- আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
৬ম পর্ব
.
অন্তরাকে কলতলায় পাওয়া গেল। হারিকেনের হলদে আলোয় ভাতের চাল ধুচ্ছে।
সায়মা সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এসে এখন খানিকটা হাঁপাচ্ছে। তবুও বুকের ভেতর কেমন জানি ওম।
সে আদুরে গলায় বলল,
– ‘আপু তাড়াতাড়ি হাতটি ধৌ তো।’– ‘খেনে?’
– ‘প্লিজ তাড়াতাড়ি ধৌ।’
অন্তরা হাত ধুয়ে দাঁড়াতেই শক্ত করে জড়িয়ে সমস্ত মুখে চুমু দিয়ে বলল,
-‘তুমি আমার লক্ষী সোনা আপু।’অন্তরা মুচকি হেঁসে বলল,
– ‘কিতা অইছে হঠাৎ?’– ‘জিসান আমার প্রেমে পড়ে গেছে। এখন কে সাজিয়ে দিছে তাকে দেখতে চাইছে আপু।’
অন্তরা নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,
– ‘আমারে খেনে দেখতে চাইছে?’– ‘তোমার অনেক প্রশংসা করছে আপু। রান্না, কোরআন তেলাওয়াত। এখন যে সাজগোজও করিয়ে দিলে তাই আমার গুণবতী বোনটিকে দেখতে চায়।’
– ‘আমি যাইতাম নায়। এরমাঝে চাচা-চাচী হুনলে কিতা খান্ড অইব জান তো।’
– ‘কিচ্ছু হবে না আপু চল।’
কথাটি বলে সায়মা টানতে লাগল।অন্তরা কোনোভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,
-‘ওলাখান যাইতামনি আমি?’– ‘হাত-মুখ ধুয়ে চুল ঠিক করে নাও। ড্রেস এটাই থাকুক, জিসান অপেক্ষা করছে।’
অন্তরা হাত-মুখ ধুয়ে চুলগুলো হাত দিয়ে খানিকটা ঠিকঠাক করে নেয়। রুম থেকে বড় একটি কালো ওড়না দিয়ে মাথা থেকে বুক অবধি পেচাঁয়। সাময়ার পেছনে পা টিপে টিপে হাঁটে। চিলেকোঠার পাশের ছোট্ট রুমের সামনে দাঁড়ায় তারা। সায়মা দরজা খুলে বলল, ‘নিয়ে আসছি।’
অন্তরা থুতনি বুকের সঙ্গে লাগিয়ে মাথা নীচু করে প্রবেশ করে রুমে।প্রথম দর্শনেই জিসানের কাছে অন্তরাকে কাজের মেয়ে মনে হল না। তবুও কথোপকথন শুরু করল কাজের মেয়ে হিসেবেই।
– ‘আরে লজ্জা পাচ্ছ কেন৷ সায়মার সঙ্গে ওখানে বস।’অন্তরা বিব্রতকর ভঙ্গিতে বসল।
– ‘আপনার রান্নার ভক্ত হয়ে গেছি। তা বাড়ি কি এই গ্রামেই? ভাইবোন কয়জন আপনারা?’– ‘ভাইবোন নেই।’
– ‘ও আপনি একা। এ বাড়িতে কতদিন থেকে কাজ করেন?’
আহত, বিস্মিত নয়নে এই প্রথম জিসানের দিকে মাথা তুলে তাকাল অন্তরা। নিজের এই পরিচয় সে জানতো না। চাচার বাসাকে সে নিজের বাসাই এতকাল মনে করে এসেছে। লোকটি কি তাকে এ বাড়ির কাজের মেয়ে ভাবছে? না-কি সত্যিই সে কাজের মেয়ে?
অন্তরা আবার থুতনি বুকের সঙ্গে লাগিয়ে মাথা নীচু করে উত্তর দেয়,
– ‘ফুরু তাকি।’ ( ছোট থেকে )
চোখ থেকে একফোঁটা জল নিজের অজান্তেই টপ করে পড়ে গেল৷ অন্তরা নিজেকে সামলাতে পারবে না বুঝে আচমকাই উঠে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
জিসান বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কি করবে বুঝতে পারে না।
– ‘সায়মা কি হল মেয়েটার? কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল মনে হচ্ছে। আমি কি ভুল কিছু বলে ফেললাম?’– ‘বুঝতে পারছি না। আচ্ছা বাদ দিন স্যার আমরা পড়ার টেবিলে বসি।’
– ‘আরে কি বল বাদ দেব! কিছু একটা ভুল হয়েছে। মেয়েটি আচমকা কেঁদে চলে যাবে কেন?’
– ‘আচ্ছা আমি গিয়ে দেখছি।’
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিচে গেল সায়মা। সে ভালো করেই বুঝেছে কাজের মেয়ে বলায় অন্তরা এমন করেছে। রুমে গিয়ে দেখল অন্তরা উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে আছে। সায়মা আচমকা চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে গালে চড়-থাপ্পড় মেরে বলল, -‘চিলানের ফুরি তুই হঠাৎ আইলে কেনে?জবাব দে কেন অইলে?’
– ‘আশ্চর্য! তুমি মেয়েটিকে এভাবে মারছো কেন সায়মা? কাজের মেয়ে হলেও তোমার বয়সে বড় হবে সে।’
আঁতকে উঠল সায়মা। জিসানের হঠাৎ মনে হয়েছিল সে নিজেই জিজ্ঞেস করে যাবে হঠাৎ কেন কাঁদতে কাঁদতে চলে এলো অন্তরা। কিন্তু এখানে এসে এমন একটি দৃশ্য দেখবে সে কখনও ভাবেনি।
সায়মা আমতা-আমতা করে বলল,
–‘স্যার আপনি এখানে!’ তারপর থুতনি বুকে লাগিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
অন্তরা লজ্জায় মুখ ঢেকে কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল৷ জিসান অনেকটা সরল মনেই হাত টেনে সরাল।
তাকিয়ে দেখল ফরসা গাল লাল হয়ে আছে। কপালেও একটি কালো দাগ। গলার চামড়াও অনেকটা জ্বলে যাবার মতন কুঁচকে আছে৷
– ‘আপনার কপালে এটা কিসের দাগ?’অন্তরা কোনো জবাব দিল না।
– ‘আর গলায় কি হয়েছে।’
অন্তরা হাত ছাড়িয়ে উপুড় হয়ে বিছানায় পড়ে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে থাকে। জিসান কি করবে ভেবে পেল না। সে কেবল ‘ছি সায়মা’ বলে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
—
রোজকার মতো জিসানকে ফজরের নামাজে ডেকে নিলেন ইমরাজ চেয়ারম্যান। নামাজ শেষে দেখা হল বক্কর আলীর সঙ্গে।
– ‘বক্কর ভাই কি অবস্থা?’– ‘আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতে ভালা আছি মাস্টার সাব।’
– ‘আজ বেশ ভোরেই গরু নিয়ে যাচ্ছ মনে হচ্ছে?’
– ‘অয় ভোরেই যাচ্ছি। দেরিতে গেলে ভালা ঘাসে গরু দেওয়ার যায়গা মিলে না।’
– ‘ও আচ্ছা, চল আজ তোমার সঙ্গে মাঠে যাব। সকালে হাঁটাচলা সাস্থ্যের জন্য ভালো।’
– ‘আইচ্ছা চলেন।’
জিসানের মাথায় কাল সন্ধ্যার পর থেকেই কাজের মেয়েটির চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এই মেয়ের ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছে না সে৷ সায়মা এই মেয়েকে মারবে কেন? আর মারলেই এখানে পড়ে থাকবে কেন?
কোনো কৌশলে সে বক্কর আলীকে সব জিজ্ঞেস করার সুযোগ খুঁজছে।মাঠ থেকে ফেরার পথে জিসান বলল,
– ‘বক্কর ভাই চলুন টং দোকানে চা-টা খাই।’– ‘আচ্ছা চলেন।’
চা খাওয়ার পর দোকানীকে বলল,
-‘বক্কর ভাইকে পান সিগারেট দেন।’পান মুখে পুরে সিগারেটে একটা টান দিতেই বক্কর আলীর মনটা ভালো হয়ে গেল।
আপন মনে ভাবল,
– ‘মাস্টার সাব আসলেই খুব ভালা মানুষ৷ গরান আর টাকা চুরি করা ঠিক হয়নি।’– ‘বক্কর ভাই মাঠে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি।’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল বক্কর। দু’জন বসল গিয়ে একটি ছোট্ট আইলে।
জিসান আমতা-আমতা করে বলল,
– ‘বক্কর ভাই প্রতি শুক্রবার ভোরে যার কোরআন তেলাওয়াত শুনি সে কে? তাকে তো কখনও দেখি না।’– ‘চেয়ারম্যান সাবের বড় ভাইয়ের মাইয়া।’
আঁতকে উঠল জিসান,
– ‘হোয়াট! মানে মেয়েটি সায়মার বড় চাচার মেয়ে?’– ‘হ।’
– ‘আপন চাচাতো বোন?’– ‘হে আফন।’
– ‘তাহলে সায়মা যে বলল…।
আঁটকে গেল জিসান। কি বলবে ভেবে পেল না। আপন চাচাতো বোনকে কেন কাজের মেয়ে বলবে? আর মাইর খেয়েও পড়ে থাকবে কেন মেয়েটি?– ‘আইচ্ছা তাইলে মেয়েটির বাবা-মা কোথায়?’
– ‘জানি না। খালি জানি বড়ই দুঃখিনী মাইয়া৷ এখদিন সখালে সায়মার মা ডেকেছিলেন অন্তরাকে। রান্নাঘরে থাকায় হুনেনি। হেশখালে সামনে আসায় সুপারি কাটনি ছুড়ে মারল সায়মার মা। গিয়ে পড়লো অন্তরার হাঁটুর নীচে। ফিনকি দিয়া রক্ত বারইল। বেদনায় চিৎকার দিয়া উঠলো মাইয়া। চেয়ারম্যান সাব হেবেদায় ফজরের নামাজ ফইড়া ঘুমাইছে। চিৎকারে ঘুম ভাইঙ্গা যাওনে আইয়া যা মাইর মারল মাইয়াটারে।’
জিসানের চোখটি জলে ভরে এলো। সামনের পুরো মাঠ কুয়াশার মতন ঝাপসা লাগছে। ভোরের কোমল সূর্যের আলোকে ছোট্ট একটি গাছ ভেঙে টুকরো টুকরো করে তাদের পায়ের সামনে ফেলেছে। ঢালে বসা কাককে কয়েকটি কালো ফিঙে বারংবার ঠুকর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
না তবুও চোখের জল আটকাতে পারলো না জিসান। চোখ ফেটে বেরুলো। পুরুষ মানুষের চোখের জলের মতন বেমানান দৃষ্টিকটু দৃশ্য অন্যকে দেখাতে নেই। জিসান অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘চলুন বক্কর ভাই, এবার বাড়ি যাই।’—-
রাত প্রায় একটা তখন। পুরো গ্রামের মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ইলাশপুর মসজিদের ইমাম সাহেব দাওয়াত থেকে ফিরছিলেন। পশ্চিম পাড়ায় মাদ্রাসার শিক্ষক সহ উনার দাওয়াত ছিল ৷ দাওয়াত শেষে মাদ্রাসার হোস্টেলে গল্পগুজব করে রাত বেশি হয়ে গেছে। নারায়ণ মাস্টারের বাড়ির পাশ দিয়ে মসজিদেই ফিরছিলেন। ঠিক তখনই শোনলেন নারায়ণ মাস্টারকে কেউ একজন ডাকছে। একটু কৌতূহলী হয়ে আড়াল থেকে খেয়াল করে এগোলেন।
দরজার সামন থেকে যে ডাকছে তাকে তিনি চিনলেন। সে হাত ইশারা দিয়ে কাউকে কিছু বলল। ইমাম সাহেব ঠিক তখনই খেয়াল করলেন উঠোনের আবছা অন্ধকারে কয়েকজন দাঁড়ানো। তাদের মুখ বাঁধা৷ তাই চেনা গেল না। কিন্তু হাতে ছায়ার মতন কিসব দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। ইমাম সাহেব দরজার সামনে দ্বিতীয় বার তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন। গ্রিলের সামনে মুখোশ ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির দুইপাশে মুখোশ পরা দু’জন বসে আছে। ভেতর থেকে তাদের দেখা যাবে না দেয়ালের জন্য। কি হতে যাচ্ছে ইমাম সাহেব কিছুই বুঝতে পারছেন না। কি করবেন সেটাও মাথায় আসছে না। সবকিছু যেন স্বপ্ন দৃশ্যের মতো লাগছে।
হাই তুলতে তুলতে বেরিয়ে এলেন নারায়ণ মাস্টার।– ‘আরে এতো রাতে তুমি? দাঁড়াও চাবি আনি।’
সহজ-সরল নারায়ণ মাস্টার চাবি আনতে ভেতরে গেলেন। বাড়িতে আর কেউ নাই। একটি কাজের মেয়ে রাতের রান্না করে দিয়ে চলে যায়। তিনি একাই থাকেন।
নারায়ণ মাস্টার গ্রীলের তালা খুলে বললেন,
-‘আসো ভেতরে আসো।’
তখনই গ্রীলের নিচের দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে থাকা মুখোশধারী দু’জন আচমকা হেঁচকা টানে উঠোনে এনে ফেলল মাস্টারকে। মুখোশহীন লোকটি তাড়াতাড়ি সরে গেল। পাঁচ-ছয়জন অস্রহাতে ধেয়ে আসলো। ইমাম সাহেবের হঠাৎ যেন হুশ ফিরল। তিনি জীবনের মায়া ত্যাগ করে চিৎকার দিয়ে বেরিয়ে এলেন আড়াল থেকে। ঝাপিয়ে পড়লেন সবার উপর। টেনে টেনে সরাতে লাগলেন। প্রথমে মুখোশধারীরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না।
একজন ধেয়ে এসে বলল,
– ‘মালাউন হিন্দুর লাগি নিজওর জীবন দিও না ইমাম সাব।’ইমাম সাহেব চিৎকার করে বললেন,
– ‘প্রয়োজনে জীবন দেব, তবুও একজন মানুষকে চোখের সামনে খুন হতে দেব না। হিন্দু-মুসলিম মানুষের আসল পরিচয় না। আসল পরিচয় আমরা মানুষ।’
কথাটি বলে রক্তাক্ত নারায়ণকে টেনে কাঁধে তুলতে গেলেন।
আহত নারায়ণ অস্ফুটে বললেন,
-‘ইমাম সাহেব আপনি পালান৷ দয়া করে আমাকে রেখে পালান।’
ইমাম সাহেবের পিঠে স্বজুড়ে কেউ লাত্থি মারল। তিনি পড়লেন গিয়ে একটি গাছের শেকড়ে। মাস্টার পড়লেন তার নিচে৷ দু’জন এসে ইমামকে টেনে সরিয়ে নিল।
ইমাম তখনই ভুলটি করলেন। তিনি চেঁচিয়ে বললেন,
-‘তোমাদেরকে আমি চিনেছি। মাস্টারের কিছু হলে কেউ রেহাই পাবে না।’
মুখোশধারীরা বুঝে গেল ইমামকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। দু’দলে ভাগ হয়ে এলোপাথাড়ি কোপ মারতে লাগল। রাতের আঁধারে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে একজন মানুষকে বাঁচাতে ইমাম সাহেব নিজের জীবন দিয়ে দিলেন। পরেরদিন গ্রামবাসী ইমাম সাহেবকে কোথাও খুঁজে পেল না। অন্যদিকে খুঁজে পেল না নারায়ণ মাস্টারকেও।
–চলবে..
লেখা: জবরুল ইসলাম