আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
১৯ পর্ব
.
জিসান কি বলবে ভেবে পেল না৷ এরিমধ্যে সেতারা বেগমও ফিরে আসলেন।
সিক্তা প্রশ্ন করল,
— ‘কার ফোন ছিল?’
জিসান একবার ভাবছে তাদেরকে না বলেই সে একা চলে যাবে। আবার ভাবছে এটা কি ঠিক হবে? আমতা-আমতা করে বলেই ফেলল, ‘এডভোকেট একজনের সঙ্গে পিয়াস মনে হয় দেখা করতে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এখন সদর হাসপাতালে আছে।’
সেতারা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়লেন৷ সিক্তা নিজেকে সামলে বলল, ‘ঠিকানা দিয়েছে তো। চলুন যাব।’
– ‘আন্টি কি বাড়িতে থাকবেন?’
– ‘হ্যাঁ, উনি বাড়িতেই থাকতে হবে। সবাই গেলে তো হবে না।’
তারা গিয়ে পৌঁছাল রাত দশটার দিকে। পিয়াসের এপেন্ডিসাইটিসের ব্যথায় ধরেছে। বেশ কিছুদিন যাবত তার পেট ব্যথা করতো। ততটা আমলে নেয়নি। আজ সকাল থেকেই চিনচিনে ব্যথা করছিল। এডভোকেটের এখানে ছটফট করতে থাকে৷ অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি নিজেই হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ডাক্তার জানায় দ্রুত অপারেশন করাতে হবে। টাকা পনেরো হাজার লাগবে। সিক্তার বা পিয়াসের সঙ্গে এতো টাকা নেই। জিসান যেখানেই যায় তার সঙ্গে একটা ব্যাগ থাকে৷ সেখানে প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়েই বের হয়। সবকিছু মিলিয়ে এতো টাকা তার কাছেও হলো না। কর্তৃপক্ষকে জানালো কাল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে দিতে পারবে। আর এখন চাইলে চেকে নিতে হবে। পিয়াসের অপারেশনের ব্যবস্থা হয়।
বেশ কয়েকদিন পর তারা বাড়ি ফিরে। আরও আগেই আসা যেতো৷ লঞ্চ থেকে নেমে হাঁটার রাস্তা তাই পুরোপুরি সেরে উঠার অপেক্ষা করতে হয়েছে। জিসান এই সুযোগে শহর ঘুরে একটা মোবাইল, সিম, ব্যাংক বীমার নকল ফাইল বানিয়ে ফেলেছে।
ময়নুল সাহেবের মামলা চলছে। তদন্তকারী পুলিশ প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, ‘সেদিন রাতে নারায়ণ মাস্টারকে দাওয়াতে নিয়ে কীভাবে মেরেছিল। কারা কারা সঙ্গে ছিল।’
ময়নুল মাস্টার শত প্রহারের পরও বারংবার একটা কথাই বলেন, ‘আমি এসবের কিছুই জানি না। নারায়ণ মাস্টারের দাওয়াতই আমার বাড়ি ছিল না। রাতে উনি আমার এখানে যাননি।’
পুলিশ আরও কয়েকটা মাইর দিয়ে বলে, ‘নারায়ণের বাড়ির কাজের মহিলা বলছে তোর বাড়িতে দাওয়াত ছিল। তাছাড়া বাড়িতে যেতেও দেখেছিল পাশের বাড়ির রইসু মিয়া।’
ময়নুল মাস্টার ভাবলেশহীনভাবে বলেন, ‘এটা মিথ্যে মামলা। সবকিছু সাজানো।’
পিয়াস আর সিক্তাকে হসপিটাল রেখে জিসান একদিন দেখা করতে গিয়েছিল ময়নুল সাহেবের সঙ্গে। অল্প কয়দিনে বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে মানুষটার। চেহারায় হঠাৎ মনে হয় ডর-ভয়ের কোনো ছাপ নেই। আবার হঠাৎ যেন ভয়ের ছায়া স্পষ্ট হয়।
ময়নুল সাহেব একবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাড়ির সবাই কেমন আছে মাস্টার?’
জিসান উত্তরে বলেছে, ‘ভালোই আছে সবাই। পিয়াস চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করছে।’
পিয়াসের অপারেশনের কথাটি এড়িয়ে যায় জিসান।
— ‘ওদেরকে বলবেন আমার কথা চিন্তা না করতে। আল্লাহ পাক যা ভালো মনে করেন তাই হবে।’
জিসান সেখান থেকে এসে আবার এডভোকেট জহির আকন্দের সঙ্গে দেখা করতে যায়।
মামলা পরিচালনা করছেন ইজাজ মেম্বারের খাস উকিল জহির আকন্দ। উনি খবু বেশি আশ্বাস দিলেন না জিসানকে। তর্জনী দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে বলেন, ‘ওদের কাছে খুনের মোটিভ আছে ফার্মেসি ব্যবসা আর টিউশনি। এদিকে কাজের মহিলা সাক্ষী দিয়েছে ময়নুল সাহেবের বাড়িতে দাওয়াত ছিল। পাশের বাড়ির একজনও দেখেছে। লাশও পেয়েছে আবার উনারই পরিত্যক্ত বাড়িতে। কেবল খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নাই। মামলাটি খুব জটিল হয়ে পড়েছে৷ ফাঁকফোকর কম।’
রাতের খাবার খেয়ে পিয়াসের রুমে বসে তারা। পিয়াস বিছানায় শুয়ে আছে৷ মাথার কাছে সিক্তা বসা। সেতারা বেগম আরেকপাশে।
জিসান চিন্তিত ভঙ্গিতে সবকিছু বলল। ময়নুল সাহেবের সঙ্গে দেখা এবং উকিলের বক্তব্য।
তারপর বলল, ‘এখন আমাদের ভরসা হচ্ছে অন্তরা। প্রমাণ করতে হবে এটা মিথ্যে মামলা। সবকিছু সাজানো। আমার মনে হয় এতো বড় একটা মিথ্যে মামলা যারা সাজিয়েছে তারা প্রতিদিন এগুলো নিয়ে বৈঠক করবে৷ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে। তাই কালই সিক্তা দুপুরের সময় চলে যাও।’
তারপর সে মোবাইল, বীমার ফাইল দিল।
পিয়াস এসবের কিছুই জানে না। সে অবাক হয়ে বলল, ‘কি এগুলো?’
সিক্তা মাথায় হাত রেখে বলল, ‘পরে বলবো সব।’
জিসান বলল, ‘আপনি শুধু মোবাইল হাতে দিয়ে বলবেন জিসান ভাই পাঠিয়েছে। চিঠিতে নাম্বার সহ বিস্তারিত লেখা আছে৷ আর সে ছাদে গিয়ে সতর্কভাবে ফোন দিবে। মোবাইলের রেকর্ডের আর ফোন দেওয়া শিখিয়ে চলে আসবে। আমাকে কল দিলেই বাকিটা আমি বুঝিয়ে দেব।’
— ‘আচ্ছা ভাই। এখন আপনি গিয়ে ঘুমান। কয়েকদিন ঘুম হয়নি। আর আপনার টাকাটা দিতে ক’দিন দেরি হতে পারে।’
জিসানের ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। নিজের রুমে এসে শরীরটা বিছানায় হেলিয়ে দিতেই ঘুমে চোখের পাতা বুঁজে এলো৷ তখনই মনে পড়লো তার ব্যাগ পিয়াসদের রুমে ফেলে এসেছে৷ সেখানে মোবাইল মানিব্যাগ সহ প্রয়োজনীয় সবকিছু৷ একবার মনে হলো গিয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলসেমির কারণে গেল না৷ খানিক বাদেই গভীর ঘুম নেমে এলো চোখে।
রাত তখন প্রায় দু’টা৷ একদল মুখোশধারী
ইজাজ মেম্বারের বাড়ি থেকে বের হলো। একজনের হাতে কেরোসিনের ড্রাম। তারা হাওরের রাস্তা দিয়ে এসে উঠলো ময়নুল সাহেবের বাড়িতে। কয়েকজন তাদের সবজি বাগানের সবকিছু কেটে ফালাফালা করে ফেলল প্রথমে। একজন আস্তে করে জিসানের ঘরের দরজার ছিটকিনিটা বাইরে থেকে তুলে দিল। অন্যজন কেরোসিন ছিটিয়ে দিল চারদিকে। একজন মশালে লাইটার দিয়ে আগুন নিয়ে জিসানের ঘরে ধরে রাখল। খানিক বাদেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন।
জিসান গুটিশুটি খেয়ে ঘুমোচ্ছে৷ স্বপ্নে দেখছে সে আর অন্তরা এখন একটা জঙ্গলে। কনকনে শীতের রাত। একই চাদর জড়িয়ে দু’জন বসে আছে তাঁবুর ভেতর। বাইরে মশাল জ্বলছে। অন্তরা সেদিকে তাকিয়ে আছে। জিসান ওর পেটের দিকে দুহাত পেঁচিয়ে কোলে নিয়ে বসে আছে৷ মাঝে মাঝে পিঠে মুখ ঘষছে৷ কখনও চুলে নাক ডোবাচ্ছে। হঠাৎ দুষ্টুমি করে ঠান্ডা হাতে কাতুকুতু দিল। অন্তরা লাফ দিয়ে উঠে। স্বপ্নদৃশ্য পাল্টে যায়। দু’জন মশালের কাছে গিয়ে আগুন পোহাচ্ছে। জিসানের মনে হল তার যেন গা পুড়ে যাচ্ছে৷ ধীরে ধীরে অসহ্য হয়ে উঠলো। সে মশালের কাছ থেকে সরে যাবে কিন্তু অন্তরা ছাড়ছে না। হেঁচকা টানে নিজেকে ছাড়াতে যাবে তখনই পাশের ঘরের ছাগলের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল৷ চোখ মেলে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে গেল। চারদিকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের তাপে তার শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে। লাফ দিয়ে উঠলো বিছানা থেকে। দরজার ছিটকিনি খুলে টান দিতেই দেখে খুলছে না।
.
— চলবে..
লেখা: জবরুল ইসলাম