচি আমিও জানি না অন্তরার ভেতরে কি চলছে। সে কখনও আমাকে ভালোবাসে বা বিয়ে বসবে বলেনি। কিন্তু বন্ধুটার ধারণা আমার আর অন্তরার মধ্যে বোঝাপড়াটা কেবল হয়নি৷ মেয়েটি বিয়ে বসতে রাজি হওয়ার কথা। যদি তাই-ই হয় অন্তরা আমাদের সহযোগিতা করবে।’
সিক্তা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, ‘আমারও মনে হয় অন্তরা মেয়েটি বিয়ে বসতে রাজি হওয়ার কথা। আর যদি তাই হয় তবে চেয়ারম্যানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে সহযোগিতা করবে। শুধু তার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। সবকিছু বুঝিয়ে বলতে হবে৷ একবার ওর কাছে মোবাইল চলে গেলেই হয়।’
— ‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। সে যদি জানতে পারে কাউকে মিথ্যে খুনের আসামী বানানো হচ্ছে তাহলে গোপনে সহযোগীতা করবে।’
তখনই এক ব্যাংক বীমার মহিলা এসে সেতারা বেগমকে ডাক দিল। সেতারা বেগম চলে গেলেন।
সিক্তা জিসানকে বলল,
— ‘কিন্তু সেখানে যাওয়াটাই তো পসিবল মনে হচ্ছে না।’
— ‘পসিবল না, বাট আমি তো সেখানে ছিলাম। তাই জানি। দিনে চেয়ারম্যান বাড়িতে থাকে না। সায়মা থাকে স্কুলে। ওর মা পঙ্গু। এক ঘরে শুয়ে থাকে। কোনোভাবে ডায়রেক্ট রান্নাঘরে চলে গেলেই অন্তরাকে পেয়ে যাবে। কিন্তু অনেক রিস্ক। হঠাৎ চেয়ারম্যান বা অন্যকেউ পেয়ে গেলে অযুহাত দেখাবে কি?’
সিক্তা কথাগুলো শুনে খানিক্ষণ ভেবে বলল, ‘আপনি যেভাবে বললেন সেরকম যাওয়া পসিবল। শুধু অযুহাত হলেই হয়। কারণ এমনও হতে পারে অন্তরার সঙ্গে কথা বলে চলে আসছি অন্য কেউ দেখেইনি। আর পেলেই শুধু অযুহাত দেখাতে হবে একটা।’
— ‘হ্যাঁ। কিন্তু কীভাবে?’
— ‘আচ্ছা অই যে বীমার মহিলা দেখছেন। নানান বীমা ব্যাংক থেকে ওরা প্রায়ই আসে। অনেকের আবার বোরকা থাকে। তারা সবার বাড়িতেই যায়। আমি যদি বোরকা পরে বীমার মতো কোনো ফাইল নিয়ে ঢুকে পড়ি ভাগ্য ভালো থাকলে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখাই হবে না। পেলে বলবো বীমার মহিলা।’
জিসান খানিক ভেবে বলল, ‘তাহলে তো বীমার মহিলাদেরকে টাকা দিয়েও করা যায়।’
— ‘ওরা করবে কি-না সন্দেহ। কারণ চেয়ারম্যানের বাড়িতে এই কাজ করতে গেলে তাদের চাকুরির ভয় আছে। তাছাড়া রাজি না হলে আমাদের জন্যেও রিস্ক।’
— ‘কিন্তু আপনি কি পারবেন?’
— ‘হ্যাঁ পারবো। আপনার জন্য হলেও আমি কাজটা করতাম। ওর কাছে একবার মোবাইল চলে গেলে আপনাদের গোপনে যোগাযোগ হবে। তাছাড়া এখন বাবাও হাজতে। আমি চেষ্টা করতে চাই। শুধু একটা মোবাইল, চিঠি, আর বীমার নকল ফাইল লাগবে৷ আমি শুধু অন্তরাকে গিয়ে বলবো জিসান ভাই পাঠিয়েছেন। চিঠিটা পড়বে সেখানে উনার নাম্বার সহ বিস্তারিত লেখা আছে। তারপর মোবাইলের ফাংশন দেখিয়ে দিয়ে চলে আসবো।’
— ‘তাহলে পিয়াস বাড়িতে আসুক। আমরা এক সঙ্গে শহরে গিয়ে কাল নিয়ে আসবো।’
তখনই জিসানের ফোনটি বেজে উঠলো। পিয়াসের ফোন।
— ‘হ্যালো পিয়াস, বলো।’
— ‘আসসালামু আলাইকুম। আমি এডভোকেট জহির আকন্দ বলছি। আমার অফিসে এসে পিয়াস হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি মেসেজে হসপিটালের ঠিকানা দিচ্ছি। আপনারা চলে আসুন।’
জিসান ফোন কান থেকে নামিয়ে কি বলবে ভেবে পেল না। সিক্তা তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
—চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম