আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন পর্ব ২০

0
400

 

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
২০ পর্ব
.
চারদিকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে।আগুনের তাপে যেন শরীর পুড়ে যাচ্ছে। জিসান লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে। দরজার ছিটকিনি নামিয়ে টান দিতেই দেখে খুলছে না। পাশের ঘরে গরু-ছাগল ডাকতে শুরু করেছে। বিছানার ওদিকে টিন ধসে পড়ার আওয়াজ হলো। চোখের পলকে আগুন ধরে গেল চাদরে। পাশের ঘরের অস্থির একটা গরু বাঁধন ছিঁড়ে ছিটকে এসে পড়লো মাঝের লিকলিকে টিনের বেড়ায়। একপাশের টিন ভেঙে এসে লাগে জিসানের পায়ে। কেটে গেল কি-না কে জানে৷ সেদিকে তাকানোর সময় নেই। সে ভাঙা বেড়া দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল গরু ঘরে। ছিটকিনি নামিয়ে টান দিতেই দরজা খুলে গেল। ততক্ষণে গরু-ছাগলের ডাকে সেতারা বেগম আর সিক্তারও ঘুম ভেঙে গেছে। সবাই উঠোনে বের হয়ে এলেন। সেতারা বেগম আর সিক্তা চাপাকল থেকে পানি মারতে লাগল। জিসান বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছে না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে কি দেখছে সে? যেন কোনো স্বপ্ন দৃশ্য। হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে হাঁপাতে লাগলো। ছাগলের ডাক কানে আসায় দাঁড়িয়ে গেল। সাহস করে আবার গরু ঘরে ঢুকে পড়ে। উপরের টিন এবং বেড়া ভেঙে পড়া শুরু হয়েছে। আগুনের তাপে শরীর পুড়ে যাবার যোগাড়। তাড়াতাড়ি গরু-ছাগলের বাঁধন খুলে বাইরে নিয়ে এলো সে। ছিটকে পড়া গরুটি ছাড়া বাকী সব রক্ষা পেয়েছে। ইতোমধ্যে আশেপাশের লোকজনও জড়ো হয়ে গেছে। সবাই চাপাকল এবং পুকুর থেকে পানি মেরেও আগুন নেভাতে পারেনি৷ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সবকিছু। খবর পেয়ে এলেন ইজাজ মেম্বারও। তাকে খুব অস্থির দেখালো, পাড়ার লোকজনকে ডেকে নিয়ে বললেন ‘এরা মানুষ না-কি পশু দেখেন তো। এইযে সবজি বাগানের এই অবস্থা। বুঝাই যাচ্ছে দুশমনের দল বাড়িতে আগুন ধরিয়ে মাস্টারকে মারতে চাইছিল।’
ইজাজ মেম্বারের সঙ্গে সবাই একমত পোষণ করে। জিসানও জানালো তার দরজা বাইরে থেকে আটকানো ছিল। সুতরাং জিসানের কোনো ত্রুটিতে যে অগ্নিকাণ্ড হয়নি স্পষ্ট।
ইজাজ মেম্বার ভোরেই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করার পরামর্শ দিয়ে গেলেন পিয়াসকে। কিন্তু এ বাড়ির কারও কাছে সবজি বাগান কিংবা ঘর নিয়ে আফসোস করতে দেখা গেল না। কারও প্রতি মামলা করার মতো ক্ষোভও দেখা গেল না। তারা বরং আল্লাহ পাকের কাছে অশেষ শুকরিয়া জানাচ্ছে জিসানের কিছু না হওয়ায়। সিক্তা কাঁদছে। ভয়ে কাঁদছে কি-না জানার জন্য কেউ ঘাঁটাতে গেল না।
….

অন্তরা চা বসিয়েছে। সকালে বাইরে রাঁধতে এলে মনটা হালকা হয়ে যায়। এদিক-সেদিকে পাখি ডাকে। এখন চুলোর সামনের একটা ছোট্ট আমগাছে বসে বুলবুলি ডাকছে। ছোটবেলায় বুলবুলিকে দেখলে সুর দিয়ে, ‘বুলবুলি তর পুটকি কেনে লাল..’ বলার অঘোষিত নিয়ম ছিল।
কথাটি মনে পড়ায় সে মুচকি হাসলো। মাঝেমাঝে মন ভালো করার কিছু উপাদান খুঁজে পায়, পরক্ষণেই জিসানের জন্য বুকের বিষাদ সমুদ্রে যেন ঢেউ উঠে৷ ইচ্ছে করে সবকিছু ভেঙেচুরে ওর কাছে ছুটে যেতে। বক্কর ভাইয়ের কাছে শুনেছে জিসান এখন ময়নুল সাহেবের বাড়িতে থাকে। অন্তরা নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যায় না। এই লোকটাকে সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না৷ চাচা যা বলেন সবই তার কর্ম।
হঠাৎ শুনতে পেল চেয়ারম্যান ছাদে কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন। একটা কথা শুনে অন্তরার পিলে চমকে উঠলো, ‘আখলাছুর খবর পাইছ? ইজাজ মেম্বার লোকজন ডাইকা না-কি বলতাছে আমরা জিসান মাস্টারের ঘরে আগুন দিছি।’

কথাটি শুনে অন্তরার বুক ধুকপুক করছে৷ কান দিয়ে যেন গরম বাতাস বেরুচ্ছে। কি শুনলো সে? জিসানের কি কিছু হয়েছে? কীভাবে খবরটা জানবে এখন? অন্তরা কান পেতে দাঁড়াল। চাচার আর কথা শোনা যাচ্ছে না।
তখনই এলো বক্কর আলী। রোজকার মতো খাট টেনে চুলোর কাছে বসে বলল, ‘আইজ কি হইছে জানো? কারা জানি মাস্টারের দরজা বাইরে থাইকা বন্ধ করে আগুন লাগিয়ে দিছে।’

— ‘তারপর কি হইছে? মাস্টার এখন কেমন আছেন?’

— ‘আল্লা পাকের রহমতে ভালাই আছে।’

— ‘ও আচ্ছা।’

— ‘বইন তুমি ভয় পাইছিলা মনে হইল।’

— ‘তা তো সবাই-ই পাবে বক্কর ভাই। কারও ঘরে আগুন লাগছে শুনলে কি ভয় পাবে না?’

— ‘তাও ঠিক বইলছো।’

বক্কর আলীকে চা দিল অন্তরা। তারপর নিয়ে গেল চাচি এবং সায়মার জন্য। খানিক পর বক্কর আলী চলে গেল বাইরে। সায়মা ঘন্টা খানেক পর গেল স্কুলে।
তখন দুপুর। রাশেদা বেগম ঘুমাচ্ছেন। অন্তরা রান্নাঘরে টুকটাক কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ রান্না ঘরে একজন বোরকা পরিহিতা দেখে চমকে উঠলো সে।
— ‘আপনি কি অন্তরা?’

— ‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?’

সিক্তা নেকাব তুলে বলল, ‘আমাকে জিসান ভাই পাঠিয়েছে চুপচাপ আমার কথা শুনেন। এই চিঠি রাখেন। এখানে ভাইয়ের নাম্বার আছে। এই নেন মোবাইল। লুকিয়ে রাখবেন। চিঠি থেকে এভাবে নাম্বার তুলে কল দিবেন। আর মোবাইল দিয়ে এখানে গিয়ে রেকর্ডিং করতে হয়। এই দেখেন রেকর্ড করবে কীভাবে..এইতো হচ্ছে.।’

অন্তরা বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছে৷ ভয়ে তার শরীর কাঁপছে।

— ‘বুঝতে পারছেন সবকিছু? আমার তাড়াতাড়ি যেতে হবে শাশুড়ি অপেক্ষায় আছেন।’

— ‘হ্যাঁ বুঝতে পারছি৷ আপনি তাড়াতাড়ি যান কেউ দেখে ফেলতে পারে।’

সিক্তা হাত বাড়িয়ে গাল টিপে বলল, ‘অনেক মিষ্টি আছেন দেখতে। কিন্তু বোকা মেয়ে।’ তারপর নেকাব নামিয়ে বেরিয়ে গেল সিক্তা। অন্তরা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর তাড়াতাড়ি মোবাইল লুকিয়ে রাখলো রান্নাঘরে। চিঠি নিয়ে ঢুকে গেল বাথরুমে। গোটা গোটা অক্ষরে অনেক লম্বা চিঠি।
“অন্তরা চিঠিটা মনযোগ দিয়ে পড়ো। তুমি কেমন আছো আমি জিজ্ঞেস করবো না। কারণ তুমি ভালো কি-না সেটা বুঝার ক্ষমতা তোমার নেই। তুমি একটা পাগল, ছাগল মেয়ে। না, তুমি পাগল ছাগলও না। গতকাল ঘরে আগুন লাগায় ছাগলও বাঁচার জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করেছে। তুমি চিৎকার করো না। তোমার কাছে মনে হয় এটাই জীবন। কাউকে যদি জন্মের পর থেকে একটা অন্ধকার ঘরে বন্দী করে রাখা হয়। তারপর একটা সময় গিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়। আচ্ছা তুমি যে ভোর-সন্ধ্য, আলো, বাতাস, নদী, গাছগাছালি, পাখির ডাক, সমুদ্র, চাঁদ-সূর্য কখনও দেখোনি? তোমার কি দুঃখ হয় না?
সে বলবে এগুলো কি? দেখতে কেমন? তার আসলেই কষ্ট হবে না। কারণ এসবের অভাববোধ করতে পারেনি। এগুলো স্বাদ, সৌন্দর্য কিছুই সে জানে না। তার কাছে ঐ অন্ধকারই জীবন। উদাহরণটা পুরোপুরি তোমার সঙ্গে মিলেনি। তবুও খানিকটা এরকমই। আচ্ছা, এসব থাক। তুমি বলো তো আমার কাছে বিয়ে বসতে রাজি হবে না কেন? আমার এক কবি বন্ধুকে সবকিছু বললাম। সে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছে তুমি পাগল না হলে রাজি হওয়ার কথা। চেয়ারম্যান যেহেতু তোমাকে বিয়ে দিতে চায় না। যেদিকে সুযোগ পাও চলে যাওয়ার কথা। পুরুষ সঙ্গ কি এতো ফেলনা? জগতে অসংখ্য পুরুষ আছে বিয়ে করতে চায় না। অসংখ্য পুরুষ আছে করেও না। নায়ক, গায়ক, কবি-সাহিত্যিক অসংখ্য অবিবাহিত পাবে। কিন্তু সব মেয়েই মোটামুটি বিয়ের জন্য পাগল৷ অথচ বিয়ের পর মেয়েদেরই জীবন আর জীবন থাকে না। ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে যায়। দিনেও কাজ, রাতেও কাজ। এদিকে বাচ্চা হয়ে গেলে তো জীবন তেজপাতা।
আচ্ছা তাই বলে তুমি ভয় পেও না। একবার আমার সঙ্গে পালিয়ে দেখো। একবার শুধু বিয়ে বসে দেখো, তুমি নিজেকে বকা দিবে। ভাববে একটুর জন্য বোকামি করে মানুষটাকে হারাচ্ছিলাম।

এখন জরুরী কথায় আসি। নারায়ণ মাস্টারের খুনের আসামীতে ময়নুল সাহেব হাজতে আছে। বেচারার পরিবারের দিশেহারা অবস্থা৷ একমাত্র ছেলের কয়েকদিন আগে অপারেশন হয়েছে। যে মেয়ে তোমার কাছে চিঠি আর মোবাইল দিয়েছে ওর নাম সিক্তা। ভারী মিষ্টি মেয়ে। ও হচ্ছে ময়নুল সাহেবের ছেলে বউ। সবাই খুব বিপদে আছে। এদিকে আমার ঘরেও আগুন দিয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছে। সবাই ভাবছে তোমার চাচাই এসবে জড়িত। এখন ভাবো তো তোমার চাচা কাউকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিতে ঝুলাইবেন তুমি কি মেনে নিতে পারবে? সুতরাং তুমি শুধু পরীক্ষা করে দেখো তোমার চাচা এগুলো করাচ্ছেন কি-না। বৈঠক খানার সব কথা কয়েকদিন রেকর্ড করতে পারলেই কোনো সুত্র পেয়ে যাবে। বাকি কথা ফোনেই বলবো। তুমি সময় সুযোগ বুঝে কল দিও। মোবাইল লুকিয়ে রাখবে। আমি কখনও কল দেবো না। শেষ কথা বলি। যদি তুমি আমাকে চাও। তাহলে এখন আর ভয় নেই তোমার। কারণ মোবাইল যেহেতু তোমার হাতের মুঠোয় আছে। যেকোনো সময় তোমাকে নিয়ে পালাতে পারবো। তারপর তুমি মুক্ত বিহঙ্গ। আচ্ছা মুক্ত বিহঙ্গের কাহিনী তোমাকে কি বলেছিলাম? স্বপ্নে দেখেছিলাম, তুমি মুক্ত বিহঙ্গ হতে চাও। আচ্ছা ভালো থেকো৷ তুমি চাইলে ফোনে কথা হবে।’

চিঠিটা অন্তরা কয়েকবার পড়লো। তার এতো ভালো লাগছে, এতো ভালো লাগছে। চিঠি পড়াতেই যেন জীবনের সকল সুখ লুকিয়ে আছে। কেমন পাগলাটে কথাবার্তা৷ বারবার হাসি পাচ্ছিল তার। চোখবুঁজে চিঠিখানা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে খানিক্ষণ বাথরুমে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ভেতর কেমন ওম। কেউ যেন উষ্ণ ছোঁয়াতে তাকে আজ পুর্ণাঙ্গ নারী করে তুলেছে।
… চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here